সিডনী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১

ইয়াসের তাণ্ডবলীলায় বিপন্ন সুন্দরবন- নিশ্চিহ্ন জনপদ ভূমি : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
৩১ মে ২০২১ ২১:০০

আপডেট:
২৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:৫৭

 

বিশ্বপ্রকৃতির এক বিশ্বয় সুন্দরবন। ঘন ম্যানগ্রোভ আচ্ছাদিত দ্বীপভূমি আর শিরা--উপশিরার মত অজস্র খাঁড়ির বিন্যাসে সুন্দরবন মোহময়ী। বাঘ, হরিণ, শুকর, কুমির আর নানান রঙের পাখির স্বর্গরাজ্য সুন্দরী সুন্দরবন। বারবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সুন্দরবন আজ বিপন্ন, অস্বিত্বের সংকটে। ইয়াসের তাণ্ডবলীলায় বিধ্বস্ত সুন্দরবন। জনপদভূমির অধিকাংশই নিশ্চিহ্ন। আগামী দিনে এখানকার লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ যারা গৃহহীন হয়েছেন, তাদের ভবিষ্যত কি? এঁরা মানুষের মতো বাঁচতে চায়। গভীর সঙ্কটে সুন্দরবনের মানুষ লড়াই করে বেঁচে থাকার অধিকার চায় সভ্য সমাজের মানুষের কাছে। জীবন যাদের স্পর্ধিত, বেঁচে থাকা যাদের দুঃসাহসিক, যারা অনন্তকাল ভেসে চলেছে উত্তাল কাল- তরঙ্গে, ভাঁটা থেকে জোয়ারে--জোয়ার থেকে ভাটায়। সুন্দরবনের মানুষ লড়াই করে বেঁচে থাকে। এদের হাসি-কান্না, সুখ- দুঃখের সাথী এই অরণ্য। এর বন্ধন থেকে মুক্তি নেই। এটাকেই ভবিতব্য বলেই মেনে নিয়েছে। এই মুহূর্তে সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে একটাই প্রশ্ন সুন্দরবনের মানুষ কি আগামী দিনে  বেঁচে   থাকতে পারবে?

"নদীর ধারে বাস ভাবনা বারো মাস”
এই প্রবাদপ্রতিম কথাটি ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রাঢ়ের কোপাই নদীর পার্শ্ববর্তী জনজীবনকে নিয়ে লিখলেও  কথাটি সুন্দরবনের মানুষের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। বিশাল এলাকা জুড়ে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন।  বাংলাদেশ ও ভারত মিলে সুন্দরবনের মোট আয়তন ২৫,৫০০ বর্গ কিলোমিটার। ভারতের অংশে ৯৬৩০ বর্গ কিমি। দুই বাংলা মিলে প্রকৃত বনভূমির পরিমাণ মোট ৮৩০০ বর্গকিমি। কারণ বহুদ্বীপে জনবসতি গড়ে উঠেছে। নদী আছে। ভারতের সুন্দরবনের মোট দ্বীপের সংখ্যা ১০২টি। এর মধ্যে  দুটি বর্তমানে বিলীনহয়ে গেছে। সুপারিভাঙা ও লৌহচূর। মোট মানব বসতি গড়ে উঠেছে ৫৪ টি দ্বীপে । লোকসংখ্যা আনুমানিক ৬০--৬৫ লক্ষ। ৪৮টি দ্বীপ বনাঞ্চল। এই বনাঞ্চলের মধ্যে ২৪৫০ বর্গ কিমি বনভূমি  এবং ১৮১০ বর্গ কিমি জলাভূমি। সুন্দরবনের মোট ফরেস্ট ব্লক ২১ টি। এর মধ্যে ১৫ টি আছে বসিরহাট, গোসাবা, ক্যানিং রেঞ্জের অধীনে। ৬টি ব্লক নামখানা রেঞ্জের অধীনে। ব্যাঘ্র প্রকল্পের এলাকা ২৫৮৫ বর্গ কিমি। এর মধ্যে 'কোর এলাকা' ১৩৩০ বর্গ কিমি। এখানে  মানুষের প্রবেশ নিষেধ। বাকি ১২৫৫  বর্গ কিমি বাফার জোন। এই বাফার জোনে জেলেরা মাছ ধরার অনুমতি পায়। সেই সঙ্গে  ট্যুরিস্টরা বন পরিদর্শনে যেতে পারেন। 

