সিডনী মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল ২০২৪, ১০ই বৈশাখ ১৪৩১

তপ্ত মরুর বুকে - স্থাপত্যের বিস্ময় : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
১০ জুন ২০২১ ২০:৩৭

আপডেট:
২৩ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:২৩

ছবিঃ রাজকুমারী রত্নাবতী গার্লস স্কুল

 

রাজস্থানের তপ্ত মরুর বুকে বিশাল ও শীতল এই স্কুল বানিয়ে দিলেন এক আমেরিকান দম্পতি মাইকেল কেল্লগ ও ডায়ানা। এ রূপকথার কল্প কাহিনী নয়। মাটির কাছাকাছি মানুষের রক্ত- ঘামের পরিশ্রম লব্ধ ফসল। রাজস্হানের শিক্ষার ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। এক সময়ে সমস্ত বিশ্বের মানুষকে আলোড়িত করেছিল। পড়ন্ত রোদে হলুদ বেলেপাথরে চুঁইয়ে ঠিক সোনার রঙেই রেঙে ওঠে। দেওয়াল বেয়ে সোনার আলো ঠিকরে বেরোয়। এক ঝলক দেখলে মনে হয় সোনার কেল্লা!  সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লা ছিল রাজরাজরাদের বাস। আর এই কেল্লার দেওয়ালে কান পাতলেই বাচ্চাদের খিলখিলিয়ে হাসির শব্দ ভেসে আসবে, অথবা একটানা নামতার সুর। কেল্লা নয়, এটা আস্ত একটা স্কুল।   

থর মরুর মাঝে এমন আশ্চর্য স্কুল তৈরি করেছেন নিউ ইয়র্কের এক দম্পতি মাইকেল কেল্লগ ও ডায়ানা। সোনার শহর জয়সলমির, জয়পুর বা যোধপুরের মত রঙ করা নয়, বাড়িঘর, অফিস, কাছারি থেকে মন্দির, দুর্গ সবকিছুই স্যাণ্ডস্টোন দিয়ে তৈরি। হালকা সোনালি হলুদ বেলে পাথরের কারুকার্য আস্ত একটা শহরকে সোনার রঙ ধরিয়ে। জয়সলমির শহরের কাছে কানোই গ্রামে হলুদ রঙের বেলে পাথরে দিয়েই রাজকুমারী রত্নাবলী গার্লস স্কুলটি নির্মাণ করেছিলেন মার্কিন স্হপতিরা। পুরো স্কুলটি ঝলসানো রোদ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে পুরোপুরি সুরক্ষিত।

২০১৪ সালে এই স্থপতি দম্পতি রাজস্থানে ঘুরতে এসে এখানকার স্থাপত্য-ভাস্কর্যের প্রেমে পড়েন, একই সঙ্গে এখানকার মেয়েদের অশিক্ষা, কুসংস্কার তাঁকে বিচলিত করে। তিনি মনে করেছিলেন, বিশাল মরুভূমির মাঝে এমনই একটাস্কুল তৈরি করতে হবে।

অন্তহীন বালির সমুদ্রের মাঝে এই স্কুল তৈরি হলেও হলুদ বেলেপাথরের কারণে স্কুলবাড়ির ভেতরটা বেশ ঠান্ডা। বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা আছে। বাড়ির ছাদে সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে, যেখান থেকে সৌরবিদ্যুতে আলো, পাখা সব চলে। ডায়ানা বলেছেন, জিওথার্মাল এনার্জি সিস্টেমে দিনের বেলা স্কুলের ভেতরটা ঠান্ডা থাকে, রাতের বেলা যখন বালির রাজ্যে হিমশীতল ঠান্ডা নামে, ওখন স্কুলের ভেতরের পরিবেশ আরামদায়ক থাকে। স্কুলের ভেতরে জল সংরক্ষণ করে রাখার ব্যবস্থাও আছে। স্কুলবাড়ির নির্মাণের দায়িত্বে থাকা করিম খান বলেছেন, ৩.৫ লক্ষ লিটার জল স্কুল বাড়ির ভেতরেই সংরক্ষণ করে রাখা আছে। তাছাড়া বৃষ্টির জল ধরে রাখার ব্যবস্থাও আছে। স্কুলের প্রতিটা ঘরে ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা আছে। দিনের বেলা প্রখর রোদে শিশুদের কষ্ট পেতে হয় না।

