সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

করোনায় শেক্সপিয়র ও অন্যান্য মহান ব্যক্তিরা : সাইফুর রহমান


প্রকাশিত:
৯ এপ্রিল ২০২০ ২১:৫০

আপডেট:
৪ মে ২০২০ ২০:৫৩

সাইফুর রহমান

 

এখন থেকে ৩৫৬ বছর পূর্বের কথা। ১৬৬৪ সালে ক্রিসমাস ইভের প্রাক্কালে লন্ডন শহরে গুডওমেন ফিলিপ্স নামে এক ইংরেজ মহিলা তার নিজ গৃহে মৃত্যুবরণ করলেন। পরিক্ষা-নীরিক্ষা করে দেখা গেল জনৈক সেই ইংরেজ মহিলা আক্রান্ত হয়েছিলেন প্লেগে। সঙ্গে সঙ্গে সে বাড়িটি সিলগালা করে দেওয়া হলো। প্লেগে আক্রান্ত মৃতের সদর দরজায় বড় বড় হরফে লিখে দেওয়া হলো “মহান ঈশ্বর আমাদের উপর দয়া করুন। গুডওমেন ফিলিপ্স নামের এই মহিলাটি ব্যুবুনিক প্লেগে মারা গেছেন।” ১৬৬৪ সালে প্লেগ রোগটির শুরু এভাবেই। পরবর্তী মাসগুলোতে মাত্র কিছু লোকেরই প্রাণহানি হলো প্লেগে। কিন্তু ১৬৬৫ সালের এপ্রিলের দিকে প্লেগ রোগটি মহামারি আকার ধারণ করলো। গ্রীষ্মঋতু পুরুদস্তুর শুরুর সঙ্গে সঙ্গে মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেলে দু’সহস্রাধিক এবং জুলাই নাগাদ মৃত্যুর এই মিছিল সংখ্যায় গিয়ে দাঁড়ালো ৭,৪৯৬। রোগটি শুরু হওয়ার পর থেকে ১৮ মাস পরে শুধুমাত্র লন্ডন শহরে মৃতের সংখ্যা অবিশ্বাস রকম বেড়ে দাঁড়ালো ১ লক্ষে যা সংখ্যায় লন্ডন শহরের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ।

মহামারিটি শুস্ক অরণ্যে দাবানলের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে লাগল লন্ডন শহরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতেও। অনিবার্য ভাবে দাবানলের সেই ঢেউ এস পড়ল অক্সফোর্ড, ক্যামব্রীজ ও অন্যান্য শহরগুলোতেও। ২৩ বছরের তারুণ্যেপরিপূর্ণ টকবগে যুবক আইজ্যাক নিউটন তখন ক্যামব্রীজে পড়াশুনা করছিলেন গণিত বিষয়টিতে। আচানক একদিন তার শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ঈষৎ বেশি হওয়ায় অবিলম্বে তিনি নির্দেশিত হলেন ক্যামব্রীজ ছেড়ে যাওয়ার। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আদেশের সঙ্গে সঙ্গে নিউটন চটজলদি সেখানকার পাততারি গুটিয়ে চলে গেলেন তার পরিবারের মালিকানাধিন খামারবাড়ি লিঙ্কনশায়ারে। সেখানে নিউটনের বিস্তর অবসর কিন্তু অবসরে অযথা সময় নষ্ট করার মতো মানুষ মোটেও ছিলেন না তিনি। বিশাল বাড়িটির দক্ষিণমুখী জানালার গরাদের ফাঁক গলে সূর্যের আলো এসে খেলা করে ঘরের মেঝেতে। দীর্ঘ সময় ধরে একদৃষ্টিতে নিউটন তাকিয়ে থাকেন সেই আলোর দিকে। মনে মনে ভাবেন বাঁধা পেলে আলো কি বেঁকে যায়? কিংবা আলোর প্রকৃত রং-টাই বা কী?

কোয়ারেন্টাইনে নিউটন ছিলেন দীর্ঘ ২২ মাস। ১৬৫৫ সালের ২২ জুলাই থেকে ১৬৬৭ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এই বাইশ মাসে নিউটন লিখেফেললেন দুটি গবেষণাপত্র। অথচ আমরা চলমান করোনা মহামারির ভয়াবহতার মধ্যেও একসপ্তাহ কোয়ারেন্টাইনে থেকে হাঁপিয়ে উঠি। ঘরবন্দি থাকা অবস্থাতেই নিউটন মাধ্যাকার্ষণ ও গতির সম্পর্ক নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। এ নিয়েও মজার একটি গল্প চালু আছে। আমার ধারণা পাঠকবৃন্দের মধ্যে অনেকেই সে গল্পটি জানেন। কোয়ারেন্টাইনের সেই সময়টাতেই নিউটন একদিন বাগানে বসেছিলেন। হঠাৎ করে একটি আপেল গাছের মগডাল থেকে সোজা পড়ল মাটিতে। নিউটন ভাবতে লাগলেন আপেলটি মাটিতে পড়ল কেন? চাঁদও তো আকাশে ঝুলে আছে। কই চাঁদ তো মাটিতে এসে আছড়ে পড়েনা।

