সিডনী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১


মাসুদ করিম: সঙ্গীতকে যিনি দিয়ে গেছেন অমৃত গানের ছন্দ : অশ্রু বড়ুয়া


প্রকাশিত:
৩০ নভেম্বর ২০২০ ২১:৩৩

আপডেট:
২৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:০৫

ছবিঃ মাসুদ করিম

 

গত ১৬ নভেম্বর ছিল কালজয়ী গীতিকবি মাসুদ করিম ' ২৪তম প্রয়াণবার্ষিকী

যখন আমি থাকবো নাকো আমায় রেখো মনে...
ও বন্ধু ওগো আমায় খুঁজো সুরের আলাপনে...

প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ সুবল দাস'র সুর ও সঙ্গীতে এই গানটির প্রসঙ্গ আসলেই একটি প্রিয় মুখ যে কারো চোখে সর্বাগ্রে ভেসে উঠে তিনি বাংলা সঙ্গীতের জীবন্ত কিংবদন্তী শিল্পী রুনা লায়লা। কিন্তু হৃদয় উজার করে যিনি লিখে গেছেন দরদমাখানো অমর এ গানের কথা কিংবা  গানের কথায় যিনি মনে রাখার জন্য বলে গেছেন-সত্যিকার অর্থে আমরা ক'জনই মনে রেখেছি গানের এই অমর স্রষ্টাকে। এমনিতেই ছিলেন একজন নিভৃতচারী মানুষ। বেশির ভাগ সময় থাকতেন চুপচাপ। তবু মুখে লেগেই থাকত হাসি।পোষাকে-আশাকে ছিলেন পরিচ্ছন্ন। কবিদের বাইরে রোমান্টিক ধারার গান রচনায় তিনি ছিলেন একজন সফল ব্যক্তিত্ব। তেমনি মানুষ হিসেবেও ছিলেন বড় মনের অধিকারী। হ্যাঁ। নাম তাঁর- মাসুদ করিম। নাম শুনেই হয়তো প্রথমে তাঁকে চিনতে একটু ভাবতে হবে। তবে তাঁর লেখা গানের প্রথম কয়েকটা শব্দ শুনলেই কারও সমস্যা হবে না গীতিকার মাসুদ করিমকে চিনতে বা জানতে।

- তন্দ্রা হারা নয়ন আমার : শিল্পী হাসিনা মমতাজ
- শক্র তুমি বন্ধু তুমি : শিল্পী মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার
- সজনী গো ভালোবেসে এত জ্বালা : শিল্পী বশির আহমেদ
- চলে যায় যদি কেউ বাঁধন ছিঁড়ে : শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী
- আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো  : শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন
- যখন থামবে কোলাহল : শিল্পী রুনা লায়লা
- সন্ধ্যার ছায়া নামে : শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন
- তোমরা যারা আজ আমাদের : শিল্পী খুরশীদ আলম
- শিল্পী আমি তোমাদেরই গান শোনাব : শিল্পী রুনা লায়লা
- যদি ভালবেসে কাছে এলে : সাবিনা ইয়াসমীন ও কাদেরী কিবরিয়া
- তুমি সন্ধ্যা আকাশের তারার মতো : শিল্পী সাইফুল ইসলাম
- জোনাক জোনাক রাত : শিল্পী দিলারা আলো
- তুমি আমি দুজনাতে :  শিল্পী রুনা লায়লা ও সহশিল্পী
- বাশি বাজে ওই দুরে : শিল্পী মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী
- নেই নি:শ্বাসের বিশ্বাস : ´ঊষা উত্থুপ
- পথের সাথী পথে নামো গো আজ : শ্যামল মিত্র ও সাবিনা
- দুটি চোখে চোখ রেখে আমারে সুধালে : ফেরদৌসি রহমান
- মেরী জিন্দেগী মেরে পাছ : শিল্পী মেহেদী হাসান (পাকিস্তান)
- তুমি যে আমার ভালবাসা : শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন
- মনে কি পড়ে একদিন আমিও ছিলাম : এম এ শোয়েব
- আমাদের পৃথিবীতে তোমারা : কুমার শানু, অনুরাধা ও উমা
- মন তো নয় আমার আয়না : শিল্পী ফৌজিয়া ইয়াসমিন
- কিছু বলো কিছু বলো : শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী
- বাতাসে তোমার সংলাপ শুনি : শিল্পী মাহমুদন্নবী
- ঐ আকাশ ঘিরে সন্ধ্যা নামে : শিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ
- যদি নীল সাগরের মুক্ত তুমি চাও : আনোয়ার উদ্দিন খান
- আমি সুজন দেখে ভাব করেছি : রুনা লায়লা

