সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

উত্তরাঞ্চলে তাপদাহে মরুভূমির উত্তাপ : বৃষ্টির দেখা নেই

আমনচাষিদের মাথায় ৬০০ কোটি টাকা বাড়তি খরচের খড়গ


প্রকাশিত:
২৩ জুলাই ২০২২ ২৩:৩৭

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:০০

রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের প্রকৃতিতে চলছে মরুভূমির উত্তাপ। সাথে ভ্যাপসা গরম। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে এসেও স্বাভাবিক চাহিদার মাত্র দশমিক ৫২ শতাংশ বৃষ্টি হয়েছে এ অঞ্চলে। সর্বত্রই চলছে পানির জন্য হাহাকার। কৃষি বিভাগ বলছে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবার ২৫ লাখ হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও অনাবৃষ্টির কারণে আবাদ হয়েছে মাত্র এক লাখ হেক্টরে। তাও আবাদ করতে হয়েছে সম্পূরক সেচ দিয়ে। বাকি জমিগুলোও যদি সম্পূরক সেচ দিয়ে আবাদ করতে হয় তাহলে কৃষকের বাড়তি খরচ হবে ৬০০ কোটি টাকার ওপরে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কৃষি বিভাগ লিফলেট বিতরণ ও মাইকিং করে সম্পূরক সেচ দিয়ে আমন রোপণের পরামর্শ দিচ্ছেন।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে জানান, জুলাই মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ৪৫৩ মিলিমিটার। এর মধ্যে ২০ জুলাইয়ের আগেই প্রায় ৪০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা। কিন্তু বৃষ্টি হয়েছে মাত্র ১৯ দশমিক চার মিলিমিটার। এর মধ্যে ১৭ মিলিমিটার হয়েছে ২ জুলাই এবং ২ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে ২০ জুলাই। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কাছাকাছি হওয়া, বাতাসে আর্দ্রতা কমে যাওয়ার কারণে এ অবস্থা। ১৯ জুলাইয়ের পর থেকে এ অঞ্চলে কাক্সিক্ষত বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা থাকলেও সেটি হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিপাত হয়েছে।

এ বছর জুন মাসে ৩২৭ দশমিক ১ মিলিমিটার, জুলাই মাসে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ২৬৯ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র। মাস শেষ হওয়া পর্যন্ত আর বৃষ্টি কতটুকু হবে তা নিয়ে সংশয়ে আছেন আবহাওয়াবিদরা। আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে জুন মাস ৪৩৭ এবং জুলাই মাসে ৪৫৭ মিলিমিটার স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা।

কামরুল ইসলাম আরো জানান, জুলাই মাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩২ থেকে ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠানামা করে। কিন্তু গেল ২০ দিনে রংপুসহ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৭ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যেখানে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২২ থেকে ২২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকার কথা, সেখানে এবার এই সময়ে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ২৭ থেকে ২৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলিসিয়াস। এ অবস্থা সাধারণত তিন থেকে চার দিন থাকার কথা থাকলেও এটা টানা জুলাই মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত চলছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে আমন, আউশ ও পাটচাষিদের মধ্যে।

রংপুর আবহাওয়া অফিসে রেকর্ড অনুযায়ী বছর ২০২১ সালে জুলাই মাসে ১৯৬ মিলিমিটার, ২০২০ সালে ৮০৪ মিলিমিটার; ২০১৪ সালে ৩০৪ মিলিমিটার; ২০১৩ সালে ৪৪৬ মিলিমিটার; ২০১২ সালে ৫১০ মিলিমিটার; ২০১১ সালে ৩৪৬ মিলিমিটার; ২০০৯ সালে ২৮১ মিলিমিটার এবং ২০০৮ সালে ৯১০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের দেয়া তথ্যমতে এবার জুলাই মাসে এ পর্যন্ত যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে তা আমনের চারা জমিতে রোপণ ও স্থায়িত্বের জন্য চাহিদার তুলনায় দশমিক ৫২ শতাংশ।

পরিবেশবিদ, চাষি ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, আমনের আবাদ কৃষকদের জন্য আল্লাহর বিশেষ রহমত এবং মৌসুমের বোনাস আবাদ হিসেবে পরিচিত। কারণ আমনে বৃষ্টির পানি দিয়েই গোলায় ধান তোলেন কৃষক। কিন্তু সেই পরিস্থিতি এবার এ অঞ্চলে নেই। আর এবার এ অঞ্চলের প্রকৃতি বিগত ১০ বছরের চেয়ে বেশি উত্তপ্ত। ফলে খোদ কৃষি বিভাগই আমনের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কায় ভুগছেন। এ অবস্থার উন্নতি না ঘটলে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকই অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা করছে খোদ কৃষি বিভাগ।

উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার চারটি কৃষি জোন হলো রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও রাজশাহী। এ চারটি কৃষি জোনের আওতায় এবার আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ২৫ লাখ হেক্টর জমিতে। এ পরিমাণ জমিতে আমন রোপণের জন্য এপ্রিল-মে মাসের মধ্যেই বীজতলা তৈরির পর মধ্যজুন থেকে ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে আমনের চারা রোপণের সঠিক সময়। এরপর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত আমন রোপণ করা গেলেও তাতে ফলন কম হওয়ার পাশাপাশি পোকা-মাকড়ের উপদ্রব বেশি হয়। এ চার জোনের কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী এ পর্যন্ত মাত্র এক লাখ হেক্টরের কিছু বেশি জমিতে আমনের আবাদ করেছেন চাষিরা। যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৪ শতাংশ। তাও কৃষকদের করতে হয়েছে সম্পূরক সেচ দিয়ে। এতে বাড়তি খরচ করতে হয়েছে চাষিদের।

