সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

নিরপেক্ষ ও স্বল্প সময়ে সঠিক বিচার হলেই ধর্ষণ কমবে : ওসমান গনি 


প্রকাশিত:
১৭ অক্টোবর ২০২০ ২১:০৬

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৮:৪৫

 

দেশে চলমান মহামারি করোনার ন্যায় দিন দিন ধর্ষণের মাত্রা বেড়ে চলছে। তবে করোনাভাইরাস কে চিরতরে বন্ধ করার জন্য সারা পৃথিবী জোড় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হয়ত একদিন করোনা নির্মূলে ভ্যাকসিন এসে যাবে। নির্মূল হয়ে যাবে করোনাভাইরাসের আক্রমণ। তখন মানুষ স্বস্তিকর নিশ্বাস ফেলবে। কিন্তু ধর্ষণ নির্মূলে আজ এপর্যন্ত কি কোন কঠোর ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছে? কেউ কি তা বলতে পারবে? মনে হয় না।  দেশবিদেশে ধর্ষণ নির্মূলের কোন কঠোর বিচার ব্যাবস্থা না থাকায় দিন দিন ধর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে। ধর্ষণ নির্মূলে আইন কাগজকলমে আছে পৃথিবীর সবদেশে। কিন্তু তার বাস্তব প্রয়োগ নেই। কারন রাজনীতি, কালোটাকা, পেশীশক্তি, সামাজিক চাপসহ আরও অন্যান্য কারনে ধর্ষকরা পার পেয়ে যাচ্ছে। য়ার কারনে দেশে ও সমাজে বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন। বিগত দিনে দেশে যে ধর্ষণ হয়েছিল সেগুলোর যদি সঠিক বিচার হতো তাহলে হয়তো নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের একলাশপুরে মহিলা কে বিবস্ত্র হতে হতো না। মনে হয় যেন দেশে প্রতিযোগিতামূলক ভাবে ধর্ষণের কাজ চলছে। আর ধর্ষণের সংখ্যা বাড়ছে গাণিতিক হারে। ধর্ষণ কে কেন্দ্র করে আজ সারাদেশ শ্লোগানে শ্লোগানে উত্তাল হয়ে গেছে। ভোগান্তিতে পড়ছে দেশের সাধারন মানুষ। ধর্ষণের বিচারের নামে চলছে সরকার হঠানোর চেষ্টা। 

 কঠোর আইন প্রণয়ন, প্রচারণা ও  উচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকার পরেও কমছে না নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন ও নিপীড়ন । এর প্রধান কারণ আমাদের দেশে ও সমাজের বিচারহীনতার সংস্কৃতি । আইন আছে, কিন্তু এর কার্যকারিতা নেই। ধর্ষণের দ্রুত বিচার এবং ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর করা খুব জরুরী। একজন নারী বারবার ধর্ষিত হয়। যখন বিচার চাইতে আদালতে বা থানায় যায়, তখন জেরার মুখে তার চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হয়, সে ধর্ষিতা কি-না তা প্রমাণ করতে হয়। রবি ঠাকুরের মতো বলতে হয়, কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই।’ একজন ধর্ষিতা এ সমাজে না পারে ভালোভাবে বাঁচতে, না পায় ন্যায়বিচার। একজন নারী ধর্ষণের পরে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। একজন পুরুষ ধর্ষণ করতে জানে কিন্তু ধর্ষিতা নারীকে নিয়ে সংসার করতে পারে না। ধর্ষিতা নারী যেন জীবন্ত মৃত। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ মোতাবেক, চলতি বছরে সারা দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা, বিশেষত ধর্ষণ, হত্যা, যৌন নিপীড়ন এবং পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা ও ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সংস্থাটির ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যাগত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে নিপীড়নের এ তথ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়, এ সময়কালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৭৫ জন, যার মধ্যে একক ধর্ষণের শিকার হন ৭৬২ জন এবং সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ২০৮ নারী। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হন ৪৩ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ১২ নারী। গত নয় মাসে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৬১ নারী। এর মধ্যে যৌন হয়রানির কারণে ১২ নারী আত্মহত্যা করেছেন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৩ নারী এবং ৯ পুরুষ নিহত হয়েছেন। গত নয় মাসে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৩২ নারী। এর মধ্যে হত্যার শিকার হন ২৭৯ নারী এবং পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৭৪ নারী। এতে আরও বলা হয়, এ বছরের মার্চ থেকে শুরু হওয়া করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সময়কালে নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা লাভের অধিকার লঙ্ঘনের পাশাপাশি চিকিৎসা অবহেলা, স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা, নজরদারি ও জবাবদিহিতার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।

