সিডনী মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল ২০২৪, ১০ই বৈশাখ ১৪৩১


ওই দুর-দুরান্তে মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী : অশ্রু বড়ুয়া


প্রকাশিত:
৫ নভেম্বর ২০২০ ২১:১১

আপডেট:
২৩ এপ্রিল ২০২৪ ২৩:১৬

ছবিঃ মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী

 

ভাটি অঞ্চল- বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং নেত্রকোনা-এই সাতটি জেলার ৪০টি উপজেলা জুড়ে ভাটি অঞ্চল বিস্তৃত। ভাটি অঞ্চল-যেখানে ছয় মাস পানি আর বাকি ছয় মাস শুকনো মৌসুম। পুরো অঞ্চলে সুতোর মতো জড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য হাওর-খাল-বিল-নদী-নালা। প্রকৃতি যেন তার অপার সৌন্দর্যে এ অঞ্চলকে অপরূপ করে রেখেছে সাজিয়ে।

ভাটি অঞ্চলের সাত জেলার মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত নেত্রকোণা। ইতিহাস, প্রাচীন ঐতিহ্যে যেমন টইটুম্বুর এ জেলাটি তেমনি ঐতিহ্যের বিচিত্র ঘটনা সম্ভারে গর্বিতও।

প্রকৃতির মতোই উদার ও প্রাণবন্ত এখানকার মানুষগুলোও। ভৌগলিক বৈচিত্র্যের কারণেই বোধহয় হাওরবেষ্টিত জনপদের জীবনাচরণ ও সংস্কৃতি অত্যন্ত বিচিত্র, বর্ণিল, সমৃদ্ধ ও প্রাণবান। পুরো অঞ্চল জুড়ে যাত্রাগান, পালাগান, বাউলগান, কীর্তন, গাজীরগান, ভাটিয়ালি, ধামাইলগান, মালসিগান, বারোমাসি, সূর্যব্রতের গানসহ কত ধরনের গানের প্রচলন রয়েছে। ময়মনসিংহ গীতিকা, বাউল সঙ্গীত, পালাগীত, গারো সম্প্রদায়ের প্রবাদ, ছড়া এবং হাজং সম্প্রদায়ের শ্লোক (হিলুক), ধাঁধাঁ (থাচিকথা), গান (গাহেন) হচ্ছে জেলার লোকসংস্কৃতি।

এই ভাটির দেশে জন্মেছিলেন শত সহস্র গুনী।

দ্বাদশ শতকে চর্যাপদের চুরাশিজন বৌদ্ধ মহাসিদ্ধদের অন্যতম 'কাহ্নপাদ'-সহ শত সহস্র গুনীর জন্মেছিলেন ভাটির এই দেশে। এ জেলায় রয়েছে গারো, হাজং, হদি, বানাই প্রভৃতি ক্ষুুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস। আর তেমনি ক্ষুদ্র-নৃ গোষ্ঠী গারো সম্প্রদায় থেকে উঠে এসে সাদাকালো যুগের বাংলা ফিল্মে অসংখ্য জনপ্রিয় গান গেয়ে শ্রোতাদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন এক কন্ঠ সঙ্গীত শিল্পী।

শুধুমাত্র স্বতন্ত্র গায়কী সৌন্দর্য দিয়ে নিজেকে পরিণত করেছিলেন-বাংলাদেশের আধুনিক গানের একজন কিংবদন্তী শিল্পী।

আজও সোনালী দিনের সেসব পুরানো কোনো না কোনো বাংলা ছবিতে নায়করাজ রাজ্জাক, নায়ক উজ্বল কিংবা নায়ক আলমগীরের লিপসিংয়ে এখনো বেজে উঠে শিল্পীর গাওয়া অমর সেসব গানগুলো। আমার বিশ্বাস- এখনো যারা শোনেন তারা হয়ে যান বেশ-নস্টালজিক! তাঁর নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের স্বর্ণালী সময়।

