সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

কোভিড ১৯, গ্রহের সবুজ ভবিষ্যৎ এবং আমরা : এম মাহমুদুল হাসান


প্রকাশিত:
২৩ জুলাই ২০২০ ০০:০৬

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:৪৪

 

কোভিড ১৯ মহামারি সারা বিশ্বের জীবন ও অর্থনীতির জন্য হুমকিস্বরূপ । ভাইরাসটি আরও প্রমান করেছে যে মানুষ তার অভ্যাস রাতারাতি পরিবর্তন করতে সক্ষম । বেশ কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন যে, এখন পদ্ধতিগত  অর্থনৈতিক পরিবর্তনের  সূচনার সময় এসেছে। করনাভাইরাস অনেক দেশকে লক ডাউন অবস্থায় যেতে বাধ্য করেছে । এখনো লক ডাউন চলছে বা আরো চলবে ১২-২৪ মাস । বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা আতঙ্কগ্রস্ত এবং আর্থিক বাজার হুমকির সম্মুখে পড়েছে । তবে সংকট পরিচালনার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি নীতি অনুসরণ করা উচিত বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন । উদাহরণস্বরূপ ইউরোপিয়ান কমিশনের "গ্রীন ডিল " যা বর্তমান সঙ্কটে থাকা দেশগুলির বা ব্যবসায়ের পক্ষে সহায়তা করার একটা উপায় বলে ইউরোপের দেশগুলি ভাবছে।

কোভিড ১৯ সংকেত দিচ্ছে যে আরো সঙ্কট আসবে।  সরকার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলির আর্থিক ক্ষমতা করোনা সংকট পরবর্তী অবস্থা মোকাবেলায় হিমশিম অবস্থায় পড়ছে বা আরো পড়বে।  আরো যদি এ ধরণের  ক্রাইসিস আসে তাতে এসব প্রতিষ্ঠানের আগের অর্থনৈতিক অবস্থায় ফিরে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। "ক্লাব অফ রোম"  তার বিখ্যাত ১৯৭২ সালের প্রতিবেদনে, "দা লিমিটস টু গ্রোথ"  এবং ডোনেলা মেডোজের ১৯৯২ সালের "বিয়ন্ড দা লিমিটস" একটি অনুরূপ সতর্কতা দিয়েছিলো। মিডোজের সতর্কতা ছিল এরকম , মানবসভ্যতা শুধু একটা জরুরি অবস্থার মধ্যে পড়বে না , সংখ্যাটা হবে অনেক, কারণ মানুষ শুধুমাত্র সাস্টেইনবেলভাবে  বাঁচার জন্য (বর্তমান প্রয়োজন বা অবস্থা বিবেচনায়) বেঁচে থাকার জন্য কাজ করে যাচ্ছে এবং বিশ্বের সম্পদগুলি শেষ হয়ে যাচ্ছে। যেভাবে সম্পদগুলি দ্রুত নিঃশ্বেস হচ্ছে ঠিক সেই হারে পুনরুদ্ধার হচ্ছেনা, বলতে গেলে বর্জ্য এবং দুষকগুলি পরিবেশ শুষে নিতে পারছে না। আর এজন্য দীর্ঘদিন ধরে আমরা বিপর্যয়ে পড়ার মতো অবস্থায় ছিলাম এবং আছি। একটি গ্রহে সমস্ত প্রজাতি, দেশ, এবং ভূরাজনৈতিক বিষয়গুলি শেষ পর্যন্ত পরস্পরের সাথে সংযুক্ত। আমরা সাক্ষী থাকছি যে, কিভাবে চীনের একটি নভেল করোনা ভাইরাসটির প্ৰাদূৰ্ভাৱ পুরো বিশ্বকে ধ্বংস করে দিতে পারে। করোনার মতো জলবায়ু পরিবর্তন, জীব বৈচিত্র হ্রাস এবং আর্থিক পতন জাতীয় বা নির্দিষ্ট সীমানায় বেঁধে ফেলা যায় না। এই সমস্যাগুলি কেবল সম্মিলিত ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে পরিচালিত হতে পারে যা তারা পূর্ণ সঙ্কটযুক্ত হয়ে ওঠার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়।