রংপুর কৃষি জোনের উপ-পরিচালক মাহবুবুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের শঙ্কা ছিল এবার জুলাই মাসে খরা হবে ভয়াবহ। সে কারণে আমরা চাষিদের সেচনালাগুলো ঠিক রাখতে বলেছিলাম। সে অনুযায়ী মাঠপর্যায়ে আমাদের কর্মীরা কাজ করেছেন। এতে বাড়তি খরচ হলেও কৃষকরা সেই চেষ্টা করছেন।

কৃষকের বাড়তি খরচ ৬০০ কোটি টাকা : সরেজমিনে দেখা গেছে, কষ্ট করে বীজতলা তৈরি করলেও পানির অভাবে কৃষক জমিতে আমনের চারা রোপণ করতে পারছে না। আবার তৈরি করা বীজতলার বয়স হয়ে যাচ্ছে। অনেক বীজতলা পানির অভাবে হলুদ হয়ে গেছে। মরে যাচ্ছে। সামান্য যেসব জায়গায় সম্পূরক সেচ দিয়ে আমনের চারা লাগিয়েছেন কৃষক, তাও পানির অভাবে মরে যাচ্ছে, রোদে পুড়ে ঝলসে যাচ্ছে। পানি নেই কোথাও। অনেক কৃষক জমিতে হাল দিয়ে রেখেছেন, কিন্তু চারা লাগাতে পারছেন না। অনেকে এখনো জমিতে হালই দিতে পারেননি। সামর্থ্যবান কিছু কৃষক স্যালো ও বিদ্যুৎচালিত মোটর দিয়ে আমন লাগানো শুরু করলেও তারা খরচে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। অপর দিকে প্রান্তিক, বরগা, বন্দকী ও ক্ষুদ্রচাষিরা এখনো চেয়ে আছেন আকাশের পানে।

রংপুর সদরের চন্দনপাট ইউনিয়নের চাপড়ার বিলে শ্রাবণ মাসে কখনো পানি না শুকালেও এবার রেকর্ড ভেঙে খরতাপে খাঁ খাঁ করছে। এখানকার কৃষক জাহাঙ্গীর আলম জানালেন আমরা আরো ২/৪ দিন দেখব। তারপর সেচ দিয়ে আমন লাগাব। চাষি আশরাফুল ইসলাম বলেন, আর দুই দিন অপেক্ষা করব। তারপর ডিপের পানি নিবো। ডিপের পানি প্রতি ঘণ্টায় নিতে হয় ১৫০ টাকা।

২৫ জুলাইয়ের আগে আমন লাগাতে না পারলে ফলন কাক্সিক্ষত হবে না। তাই দেখা গেলো, বদরগঞ্জের নানদিয়ার বিলের অনেক কৃষক স্যালোসহ গভীর-অগভীর নলকূপের সেচে আমন লাগানো শুরু করেছেন। এখানকার কৃষক সোহরাব হোসেন জানালেন, ঘণ্টা ১৫০ টাকা হিসেবে এক একর জমিতে পানি নিচ্ছি। প্রায় ৮ ঘণ্টা লাগবে আমার শুধু জমি কাঁদো করতে। এরপর চারা লাগানোর পর চারা জীবন্ত রাখতে কয়েক দিন পর আবার পানি নিতে হবে। এতে আমার লাগানো এবং পরের সেচ দিতে প্রায় এক একর জমিতে টাকা লাগবে এক হাজার ৫০০ টাকার ওপরে। এটা আমার বাড়তি খরচ।

বাড়তি এই খরচ মেটাতে গিয়ে অনেক কৃষক গোলায় খোরাকির জন্য জমানো ধান বিক্রি করছেন। পাগলাপীরের কৃষক কৃষ্ণ সরকার জানালেন, আমার নিজের স্যালো মেশিন আছে। চারদোন জমি লাগাবো। বৃষ্টি না থাকায় এখন খোরাকির ধান বিক্রি করে ১০ লিটার ডিজেল নিয়ে এসে সেচ দেয়া শুরু করেছি। এক লিটার ডিজেলের দাম ৭০ টাকা জানালেন তিনি।

কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী রংপুর অঞ্চলে ৯ হাজার গভীর ও ৪ লাখ অগভীর নলকূপ আছে। বৃষ্টি না হলে সম্পূরক সেচ দিয়েই আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ জন্য সেচনালাগুলো নষ্ট না করার পরামর্শ দেয়েছিল কৃষকদের। এখন বৃষ্টি না হলে সম্পূরক সেচেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণের আশা কৃষি বিভাগের। সেক্ষেত্রে প্রতি হেক্টরে জমিতে আমনের চারা রোপণ করা বাবদ গড়ে ২ হাজার ৫০০ টাকা অতিরিক্ত খরচ হবে। পুরো আবাদটিই যদি সম্পূরক সেচ দিয়ে করতে হয় তাহলে কৃষকের অতিরিক্ত ৬০০ কোটি টাকা বেশি খরচ হবে।


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top