হ্যাঁ-বলছি, জাদুকরী কন্ঠশিল্পী মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী'র কথা। তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তবে রেখে গেছেন তাঁর অসংখ্য গান। এক সময় সেই গানগুলো মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। এখনো বৈকি।

বাংলা গানের কালজয়ী কণ্ঠশিল্পী মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীর আজ ৬ষ্ঠ প্রয়াণ দিবস।

আজ এদিনে অমর কণ্ঠশিল্পী'র প্রতি রইল এক হৃদয়ের নিংড়ানো ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার্ঘ।

ওই দূর-দূর দুরান্তে
দিন দিনান্তে, নীল নীলান্তে
কিছু জানতে না জানতে
শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়...

 

রাজ্জাক অভিনীত 'দীপ নেভে নাই' চলচ্চিত্রে গাজী মাজহারুল আনোয়ার'র লেখা এ গানে সুর ও সঙ্গীত আয়োজন করেছিলেন সত্য সাহা। আর গেয়েছিলেন মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী। একি এক অপূর্ব সৃষ্টি। আধুনিকের চেয়েও আরো আধুনিক। পঞ্চাশ বছর আগের গান অথচ এখনও সমান আধুনিক!

একই জুটির কথা ও সুরে মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী গাইলেন আরেক গান। তা-ও নায়ক রাজ্জাক'র লিপসিংয়েই। সেই গানও আজ ইতিহাসের অংশ।

আমি এক দুরন্ত যাযাবর
দিন নেই রাত নেই
বসে থাকি গাড়িতে
পথেই বেঁধেছি মোর ঘর
আমি এক দুরন্ত যাযাবর...

 

জহিরুল হক পরিচালিত 'রংবাজ' সিনেমায় রাজ্জাক-কবরী'র বৃষ্টি ভেজা রাতে অসাধারণ অভিনয় নৈপূর্ণ্যে জড়ানো সেই গান। গানের কথা সাজালেন-গাজী মাজহারুল আনোয়ার। আনোয়ার পারভেজের সুর ও সঙ্গীতে -

হৈ হৈ রঙিলা রঙিলা রে
হায় হায় রঙিলা
রঙিলা রঙিলা রে
রিমঝিমঝিম বরষায় মন নিলা রে
আমি যে কী করি, আহারে সুন্দরী
জানি না কখন সে মন দিলো রে...

 

-মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী'র সতন্ত্র গায়কীর অনবদ্যতায় বাংলা চলচ্চিত্রে এই গানটিও যেমন সাড়াজাগানো তেমনি তুমুল জনপ্রিয়।

বরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ আলম খানের সুরে আর মুকুল চৌধুরীর কথায় মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী গাইলেন এমন এক গান । যা এখনও শ্রোতার হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়।

শোনো গো রুপসী ললনা
আমাকে যখন তখন
চোখ রাঙানো চলবে না...

 

‘নীল আকাশের নীচে’ চলচ্চিত্রে নায়ক রাজ্জাক'র ঠোঁটে-মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান'র লেখা এবং সত্য সাহা'র সুরে তিনি গাইলেন-

‘হেসে খেলে জীবনটা যদি চলে যায়’

 

এছাড়াও মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী-সাবিনা ইয়াসমিন, লায়লা আর্জুমান্দ বানু, জিনাত রেহানাসহ আরও অনেকের সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে গেয়েছেন অসংখ্য গান। যে গানগুলোর অধিকাংশই বাংলা গানে বিশেষ স্থান দখল করে আছে এমনটাই মনে করেন শুদ্ধ সঙ্গীতবোদ্ধারা।

উনিশ'শ চুয়াল্লিশ সালের দুই ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুরে জন্মগ্রহন করেন মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী। মূলত উনিশ'শ ষাট সাল থেকেই মিডিয়ায় গান গাওয়া শুরু করেন বরেণ্য এ শিল্পী। তিনি বিপিন দাস, সমর দাস, আবদুল আহাদ, কাদের জামেরী প্রমুখ সংগীত ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে সংগীতে দীক্ষা গ্রহণ করেন।