দুটি জেলায় (উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার) বিস্তৃত সুন্দরবন। ১৯ টি ব্লক (উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় ৬টি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় ১৩ টি, মহকুমা ৫টি, থানা-১৬টি (উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার ৫ টি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার ১১  টি), গ্রাম পঞ্চায়েত (উত্তর চব্বিশ পরগনা ৫০টি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় ১৩৭টি), সুন্দরবনের মোট গ্রামের সংখ্যা- ১০৯৩টি (উত্তর চব্বিশ পরগনায়-৫৩৬টি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায়- ৫৫৭টি), মোট কৃষি জমি- ৩১,০৫৬১ হেক্টর (উত্তর চব্বিশ পরগনা ৭০৮৬০ হেক্টর, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার ২,২২,৭১৪ হেক্টর), নদী বাঁধ- ৩৫০০ কিমি (উত্তর চব্বিশ পরগনা ১২০০ কিমি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার ২৩০০ কিমি)।

উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় অবস্থিত সুন্দরবন অধ্যুষিত ৬টি ব্লকের মধ্যে (১) হিঙ্গলগঞ্জ (২) সন্দেশখালি ১ (৩) সন্দেশখালি ২ (৪) বসিরহাট ১ (৫) মিনাখাঁ (৬) হাসনাবাদ। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার সুন্দরবন অধ্যুষিত ব্লক ১৩টি। কাকদ্বীপ, সাগর, নামখানা, মথুরাপুর ১, মথুরাপুর ২, কুলতলি, জয়নগর ১, জয়নগর ২, ক্যানিং ১, ক্যানিং ২, বাসন্তী, গোসাবা, পাথরপ্রতিমা।   

ভারতের সুন্দরবনের পূর্বদিকে রায়মঙ্গল, কালিন্দী, ইছামতী নদী। পশ্চিম দিকে হুগলি নদী। উত্তরে ডাম্পিয়ার-- হজেস লাইন (কাকদ্বীপ থেকে হাসনাবাদ  পর্যন্ত) এবং  দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ।

সুন্দরবনের বেশির ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করে। কৃষি আর মৎসজীবী  মানুষের সংখ্যা সবচাইতে বেশি। বেঁচে থাকার জন্য  লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। এক ফসলের দেশ। পরিযায়ী  মানুষের  সংখ্যা কম নয়। দুমুখো ভাত খেতে পাওয়া এক বিরাট স্বপ্ন। আজ স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় ক্ষতবিক্ষত।  সভা  সমাজের  নীরবতা বেদনাদায়ক। সুন্দরবনের মানুষ  শুধুই ভোটার। মানুষ হিসেবে তাদের মূল্য নেই। ভোট আসে, ভোট চলে যায়। সুন্দরবনের মানুষের জীবনের চালচিত্রের কোন পরিবর্তন হয়নি আজও। আর এই সমস্ত মেহেনতি মানুষরা অনেক কষ্টে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ঘর-সংসার সুন্দর করে গুছিয়ে তুলতে চায়। কিন্তু প্রতিবছর কোন না কোন ঝড় বা জলোচ্ছ্বাসে তাদের এই আশা ভরসা দিয়ে গড়া স্বপ্ন এক নিমিষে তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ে, আর আমরা তখনই তাদেরকে ত্রাণ বা সাহায্য দেওয়ার জন্য ছুটে যাই। কিন্তু আমরা কখনও কি তাদের মনের খবর জানতে চেয়েছি? যে তাদের আসল প্রয়োজন টা কি? এই সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পরিবারকে ত্রান দিয়ে হয়ত সাময়িক তাদের আহারের যোগান দেওয়া সম্ভব। কিন্তু তাদের নদী বাঁধ,  জীবন- জীবিকা, ঝঞ্ঝা, বন্যা, ইত্যাদি নিয়ে যে ভয়, আশঙ্কা তা দূর করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনা। কারণ বেশিরভাগ নদী বাঁধই কাঁচামাটির যা জলোচ্ছ্বাসকে আটকে রাখার পক্ষে যথেস্ট নয়। যে কারণে আয়লা,ফনি আম্ফান, ইয়াস প্রভৃতি ঘূর্ণিঝড় ও তাদের দোসর জলোচ্ছ্বাস এর চোখরাঙ্গানি কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, নিজেদের পিঠ দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে তারা নদী বাঁধ রক্ষা করে ঘরবাড়ি বাঁচানোর জন্য। এতে তাদের প্রাণ সংশয়েরও সম্ভাবনা থাকে কুমির বা কামটের কামড়ে। তাই শুধুমাত্র ত্রাণ নয় প্রশাসনের এবার নদী বাঁধের দিকে একটু নজর দেওয়া দরকার। যদিও কাজটি খুব একটা সহজ নয়, কিন্তু সরকারের সদিচ্ছায় এবং সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতায় এটিকে রূপ দেওয়া সম্ভব।  নদী বাঁধ গুলি কংক্রিটের করা হলে সুন্দরবনের মানুষদের একটু সুরাহা এবং তার পাশাপাশি প্রতিবছর যে বন্যার ভয় তা দূরীভূত হবে। না হলে বছরে বছরে যে দুর্যোগ সুন্দরবনকে গ্রাস করছে তাতে ভবিষ্যতে  আমরা আমাদের স্বপ্নের সুন্দরবনকে হয়তো হারিয়ে ফেলবো!