-মাসুদ করিমের লেখা এসব গান এখনো সিনেমাপ্রেমী দর্শকদের মুখে মুখে ফেরে।
বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনের এক অবিস্মরণীয় নাম-মাসুদ করিম। কালজয়ী এই গীতিকবি'র গানের বানী সাধনাময় সঙ্গীতকে করেছে আরো শ্রুতিমধুর। এদেশের অসংখ্য গুণী শিল্পী তাঁর গান গেয়ে যেমন মাসুদ করিমকে করেছেন নন্দিত তেমনি তাঁরাও
হয়েছেন ধন্য। চলচ্চিত্রে কালজয়ী এমন শত শত গানের জন্য মাসুদ করিম বিখ্যাত হয়ে আছেনমানুষের হৃদয়ে। যেসব গানে কণ্ঠ দিয়েছেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, বশির আহমেদ, সৈয়দ আবদুল হাদী, মাহমুদুন্নবী, মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, খোন্দকার ফারুক আহমেদ, কাজী আনোয়ার হোসেন, কাদেরী কিবরিয়া, প্রবাল চৌধুরী, নার্গিস পারভিনসহ প্রখ্যাত শিল্পীরা। এছাড়াও গজল সম্রাট মেহেদী হাসান, ভারতীয় শিল্পী শ্যামল মিত্র, ভূপেন হাজারিকা, উদিত নারায়ণ, কুমার শানু, অনুরাধা পাডোয়াল, ঊষা উথুপরাও তাঁর গানে কণ্ঠ দিয়েছেন।

বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতে জনপ্রিয় একটি নাম গীতিকার মাসুদ করিম। শুধু চলচ্চিত্রের গানই নয়, মাসুদ করিমের লেখায় সমৃদ্ধ হয়েছে আধুনিক, দেশাত্মবোধক, পল্লীগীতি-সহ বাংলা গানের বিভিন্ন শাখা।

ইংরেজি উনিশ'শ ছত্রিশ সাল সতের ফেব্রুয়ারি। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের(বর্তমান বাংলাদেশ) কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার দুর্গাপুর কাজীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন মাসুদ করিম। তাঁর বাবা-রেজাউল করিম একজন সরকারি কর্মকর্তা এবং মা নাহার ছিলেন গৃহিনী।

শৈশব থেকেই স্বপ্ন সাধনায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন মাসুদ করিম। ছোটবেলা থেকে মাসুদ করিম ঢাকাতেই বড় হন এবং কবি ও গীতিকার রূপে প্রতিষ্ঠিত হন।

স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রাম বেতারে প্রযোজক হিসেবে জীবনের কর্মক্ষেত্র শুরু করেন। কয়েক বছর পরে তিনি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দান করেন।

ইংরেজি ১৯৫৫ সাল থেকে গান লেখা শুরু করলেও মূলত ১৯৬০ সাল থেকেই তিনি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের জন্য গীত রচনা শুরু করেন। তবে ষাট, সত্তর ও আশির দশকে চলচ্চিত্রের গান রচনা করে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। রেডিও, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের গানের প্রখ্যাত গীতিকার মাসুদ করিম খুব
অল্প সময়েই যিনি বেতার ও টেলিভিশনের গীতিকার রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যান।যাঁর গান এই সব প্রচার মাধ্যমে বাজতো প্রতিদিন।

মাসুদ করিম ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম বেতারে কর্মরত অবস্থায় দিলারা আলো'র সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মাসুদ করিম'র সহধর্মিণী দিলারা আলো একজন সঙ্গীতশিল্পী। ঢাকা ও চট্টগ্রাম রেডিও এবং বাংলাদেশ টেলিভিশন এর নিয়মিত শিল্পী দিলারা আলো ছিলেন ষাট ও সত্তর দশকের অডিও এবং প্লেব্যাক এর জনপ্রিয় শিল্পী।
বর্তমানে দিলারা আলো পরিবার নিয়ে কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। এই দম্পতির এক পুত্র ও তিন কন্যা।

পরবর্তীতে ঢাকায় স্থায়ীভাবে এসে গান লেখার কাজে সার্বক্ষণিক হয়ে যান মাসুদ করিম। দীর্ঘদিন গান লিখেছেনও তিনি। ষাটের দশক থেকে ঢাকা শহরে যে সংগীতের জগৎ তৈরি হয়েছিল মাসুদ করিম তাঁর একজন উল্লেখযোগ্য সদস্য। নিশ্চুপ-নীরব কর্মী মাসুদ করিম তাঁর বিনয়ী স্বভাবের জন্য ছিলেন সকলের প্রিয়।

