সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১


ধার্ম - ধর্মের মানে খোঁজার চেষ্টা : মোঃ ইয়াকুব আলী


প্রকাশিত:
২৮ জুলাই ২০২০ ২২:৪৯

আপডেট:
২৮ জুলাই ২০২০ ২৩:২০

 

ধর্মীয় সম্প্রীতিকে বিষয়বস্তু বানিয়ে যুগেযুগে অনেক ছবি তৈরি হয়েছে কিন্তু এই ছবিটার বিশেষত্ব হচ্ছে এখানে ধর্মীয় সম্প্রীতির কথা বলানো হয়েছে একজন প্রচন্ড ধার্মিক হিন্দু পন্ডিতের মুখ দিয়ে। পন্ডিত চতুর্বেদী হিন্দু ধর্মের প্রত্যেকটা অনুশাসন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন এবং তার সামান্য ব্যত্যয় হলেই সেটা আবার শুদ্ধাচার করে ঠিক করে নেন। উনার প্রত্যেকটা কাজে নিয়ম এবং অনুশাসন পরিলক্ষিত হয়। এই ছবিতে ধর্মের দুই ধরণের বৈষম্যের কথায় বলা হয়েছে। প্রথমত প্ৰত্যেকটা ধর্মের প্রয়োগের মধ্যেই অনেক জাতপাতের ব্যবধান রয়েছে যেগুলো নিয়ে সমাজে অনেক ভেদাভেদ, সংঘর্ষ বিদ্যমান আর দ্বিতীয়ত অন্য ধর্মের সাথে ব্যবধান যেটার কারণে ধর্মের নাম সবচেয়ে বড় অনাচারগুলো হয়ে আসছে বিশেষকরে দক্ষিণ এশিয়াতে ইংরেজরা দ্বিজাতিতত্ত্বের মাধ্যমে যে "ডিভাইড এন্ড রুল" শুরু করেছিলো সেটা এখনও চলমান। এখনও মানুষ রাজনৈতিকভাবে নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য ধর্মের নামেই সবচেয়ে বড় অধর্ম করে আসছে। 

পন্ডিত চতুর্বেদী একইসাথে তার ছাত্রদের ধর্ম শিক্ষা দেন অনেকটা বাংলদেশের মক্তবের আদলে আবার একইসাথে উনি পাড়ার মাতুব্বর বাড়ির প্রধান পুরোহিত। পাড়ার সব মানুষ যেকোন ধর্মীয় শাসনের জন্য তার কাছে ধর্ণা দেন। তাঁর পরিবারে আছেন গিন্নী প্রভাতী আর স্কুল পড়ুয়া মেয়ে বেদিকা। এভাবেই চলে যাচ্ছিলো তাদের সংসার। এর মধ্যেই শহরে একদিন শুরু হয় হিন্দু মুসলমান সংঘাত। সংঘাতেরই একদিন প্রভাতী তাদের দরোজার সামনে আবিষ্কার করে একজন দুধের শিশুকে। শিশুটিকে দেখে তার মনে মায়ের মমতা জেগে উঠে। শিশুটিকে রাস্তা থেকে তুলে আনেন। উনি এবং উনার মেয়ে শিশুটিকে নিজের ছেলের যত্নে মানুষ সেবা শুশ্রষা করতে শুরু করেন। পন্ডিত বাসায় ফিরে তার জাত জানতে চাইলে প্রভাতী বানিয়ে বলেন যে ছেলের জাট ব্রাম্মণ। এরপর ছেলেটি পাকাপাকিভাবে আশ্রয় পায় তাঁদের বাড়িতে।   