সুন্দরবনকে রক্ষা করার মূল হাতিয়ার যে ম্যানগ্রোভ তা ২০২০ সালের আম্ফান ঝড়ে বহুলাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে কারণে এখন সুন্দরবনকে রক্ষা করার মত ম্যানগ্রোভের সংকট দেখা দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার যদিও আম্ফান পরবর্তী সময়ে প্রচুর সংখ্যক ম্যানগ্রোভ বসানোর কাজে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টকে নিয়োজিত করেছে। কিন্তু সেই সমস্ত ম্যানগ্রোভ এখন নিতান্তই ছোট। তাই শুভানুধ্যায়ী মানুষের কাছে একান্তই অনুরোধ যদি আপনারা এই সুন্দরবনকে শধুমাত্র নিজেদের ছুটি কাটানোর এবং অবসর যাপনের মাধ্যম হিসেবেই না দেখে থাকেন তাহলে এখানকার মানুষের জনজীবন নিয়ে একটু ভাবুন। কারণ সুন্দরবন কলকাতা এবং বৃহত্তর অর্থে দক্ষিনবঙ্গের রক্ষাকবজ,ফূসফুস।

সুন্দরবন বারবার কলকাতাকে বাঁচিয়ে চলেছে। কিন্তু নগর সভ্যতার কাছে চির উপেক্ষিতও। সুন্দরবনকে বাঁচাতে দরকার ইতিবাচক ভাবনা। চাই সরকারি  উদ্যোগের পাশাপাশি আমাদের প্রত্যেকের ভাবার এটাই সময়। সুন্দরবনের বাঁধ ইংরেজ আমলে। স্বাধীনতার ৭৫  বছরেও  কোন  মজবুত বাঁধ তৈরিতে মনোযোগ দেয়নি কোন সরকার। একমাত্র ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় হল্যান্ড থেকে বিশেষজ্ঞ দল এনে একটি পরিকল্পনা করেন। পরবর্তী কালে আধুনিক  সুন্দরবনের রূপকার গোসাবার রাঙাবেলিয়া হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক এ ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বহুবার। বহু কাগজে লিখেছেন। নিজস্ব ভাবনার কথা বলেছেন। সবই নিঃফল। অরণ্যের রোদন। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সহায়তায় ৫০০০ কোটি  টাকা কেন্দ্র সরকারের কাছ থেকে পায় ২০১০-২০১১ সাল নাগাদ। মাত্র ৭০-৭৫ কিমি কংক্রিটের মজবুত বাঁধ তৈরি করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করেনি বলে বাকি টাকা ফেরত চলে যায়। এটাই ইতিহাস।

