সিডনী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১


ইরানি চলচ্চিত্রকার মোহসেন মাখমলবফ: কিশোর বয়স থেকেই যিনি বিপ্লবী : ড. আফরোজা পারভীন


প্রকাশিত:
৪ আগস্ট ২০২০ ২৩:৩৮

আপডেট:
২৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:৩৬

ছবিঃ মোহসেন মাখমলবফ


মোহসেন মাখ্মলবফ (ফার্সি: محسنمخملباف‎‎) একজন প্রভাবশালী ও বিতর্কিত ইরানি চলচ্চিত্র পরিচালক, সম্পাদক, লেখক ও প্রযোজক। তিনি ২৯ মে ১৯৫৭ ইরানের তেহরানে জন্মগ্রহণ করেন। জীবিকা নির্বাহের জন্য ১৭ বছরের মধ্যে তিনি ১২ ধরণের কাজ করেন যার মধ্যে বেলবয় ও প্লেনওয়ার্কারও আছে। তিনি ইরানের নবতরঙ্গ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। বর্তমানে এশিয়ান ফিল্ম একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর চলচ্চিত্র ‘এ মোমেন্ট অব ইনোসেন্স’, ‘গাবেন’, ‘কান্দাহার’, ‘প্রেসিডেন্ট’ সারা দুনিয়ায় পরিচিত। গত ১০ বছরে তাঁর চলচ্চিত্রগুলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বহুবার প্রদর্শিত হয়েছে। তিনি ৫০টির বেশি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছেন। তাঁর ২০০১-এর চলচ্চিত্র ‘কান্দাহার’কে টাইম ম্যাগাজিন সর্বকালের সেরা ১০০ চলচ্চিত্রের তালিকায় স্থান দিয়েছে। তিনি কানস, ভেনিস, লোকার্নো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল থেকেও পুরস্কার অর্জন করেন।
মাখ্মলবফ একটি ফিল্ম হাউজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। নাম ‘মাফলাবাফ ফিলম হাউস’। যেখানে চলচ্চিত্র শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে তাঁর দুই মেয়ে সামিরা মাখ্মলবফ ও হানা মাখ্মলবফ চলচ্চিত্র জগতে ইতোমধ্যে বেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। বড় মেয়ে সামিরা সতের বছর বয়সে তার ‘দ্য এপেল’-এর জন্য কানস (cannes) এর অফিসিয়াল সিলেকশন পান। সামিরা তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় চলচ্চিত্র ‘দি ব্লাকবোর্ড’ ও ‘এট টাইম ইন দি আফটারনুন’-এর জন্য ক্যানস এর গ্যান্ড জুরি প্রাইজ জেতেন দুবার। তাঁর ছোট মেয়ে হানা Afgan Alphabet ফিচার ফিল্মের জন্য বার্লিন উৎসবে ক্রিস্টার ও সানসেবাসটিন ফিল্মসে গ্রান্ড জুরি পুরস্কার জেতেন। মাখ্মলবফ এর স্ত্রী marzieh একজন নির্মাতা ও লেখক। তিন তাঁর চলচ্চিত্র ‘দি ডে আই বিকেম এ ওয়াম্যান’-এর জন্য চিকাগো আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল (২০০০) থেকে সিলভার হুগো (Silver Hugo) ও ওয়াইফ স্টেয়ারি ডগস (Wife stray dogs (২০০০) এর জন্য ইউনেস্কো এওয়ার্ড পান।
এদিক বিবেচনায় দেখা যায় মহসিনের পুরো পরিবারই চলচ্চিত্রে নিবেদিত। চলচ্চিত্রকে গভীরভাবে ভালো না বাসলে এভাবে গোটা পরিবার একসাথে চলচ্চিত্রে নিবেদিত হওয়া সম্ভব না। আব্বাস কিয়ারোস্তমির কাছে চলচ্চিত্র নির্মাণ শেখেন মহসিন। ১৭ বছর বয়সে একজন পুলিশকে ছুরিকাঘাত করে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে কারারুদ্ধ হন পাঁচ বছরের জন্য। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ইরান সরকারের স্বৈরাচারি আচরণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন তিনি। আজও সে যুদ্ধ চলমান।