পরিবারে একজন বাড়তি সদস্য যোগ হওয়াতে স্বভাবতঃই তাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যস্ততা বেড়ে যায়। তারা আর আগের মতো করে পন্ডিতের পূজাপাঠের তৈরি করে রাখতে পারেন না বরং অনেক কিছুই শাস্ত্র অনুসারে ভুল ভাল হওয়া শুরু করে। এমনকি অনেক সময় অনিচ্ছা সত্ত্বেও পন্ডিতকে সংসারের কাজে হাত লাগাতে হয়, কোলে তুলে নিতে হয় ক্রন্দনরত ছেলেটিকে। এভাবেই ছেলেটি একসময় পন্ডিত পরিবারের একেবারে অপরিহার্য একটা অংশ হয়ে যায়। তাঁরা অনেক আদর করে ছেলেটির একটা নামও রাখে কার্তিক। কার্তিক বড় হতে থাকে আর শিখতে থাকে পন্ডিত পরিবারের আচার। পূজার সময় বাবুজি মানে বাবাকে যে বিরক্ত করা যাবে না সেটাও সে শিখে ফেলে।  

এর পাশাপাশি দেখানো হয় ধর্ম বিশ্বাসের রূপান্তরের গল্প। মাতুব্বরের ছেলে সুরিয়া প্রকাশ একেবারে মান্ধাতার আমলের ধর্ম বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে আছে আর তাকে ভুল পথে প্রচালিত করে নিজের স্বার্থ হাসিল করতে চায় ভন্ড ধর্ম ব্যবসায়ী পন্ডিত দয়াশংকর। মাতুব্বরের মেয়ে মানি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং পাশাপাশি সে প্রচলিত ধর্ম বিষয়েও জ্ঞান রাখে কিন্তু তার ভাই সুরিয়াপ্রকাশের সাথে তার তফাৎ হলো সে যথেষ্ট উদার মানসিকতা ধারণ করে। একজন বিদেশি পন্ডিত চতুর্বেদীর উপর একটা ডকুমেন্টারি বানাতে আসে। মানির সাথে তার সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং তারা একসময় সিদ্ধান্ত নেয় বিয়ে করার কিন্তু ধর্ম অনুযায়ী বিজাতির সাথে বিয়ের কোন নিয়ম নেই তাই সেটা নিয়ে মাতুব্বর পরিবারে তৈরি হয় জটিলতা।   

এরপর একসময় দাঙ্গা থেমে যায়। কার্তিক তখন বেশ বড় হয়ে গেছে। কার্তিক পন্ডিত পরিবারেরই একজন এখন। ঠিক তখনই একজন বোরকা পরা মুসলিম মহিলা এসে দাবি করেন কার্তিক আসলে তার ছেলে মোস্তফা। দাঙ্গার সময় তাকে বাঁচানোর জন্যই পন্ডিতের দরোজার সামনে রেখে গিয়েছিলেন। স্বভাবতঃই পন্ডিত কার্তিককে ফিরিয়ে দেয় তার মায়ের কাছে যদিও তার স্ত্রী প্রভাতী এবং মেয়ে ভেদিকা কোনভাবেই রাজি হয়নি কিন্তু পন্ডিতের শাস্ত্রের যুক্তির কাছে তারা পরাস্ত্র হয়। কার্তিকও যেতে রাজি হয় না মোটেও কারণ সে বুদ্ধির পর থেকেই পন্ডিতকে তারা বাবা, প্ৰভাতীকে তার মা আর ভাদিকাকে তার বোন জেনে এসেছে। কার্তিকের বিদায় মুহূর্তে তার কান্নার রোলে পন্ডিত বাড়ি ভারী হয়ে উঠে।