১৯৯৯ সাল থেকে ২০২১ পর্যন্ত বহু বার ইয়াসের মতো ঝড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটেছে। কিন্তু সুন্দরবনের মানুষের দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছে স্হায়ী কংক্রিটের পরিবেশ বান্ধব মজবুত বাঁধ। এই মুহূর্তে সবচাইতে বেশি দরকার রাজনীতির উর্ধ্বে  উঠে রাজ্য সরকার ও  কেন্দ্রিয় সরকারের এক সঙ্গে  কাজ করা। কেন্দ্রীয় সরকারের ইতিবাচক সহযোগিতা   দরকার। বাঁধ নির্মাণের জন্য  বিপুল পরিমাণ টাকা বরাদ্দ দরকার কেন্দ্রের । হোক উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন। নদী ও নদী  বাঁধ বিশেষজ্ঞদের সামিল করা দরকার। সমস্ত স্কুলের বাড়িগুলো ধাপে ৪-৫ তলা করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে জোর  দিতে হবে ম্যানগ্রোভ অরণ্য বৃদ্ধি ও বাঁধ সংলগ্ন এলাকা জুড়ে অরণ্য তৈরি। বিপর্যয়কালীন অবস্থায় মানুষের ও গবাদি পশুদের রাখার জন্য বহুতল ভবন নির্মাণ প্রতিটি গ্রামে আবশ্যক হোক। ধারাবাহিক ভাবে বাঁধ রক্ষণা বেক্ষণের ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও নজরদারি বাড়ানো দরকার। বাঁধ জুড়ে ক্ষয়রোধক ঘাস লাগলো দরকার।  গ্রামের ভিতরের রাস্তা গুলোর উচ্চতা বাড়ানো, মিষ্টি জলের উৎস নষ্ট হয়ে না যায়, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। ১০০ দিনের কাজকে রাস্তা ও বনসৃজন প্রকল্পের অন্তর্ভূক্ত করা দরকার। এতে লোকাল মানুষ সারা বছর কাজ পাবে। 

উত্তরণের দিশার খোঁজে:                                                                 
আমরা যাঁরা সুন্দরবনের মানুষ, যাঁরা জঙ্গলমহলের মানুষ, যাঁরা রাঢ় বাংলার মানুষ, যাঁরা উত্তরবঙ্গ, মালদার মানুষ-  বরং আমাদের কাজ জনমানসে  একটা  জনমত গড়ে তোলা। আমরা আমাদের লড়াইটা  সুন্দরবনের জন্য। আমরা আমাদের কথা নিজেরাই লিখি আসুন। পরস্পর পরস্পরের সুখ, দুঃখ, লড়াই শেয়ার করি আসুন। মিডিয়া এলে ভালো। না এলেও, আমাদের কিছু যায় আসেনা। আসুন, সুন্দরবনের মানুষ, আমরা বরং এই জীবন রক্ষার লড়াইটা শুধু একদিন নয়, শুধু ঝড়ের দিন নয়, শুধু বিপর্যয়ের সময় নয়, বছরভর করে যা। আসুন, নদীবাঁধ ও ম্যানগ্রোভের যত্ন নিই। আসুন, বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে,জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গণ আন্দোলন গড়ে তুলি। আমাদের আওয়াজ পৌঁছে দিই রাজ্য, কেন্দ্র ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে। আমাদের জীবন, আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের সুরক্ষাই, আমাদের এই লড়াইয়ের বড় উপহার। কাগজ, মিডিয়া না দেখালে আমাদের কিচ্ছু যায় আসে না। কারণ, যাঁরা এমন লড়তে পারে, তাঁদের কাছে এসব তুচ্ছ। কারণ, আমাদের যে আরো বড় পরিসর আছে। কারণ, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে, যে কোনও প্রান্তজনের কাছে, অবহেলিত সুন্দরবনের মানুষের হাতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মিডিয়া, সব মিডিয়ার "বাপ" Facebook / Whatsapp আছে। বড় কাগজ, মিডিয়াও তো ফেসবুক দিয়ে নিজেদের প্রমোট করে। Facebook যে আমাদের মতো ছাপোষাদের কথা, প্রান্তজনের যন্ত্রণা, সংগ্রাম কাহিনি ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে না। ফেসবুক যে আমার, আপনার, খেঁদি পিসির, বুঁচি দিদির,ক্যাবলা দাদার, ফরিদ চাচার কথা বলার, সুখ দুখ বাঁটার "ইচ্ছেখুশি মাধ্যম"। যত পারেন ছবি দিন জীবন যুদ্ধের। যত পারেন লিখুন মানুষের কথা। যত পারেন শেয়ার করুন সেসব। Facebook বাহিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ুক গোটা রাজ্যে, দেশে, বিদেশে। অন্যান্য রাজ্যের মানুষ, অন্যান্য দেশের মানুষ দেখুন, সুন্দরবনের মানুষের এইসব দুঃসাহসিক লড়াইয়ের দৃশ্য।জানুন, আমাদের দুরবস্থার কথা। বুক দিয়ে নদীবাঁধ আগলানো মানুষগুলোর মতো, রাজ্য, দেশ ও বিশ্বের সহৃদয় মানুষরা এগিয়ে আসুন কলকাতা তথা বিশ্বের অন্যতম "ফুসফুস", ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট সুন্দরবনকে রক্ষা করার জন্য। সুন্দরবন বাসীদের সহায়তা করার জন্য। এগিয়ে আসুন সুন্দরবনের এইসব বীর, বীরাঙ্গনাদের সম্মান জানানোর জন্য। সুন্দরবনের বাঁধ, ম্যানগ্রোভ ও পরিবেশ রক্ষায় আরও আরও উৎসাহিত করার জন্য। এইসব "রিয়েল লাইফ হিরোদের" উষ্ণ ভালোবাসায় ভরিয়ে দেওয়ার জন্য। তাঁদেরকে একটু তারিফ করার জন্য। তাঁদেরকে একটু বাহবা দেওয়ার জন্য। যাঁদের অসম সাহসী লড়াইয়ের সাথে মিলে যায় রবীন্দ্রনাথের লাইন:
"আমি পরাণের সাথে খেলিব আজিকে/ মরণ খেলা"