মহসেন মাখমালবাফের সব চলচ্চিত্রই কম-বেশি আলোচিত। কোনো কোনোটি তো রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছে। তেমনই একটি চলচ্চিত্র কান্দাহার।
২০০১ সালে মুক্তি পায় কান্দাহার। মহসেন মাখমালবাফ এখন ইরানের একজন ডাকসাইটে নির্মাতা। শোনা কথা, এই চলচ্চিত্র মুক্তি পাবার পর প্রথমদিকে খুব একটা মানুষের নজরে আসে নি। তবে ৯/১১'এর বিশ্বব্যাপী পট পরিবর্তনের পর হঠাৎ আফগানিস্তান পুরো পৃথিবী'র আকর্ষণের কেন্দ্রে চলে আসে। আর সাথে সাথে চলে আসে 'কান্দাহার' মুভি। এ চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে তৎকালীন আফগান পরিস্থিতির এক অসামান্য দলিল। চলচ্চিত্রের কিছু অংশের শুটিং হয়েছে তৎকালীন তালেবান-শাসিত আফগানিস্তানে। বলতেই হয় মহসেন মাখমালবাফ বরাবরই যেমন সাহসী তেমনই দুর্মর সাহসের পরিচয় দিয়েছেন ওই অবরুদ্ধ এলাকায় শুটিং করে।
ফারসী ভাষায় চলচ্চিত্রটির মূল টাইটেল 'সফর-ই-গান্ধাহার' (Safar-e-Ghandehar)। চলচ্চিত্রের নামই বলে দিচ্ছে চলচ্চিত্রের বিষয় কি। নামই বোঝা যায় পুরো চলচ্চিত্র কান্দাহার যাত্রা'র এক সফরকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
কান্দাহারের গল্পে চলে যাই আমরা। আফগানকন্যা নাফাস বহুকাল পূর্বে দেশত্যাগ করে কানাডা চলে যায়। তবে তার বোন যায়নি। সে রয়ে যায় তালেবান অধ্যুষিত দেশ আফগানিস্তানে। বহুদিন পর নাফাস তার বোনের কাছ থেকে একটা চিঠি পায়। ভয়ানক সে চিঠি। বোন জানিয়েছে,একটি খনির ভিতর পা পড়ায় সে উভয় পা হারিয়েছে। বোন আরও জানিয়েছে, বিংশ শতাব্দীর এই শেষে এসে সে নিজেকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছে। পরবর্তী সূর্যগ্রহণের দিন সে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে দেশে বেঁচে থাকা আর সম্ভবপর হচ্ছে না। চিঠির তারিখ দেখে নাফাস বুঝতে পারে, রিফিউজি ক্যাম্প পার করে চিঠি এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এরই মাঝে পেরিয়ে গেছে কয়েকমাস। হাতে আছে আর মাত্র অল্প কয়েকটা দিন। তারপরই সূর্যগ্রহণ। বোনকে বাঁচাতে তৎক্ষণাৎ কান্দাহারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে নাফাস। এ যাত্রা সহজ ছিল না। এ ছিল এক মরিয়া হয়ে যাত্রা। নাফাস শুরু করে ভয়ানক বিপদসঙ্কুল আর অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতায় ভরপুর এক যাত্রা। নাফাস সাধারণ উপায়ে আফগানিস্তানে প্রবেশ করতে পারছে না। হয়তো এ কারণে যে তার পরিবার রাজনৈতিক অজুহাতে পালিয়ে গিয়েছিলো। সে দু'দেশের মাঝখানে ভ্রমণ করে এমন একজন ভ্রমণ ব্যবসায়ীকে অর্থ প্রদান করে। চুক্তি থাকে ব্যবসায়ী নাফাসকে নিজের স্ত্রী পরিচয় দিয়ে আফগানিস্তানে নিয়ে যাবেন। নাফাস একটি বোরকা পরে থাকে। সে বোরখা তার মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত ঢেকে দেয়। এ বোরখার কারণে প্রতারণা করা আরও সম্ভব হয়। সে যখন যাত্রা শুরু করে, আমরা বুঝতে পারি যে তার বোনের ভাগ্য নয়, তার যাত্রাটিই চলচ্চিত্রটির মূল বিষয়। এটাই চলচ্চিত্রে বলতে চেয়েছেন মহসিন। নাফাস ফিরে যাচ্ছে তার জন্মভূমিতে, নিজের জন্মের জগতে। যে জগত থেকে আত্মহত্যা করে মুক্তি পেতে চাইছে তার বোন। তাহলে সে কেমন জগত!