 এখানে দেশে বর্তমানে ‘ধর্ষণের সংস্কৃতিটা যেন একটা রেওয়াজে পরিনত হয়েছে। ‘ধর্ষণের সংস্কৃতি’ বলতে এমন এক সংস্কৃতিকে বোঝানো হয়, যেখানে সমাজের প্রত্যেক নারী, শিশু কিংবা কিশোরী বালিকা ধর্ষণের মতো পরিস্থিতির শিকার হতে পারে। শুধু পুলিশ পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৪০০টি। এ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ধর্ষণের হার ৩.৮০ অর্থাৎ প্রতি ১ লাখ নারীর মধ্যে প্রায় ৪ জন নারী-শিশুকেই ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে, যা স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। আমরা দেখতে পাই ১৯৯১, ২০০১, ২০১১ ও ২০১৮ সালে প্রতি লাখে ধর্ষণের হার যথাক্রমে ০.৩৯ জন, ২.৩৭ জন, ২.৩৮ জন ও ২.৪৫ জন। শুধু পরিসংখ্যান বিবেচনায় ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ধর্ষণের এ হার বাড়ার পরিমাণ প্রায় প্রতি লাখে ১.৩৫ জন বা এক-তৃতীয়াংশ (বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ওয়েবসাইট, ২০১৯)।

যদিও নারী ও শিশুর প্রতি সার্বিক সহিংসতা বা নির্যাতনের প্রকাশিত ঘটনার মাত্রা আরও অনেক বেশি। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে যথাক্রমে প্রতি লাখে এ হার ৮.১৮ জন ও ৭.২১ জন। আর ২০১৯ সালের প্রথম ৬ মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১০ হাজার ১৫৯টি এবং হার বৃদ্ধির কথা বিবেচনা করলে প্রায় এটা আগের প্রায় দ্বিগুণ। অন্যদিকে, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ধর্ষণের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৮ সালে যেখানে মোট নারী ও শিশু ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৭৩২টি, সেখানে ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪১৩টি (আসক, ২০২০)। প্রকৃত ঘটনা এর চেয়েও আরও অনেক বেশি। পরিসংখ্যান বিবেচনায় বাংলাদেশে যে ধর্ষণের সংস্কৃতি বিরাজমান, তা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ এসব পরিসংখ্যান দেয় না।

ডয়েচে ভেলের তথ্যানুযায়ী, বিদেশি সমীক্ষা মোতাবেক বাংলাদেশে ধর্ষণের হার প্রতি লাখে ১০ জন এবং সমগ্র বিশ্বে আমাদের অবস্থান ৪০তম। ধর্ষণের বেলায় আমাদের থেকে অধঃপতিত দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা, লেসোথো, বোতসোয়ানা, সোয়াজিল্যান্ড ও সুইডেনে ধর্ষণের হার যথাক্রমে প্রতি লাখে ১৩২ জন, ৯৩ জন, ৮৩ জন, ৭৮ জন ও ৬৩ জন (ডয়েচে ভেলে, ৬ অক্টোবর ২০১৯)। কিন্তু আমার মতে, এসব দেশের মধ্যে বেশির ভাগ আফ্রিকার দারিদ্র্য ও গৃহযুদ্ধপীড়িত দেশ। যদিও পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতে প্রতি লাখে ৮ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়, যা বাংলাদেশের তুলনায় কম। পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোতে যেখানে বাংলাদেশের তুলনায় ধর্ষণের হার বেশি, সেখানে ব্যাপক জৈবিক, সাংস্কৃতিক, শ্রেণিগত ও নগরকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য বিরাজমান। উল্লিখিত প্রতিটি রাষ্ট্রই বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগত উপাদানে ‘অসমজাতীয় ( সূত্র- প্রথম আলো, ৩ ফেব্রুয়ারি/২০২০)

মিসর, সৌদি আরব, চীন, ইরান, গ্রিস, নর্থ কোরিয়াসহ বেশ কিছু রাষ্ট্রের ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। বাংলাদের দণ্ডবিধির ৩৭৬ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কিংবা ১০ বছরের উর্ধ্বে কারাদণ্ড বা তদ্রূপ অর্থদণ্ড। নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০ এর ৯ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কিন্তু এই আইনের প্রয়োগ কতটুকু তা বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

এক ব্যক্তিকে হত্যা করলে তার একটা অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। তা হলো জীবন ধারণের অধিকার। একটা নারীকে ধর্ষণ করলে তার দুইটা অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। এক. জীবন ধারণের অধিকার, দুই. মর্যাদা সম্ভ্রমের অধিকার। তাই বলা যায়, ধর্ষণ মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ। অথচ এদেশে ধর্ষকের শাস্তি হয় না, শাস্তি হয় ধর্ষিতার। সমাজের দ্বারা হয় নিগৃহীত, নিপীরিত। অথচ ধর্ষক বুক ফুলিয়ে চলফেরা করে। ধর্ষণের জন্য যারা নারীর পোশাককে দায়ী করেন, তারা জানেন তো এ দেশে প্রাপ্তবয়স্ক নারীর চেয়ে শিশু ধর্ষণের হার ৩ শতাংশ বেশি। আমাদের দেশে বিরজমান বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালে যে বিচার হয়, সেখানে মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ মামলার বিচারের চূড়ান্ত রায় হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মামলা প্রক্রিয়ায় তদন্ত, মেডিকেল রিপোর্ট, আইনজীবীর অনাগ্রহ বা পক্ষপাতের কারণে চূড়ান্ত রায় আসার আগে মামলা খারিজ হয়ে যায়। অপরাধের বিচার ও শাস্তি প্রদানের প্রক্রিয়ার মাঝে যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক বিরাজমান তা আমাদের বন্ধ করতে হবে। ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে রাষ্ট্রকেই।

 

ওসমান গনি 
সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top