ষাট, সত্তর ও আশির দশকে চলচ্চিত্র, রেডিও এবং টেলিভিশনে গান করেই সারাদেশে ঝড় তোলেন মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী।

জানা যায়, ২০৬টি চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন মহান এই কন্ঠ সঙ্গীত শিল্পী। তাঁর গাওয়া গানের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার। বাংলা গানের পাশাপাশি তিনি উর্দু গানেও কণ্ঠ দিয়ে পেয়েছিলেন দারুণ দর্শকপ্রিয়তা। কণ্ঠশিল্পী ছাড়াও সুরকার এবং সংগীত পরিচালক হিসেবেও বেশ সুনাম রয়েছে মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীর। এছাড়াও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে বাংলাদেশ বেতারের হয়ে বেশ কয়েক বছর কাজ করেছিলেন।

ইংরেজি উনিশ'শ তিয়াত্তর সালের আটাশ মার্চ ইসলাম ধর্ম গ্রহনপূর্বক ভালোবেসে সুরাইয়া সিদ্দিকী'র সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। এ দম্পতির তিন কন্যাসন্তান -এ্যানি সিদ্দিকী, রেনি সিদ্দিকী ও গিনি সিদ্দিকী। তারা সবাই সংগীতের সঙ্গে জড়িত।

অজস্র জনপ্রিয় গান উপহার দিয়ে বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনকে সমৃদ্ধ করে মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী

পরিনত হন বাংলা গানের একজন কিংবদন্তী।

বাংলাদেশের আধুনিক গানের অন্যতম কণ্ঠ শিল্পী মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী'র গাওয়া অসংখ্য গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-

১. জানতাম যদি শুভংকরের ফাকি

২. শ্যামলা মেয়ের ডাগর চোখে কি মায়া লুকানো

৩. হেসে খেলে জীবনটা যদি চলে যায়

৪. আমি কতদিন কত রাত ভেবেছি

৫. আমি এক দুরন্ত যাযাবর

৬. একটি ছোট্ট আশা একটি ভালবাসা

৭. আজ নয় কাল,কাল নয় পরশু

৮. কে তুমি এলে মোর এই জীবন

৯. ঐ দুর দুর দুরান্তে নীল নীলান্তে

১০. জীবনটা হয় যদি এমনি সুন্দর

১১. তোমার চিঠি পেলাম আমি

১২. দুনিয়ার হাল দেখে হয়ে গেছি বেসামাল

১৩. এই মেঘলা বরন কন্যা চলে

১৪. এই শহরে আমি যে এক নতুন ফেরীওয়ালা

১৫. শোন গো রুপসী ললনা

১৬. দেখ দেখ গ্রামবাসী পাড়া প্রতিবেশী

১৭. লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে

১৮. আমি এক মাস্তানা, আমার নেই ঠিকানা

১৯. হৈ হৈ রঙিলা- রঙিলারে

২০. বাঁশি বাজে ওই দূরে

সংগীত জীবনে জাতীয় পুরষ্কার ছাড়াও অসংখ্য পুরষ্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন তিনি। এসবের মধ্যে রয়েছে দীনেশ পদক, বন্ধন লাইফটাইম এ্যাচিভমেন্ট, শিল্পকলা একাডেমি থেকে সংগীত ও নাট্যকলা পুরষ্কার প্রভৃতি।

 

ইংরেজি দু'হাজার চৌদ্দ সালের চার নভেম্বর। এদিনে কণ্ঠশিল্পী মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। এবার ছিল তাঁর ৬ষ্ঠ প্রয়াণবার্ষিকী। তিনি চলে গেছেন দুর-অজানায়। তবুও ক্ষণজন্মা শিল্পী মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী তাঁর গানের মধ্য দিয়েই সঙ্গীতপ্রেমীদের মাঝে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল ।

যেখানেই থাকুন-ভালো থাকুন সত্যিকারের কিংবদন্তী।

 

লেখক-

অশ্রু বড়ুয়া
গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক, বাংলাদেশ টেলিভিশন

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top