মরুভূমির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে নাফাস আর সেই ভ্রমণকারী। মাখমালবাফ এবং তাঁর চিত্রগ্রাহক ইব্রাহাম গাফৌরি তাদের পরিচালনা ও ক্যামেরা সম্পাতে এই মরুভূমিকে একসাথে সুন্দর, প্রত্যন্ত এবং নিষেধাজ্ঞাগ্রস্ত হিসাবে দেখান। প্রতিপদে যেন বাধার দেয়াল। রাস্তাগুলো সমতল। কিন্তু যাত্রা সোজা বা সমতল নয়। নাফাস অন্য মহিলাদের সাথে একটি ট্রাকের পেছনে উঠে যাত্রা করে। তার ব্যক্তিত্ব ঢাকা পড়ে বোরখার আড়ালে । বিভিন্ন বাধা বিপত্তি অতিক্রম করতে হয়। অবশেষে সেই বণিক যার স্ত্রী হিসেবে নাফাস এসেছিলো সে একটা জায়গায় নাফাসকে রেখে চলে যায়। যাবার আগে বণিক নাফাসকে ‘খাক’ নামে ১০/১২ বছর বয়সের একটি ছেলের জিম্মায় দিয়ে যায়। খাক জন্ম থেকেই এসব ভয়ঙ্কর আর জটিল পরিস্থিতিতে বেড়ে উঠেছে । তাই সে বেশ বুদ্ধিমান। সে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে জানে। জানে বিপদ থেকে নিজেকে কিভাবে বাঁচাতে হয় । এখান থেকে ৫০ ডলারে সে নাফাসকে কান্দাহারে নিয়ে যায়।
যাত্রার এক পর্যায়ে নাফাস অসুস্থ হয়ে পড়ে। খাক তাকে একজন চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায়। নাফাস একটি কম্বলের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে, অন্য পাশে ডাক্তার। কম্বলের ভেতর একটি গর্ত করা থাকে, যার মাঝখান দিয়ে তারা একজন আরেকজনের সাথে কথা বলে।
তবে এই চিকিৎসকের একটি গোপন কথা আছে। নাফাসের কন্ঠে উত্তর আমেরিকান টান (এক্সেন্ট)শুনে এই গোপন কথা তিনি নাফাসকে বলতে চান। খাক এমন কোনো তথ্যের খোঁজে আশপাশে ঘুরে বেড়ায়, যা সে বিক্রি করতে পারে। ডাক্তার তাকে চিনাবাদাম ঘুষ দিয়ে পাঠিয়ে দেয় নিজের কথা বলার জন্য।
খাককে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। চলচ্চিত্রে আমরা একটি তালিবান স্কুল দেখতে পাই। শিক্ষার্থীদের সকলে অবশ্যই ছেলে। মহিলাদের পড়াশোনা করার অনুমতি নেই। এটি কোনও সমস্যা না। ছেলেরা সামনে পিছনে দুলে দুলে কোরআন পড়ছে। পড়ছে বলে বোঝার চেষ্টা করছে না বা সেটি নিয়ে আলোচনা করছে না, কেবল পড়ে যাচ্ছে। তারপরে তারা রাইফেল দ্বারা ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেলো।
"আফগানিস্তানের একমাত্র আধুনিক জিনিস হলো এসব অস্ত্র” চিকিৎসক নাফাসকে বলেছিল। এটাই ছিল চিকিৎসকের নাফাসকে বলা গোপন কথা।
"কান্দাহারে" গভীর কোনো চরিত্র, স্মরণীয় কোনো সংলাপ বা উত্তেজনাপূর্ণ কোনো সমাপ্তি নেই যা মনে গেঁথে থাকার মতো। এর বিশেষত্ব এর চিত্রগুলোয়। সিনেমাটি আমাদের ভাবায় কিভাবে একটি বিশ্বাস মানুষের চেতনার গভীরে প্রথিত করে দেয়া হয় যে, মানুষকে দুর্দশাগ্রস্ত করা ঠিক, জীবনের সাধারণ আনন্দগুলো থেকে তাদের বঞ্চিত করা ঠিক। এভাবে নারীদের শিক্ষার বাইরে রাখা যায়। কিভাব সারসত্য পাঠ না করিয়ে শিক্ষার নামে মানুষকে মূর্খ বানিয়ে রাখা যায়। তাই কান্দাহারে স্মরণীয় সংলাপ নেই, উত্তেজনাপূর্ণ সমাপ্তি নেই, কিন্তু যা আছে তার কোনো সমাপ্তি হয় না। যে কান্দাহার দেখেছে সে কখনই তালেবানদের ক্ষমা করতে পারবে না। এ চলচ্চিত্র তালেবান রাজত্বের শেষ সময়ের। না, তারপরও তাদের ক্ষমার আওতায় রাখতে পারবে না কোনো বিবেকসম্পন্ন মানুষ। নাফাসের সাথে যাত্রার পথে পথে বিভিন্ন সময় যা ঘটেছে তা দেখে শিউরে উঠতে হয়। সেই সময়ের আফগানিস্তানের পথে-প্রান্তরে একা একজন নারীর চলাফেরা যে কী পরিমাণ অসম্ভব আর অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল সেটা কান্দাহার দেখলেই কেবল বোঝা যায়। সেটা দেখে মানুষ হিসেবে নিজেকে অসহায় মনে হয়। নারী কি মানুষ নয়! মানুষ হিসেবে নারী কি নিজেদের দাবি করতে পারে না! তাদের কোনও অধিকার নেই! অথচ নারী'রাই পৃথিবী'র অর্ধেক জনসংখ্যা না! একী নির্মম প্রহসন!