সুন্দরবনের বাস্তব ছবি: 
রাজা যায় রাজা আসে, সুন্দরবন একই থাকে, আর প্রতিবেশী কোলকাতা বেশ আরাম করে কফি হাতে হা হুতাশ করে, আবার ভুলে যায়। রাজারা কুকুর বিড়ালের মত দুই চারটে মুড়ি বিস্কুট ছরিয়ে দায় সারে। মানুষ জীবিকা একবারই শুরু করে, তারপর তার উপর ভর করে জীবন চালায়, ভেসে যাওয়া সুন্দরবন প্রতিবৎসর শুরু করে একবুক স্বপ্ন নিয়ে, ঝড়, বন্যা আর সরকারের ঔদাসিন্যতায় সেই স্বপ্ন নদীর বুকে ভেসে যায়। কোলকাতার কোন স্বনামধন্য লেখক, চিত্রপরিচালক অথবা শিল্পীদের ও নেতাদের মনেও সুন্দরবনের যন্ত্রনার প্রভাব পড়েনা, সমাজ তুমি কি অন্ধ? আর টিভি চ্যানেলের রিপোর্টাররা টিয়ারপি বাড়াতে ব্যস্ত, কই কোন চ্যানেলে আলোচনা করতে দেখলাম না তো বাঁধ নির্মাণ অথবা পারমানেন্ট সল্যুশন বের করা নিয়ে? যত সব বস্তা পচা নাটক, কোলকাতার মানুষের বিনোদন মাত্র এটা। সুন্দরবনের বাঁধ নির্মাণ আজ পর্যন্ত কোন ইলেকশানে ইস্যু হয়নি, কারন সুন্দরবনের মানুষরা সহজ সরল বোকা। তারা নিজেদের বুক পেতে নদীর সাথে সংগ্রাম করতে পারে, তারা জীবন ও জীবিকার জন্য বাঘের মুখে প্রান দিতে পারে, কিন্তু ঝান্ডা হাতে নিজের দাবিদাওয়া আদায় করতে পারে না। এখনও যদি তুষ্ট থাকি

ফি-বছরের ত্রাণে,
বছর বছর ভাসতে হবে
ফ্রি তে আসা বানে।।
এই মুহূর্তে ত্রাণ যদিও ভীষণ দরকার। তবে, যাতে ত্রাণ আর না লাগে, মানুষকে মানুষের মত বাঁচতে দেওয়া যায় তারজন্য ভাবনা করাটাও দরকার
তাই আর না বন্ধু, আর চুপ থাকবেন না। আপনার চুপ থাকা আপনার শুধু নয়, আপনার সঙ্গে প্রিয় সুন্দরবন, আপনার প্রিয় এই বাংলা, প্রিয় দেশ তথা বিশ্বও ধ্বংসোন্মুখে পতিত হবে।