মাধ্যাকার্ষণ নিয়ে আস্ত একটি তত্ত্বের ভ্রুণ, নিউটনের মস্তিস্কে কিন্তু সৃষ্টি হয়েছিলো এই কোয়ারেনটাইনে বসেই। ঠিক যেদিন গাছ থেকে আপেলটি মাটিতে পড়ল ঠিক সেদিনই নিউটনের চিন্তার গর্ভে মাধ্যাকার্ষণ নামক বিখ্যাত সেই তত্ত্বটির বীজ অঙ্কুরোদগম হয়েছিলো। সে সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হতে পারি এর কয়েক বছর পর নিউটন তাঁর এক বন্ধুকে যে চিঠিটা লেখেন সেই চিঠিটা থেকে। নিউটন তার বন্ধুকে লেখেন- কোয়ারেনটাইনের দিনগুলোতে আমার কাছে অনেক সময় ছিলো। তাই যেসব প্রশ্নের উত্তর তখন পর্যন্তও পাইনি সেগুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করি। মাধ্যাকার্ষণ নিয়ে যে চিন্তাভাবনাগুলো মাথায় খেলা করছিলো সেগুলোই পুনরায় ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম।

আইজ্যাক নিউটন

১৬৬৯

 

মজার বিষয় হচ্ছে মাধ্যাকার্ষণ বিষয়ে পরিপূর্ণ তত্ত্বটি নিউটন কিন্তু দিয়েছিলেন আরো ২০ বছর পর।

এতো গেল আইজ্যাক নিউটনের কথা। শ্রুতকীর্ত ইংরেজ লেখক উইলিয়াম শেক্সপিয়রও কোয়ারেন্টাইনের অবসরে লিখেছিলেন অনেক কায়জয়ী নাটক ও কবিতা। শেক্সপিয়র সম্পর্কে পড়াশুনা করে যতটুকু ধারণা করা যায় তাতে বলা যায় শেক্সপিয়রকে সম্ভবত সমগ্র সাহিত্যকর্মের তিন ভাগের একভাগ শুধুমাত্র কোয়ারেন্টাইনে বসেই লিখতে হয়েছিলো। যদিও কিছুদিন আগে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান’ শুধু ‘কিং লিয়ারের’ কথাই লিখেছেন। পত্রিকাটি আমাদের জানাচ্ছে যে শেক্সপিয়র কোয়ারেন্টাইনে বসে ‘কিং লিয়ার’ নাটকটি লিখেছিলেন। কিন্তু আমার ধারণা এক-তৃতীয়াংশ রচনা শেক্সপিয়র কোয়ারেন্টাইনে বসেই লিখেছিলেন। আমার বক্তব্যের পিছনের কারণগুলো বলছি।

ইংল্যান্ডে প্লেগের প্রাদুর্ভাব শুরু হয় ১৩০০ সালের পরে। সেই প্লেগকে বলা হতো ব্যুবুনিক প্লেগ। ব্যুবুনিক প্লেগ সাধারণত ছোট প্রাণী থেকে আক্রান্ত ফ্লিইয়া নামক মক্ষিকার মাধ্যমে ছড়ায়। এটা প্লেগে আক্রান্ত প্রাণীর মৃতদেহ থেকে নির্গত তরল পদার্থ থেকেও ছড়াতে পারে। ব্যুবুনিক প্লেগের ক্ষেত্রে, ফ্লিইয়া নামক এই জীবাণুটি ত্বকে কামড়ালে জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে লসিকানালীর মাধ্যমে লসিকাগ্রন্থিতে পৌঁছায় ফলে লসিকা ফুলে যায়। রক্ত, থুথু বা লসিকাগ্রন্থিতে জীবাণুর উপস্থিতি নির্ণয় করে রোগ নির্ণয় করা যায়।

১৩০০ সালের পর থেকে মাঝে মাঝেই সে দেশের মানুষ প্লেগে আক্রান্ত হতো এবং এর ফলে বহু মানুষের মৃত্যু হতো। একরকম ভাবে বলা যায় শেক্সপিয়রের জন্মও হয়েছিলো প্লেগ নামক এই মহামারিটি চলাকালিন সময়ের মধ্যেই। শেক্সপিয়রের জন্ম ১৬৬৪ সালের ২৪ এপ্রিল। শেক্সপিয়রের জন্মের সঠিক তারিখ জানাযায় না। মনে করা হয় তিনি ২২ কিংবা ২৩ এপ্রিল জন্মেছিলেন। কারণ ২৪ এপ্রিল যে তাকে স্ট্রাটফোর্টের একটি চার্চে ব্যাপটাইজ করা হয়েছিলো সে প্রমান আছে। অন্যদিকে ১৫৬৩ সাল থেকে ১৫৬৫ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ মাত্র দু’বছরে সমস্ত ইংল্যান্ড জুড়ে ৮০ হাজার লোক শুধু প্লেগেই মারা গিয়েছিলো। মৃত্যুবরণ করেছিলেন শেক্সপিয়রের অগুনতি বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও সুহৃদ। এছাড়াও এডমন্ড নামে ২৭ বছরের শেক্সপিয়রের আপন সহোদর ও তিন সহোদরা, যথাক্রমে- জোয়ানা ও মার্গারেট এ দু’জন একেবারে শিশু অবস্থায় এবং অ্যান নামের ৭ বছরের আরেকটি বোন মারা যায় প্লেগে। তবে শেক্সপিয়র বোধকরি সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন তার নিজের পুত্র হ্যামনেট মারা যাওয়ার সময়। দু’কন্যা, এক পুত্র ও স্ত্রী অ্যান হিতওয়েকে নিয়ে শেক্সপিয়রের গোছানো সংসার। দু’কন্যা সুজানা হল ও জুডিথ কুইনী, একটি মাত্র পুত্র হ্যামনেট। ১৫৯৬ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে পুত্র হ্যামনেটও মারা যান প্লেগে। পরবর্তীকালে ‘হ্যামলেট’ নাটকটি শেক্সপিয়র তার পুত্র হ্যামনেটের নাম অনুসারেই যে রেখেছিলেন সেটা সহজেই অনুমেয়।