শুধু কি তাই, পুরুষই কি মানুষ! যে ১০/১২ বছরের বালক বিক্রির জন্য তথ্য খুঁজে বেড়ায়, কী তার নৈতিক শিক্ষা, কী তার জীবনের মানে! যে ছেলেগুলো না বুঝে শুধু পড়ার জন্য পড়ে যায় এ শিক্ষা তাদের কী দেবে! যে জনগোষ্ঠী নারীকে শিক্ষা বঞ্চিত করে রাখে সে কেমন জনগোষ্ঠী! এসব কিছুকে হালাল আর ন্যায্য করেছে যে ব্যবস্থা তার নাম তালেবানি ব্যবস্থা।
মহসেন মাখমালবাফের এ চলচ্চিত্রটি ২০০১ সালে কান ফেস্টিভালে প্রদর্শিত হয়ে প্রশংসিত হয়েছিল। তবে এটির উত্তর আমেরিকায় মুক্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ ছিল। ৯/১১ এর পরিবর্তনে ‘কান্দাহার’ এই চলচ্চিত্রের কারণেই বিশ্বব্যাপী একটি পরিচিত জায়গা হয়ে যায়। মুভিটি আরো বোধগোম্য হবার কারণ এটির বেশিরভাগ সংলাপ ইংরেজিতে - নায়িকার ভাষা ইংরেজি। যিনি তার যাত্রার একটি রেকর্ড তার টেপ রেকর্ডারে রাখেন। অন্য প্রধান চরিত্রগুলির মধ্যে একটির ভাষা ইংরেজি।
তালেবানি আফগানিস্তান ছিল এক অদ্ভুত দেশ। ৮ বছরের বেশি বয়স হলেই মেয়েদের পড়াশুনা বন্ধ। বোরখা বাধ্যতামূলক। তারপরও যদি কেউ পড়তে চায় তাকে যেতে হবে ভূগর্ভস্থ স্কুলে। নারী থাকবে পাতালে। প্রকাশ্যে আলো ছায়ায় আসার অধিকার তার নেই। নারী অসুস্থ হলে পুরুষ ডাক্তার দেখাতে পারবে না। বিশেষ পরিস্থিতি হলে, তারা ডাক্তার দেখাতে গেলে সাথে ভাই বা স্বামী কেউ একজনকে নিয়ে যেতে হবে। নারীর কোনো আলাদা আইডিনটিটি নেই। সে কারণেই নাফাস ডাক্তার দেখাতে যায় খাককে সাথে করে আর কথা বলে কম্বলের ফুটো দিয়ে। আর ডাক্তার তার গোপন কথাটি বলে দেয়। সেটা তালেবানিদের ‘অস্ত্র’। ওই অস্ত্রই তাদের একমাত্র আধুনিকতা। যে তালেবানে বাস করা অসহনীয় হয়ে উঠেছে বলে নাফাসের বোন আত্মহত্যা করতে চাইছে, যে তালেবানিদের কারণে আফগানিস্তান হারিয়েছিল জাতিসংঘের সদস্যপদ, সেই তালেবানকে মহসিন তুলে আনলেন পর্দায়। আনবেনই। কারণ ১৭ বছর বয়স থেকেই তো তাঁর অন্যয়োর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু। কিন্তু তালেবানি রাজত্ব শেষ হলেও কি নিঃশেষ হয়েছে ওরা! হয়নি। আফিম খনিজ আর বিদেশী টাকায় এখনও তো চলছে অস্ত্রের ঝনঝনানি। সেটা অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ।