ছবিঃ মাইকেল কেল্লগ ও ডায়ানা

রাজকুমারী রত্নাবতী শুধু স্কুল নয়, এক অসামান্য ভাস্কর্য যার প্রতিটা পাথরে পাথরে গরিব, পরিশ্রমী মানুষগুলোর ভালবাসা গেঁথে আছে। মার্কিন স্থপতিদের নকশা করা ভবনে স্থানীয় ভাস্করদেরই পরিশ্রম মিশে আছে। সিআইটিটিএ-র কর্ণধার মাইকেল ডৌবে বলেছেন, এখানে যে গরিব ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করতে আসে তাদের অনেকেরই বাবা বা আত্মীয়রা পাথরের কাজ করেন। তাঁরাই হলুদ বেলেপাথরের জোগান দিয়েছেন। পাথরের পর পাথর গেঁথে ৯ হাজার বর্গফুটের বিশাল স্কুলবাড়ি তৈরি করেছেন তাঁরাই।

আপনি কী কল্পনা করেছেন যে থর মরুভূমির মাঝখানে পড়াশোনা করা বাচ্চারা, যেখানে দিনের তাপমাত্রা প্রায় 50 ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি এবং উষ্ণ বাতাস বয়ে যাওয়ার কারণে দিনের বেলা স্বাভাবিক জীবন অচল। জয়সলমিরের বিখ্যাত স্যাম ডুনেস থেকে মাত্র ছয় মিনিটের দূরে অবস্থিত একটি বিস্ময়কর স্থাপত্য। বিস্ময়টি মেয়েদের শিক্ষিত করা এবং তাদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে কানোই গ্রামে রূপ নিয়েছে। রাজকুমারী রত্নাবতী বালিকা বিদ্যালয় হলুদ বেলেপাথর দিয়ে তৈরি, এবং আশ্চর্যের বিষয় হল, এয়ারকন্ডিশনার নেই। এখানে, শিক্ষার্থীরা চরম আবহাওয়ার বিষয়ে চিন্তা না করে সুরক্ষিত উঠোনে অধ্যয়ন করতে এবং খেলতেও পারে।

ওভাল-আকৃতির কাঠামো সহ মরুভূমির প্রাকৃতিক দৃশ্যে মিশ্রিত স্কুলটি দৃশ্যত চিত্তাকর্ষক। বিল্ডিংটিও টেকসই তার উপাদানগুলির সাথে আসে। জ্ঞান সেন্টার নামে পরিচিত স্কুলের অংশটি কিন্ডারগার্টেন থেকে দশম শ্রেণিতে ৪০০ জন মেয়েকে থাকার ব্যবস্থা আছে, বর্তমানে ছাত্রীদের সংখ্যা ৮০০ ছাড়িয়েছে করোনার আবহে বর্তমানে বন্ধ আছে, অবৈতনিক শিক্ষার আয়োজন, রাজস্থানের পিছিয়ে পড়া প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েরা এখানে বিনামূল্যে শিক্ষা দেওয়া হয়। রাজকুমারী রত্নাবলী গার্লস স্কুলে ছোট ছোট রাজকুমারীরাই পড়তে আসে। কমপ্লেক্সটিতে একটি টেক্সটাইল যাদুঘর এবং পারফরম্যান্স হলের পাশাপাশি কারিগরদের কারুশিল্প বিক্রয় করার জন্য একটি প্রদর্শনীর স্থানও রয়েছে। অন্য একটি বিল্ডিংয়ে নারীরা মরা হস্তশিল্প সংরক্ষণের জন্য বুনন এবং টেক্সটাইলের মতো traditional ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলার প্রশিক্ষণ পান।

সিআইটিটিএ-র একটি অলাভজনক সংস্থা প্রতিষ্ঠাতা মাইকেল ডাউবের ভবনের ধারণাটি তৈরি করতে এবং এটি বাস্তবায়নে সহায়তা করতে এক দশক লেগেছে। মাইকেল আমেরিকা ভিত্তিক স্থপতি ডায়ানা কেলোগের সাথে যুক্ত, যিনি নকশাটি কল্পনা করেছিলেন।রাজকুমারী রত্নাবতী বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত ভাগ্যবান। সব্যসাচী মুখোপাধ্যায় কেবল তাদের ইউনিফর্মগুলিই বিশেষভাবে ডিজাইন করেছেন তা নয়, তাদের স্কুল চত্বরটি আমাদের বন্য স্বপ্নের বাইরে বলে মনে হয়!