প্লেগে যে শুধুমাত্র তার আপন চার ভাই-বোন ও এক পুত্রই মৃত্যুবরণ করেছিলেন তা কিন্তু নয়। শেক্সপিয়র মারা যান ১৬১৬ সালের ২৩ এপ্রিল। ১৬১৭ সালের মে মাসে মারা যান তার ৬ মাসের এক নাতি, নাম শেক্সপিয়র কুইনি এবং আরো দুই নাতি যথাক্রমে ১৯ বছরের রিচার্ড কুইনিং এবং ২০ বছরের থমাস কুইনি। উপরোক্ত মৃত্যুর পরিসংখ্যান দেখে অনেকেই হয়তো চমকে উঠছেন!! ভাবছেন তাহলে শেক্সপিয়র বেঁচে গেলেন কিভাবে? চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস আমাদের জানাচ্ছে- হাঁড়কাঁপানো শীতের দেশের মানুষ হয়েও শিশুকাল থেকেই শেক্সপিয়র নাকি ছিলেন ভয়ানক রকম শীতকাতুরে। সেইজন্য সবসময় তিনি ফায়ার প্লেসের আশেপাশে থাকতেন। আর রাতে ঘুমাতেনও সেই অগ্নিচুল্লির পাশে। সেজন্য ফ্লাইয়া নামক যে কীটগুলো প্লেগ ছড়ায় সেগুলো শেক্সপিয়রের ধারেকাছেও ভিড়তে পারেনি কখনো।

উপরোক্ত হিসেব থেকে সহজেই অনুমান করা যায়। যদি একটি পরিবারেই শুধু ৮ জন সদস্য মারা যায় প্লেগে তাহলে সে আমলে প্লেগ কতটা ভয়াবহ ছিলো। ভালমতো ইতিহাস পর্যালোচনা করে সহজেই এটা প্রভিভাত হয় যে সে সময়কার ইংরেজ জনজীবন ছিল বেশ কিছুটা প্লেগময়। ছ’মাস থেকে কখনো কখনো দু’আড়াই বছর পর্যন্ত থাকতে হতো হোম কোয়ারেন্টাইনে। তবে শেক্সপিয়রের সাহিত্যকর্ম সৃষ্টির সময়টাতে প্লেগ সম্ভবত তিনবার বেশ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিলো সেটা ১৫৯৩, ১৬০৩ ও ১৬০৮ সালে। কারণ ইতিহাস ঘেটে দেখা যায় এই সালগুলোতে লন্ডনের থিয়েটারগুলো সব বন্ধসহ সমস্ত কিছু লকডাউন করে দেয়া হয়েছিল। ১৫৯২ সালের মাঝামাঝি প্লেগের কবলে পড়ে লন্ডনে প্রথম বারো মাসেই মারা যায় এগারো হাজার লোক। এর ফলে ১৫৯৪-এ মে মাসের লন্ডনের থিয়েটার গুলোতে লাগাতার অভিনয় সম্ভব হয়নি। ১৫৯৩ সালে শেক্সপিয়র প্রকাশ করেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ভেনাস অ্যান্ড অ্যাডনিস’, আর তার পরের বছর ‘দ্য রেপ অফ লুক্রিস’। এ দুটো লেখাই সম্ভবত শেক্সপিয়র গৃহে অন্তরীণ অবস্থায় লিখেছিলেন- প্রথমটা হালকা চালে বলা প্রেমকাহিনি, দ্বিতীয়টা চড়া সুরের নিষ্ঠুর গল্প। দুটো গল্পের সূত্রই শেক্সপিয়র ধার করেছিলেন রোমান কবি ওভিদের (৪৩ খ্রীষ্টপূর্ব-১৮ খ্রিষ্টাব্দ) ‘মেটামর্ফোসেস’ থেকে। দুটো বই-ই উৎসর্গ করা হয়েছে বছর-কুড়ি বয়সের তরুণ আর্ল অফ সাউথহ্যাম্পটন হেনরি রিসলি বা রোসলিকে। ‘ভেনাস অ্যান্ড অ্যাডনিস’ এর আখ্যাপত্রে তাঁর নাম ছাপা হয়নি। স্ট্র্যাটফোর্ডের অধিবাসী রিচার্ড ফিল্ড লন্ডনে ছাপাখানা খুলেছিলেন। শেক্সপিয়রের প্রথম কয়েকটি বই ছাপা হয়েছিল রিচার্ড ফিল্ডের সহায়তায়।