কালজয়ী গীতিকবি মাসুদ করিমের গান কোন প্রজন্মেই ভোলার নয়। তিনি গান লিখে যেমন পেয়েছেন কোটি মানুষের ভালোবাসা তেমনি পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কারসহ বহু সম্মান- পুরস্কার। মাসুদ করিম বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনকে দিয়ে গেছেন অমৃত গানের ছন্দ। সঙ্গীতপ্রিয় মানুষদের যিনি বেঁধে রেখেছেন গানের মায়ায়।
অসংখ্য কালজয়ী গানের গীতিকবি মাসুদ করিম'র গানের সুরকার ছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত সুরকারগণ। তাঁরা হলেন-সুবল দাস, সমর দাস, আলাউদ্দিন আলী, আলম খান, শেখ সাদী খান, খোন্দকার নুরুল আলম, রাজা হোসেন খান, এ হামিদ, আমির আলী, সত্য সাহা, আলী হোসেন, মনসুর আহমেদ, বশীর আহমেদ, আজমল হুদা মিঠু-সহ অনেকে।

বাংলা গানের জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন মাসুদ করিম। বিশেষ করে বাংলা ছায়াছবির গান দিয়ে তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। বাংলা গানের অসম্ভব মেধাবী এই গীতিকার চলচ্চিত্রের গানই যাঁর সর্বাধিক। কোনো কোনো চলচ্চিত্র তাঁর গানের জন্যই পেয়েছে খ্যাতি।

পরবর্তীতে ‘ইউনিক’ নামে একটি বিজ্ঞাপন সংস্থাও গড়ে তুলেছিলেন তিনি।কয়েকটি সিনেমাও প্রযোজনা করেছেন। তাঁর প্রযোজিত ছবিগুলো- অচেনা অতিথি, ওয়াদা এবং ভালো মানুষ।এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে ছিলেন গভীর ভাবে জড়িত। বাংলাদেশ লায়ন্স ক্লাবের ছিলেন আজীবন সদস্য। বাংলাদেশ গীতিকবি সংসদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং সভাপতি ছিলেন মাসুদ করিম। অনেক তরুণ এবং প্রবীণ গীতিকার,
কবিদের তিনি সাহায্য করতেন গান ও কবিতা লিখতে। বাংলাদেশ সংগীত পরিষদেও তিনি যুক্ত ছিলেন সহ- সভাপতি হিসেবে।

 

নামের চেয়ে কর্মই যার বড়। নামকে ছাপিয়ে কর্ম পৌঁছে যায় মানুষের কাছে। তেমনই একজন মানুষ মাসুদ করিম।
মাসুদ করিম ১৯৮২ সালে 'রজনীগন্ধা' চলচ্চিত্র এবং ১৯৯৪ সালে 'হৃদয় থেকে হৃদয়' চলচ্চিত্রের সঙ্গীতে অবদানের জন্য শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে দু'বার জাতীয় চলচ্চিত্র অর্জন করেন।

নব্বইয়ের দশক। আমেরিকায় অধ্যয়নরত একমাত্র ছেলেকে দেখতে সপরিবারে আমেরিকায় চলে যান।

ইংরেজি উনিশ'শ ছিয়ানব্বই সাল। দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ষোল নভেম্বর কানাডায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
মন্ট্রিয়ালের কবরখানায় একটি গাছের নিচে তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের গানের জগতের উজ্জ্বল এই মানুষটি স্মৃতিবেদনা হয়ে মিশে আছেন সেখানেই ।

কিংবদন্তীতুল্য এই গীতিকবি আজ নেই। চলে গেলেন পরপারে। রেখে গেলেন কত স্মৃতির মনিহার। তিনি নেই তবুও তিনি বেঁচে আছেন তাঁর সৃষ্টিকর্মে। সহস্রাধিক গানের অমর স্রষ্টা মাসুদ করিম। তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে জানে না
নতুন প্রজন্মের অনেকেই।
সম্প্রতি হৃদয়ছোঁয়া গানের স্রষ্টা গীতিকার মাসুদ করিম'র সহস্রাধিক গানের মধ্য থেকে ৮০০ গান নিয়ে তৈরি হলো একটি সংকলন গ্রন্থ। যার নাম ‘৮০০ গানের সংকলন মাসুদ করিম’।

সংগীতের অমর এই স্রষ্টা বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি নাম। সংষ্কৃতির স্বার্থে সংগীতের প্রয়োজনে দেশের খ্যতিমান এ গীতিকারের যথার্থ মূল্যায়ন এবং তাঁর অমর গানগুলো রক্ষাণাবেক্ষণও ভীষণ জরুরী হয়ে পড়েছে প্রজন্মের জন্য-কালের জন্য।


অশ্রু বড়ুয়া
গীতিকবি, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক
বাংলাদেশ টেলিভিশন

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top