মহসিন মাখমালবাফের এ মোমেন্ট অব সাইলেন্স (১৯৯৬) কে ‘ব্রেড এন্ড ফ্লওয়ার’, ‘ব্রেড এন্ড ফ্লাওয়ার পট’ ও ‘দি ব্রেড এন্ড ভেস’ও বলা হয়। এ চলচ্চিত্রটি মহসিনের আত্মজৈবনিক। চলচ্চিত্রটিতে তিনি দেখান একজন কিশোর ১৭ বছর বয়সে একটা র‌্যালি করতে গিয়ে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে ছুরিকাঘাত করে জেলে যান। দুই যুগ পরে তিনি ওই লোকটিকে খুঁজছেন সংশোধনের জন্য। এই সংশোধন প্রচেষ্টা কি ওই লোকটিকে সংশোধন নাকি ওই ১৭ বছরের যুবকের নিজেকে সংশোধন সেটা বলা আছে চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্রটি ইরানে নিষিদ্ধ। এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণের অনুপ্রেরণা তিনি পান কাবুলের ‘দারুল আলাম প্যালেস’ দেখতে গিয়ে।
মহসিন মাখমালবাফের ‘দি গার্ডেনার’ চলচ্চিত্রে এক ব্যক্তি তার ছেলেকে নিয়ে ইরান থেকে ইসরায়েলে যান ধর্মের ভূমিকা জানতে।
মহসিনের আর একটি অত্যন্ত আলোচিত ও প্রশংসিত চলচ্চিত্র ‘দি প্রেসিডেন্ট’। এ চলচ্চিত্রে দেখানো হয়, একজন স্বৈরাচারী একনায়কের বিরুদ্ধে বিপ্লব শুরু হয়েছে। স্বৈরাচারী তার পরিবার বিদেশে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু নাতি তার সাথে থেকে যাবার বায়না ধরে। নাতি থেকে যায়। বিপ্লবীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য স্বৈরাচারী আর তার নাতি জিপসী সেজে হাতে গিটার নিয়ে ছদ্মবেশ ধারণ করে। এভাবে তারা একটা নদীর পাড়ে আসে। এই নদীটা যদি তারা নৌকায় করে পার হতে পারে তাহলে তারা অন্য দেশে চলে যেতে পারবে। কিন্তু এই পলাতক জীবনে তারা বুঝতে পারে স্বৈরাচার কি, একনায়কতন্ত্র কি, ক্ষুধা কি, দারিদ্র কি, একনায়কতন্ত্রের কুফল কাকে বলে!