শেক্সপিয়র সম্ভবত ‘ওথেলো’ নাটকটিও লিখেছিলেন গৃহবন্দি থাকাকালিন। কারণ ওথেলো প্রকাশিত হয় ১৬০৪ সালে। শেক্সপিয়রের শেষের দিককার একটি লেখা ‘চেম্বারলিন’ ও সম্ভবত অনিচ্ছা নির্বাসনে বসেই লিখেছিলেন তিনি। প্লেগ নামক এই মহামারির আতঙ্ক ও ভয় শেক্সপিয়রকে সমস্ত জীবন ভীষণ ভাবে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। এজন্যই বোধকরি প্লেগ নিয়ে তিনি কোন সাহিত্য রচনা করার সাহস করেননি। তবে তিনি বিখ্যাত ইতালিয়ান লেখক বোক্কাচ্চ জিওভানি (১৩১৩-১৩৭৫) লিখিত ‘দি দেকামেরন’ পড়ে প্রানীত হয়ে ‘চেম্বারলিন’, ‘দ্য মার্চেন্ট অফ ভেনিশ’ এবং ‘অলওয়েল দ্যাট এ্যান্ডস্ ওয়েল’ নাটকগুলো লিখেছিলেন। বোক্কাচ্চ জিওভানির ‘দ্য দেকামেরন’ লেখাটিও মহামারি প্লেগকে কেন্দ্র করেই। ১৩৪৮ সালে ফ্লোরেন্স নগরীতে প্লেগ মহামারি আকারে দেখা দেয়। ‘দ্য দেকামেরনে’ মহামারি আক্রান্ত শহরের বাস্তব চিত্র এঁকেছেন বোক্কাচ্চ। এই ভীতিপ্রদ পরিবেশে নাগরিকেরা দিশেহারা, পথে পথে শবযাত্রার মিছিল, গণসমাধি এবং নতুন আক্রমণের আশঙ্কায় নাগরিকেরা কেউ কেউ উদ্ভ্রান্ত। অনেকে সংক্রমণ এড়াবার জন্য বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ করে গৃহবন্দি। আবার কেউ কেউ বিচলিত হয়ে জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি হই-হুল্লোড়-মাতলামি চুরি-ডাকাতিতে ব্যস্ত, আবার শহর থেকে দূরে পালিয়ে যেতে ব্যগ্র। বোক্কাচ্চ প্লেগ মহামারি এই সংক্ষিপ্ত বাস্তবধর্মী চিত্র পাঠ করে ড্যানিয়েল ডিফোর ‘এ জার্নাল অব দি প্লেগ ইয়ার’ বইটি প্লেগ মহামারি সম্বন্ধে বিস্তৃত নিখুঁত বর্ণনার কথা মনে করিয়ে দেয়। মহামারির এই ভূমিকায় ফ্লোরেন্স-এর দশজন পলায়নপর নাগরিককে লেখক একত্রিত করেছেন কয়েক মাইল দূরে পল্লিগ্রামের এক নির্জন বাসভবনে। শহরের বাইরে এসে প্রথমে উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের সাতজন তরুণী, যাদের বয়স আঠারো থেকে আঠাশের মধ্যে, এসে প্রথম আশ্রয় নিল এক গির্জার বারান্দায়। পরে তারা স্থির করল এভাবে থাকা যাবে না। গ্রামে আত্মীয়স্বজনের যে বাড়ি আছে সেখানে আশ্রয় নেওয়াই ভালো। কিন্তু বাড়িটি প্রায় দু’মাইল দূরে সেখানে মেয়েদের একা একা যেতেও ভয় করছিল। পথে নেমে আসতেই দেখা হল তাদের পূর্ব-পরিচিত তিনজন তরুণের সঙ্গে। তখন সকলে মিলে যাত্রা করল প্রস্তাবিত সেই বাড়ির দিকে। প্লেগের ত্রাস দশজনকে দৃঢ়বন্ধনে একত্রিত করেছে ‘দ্য দেকামেরন’ আখ্যানটিতে।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে শুধুমাত্র শেক্সপিয়র কিংবা নিউটনই নয় কোয়ারেন্টাইন কিংবা এই অনিচ্ছা নির্বাসন কিছু সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে অনেকটা আশীর্বাদ বয়ে এনেছে তাঁদের জীবনে। যেমন ইংরেজ সাহিত্যের প্রথমদিককার লেখক জেফ্ররি চসার তার বিখ্যাত লেখা ‘দ্য ক্যন্টারবারি  টেলস্’ও গৃহে অন্তরীণ অবস্থায় লিখেছেন। যদিও চসার সেই সময়টায় ভীষণ ভাবে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু কুষ্ঠ রোগ কিংবা প্লেগ কোনটাই তাকে রুখতে পারেননি। আরেক বিখ্যাত ইংরেজ লেখিকা মেরি শেলীও ভয়ানক শ্বাসকষ্ট ও শরীরে কৃত্তিম শ্বাস-প্রশ্বাসের যন্ত্র লাগিয়ে লিখেছিলেন তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেস্টাইন’। অন্যদিকে যখন সমস্ত দুনিয়া পলিও রোগে আচ্ছন্ন ঠিক তখন প্রখ্যাত ইংরেজ লেখিকা সিলভিয়া প্লাথ লিখেছিলেন ‘দ্য বেল জার’ ও উইলিয়াম কেনেডি লিখেছিলেন ‘আয়রণউইড’। এবার আইরিস লেখক জেমস্ জয়েসের কথা একটু বলি। আয়ারল্যান্ডের রাজধানি ডাবলিনের ৭৫ শতাংশ লোক যখন সিফিলিসে আক্রান্ত ঠিক সেই সময়টায় ইংরেজি সাহিত্যের অত্যুঙ্গ লেখক জেমস্ জয়েস নির্বিঘ্নচিত্তে বসে লিখেছিলেন তার ভীষণ বিখ্যাত উপন্যাস ‘উইলিসিস’ সিফিলিস প্রসঙ্গ যেহেতু এলোই সেহেতু শেক্সপিয়র সম্পর্কেও কিছু বলতে হয়।