নিম্নলিখিত কয়েকটি প্রস্তাব ভেবে দেখুন-
প্রথমত, প্রতিটি দ্বীপাঞ্চল থেকে শিক্ষক, অধ্যাপক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, লেখক, গবেষক, পরিবেশবিদ, ভূগোলবিদ, কৃষক, ব্যবসায়ী, সর্বস্তরের মানুষজনকে নিয়ে একটি বৃহৎ অরাজনৈতিক বৃত্ত তৈরি করতে হবে। এবং জনগণকে বিভিন্ন উপায়ে ফি -বছরের ত্রাণ কীভাবে তাঁদের প্রকৃত অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে তা বোঝানো দরকার। সুন্দরবনের অল্পে সন্তুষ্ট সরল সাদাসিধা মানুষজনকে অধিকার রক্ষার আন্দোলনে সামিল করার প্রয়াস করতে হবে।  

 

সুন্দরবন রক্ষার জন্য কিছু বিজ্ঞান সম্মত ভাবনা:
১. বিজ্ঞান সম্মত ভাবে কংক্রীটের_বাঁধ চাই। সর্বত্র নয়। তাহলে নদীর স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
২. সর্বত্র ম্যানগ্রোভ রোপণ। এবং তাকে রক্ষা করার যথাযথ উপায় গ্রহণ।
৩. পরিবেশবিদ গবেষকগণের কথা মত কাজ করতে সরকারকে বাধ্য করা।
৪. বিজ্ঞান সম্মত ভাবে নদীগুলোর ড্রেজিং করা।
৫. রবীন্দ্রনাথ, তুষার কাঞ্জিলাল প্রমূখের সুন্দরবনের গ্রাম_পরিকল্পনার প্রায়োগিক দিকগুলোর বাস্তবায়ন। কারণ, সুন্দরবনের সর্বত্র মানুষের বাস চলবে না। জঙ্গলে মানুষ থাকবে না। জঙ্গলে জঙ্গলকে থাকতে না দিলে এমনি প্লাবন আসবে এবং গ্রাম ভাসবে। আর তার জন্য অনুপ্রবেশের দিকে এবং ইচ্ছেমত বসতি নির্মাণের ব্যাপারে লক্ষ্য রাখতে হবে।
৬. গভীর সুন্দরবনে যেখানে মানুষের বাস উচিত নয় সেখান থেকে বৈধ মানুষজনকে নিরাপদ স্থানে এনে পুনর্বাসন দিতে হবে।
৭. অবৈধ ভাবে নদীর চরে ফিশারী নির্মানের কাজ বন্ধ করতে হবে, এবং অধিকৃত জায়গা গুলো সুন্দরবন কে ফেরৎ দিতে হবে। তা নাহলে সে বারবার প্রতিশোধ নেবে।
৮. ব্লক ভিত্তিক স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অধিক উন্নত করতে হবে।
৯. সরকারের চোখ রাঙানি বা অধিকারকে দয়ারদানে পরিনত করাকেও সহ্য করা হবে না।
১০. বিশ্ব_উষ্ণায়ন বিষয়টিকেও যথাযথভাবে প্রতিরোধ করার জন্য ঘরে ঘরে সৌরবিদ্যুৎ পরিসেবা প্রদান করতে এবং যথাসম্ভব সৌরবিদ্যুৎ চালিত গাড়ি চলাচলের পরিকল্পনা গ্রহণে বাধ্য করা।
১১. অতি সত্বর সুন্দরবনের সমস্ত বাড়ি ঘরকে ছাদযুক্ত পাকাবাড়ি ও রাস্তা ঘাট পাকাকরণ কর্মসূচি গ্রহণে বাধ্য করতে হবে।

আপাতত আমাদের ত্রাণকার্যে নামতেই হবে এবং এরমধ্যে দিয়েই গণ-আন্দোলনের পথ তৈরি করতে হবে

 

শেষকথা:
সুন্দরবন ও সুন্দরবনের মানুষকে বাঁচানোর প্রধান উপায় দুটোই - পাকা বাঁধ আর এলাকার লোকেদের সাবলম্বী করে তোলা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে। যাতে বনের উপর তাদের নির্ভরশীলতা কমে। বনের মধ্যে থাকতে গেলে বন নষ্ট করে থাকা যাবেনা কারণ বন প্রাকৃতিক প্রাচীরের কাজ করে ঝড়ের সামনে। বন কমলে মূল ভূখন্ডে ভয়ানক প্রভাব ফেলবে প্রতিটা ঝড়।