করোনাভাইরাস মহামারী গ্রহের সীমা অতিক্রম বন্ধ করার জন্য একটি সংকেত, ইংরেজিতে যাকে বলে  "বিয়ন্ড  ক্যাপাসিটি অব আর্থ" । সর্বোপরি বনউজার , জীব বৈচিত্র হ্রাস , জলবায়ু পরিবর্তন সবই মহামারীর সম্ভাবনা তৈরী করেছে এবং আরো তৈরি হবে। এর ফলে বনউজার করা বন্য প্রাণীকে মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে বা আরো নিয়ে যাবে।  সারস কোভিড ২ র মতো ভাইরাস প্রাণী থেকে প্রাণীতে ছড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিবে।  এসব অনেক কিছুর সম্ভাবনা থেকে, জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আন্ত:সরকারী প্যানেল (আইপিসিসি প্যানেল ) হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে যে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি, গরম এবং শীতের প্রভাব নতুন কোনো ভাইরাসের জন্ম দিবে বা উত্থানকে ত্বরান্বিত করবে।

বেশ কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন যে ভবিষ্যতে সব সরকার সফলতা অর্জন করবে যদি তারা একটা মন্ত্র অনুসরণ করে "বিজ্ঞানকে অনুসরণ করুন এবং ভবিষ্যতের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করুন।" আর এজন্য দরকার একটা শক্ত ইকোনমিক মডেল।  দুর্যোগের পরিবর্তে প্রতিক্রিয়া দেখানোর পরিবর্তে আমরা বিজ্ঞানকে অর্থনীতির নকশা (ইকোনমিক মডেল) তৈরিতে ব্যবহার করতে পারি যা জলবায়ু পরিবর্তন, জীব বৈচিত্র হ্রাস  এবং মহামারীর হুমকিকে প্রশমিত করবে। আমাদের অবশ্যই সবুজ বৃত্তাকার (গ্রীন সার্কুলার ইকোনমি ) ভিত্তি স্থাপন এবং যা জনসাধারণের ভালোর দিকে পরিচালিত করে তাতে গুরুত্ব দিয়ে বিনিয়োগ করতে হবে।

কোভিড ১৯ দেখিয়ে দিলো যে রাতারাতি পরিবর্তন হতে পারে অনেক কিছুই যেমনটি আমরা দেখলাম এক অর্থনীতির বিশ্ব  থেকে  আর এক অর্থনীতির বিশ্বে আমরা প্রবেশ করে।  সরকারগুলি স্বল্প মেয়াদে তাদের নাগরিকদের রক্ষা করতে ছুটে চলেছে। তবে বিশ্বব্যাপী পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনতে এবং এই ধরণের সঙ্কট মোকাবেলায় একটি শক্তিশালী ব্যাবসায়িক মামলা বা বিষয় রয়েছে, যেমনটি আমি লিখেছিলাম জলবায়ু পরিবর্তন এবং পুঁজিবাদ নিয়ে । উদাহরণস্বরূপ, জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহার কমানো ত্বরান্বিত করা এবং রিনিউবেল শক্তি প্রযুক্তি স্থাপন না করার কোনও উপযুক্ত কারণ নেই কারন এগুলি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফসিল ফুয়েলের তুলনায় স্বস্তা। ইউরোপের কিছু দেশ এবং জি ৭ দেশগুলি ২০২৫ সালের মধ্যে রিনিউবেল নির্ভর হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কোভিড সময়ে সাম্প্রতিক তেলের দাম কমার জন্য, এখাতে ভর্তুকি কমানোর বা বাতিলের জন্য ইউরোপের কিছু দেশ প্রস্তাব রেখেছে। আর এই সাবসিডি গ্রিন বা রিনিউবেল টেকনোলোজির উন্নয়নে কাজে লাগানো যেতে পারে।