২০১২ সালে আমেরিকার হার্বার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জন জে রস নামে প্রসিদ্ধ এক চিকিৎসক একটি বই লেখেন, নাম- ‘শেক্সপিয়র’স ট্রেমোর এন্ড অরওয়েল’স ক্ফ। বাংলা করলে বইটির মানে দাঁড়ায় ‘শেক্সপিয়রের আঁকাবাকা লেখা এবং অরওয়েলের কাশি’। রস নামের এই চিকিৎসক ভদ্রলোক শেক্সপিয়রের হাতের লেখা পরিক্ষা করে তাঁর বইটিতে লিখেছেন- শেক্সপিয়র নাকি সিফিলিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কাঁপাকাঁপা হাতের আঁকাবাকা লেখাই নাকি এর যথেষ্ট প্রমান। ডক্টর রস আমাদের আরো জানাচ্ছেন শেক্সপিয়র যতটা না সিফিলিসে ভুগেছিলেন তার চেয়ে বেশি ভুগেছিলেন এর চিকিৎসাপত্র করতে গিয়ে। সত্যি সত্যি যদি শেক্সপিয়র সিফিলিসে ভুগে থাকেন তাহলে রস ঠিকই বলেছেন। কারণ সিফিলিস নামক ভয়াবহ রোগটি থেকে বাঁচতে সে যুগে মানুষ কী কী না করতো। সিফিলিস নামের এই মহামারিটি দাপিয়ে বেড়িয়েছে প্রায় ছ’শ বছর। কে ভুগেননি সেই সময় এ রোগটিতে। ফ্রান্সের রাজা অষ্টম চার্লস, খ্রিষ্টোফার কলম্বাস, হার্নেন কার্তেজ, লিও তয়েস্তয়, নিৎসে, বদলেয়ার, মোপাঁসা, জার্মান কবি হাইনরিক হাইনে, মুসোলিনী, হিটলার, লেলিন, বিখ্যাত ডাচ চিত্রকর র‌্যামব্রেন্ড। এ মুহুর্তে আমার এ নামগুলোই মনে পড়ছে। তবে খুঁজলে পাওয়া যাবে আরো কত কত নাম।

গী দ্য মোপাঁসা নাকি সিফিলিসের যন্ত্রণা নিয়েই লিখতেন। যখন মাথার যন্ত্রণা কিছুতেই অগ্রাহ্য করতে পারতেন না তখন সে সময়কার প্রত্যক্ষ ফলপ্রদ ওষুধ হিসাবে কানের কাছে পাঁচটা জোঁক লাগিয়ে কলম নিয়ে বসতেন। মাঝে মাঝে মাথার যন্ত্রণায় চোখে কিছুই দেখতে পেতেন না। কিন্তু সিফিলিসের অল্প আক্রমণ নাকি লেখায় প্রেরণা দেয়। সিফিলিসের জীবাণু যখন ধীরে ধীরে মস্তিস্কে উঠেআসে তখন জীবাণুর সুড়সুড়িতে মস্তিস্ক নাকি উত্তেজিত হয়। কিছু সময়ের জন্য আশ্চর্য ক্ষমতা পায় কলম। যেমন পেয়েছিলেন হাইনরিথ হাইনে, বোদলেয়ার, নিৎসে। আর পঞ্চাশ বছর পরে জন্মালে মোপাঁসার রোগ ধরা পড়ত। সেই সঙ্গে চিকিৎসাও নিশ্চয়ই হতো।

তবে ডক্টর জন জে রসের এই তত্ত্ব সম্পর্কে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণটা বলছি। সিফিলিস নামক ঘৃণিত এই রোগটি আমেরিকা থেকে আমদানী করেছিলেন খ্রিষ্টোফার কলম্বাস। তিনি আমেরিকা আবিস্কার করেছিলেন ঠিকই কিন্তু তিনি ও তার সঙ্গী জাহাজের ক্যাপ্টেন হার্নেন কার্তেজসহ আমেরিকা আবিস্কারের আরো বহু নৌকর্মী শরীরে বহন করে এনেছিলেন এই সিফিলিস। এ খবর তখন জানা ছিল না বলে এক দেশ দোষ চাপাত অন্য দেশের উপর। যেমন ফ্রান্সের লোকেরা বলত এটা ইতালির নেপলেসের রোগ। ইতালির লোকজন বলত এটা ফ্রান্সের রোগ। ইংল্যান্ড দোষ চাপাত স্পেনের উপর। পরবর্তীকালে ইতিহাসবিদগণ নিশ্চিত করেছিলেন যে এই রোগ নতুন আবিস্কৃত আমেরিকা থেকেই কলম্বাস নিয়ে এসেছিলেন। কলম্বাস আমেরিকা জয় করে স্পেনে ফিরেছিল ১৪৯৩ সালে। আমার বিশ্বাস এই চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরে ইংল্যান্ডে এ রোগ এতটা হয়তো বিস্তার নাও করে থাকতে পারে। অন্যদিকে বাংলা সাহিত্যে এই মুহুর্তে আমার দু’জন লেখকের কথা মনে পড়ছে যারা আক্রান্ত হয়েছিলেন সিফিলিসে। একজন কথাসাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় অন্যজন কবি রুদ্র মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ। প্রথমজনের খবর জানা যায় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী ‘জীবন রহস্য’ পড়ে আর দ্বিতীয়জন সম্পর্কে জানা যায় তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনী থেকে।