স্থাপত্য শৈলী- নান্দনিক সৌন্দর্য: এক কথায় বলতে গেলে অনন্য। শৈলীর মূল থিম পশ্চিমের সাথে দেখা হয় যেন প্রাচ্যের। ভারতীয় ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক রাজস্থানের ঐতিহ্যবাহী স্হাপত্যকে অক্ষুণ্ণ রেখে তৈরি করা হয় রত্নাবতী গার্লস স্কুলের বহিঃমহল ও অন্দরমহল।

শেষকথা, রাজকুমারী রত্নাবতী গার্লস স্কুল শুধুমাত্র একটি  স্কুল নয়, এক অসামান্য ভাস্কর্য যার প্রতিটি পাথরের গায়ে  লেগে আছে গরিব পরিশ্রমী মানুষ গুলোর  রক্ত, ঘাম আর অমলিন ভালবাসা। মার্কিন স্থপতিদের নকশা ঠিকই, তবে স্থানীয় ভাস্করদের অসাধারণ দক্ষতার ছাপ মিশে আছে।  সিআইটির কর্ণধার অকপটে স্বীকার করেছেন, এখানে যে সমাজে পিছিয়ে হত গরিব মেয়েরা পড়াশুনা করতে আসে তাদের অনেকেরই বাবা অথবা আত্মীয় স্বজন পাথরের কাজ করেন। তারাই ৯০০০ বর্গফুটের বিশাল স্কুল বাড়িটি তৈরি করেছেন। স্কুলের দেওয়ালের প্রতিটি কারুকার্য স্থানীয়দের। গঠন শৈলীর মধ্যে একটা আবেগময় মুগ্ধতা বিরাজমান।

এক অসাধারণ মানবিক ভাবনার ফসল এই স্কুল। বিশাল মরুভূমির সাথে এমন একটা স্কুল তৈরি করতে হবে যার নান্দনিক সৌন্দর্য মুগ্ধ করবে গোটা বিশ্বকে। সেই সঙ্গে আবার স্কুলের মাধ্যমেই শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়বে গরিব, পিছিয়ে পড়া মানুষের মধ্যে। অন্যতম স্হাপত্যবিদ ডায়না বলেছিলেন, "ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে তিনি পাশ্চাত্যকে মেলাতে চাননি। তাই রাজস্থানের ঐতিহ্যবাহী স্হাপত্য ও ভাবধারা রেখেছেন।"

এই স্কুলের ভাস্কর্য রাজপুতদের সংস্কৃতির সঙ্গে গভীর ভাবে সম্পৃক্ত।  জয়সলমিরের প্রাচীন দূর্গগুলির মতোই এর নকশা। অন্তহীন বালির সমুদ্রের মাঝে এই স্কুল অবস্থান করলেও হলুদ রঙের বেলে পাথরের জন্য শীতল থাকে। মরুভূমিতে দিন আর রাতের আবহাওয়া আলাদা। দিনের আবহাওয়া অত্যন্ত আরামদায়ক। আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর এক অনন্য সৃষ্টিকর্ম রাজকুমারী রত্নাবলী গার্লস স্কুল। আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার সব রকমের ব্যবস্হা মজুত। কি- নেই, আছে অডিটোরিয়াম, মিউজিয়াম, জ্ঞান সেন্টার, হস্তশিল্পের হাব, বিনোদন কেন্দ্র, ক্যান্টিন, গেস্টহাউস, শিক্ষকদের আবাসন, লাইব্রেরি, জলসংরক্ষণের আধুনিক ব্যবস্থা। ডায়নার সোনার কেল্লা কোনও যুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে নয়, শিক্ষার মশাল জ্বেলে দাঁড়িয়ে আছে ধূ ধূ মরুর বুকে। রাজস্থানের জয়সলমিরের কাছে রাজকুমারী রত্নাবলী গার্লস স্কুল নারী শিক্ষার এক অনন্য নজির। সার্থক হয়েছে পশ্চিমের সাথে প্রাচ্যের অপূর্ব মেলবন্ধন। 

 

ডঃসুবীর মণ্ডল
লোকগবেষক, প্রাবন্ধিক, রম্যরচনা, ফিচার, অণুগল্প ও ছোটগল্প এবং ভ্রমণকাহিনীর লেখক 
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top