সিডনী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১

বৃদ্ধাশ্রম বা নার্সিংহোমের প্রসঙ্গিকতা : কাজী সুলতানা শিমি


প্রকাশিত:
১৭ নভেম্বর ২০১৯ ১৮:৪৬

আপডেট:
৪ মে ২০২০ ২১:১৩

কাজী সুলতানা শিমি

 

প্রচলিত ধারণার বাইরে যাওয়া বা সীমানা ডিঙ্গানো খুব সহজ ব্যাপার নয়। আজকাল প্রায়ই পত্রপত্রিকা ও বিভিন্ন গণমাধ্যম সহ নানা মাধ্যমে বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে বিভিন্ন ধরণের প্রচারণা চোখে পরে। সেখানে বৃদ্ধাশ্রম বা নার্সিংহোমের ধারনাটা আমাদের মাঝে এমন ভয়ংকর, নেতিবাচক এমনকি আতংকজনকভাবে উপস্থাপন করা হয় যে এরপ্রতি একটা বিরূপ ধারণা জন্মাচ্ছে দিন দিন। কিন্তু পরিস্থিতি ও সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে বৃদ্ধাশ্রম সম্পর্কেও দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন করার সময় হয়েছে এখন। প্রচলিত ধারণায় বলা হয় অকৃতজ্ঞ সন্তানেরা তাদের বাবা মাকে অসহায় বৃদ্ধ বয়েসে দেখাশোনা ও যত্ন এড়াতে নামমাত্র কিছু টাকা পয়সা দিয়ে দায় চুকিয়ে এক আশ্রমে রেখে আসেন। শুনে মনে হয় মর্মান্তিক ও জেলখানা জাতীয় কোন একটা জায়গায় রেখে যাওয়া।এরপর তারা আর কোনদিন সেখানে আসেনা কিংবা এলেও নামমাত্রভাবে দ্বায়িত্ব ঘুচাতে আসে। সেখানে বাবা মায়েরা অসহায় একাকীত্ব নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনতে গুনতে একসময় পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। মোটামুটি এ ধরণের একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই। 

বাস্তবে ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও তা নয়। বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে অতান্ত চমৎকার কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার।প্রথম যখন দেশ ছেড়ে নিউজিল্যান্ড যাই, সেখানকার বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে ধারণা পুরোপুরি পাল্টে যায়। এ লেখায় তার সবিস্তারে যাচ্ছি না। কোন একদিন লিখবো আশা রইলো।বৃদ্ধাশ্রমকে আমি নতুনকরে দেখতে শিখি,নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে একবার এক লাইব্রেরীতে আমার ৮০ বছরের প্রবীণ একজন মানুষের সাথে পরিচয় হবার পর থেকে। যিনি বৃদ্ধাশ্রমে থাকতেন। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব, তারপর একদিন তার নিবাসে যাওয়া শুরু হয়। প্রায় বিকেলেই সেখানে যাওয়া আসা হতো আমার। সুন্দর গুছানো, পরিপাটি ও রীতিমতো ছবির মতো একটা পরিবেশ। সাধারণ বর্ণনার একেবারে বিপরীত। সেখানে প্রায় সমবয়সী মানুষজন নিজেরা নিজেদের মতো করে জীবন যাপন করছে। ছেলে মেয়ে নাতি নাতনী থাকা স্বত্বেও বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে পছন্দ করেন তারা। কেননা তাদের মতে এতে এক ধরণের স্বাধীনতা আছে বলে তারা মনে করতেন।এতে অন্য কাউকে বিরক্ত কিংবা কারো সময় নষ্ট করে তার কাছে নতজানু হয়ে থাকার প্রয়োজন পড়েনা।

বাস্তবিকভাবেই দেখা যায়, বয়স আশি কিংবা নব্বই হয়ে গেলে তাদের ছেলেমেয়েদেরও  বেশ বয়েস হয়ে পড়ে। তখন তাদের নিজেদেরও যত্ন দরকার। তাই তারা তাদের বাবা মায়েদের তেমন করে দেখাশোনা কিংবা যত্ন নিতে পারেন না। এ নিয়ে তারা এক ধরণের আত্নগ্লানি বোধ করেন। তারউপর সংসারের প্রত্তাহিক দায়-দায়িত্ব তো থাকেই। প্রতি পদে পদে প্রতিযোগিতামূলক এই সময়ে মানসিক চাপও সীমাহীন।  এই অহিনকুল অবস্থায় কোন প্রফেশনাল নার্সিং হোমে থাকলে বাবা মায়েরা বরং তুলনামুলকভাবে বেশী যত্নে থাকেন। 

নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই হোক কিংবা প্রয়োজনে একবার বৃদ্ধাশ্রমেথাকার পর দেখা যায় তারা নিজেরাই আর ছেলেমেয়ের কাছে অতিরিক্ত চাপ হয়ে থাকতে চান না। এই অস্ট্রেলিয়াতেও আমার অতি কাছের কিছু নিকট আত্বীয়ের স্বীকারোক্তি এবং নার্সিং হোমে যেয়েও আমার এ অভিজ্ঞতা হয়েছে। দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন হয়েছে। দেখেছি  সমবয়সী মানুষ পরস্পর নিজেরা তাদের নিজেদেরকথা, অভিজ্ঞতা ও সুখদুঃখযেভাবে শেয়ার করে আনন্দ পান, অসম বয়সীদের সাথে ততোটা পান না। বিশেষ করে আমাদের কালচারের বাবা মায়েরা যে মতাদর্শ লালন করেন তা থেকে সন্তানের মতাদর্শ অনেক পার্থক্য থাকে। অনেক সময় তাদের চিন্তা ভাবনায় থাকে যোজন ফাড়াক ও বৈপরিত্য। তারচে সমবয়েসীদের সাথে তারা সময় কাটাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ব্যাপারটা অনেকটা গ্যাব্রিয়েল মার্কজের Old people with old people are not so old’. বৃদ্ধ বা প্রবীণ বয়েসে তারা যে স্মৃতিচারণ করেন সেটাতেতারা তাদের সমবয়েসিদের সাথে যতোটা না আনন্দ পাবেন নাতী নাতনীরা সেটা সেভাবে অনুভব করবেনা। ব্যাপারটা অনেকটা সিনিয়র ক্লাব, গেট-টুগেদার কিংবা নৈমত্তিকআড্ডা’র মতো করে কাটানো। যেখানে কথা বলার মতো সব সময়ই কাউকে না কাউকে পাওয়া যাবে। এই যান্ত্রিক জীবনে ছেলেমেয়েরা যে মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকে তাতে তাদের নিজেদেরই তো সময় দেয়ার মতো আলাদা সময় থাকেনা। তাই ভালো নার্সিং হোমে থেকে প্রতিটা মুহূর্ত আরও ভালোভাবে কাটানো যায় নতুন নতুন মানুষের সংস্পর্শে এসে। নতুন নতুন অভিজ্ঞতা শেয়ার করার সুযোগ থেকে। পাশাপাশি শুধু নাতী-নাতনীদের কেয়ার টেকার হিসেবে না থেকে তারা অনেক সময় নিজেদের আনন্দ ও সৃজনশীলতায় সময় কাটানোটাই বেশী উপভোগ করেন। সর্বোপরি, মানুষ মানুষের জন্য এই সার্বজনীনতার একটা বোধ অনুভূত হয় সেখানকার পরিবেশ থেকে। 

এ প্রসঙ্গে আরব কবি কাহলিল জিব্রানের লেখা থেকে একটু উদ্বৃতি দিয়ে বিষয়টি বুঝানো হয়তো সহজ হতে পারে। তিনি বলেছিলেন, “তোমাদের সন্তানেরা তোমাদের নয়। নিজের জন্য, জীবনের জন্য যে ব্যাকুলতা তারই সন্তান তারা। তারা তোমাদের মাধ্যমে আসে কিন্তু তোমাদের কাছ থেকে নয়। আর তারা তোমাদের সাথে থাকলেও তোমরা তাদের মালিক নও। তোমরা তাদেরকে তোমাদের ভালোবাসা দিতে পারো কিন্তু তোমাদের চিন্তা-ভাবনা নয়। কারন, তাদের নিজেদের চিন্তা-ভাবনা আছে।তাদের দেহকে তোমরা ধারণ করতে পারো কিন্তু তাদের আত্নাকে নয়। কারণ তাদেরআত্না বাস করে আগামীকালের প্রান্তে সেখানে তোমরা যেতে পারবেনা। তোমাদের স্বপ্নেও নয়।তাদের মতো তোমরা হবার চেষ্টা করতে পারো। কিন্তু তাদেরকে তোমাদের মতো বানাবার চেস্টা তোমরা করোনা”।বস্তুতঃ আমরা সন্তানের জন্ম দিই পরিবারের প্রয়োজনে, প্রকৃতির প্রয়োজনে। তাদের কাছে কোনধরনের প্রত্যাশা না করাটাই বরং মঙ্গল ও মহত্ব্যের। তাদের জন্মদান, লালন-পালন ও পরিচর্যার বিনিময়ে যদি তাদের কাছে প্রত্যাশাটাই হয় মুখ্য, তাহলে সেটা আর অকৃত্রিম ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসা থাকেনা। ছোটবেলায় লালন-পালন করেছি বলেই শেষবেলায় তার প্রতিদান চাইবো এটা একধরণের বিনিময়। স্বত্ব ও অধিকার ছেড়ে দিয়ে মাঝে মাঝে দেখা হওয়া বা যোগাযোগ থাকাটাই বরং উভয়পক্ষের জন্যই হয় অনেক যত্নের ও মর্যাদার।

মানুষ একা থাকতে পছন্দ করেনা। সঙ্গ আর আড্ডায় চারপাশ মুখর থাকুক এটা সবারই চাওয়া। সমবয়সীদের মধ্যেই এই মুখরতা গতিশীল ও প্রসঙ্গিক হয় অনেক বেশী। এই কর্পোরেট জীবনে ব্যাস্ত সময়ে কথা বলা বা সময় দেয়ার মতো সময় কারো নেই। কেউ চাইলেও সেটা আর তেমন করে সম্ভবও হয়ে উঠছে না।এমনকি ছেলেমেয়েরা চাইলেও পারিপাশ্বিকতার কারনে অনেক ক্ষেত্রেই তা হয়ে উঠেনা।যৌথ পরিবার ছেড়ে একক পরিবার গঠন করার পর এটা এখন একটা স্বাভাবিক পরিস্থিতি। নিজের জীবনে দুর্বিষহ একাকীত্ব ভর করার আগেই বাস্তবমুখী পরিকল্পনায় দূরদর্শী হওয়া দরকার। তাই আবেগের চেয়ে বিবেককে অনুসরণ করাই বরং বিচক্ষনতার পরিচয়। সেকারণে মন ও চেতনায় ইতিবাচকপ্রস্তুতি নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমকে স্বাগতঃ জানানোই প্রাসঙ্গিক এখন।

 

লেখকঃ কাজী সুলতানা শিমি

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top