এবার বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ে কোয়ারেন্টাইন সম্পর্কে কিছু জানা যাক। শরৎচন্দ্র কোয়ারেন্টাইনে বসে যদিও কিছু লেখেননি তবে তিনি কোয়ারেন্টাইনে বেশ নাজেহাল হয়েছিলেন। সে বিষয়ে আমি বিস্তারিত লিখেছি আমার একটি জনপ্রিয় গল্প ‘শরৎচন্দ্রের শরৎ উপাখ্যানটিতে।’ গল্পটিতে লেখা হয়েছে- “অকস্মাৎ জাহাজের খালাসিরা ডেকের যাত্রীদের শুনিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, রঙ্গম শহর, রঙ্গম শহর, সবাই বিছানাপত্র গুটিয়ে উঠে পড়ো। করনটিনে যেতে হবে, করনটিন না করে কেউ শহরে ঢুকতে পারবে না। খালাসিদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে যাত্রীদের মধ্যে কার আগে কে নামবে, এই নিয়ে হুটোপুটি লেগে গেল। জাহাজের খালাসিদের সম্ভবত শিক্ষাজ্ঞান নেই। তারা ইংরেজি কোয়রান্টিন শব্দটিকে ভুল উচ্চারণে করনটিন উচ্চারণ করছে। কোনো বন্দরে সংক্রামক ব্যাধি দেখা দিলে সেই বন্দর থেকে অন্য বন্দরে গেলে বন্দরে জাহাজ ভিড়বার আগে জাহাজ বন্দর থেকে কিছুটা দূরে একটি জায়গায় কয়েক দিনের জন্য আটক থাকতে হয়। কারণ যদি প্লেগ নামক রোগটির জীবাণু কারো শরীরে প্রবেশ করে থাকে, তবে তত দিনে সেটি ধরা পড়বে। সতর্কতামূলক এই আটক থাকার সময়টাকেই বলে কোয়রান্টিন। শরৎ খালাসিদের উদ্দেশ করে বললেন, আমার করনটিনে থাকার কোনো দরকার নেই। আমি কলকাতায় জাহাজে ওঠার পূর্বেই ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করিয়েছি। আমার শরীরে প্লেগের জীবাণু নেই। জনৈক খালাসি শরৎকে ধমক দিয়ে বললেন, একটি কথাও নয়। তাড়াতাড়ি করনটিনে চলে যান। করনটিন না করে কিছুতেই রেঙ্গুনে ঢুকতে পারবেন না। প্লেগের মহামারির ভয়াবহতায় বার্মা সরকার খুবই সজাগ। শহর থেকে আট মাইল দূরে কাঁটাবেড়া দিয়ে অনেকগুলো ছোট ছোট কুঁড়েঘরের মতো কিছু একটা তৈরি করা হয়েছে। সেখানেই থাকতে হবে শরৎ এবং জাহাজের অন্য যাত্রীদের নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে, নিজেকে রান্না করে খেতে হচ্ছে।”

গোপালচন্দ্র রায় তাঁর “শরৎচন্দ্র” বইটিতে লিখেছেন- শরৎচন্দ্রের দুরসম্পর্কের এক মেসোমশাই অঘোরবাবু রেঙ্গুন শহরের একজন বিখ্যাত অ্যাডভোকেট ছিলেন, তাই তাঁর বাড়ি খুঁজে বার করতে শরৎচন্দ্রের বেশি দেরি হল না। শরৎচন্দ্র এইভাবে অঘোরবাবুর বাড়ি খুঁজে নিয়ে সেইখানে গিয়ে উঠলেন। শরৎচন্দ্র যে অবস্থায় প্রথম অঘোরবাবুর বাড়িতে গিয়ে ওঠেন, তাঁর সেই অবস্থার বর্ণনা করে অঘোরবাবুর এক পুত্র পরে বলেছিলেন- আমার বয়স তখন বারো কি তেরো বছর। আমার খুব মনে আছে, তখন আমরা ছিলাম লুইস স্ট্রীটে আমাদের নিজ বাড়ীতে। আমি বাইরের ঘরে বসিয়া পড়িতেছি, সকাল বেলা আটটা কি নয়টা বাজিয়াছে, এমন সময় বছর পঁচিশ বয়স্ক এক ভদ্রলোক ঘরে প্রবেশ করিয়াই বাবাকে দেখিয়া হাউ হাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। বাবা আমার অনতিদূরেই বসিয়াছিলেন। সামনে আরো দু একজন লোক ছিল। কে কে ছিল আমার স্মরণ নাই। আমি বই হইতে মুখ তুলিয়া দেখিতে না দেখিতেই দেখি বাবাকে প্রণাম করিতেছেন, বাবাও আশ্চর্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন- কিরে শরৎ, তুই কোথা থেকে এলি? তিনি চোখের জল মুছিতে মুছিতে বলিলেন- আমাকে করন্টিনে আটকে রেখেছিল। বাবা আরো অবাক হইয়া বলিলেন- তুই আমার নাম করতে পারলি না? আমার নাম করে কত লোক পার হয়ে যায়, আর তুই পড়ে রয়েছিস করন্টিনে? উস্কো চুল, ময়লা কাপড়, গায়ে একটা ছেড়া সার্ট, একজোড়া ঠনঠনের চটিজুতো পায়ে, গামছা কাঁধে, এই হলো বেশভূষা। আবার ভদ্রলোকটি বলিলেন- সাতদিন হাত পুড়িয়ে রেঁধে খেতে হয়েছে। বাবা আবার বলিলেন- তোর বোকামি, আমার নাম করলেই কোন কষ্ট পেতে হতো না-এমন কি আমার নাম করে রাস্তার কাকেও বললে, তোকে এনে ঘরে পৌঁছিয়েই দিয়ে যেত।’