শিল্প থেকে পুনরুত্পাদনশীল কৃষিতে (রিজেনারেটিভ এগ্রিকালচার) স্থানান্তর করাও তাত্ক্ষণিকভাবে সম্ভব এবং এটি আমাদেরকে এমন হারে পৃথিবীকে কার্বন দুর করার উপায় দেবে যা জলবায়ু সংকটকে মোকাবেলায় আমাদের অনেক সহায়তা করবে। এটি করার ফলে অর্থনৈতিক ও পরিবেশের স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি করবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং গ্রামীণ ও শহুরে উভয় সম্প্রদায়েরই মঙ্গল হবে। পুনরুত্পাদনশীল কৃষিক্ষেত্রটি নতুন অর্থনৈতিক মডেলের উপর দাড়িয়ে যা এখন সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশের সরকার আরও অনুসন্ধান করছে ,এগুলি সবই আমাদের গ্রহের সীমানার মধ্যে থাকার নীতির উপর ভিত্তি করে।

নীতিনির্ধারকগণদের বর্তমান সংকটে সাড়া দিয়ে তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত জীবাশ্ম জ্বালানীর পরিবর্তে নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ করে নাগরিকদের জীবন-জীবিকার উন্নয়নকে সমর্থন করা। এখন সময়, সবুজ অবকাঠামো, পুনরায় বনায়ন, আরও কম কার্বন, রিজেনারেটিভ এবং সার্কুলার অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করা আর তা করার জন্য জীবাশ্ম জ্বালানী ভর্তুকিতে ব্যয় করা  ট্রিলিয়ন ডলার এখন আর ব্যয় না করে, ওইসব খাতে ব্যয় করা।

অনেক আগে থেকেই পরিবেশ রক্ষায় অস্ট্রেলিয়া জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে। এ বছরের বুশ ফায়ার সঙ্গে কোভিড অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিতে বড় আঘাত হেনেছে। এর প্রভাব থাকবে বেশ কিছু সময়। তবে জলবায়ু পরিবর্তন রক্ষায় সাস্টেনিবিলিটির দিকে নজর এবং কার্বন এমিসন কমাতে গত বছর এসিটিকে ১০০% রিনিউবেল নির্ভর করার ঘোষনা দেয়া হয়েছে। এবছর নিউ সাউথ ওয়েলস ২০৩০ সালের মধ্যে ৭০% রিনিউবেল করার ঘোষনা দিয়েছে। সিডনি এবং অ্যাডিলেড ১০০% রিনিউবেল করার জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কার্বন এমিসন কমানের জন্য অস্ট্রেলিয়ার বিল্ডিং কোডের এনার্জি এফিসিয়েন্সি অংশে বড় রকমের পরিবর্তন এসেছে এ বছর থেকে।  

আমরা আবার শুরু করতে পুরোপুরি সক্ষম যদি আমরা আমাদের ব্যর্থতাগুলি থেকে শিখি এবং আমাদের জন্য সঞ্চিত ভবিষ্যতের চেয়ে আমরা একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ্য রেখে কাজ করি। উত্থানের এই মুহুর্তটিকে ভবিষ্যত স্থিতিশীল, ভাগাভাগি সমৃদ্ধ, মঙ্গল এবং গ্রহস্বাস্থ্যে বিনিয়োগ শুরু করার সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করা উচিত। আমরা দীর্ঘকাল ধরে আমাদেরপ্রাকৃতিক সীমা অতিক্রম করেছি; সময় এসেছে নতুন কিছু চেষ্টা করার। অনেকে মতামত দেন গ্রহের সাস্টেনেবিলিটি মৃত হওয়ার দিকে। আমি বলব না মৃত নয় আমাদের সাস্টেনেবিলিটির সঙ্গে এবং এর বাইরে গিয়ে ভাবতে হবে।

 

তথ্যসূত্রঃ অনলাইন মিডিয়া, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এবং লিঙ্কডিন

আমার কিছু মতামতসহ লিখা দ্বিমত থাকতে পারে

 

এম মাহমুদুল হাসান
সাস্টেনেবিলিটি কনসালটেন্ট
ব্রিসবেন অস্ট্রেলিয়া



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top