বাম জমানায় সুন্দরবনকে উন্নয়নের বাইরে রাখা হয়েছে। উন্নয়ন স্তব্ধ করে প্রান্তিক মানুষের সরকার ও পার্টির পুতুল করে রাখতে মরিচঝাঁপির মতন উন্নয়ন মডেলকে কাজে না লাগিয়ে দ্বীপ শুদ্ধ লোককে মেরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সংবাদপত্র তখন সরকারের এই কাজের খবর সেভাবে ছাপতেই পারেনি।পাকা বাঁধ বাম জমানার শেষের দিকে ভাবা হলেও তাতে কার্যকরী ভূমিকা নেওয়া হয়নি। মনে রাখতে হবে 34 বছর। শুরু থেকে সুন্দরবন এদের ভাবনাতেই ছিল না। মরিচঝাঁপি আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে সে আয়নাটাকেই ভেঙে দেওয়া হলো। অন্যদিকে এইজমানাতেও আমরা অনুদানের লট বহর দেখেছি। হ্যাঁ প্রত্যন্ত গ্রামেও সরকারী প্রকল্প ও অনুদান অফিসিয়ালি গৃহীত হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় দুর্নীতির চাপে বাঁধ মেরামত হয়নি আর লোকে পাকা বাড়ি কটা পেয়েছে তা একটু এই দুদিনের খবরের চ্যানেল খুললেই পাওয়া যাচ্ছে। আর পাকা বাঁধের ব্যাপারে এই সরকারও কোনো উদ্যোগ নেয় নি বা নিলেও কার্যকর করতে তেমন উদ্যোগ নেয় নি । রাজনীতির লোকজন  আসলে  বোধ হয় সুুন্দরবনের প্রান্তিক গ্রামকে উপনিবেশ ভাবে। তাই ট্যুরিজম করে ট্যাক্স তোলা যায়, বনের কাঁকড়া, মাছ, মধু রপ্তানি করা যায়, কিন্তু স্থায়ী উন্নয়ন করা যায়না। এর পেছনে সব সরকারের একই নীতি কাজ করে বোধহয়। সুন্দরবনে সরাসরি ইয়াস ঘুর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে নি। তবুও পূর্ণিমার ভরাজোয়ারে প্রবল জলোচ্ছ্বাসে নদীবাঁধ উপচে বা ভেঙ্গে প্লাবিত হয়েছে বহু গ্রাম। বিস্তৃত অঞ্চলে ঢুকে পড়েছে লোনাজল। সুন্দরবনের মানুষ বড়ো বিপদে পড়েছে। এই ক্ষয়ক্ষতি আমফানের থেকে বেশি বই কম নয়। সুন্দরবনের মানুষের কাছে এক ভয়ঙ্কর দিন আসতে চলেছে। তারা গৃহহীন। সহায় সম্বলহীন। ক্ষেত -খামার, খাবারদাবার সব জলের তলায়। এরপর স্নানের জল, পানীয় জলের অভাব দেখা দেবে। এমনকি গৃহপালিত পশুদের পানীয় জলের সমস্যা তৈরি হবে। তার উপর জীবজন্তু পোকামাকড়, শাকসবজি পচে মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি হবে।একে করোনা মহামারী চলছে। তার উপর কলেরা ডায়েরিয়া শুরু হবে। মশার উতপাত বাড়বে। তাই ম্যালেরিয়ের প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে। এই জল সরে গেলে যে তারা বেঁচে যাবে এমন নয়! এই লোনা হয়ে যাওয়া মাটিতে দু-তিনবছর আর চাষ হবে না!
মানুষ খাবে কি? তাদের জীবিকা নির্বাহ কিভাবে হবে? শুধু সরকারি অনুদান কি পারবে তাদের জীবন- জীবিকা ফিরিয়ে দিতে? তারা কি প্রতিবছর আয়লা, বুলবুল, আমফান, ইয়াসে এভাবেই ভেসে যাবে? স্থায়ী কোনো সমাধান সত্যি কি নেই? 

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
বাঁকুড়া,পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top