এরপর শুরু হয় কঠিন শুদ্ধি প্রক্রিয়া। শুরুতে বাড়ি ঘরের প্রতিটি কোণা ধৌত করা হয়। পরিষ্কার করে ফেলা হয় কার্তিকের সকল আঁকাজোকা। ফেলে দেয়া হয় কার্তিকের সমস্ত খেলনা। এগুলো করার পরও পন্ডিত চতুর্বেদীর মনেপড়তে থাকে কার্তিকের প্রত্যেকটা কাজকর্ম। সেগুলো থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য শুরুতে পন্ডিত মৌন ব্রত রাখেন কিন্তু তাতেও তাঁর মন থেকে কার্তিকের ভাবনা দূর না হওয়াতে রাখেন সবচেয়ে কঠিন ব্রত চন্দ্রায়ণ ব্রত। চন্দ্রায়ণ ব্রত পালন শেষ হলেই আবারও শুরু হয়ে যায় দাঙ্গা। আর ঠিক তখনই কার্তিক অথবা মোস্তফাকে নিয়ে আবারও হাজির হয় তার মা। তার মা এসে দরজায় কড়া নড়লে তার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেন প্রভাতী। বেদিকাকে আটকে রাখেন ঘরে খিল দিয়ে। তখন মোস্তফার মা মোস্তফাকে শিখিয়ে দেন মা কে ডাকতে। প্ৰভাতীকে মা ডেকে ফল না পেয়ে শিখিয়ে দেন বাবাকে ডাকতে। ঠিক তখনই ঘটে সেই ঘটনা। মোস্তফা তার মাকে বলে, চুপ করো এখন বাবাকে ডাকা যাবে না কারণ বাবা এখন পূজা করেছেন। 

অবশেষে মোস্তফার মা ফিরে যায়। তখন প্রভাতী পন্ডিতকে বলেনঃ আমরা কার্তিককে ফিরিয়ে দিয়ে ধর্মের পালন করতে পেরেছি তো ঠিকমতো। এই কথাগুলো বারংবার পন্ডিতকে ভিতরে ভিতরে আঘাত করে চলে। এরপর মাতুব্বরের বাসায় সুরিয়াপ্রসাদের লোকদের অস্ত্রে শান দেয়া দেখে তার মনে উদয় হয়, ধর্ম কিভাবে মানুষকে মারার স্বীকৃত দেয়। তখন সে আরও অধ্যয়ন শুরু করে এবং ধর্মকে নতুন আঙ্গিকে আবিষ্কার করেন। তারপর ব্রত রাখা চুল দাড়ি কমিয়ে কোমরে ধুতি গুঁজে বেরিয়ে পড়েন মোস্তফা বা উনার কার্তিকের খোঁজে। সেখানে দেখা হয়ে যায় সুরিয়া প্রকাশ এবং তার বাহিনীর সাথে। তারা ইতোমধ্যেই ধংসযজ্ঞ চালিয়ে বেড়াচ্ছে শহরের মুসলমান এলাকায়। পন্ডিতকে সামনে পেয়ে বলেনঃ পন্ডিত স্নেহের বশবর্তী হয়ে ধর্ম ভুলে গেছেন।

 

ঠিক তখনই পন্ডিত বলেনঃ এই সিনেমার মূল বক্তব্যগুলো।

"হিংসা ঘোর অপরাধ। ধর্ম শুধু কেবল সাধনা না কর্তব্য, কর্ম একতা এবং সৎচিন্তাও বটে। ভেদাভেদকে ত্যাগ করার নাম ধর্ম। মানবতাও হলো ধর্ম। এরপর সুরিয়াপ্রকাশের উঁচিয়ে তোলা তরবারি, তার দল এবং ধ্বংসযজ্ঞের জ্বলন্ত অগ্নিশিখার দিকে নির্দেশ করে বলেন এগুলো ধর্ম নয়।" 

পন্ডিতের বলিষ্ট উচ্চারণে সুরিয়াপ্রকাশের চৈতন্যোদয় হয় এবং হাত থেকে তরবারি ফেলে দেন। এরপর একেবারে শেষ দৃশ্যে দেখা যায় পন্ডিত তার ছেলে কার্তিকের হাত ধরে হেটে যাচ্ছে। তাদের সামনে এমনভাবে আলো ফেলা হয় যেন মনেহয় তারা স্বর্গীয় কোন কিছুর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। পুরো ছবিটা পরিবার নিয়ে দেখার মতো। আর পুরো ছবির বিষয়বস্তু যেহেতু ধর্মকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় তাই ছবির নামকরণ ধার্ম পুরোপুরি সার্থক। আর চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে ধর্মকে কিভাবে মানবতা ধ্বংসের কাজে এবং একইসাথে মানবতার কল্যাণে ব্যবহার করা যায়। 

 

মো: ইয়াকুব আলী

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top