মহসিন মাখমালবাফের চলচ্চিত্র নির্মিত হয় মানুষের কথা ভেবে, মানুষের কল্যাণ চিন্তা মাথায় রেখে। তার কান্দাহার চলচ্চিত্রের কারণে আধা মিলিয়ন আফগান রিফিউজির স্কুল ও কলেজে পড়ার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে আফগানিস্তানে প্রচলিত একটি আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে। তাঁর একটি এনজিও আছে যেখানে অফগান নারী ও শিশুদের জন্য ৮২ টি প্রকল্প চলমান আছে। আর মহসিন পেয়েছেন Manhae Peace Award.
মহসিন মাখমালবাফের চলচ্চিত্রের কাহিনি বিচিত্র ও বহুরৈখিক। তবে মূল সুর অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথকতা, ন্যায্যতার পক্ষে একরোখা থাকা। তাই তাঁর প্রেসিডেন্ট বুঝতে বাধ্য হয় ক্ষুধা কাকে বলে, দারিদ্র কাকে বলে, নিজেরই গড়া দানবের খপ্পরে পড়েন তিনি। আর তালেবানিদের অন্যায় শাসন সারা পৃথিবীর সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে দিনের আলোর মতো। এটাই চলচ্চিত্রের শক্তি । সে শক্তি শুধুমাত্র দেখাতে পারেন মহসিন মাখমালবাফের মতো সত্যিকার সাহসী, শক্তিমত্ত আর যোগ্য নির্মাতারাই।
২০০৯ সাল পর্যন্ত ৪০ টি সিনেমা এবং তাঁর ও পরিবারের লেখা ৩০ টি বই নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১৩ সালে ইরান সরকার তাঁর পরিবারের ১২০ টি ইন্টারন্যাশনাল এওয়ার্ড মিউজিয়াম থেকে সরিয়ে দেয় । ২৭ টি বই লিখেছেন তিনি। তাঁর বই বিশ্বের ১২ টি ভাষায় অনুদূতি হয়েছে। তিনি নির্মাতা, লেখক ছাড়াও ভালো অভিনেতা। মিডিয়াতেও তাঁকে নিষিদ্ধ করা হয়।
কাবুলে বসবাস করেন মহসিনমাখমালবাফ। তিনি অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। কখনও লেখা দিয়ে, কখনও নির্মাণের মাধ্যমে। কাজ করছেন নারী ও শিশুদের জন্য। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
সূত্র:  

  • Makhmalbaf Film House (Official Website of family Makhmalbaf: Mohsen - Marziyeh - Samira - Maysam - Hana)
  • Worlds Transformed: Iranian Cinema and Social Vision

 

ড. আফরোজা পারভীন
কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক, কলামলেখক
অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top