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকেও মাস দেড়েকের মতো কাটাতে হয়েছিল হোম কোয়ারেন্টাইনে। সে কথা আমরা জানতে পারি তার ‘জীবনস্মৃতি’ ও প্রশান্তকুমার পাল লিখিত ‘রবিজীবনী’ (১ম খন্ড) থেকে।

১৮৭২-৭৩ সালের বেঙ্গল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ১৮৭১ ও ’৭২ সালে ডেঙ্গু নিয়ে কলকাতায় একটি নোটিশ জারি করা হয়। মারাত্মক এ রোগ শীতের শেষে শুরু হয়ে গরমে বৃদ্ধি পেত এবং গ্রীষ্ম ও বর্ষায় সেটি মহামারি আকার ধারণ করত। তারপর বর্ষা শেষে ধিরে ধিরে কমতে শুরু করতো এর প্রকোপ।

১৮৭২ সালের (১২৭৯ বঙ্গাব্দ) গ্রীষ্মে যখন রোগটির সংক্রমণ সর্বব্যাপী হতে শুরু করে, সে সময় কলকাতার অবস্থাপন্ন পরিবারগুলো আশ্রয় নিয়েছিল শহর থেকে কিছু দূরে, গঙ্গাতীরবর্তী বাগানে। আর ডেঙ্গুর কারণেই জীবনে প্রথমবারের মতো কলকাতার বাইরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জীবনস্মৃতিতে তিনি লিখেছেন, ‘একবার কোলকাতায় ডেঙ্গুজ্বরের তাড়ায় আমাদের বৃহৎ পরিবারের কিয়দংশ পেনেটিতে (পানিহাটিতে) ছাতুবাবুদের বাগানে আশ্রয় লইল। আমি তাহার মধ্যে ছিলাম।’

এসব তথ্য বিশ্লেষণ করলে এটি বেরিয়ে আসে যে রবীন্দ্রনাথসহ ঠাকুরবাড়ির বৃহৎ পরিবারের অনেকে ডেঙ্গু থেকে আত্মরক্ষার জন্য ১৮৭২ সালের ১৪ মে মঙ্গলবার থেকে ৩০ জুন রোববার পর্যন্ত পানিহাটির বাগানবাড়িতে ছিলেন। ডেঙ্গুর প্রকোপ কমলে তাঁরা জোড়াসাঁকোয় ফিরে যান। রবিঠাকুরের লেখার তথ্যমতে, এ সময় ঠাকুর পরিবারের আরেকটি অংশ ডেঙ্গু জ্বরের আশঙ্কায় রিষড়ার (গঙ্গাতীরের একটি প্রাচীন পল্লি, যেখানে ওয়ারেন হেস্টিংসের একটি বাগানবাড়ি ছিল) বাগানে আশ্রয় নিয়েছিল।

ঠাকুরবাড়ির হিসাব খাতার তথ্য অনুযায়ী, ১৮৭২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত পানিহাটির বাগানবাড়িটি ভাড়া করেছিল ঠাকুর পরিবার। পরে ১ জুলাই সেখান থেকে তাঁদের নিয়ে আসার জন্য গাড়ি পাঠানো হয়েছিল বলেও খাতায় উল্লেখ রয়েছে।

মহামারি এই পৃথিবীতে নতুন কিছু নয়। সৃষ্টির শুরু থেকেই সময়ে সময়ে এই ধরণিতে নেমে আসে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মহামারি। বিখ্যাত গ্রীক নাট্যকার সফোক্লেসের (৪৯৬-৪০৬ খ্রিষ্টপূর্ব) বহুল পঠিত ও চর্চিত নাটক ‘ইডিপাসে’ এ ও আমরা দেখতে পাই মহামারির করুণ চিত্র। রাজা ইডিপাস ভাগ্যদোষে ও অজান্তে তার নিজের মা ইয়োকাস্তকে বিয়ে করার ফলে থিব্স রাজ্যে হঠাৎ একদিন নগরে মহামারি দেখা দিল। শত শত লোকের মৃত্যু হল, অনেকে পালিয়ে গেল দূরে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। রাজদরবারে প্রত্যহ প্রজাদের প্রতিকারের জন্য আকুল আবেদন। কিন্তু মানুষের হাতে প্রতিকার কোথায়? সুতরাং দেলফির মন্দিরে পুজার জন্য পাঠানো হল রানি ইয়োকাস্তের ভাই ক্রেয়নকে। ক্রেয়ন খুশি মনে ফিরে এল। সে বলল ভূতপূর্ব রাজা লাইয়ুসের হত্যাকারী এই নগরীতেই লুকিয়ে আছে, তাকে খুঁজে বের করে হত্যা করলে অথবা নির্বাসিত করলে মহামারির অভিশাপ দূর হবে এবং নগরী আবার সুস্থ ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে।

রাজা লাইয়ুসের হত্যাকারি তো আসলে তার নিজের ছেলে ইডিপাস। না চিনতে পেরে ভুলক্রমে ইডিপাস হত্যা করেছিলেন তার পিতা রাজা লাইয়ুসকে। পরবর্তীতে রাজা ইডিপাস যখন জানতে পারলেন যে তিনি ভুল করে বিয়ে করে ফেলেছেন স্বয়ং তার নিজের মাকে তখন প্রাশ্চিত্তসরূপ নিজেই নিজের দু’চোখ খাবলে তুলেফেলেছিলেন।

তবে আমার ধারণা প্রকৃতি যতটা নেয় কোনো না কোনো ভাবে আবার সে ক্ষতি পুষিয়ে দেয়। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মহামারির মধ্যেই রচিত হয়েছিলো বিখ্যাত কিছু সাহিত্য। ফ্রান্সে যখন ভয়াবহ কলেরা চলছে ঠিক তখন বিখ্যাত ফরাসি লেখক আলবেয়ার ক্যামু লিখলেন তার সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘দ্য প্লেগ’। স্পেনে ভয়াবহ ইনকুইজেশন বিখ্যাত লেখক মিগুয়েন সার্ভেন্টিস (১৫৪৭-১৬১৬) কে অনুপ্রাণিত করেছিলো তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘দনকিহতে’ লিখতে। আমেরিকায় ত্রিশের দশকে নিদারুণ মহামন্দার প্রেক্ষাপটে আমরা পেয়েছিলাম দুটো বিখ্যাত উপন্যাস। প্রথমটি জনস্টাইনবেকের ‘দ্য গ্রেপস অব র‌্যাথ’ আর দ্বিতীয়টি স্কট ফিটজেরান্ডের ‘দ্য গ্রেট গ্যটসবি’।

সেসব সম্মানিত পাঠক-পাঠিকাবৃন্দ কষ্টসহিষ্ণু হয়ে কিছুটা সময় নিয়ে এ লেখাটি পাঠ করলেন তাদেরকে মজার ও তথ্যসমৃদ্ধ একটি ঘটনা বলে লিখাটা শেষ করছি। আমার ধারনা বিষয়টি অবশ্যই আপনাদের বিবিধ চিন্তার খোরাক জোগাবে। ‘হেনরী’ দি এইটথ্’ বোধহয় শেক্সপিয়রের শেষ নাটক। এই নাটকের যখন অভিনয় চলছিল তখন হঠাৎ আগুন লেগে গ্লোব থিয়েটার ভস্মীভূত হয়ে যায়। এটা ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দের কথা। এরপর থেকে শেক্সপিয়র অধিকাংশ সময় স্ট্র্যাটফোর্ডেই কাটাতেন। এপ্রিল মাসে সে সময়ের বিখ্যাত নাট্যকার বেন জনসন ও কবি মাইকেল ড্রেটন শেক্সপিয়রের অতিথি হয়েছিলেন স্ট্র্যাটফোর্ডে। রাত্রির ভোজ বাড়িতে শেষ করে পানভোজনের জন্য শেক্সপিয়র বন্ধুদের নিয়ে হানা দিয়েছিলেন কিছু দূরের এক শুড়িখানায়। পুরোনো দিনের গল্প করতে করতে তাঁদের ফিরতে রাত হয়েছিল। প্রচন্ড ঠান্ডা লেগে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন শেক্সপিয়র। সম্ভবত আক্রান্ত হয়েছিলেন নিউমোনিয়ায়। মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। শেক্সপিয়রের জন্মদিন ও মৃত্যুদিন বোধহয় একই। ২৩ এপ্রিল, ১৬১৬ তিনি পরলোকগমন করেন। অনেকের মতে বাহান্ন বছর পূর্বে ২৩ এপ্রিলই তাঁর জন্ম হয়েছিল।

৩১ মার্চ মঙ্গলবার বাংলাদেশের যমুনা টেলিভিশন ডক্টর রাবার্ট প্যারি নামে একজন আমেরিকান চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীর সাক্ষাৎকার প্রচার করে। ডক্টর প্যারি আমাদের জানাচ্ছেন যে করোনা নামের এই ভাইরাসটির অস্তিত্ব নাকি এই পৃথিবীতে বহুকাল আগে থেকেই বিদ্যমান ছিলো। মৃদু উপস্থিতির কারণে ভাইরাসটি কিছুটা ভিন্ন রূপধরে ছিলো এতোদিন। অল্প স্বল্প উপসর্গের কারণে এতোদিন এটার উপস্থিতি ছিল অজানা। সময়ের সাথে ভাইরাসটি এতোদিন খাপ খাওয়াতে পারেনি মানবদেহে। এটি বাঁদুরসহ অন্যন্য প্রাণীর দেহে বেঁচে ছিল এতোদিন। কিন্তু বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষকে কাবু করার পর্যাপ্ত শক্তি অর্জন করেছে বর্তমানের এই করোনা।

ডক্টর রবার্ট প্যারির মতে করোনার অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে যদি বহুকাল ধরে বিদ্যমান হয়। অন্যদিকে শেক্সপিয়রও মৃত্যুবরণ করেছিলেন নিউমোনিয়ায়। তাহলে শেক্সপিয়রও কি আক্রান্ত হয়েছিলেন করোনায়। হলেও হতে পারে। এই পৃথিবীতে অসম্ভব বলে তো কিছু নেই।

 

সাইফুর রহমান
গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top