সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০


ক্ষমতা নয়, চাতুর্য নয়

প্রেমের আলোয় খেয়ালী নাট্যগোষ্ঠীর সারা দেশময় সাংস্কৃতিক জাগরণ : শাকিলা নাছরিন পাপিয়া


প্রকাশিত:
১ এপ্রিল ২০২১ ২০:৫৭

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৬:৩৯

 

এক জরিপে প্রকাশ, ঢাকার সবচেয়ে দরিদ্রতম এলাকা জুরাইন। এই এলাকায় যখন অশিক্ষা, ধর্মান্ধতা বিরাজমান ছিল, এলাকার নাম বললে অন্য এলাকার মানুষ তো দূরের কথা রিক্সাওয়ালারা পর্যন্ত চিনতো না। বরং জুরাইন বললে তারা গোড়ান শুনতো।
এমনই এক সময় জুরাইনে জন্ম হয় খেয়ালী নাট্যগোষ্ঠীর।
একজন চির সবুজ নাট্ক পাগল মানুষ এ কে এ কবীর। 
"নাটক সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার" এই শ্লোগাণ নিয়ে  খেয়ালীর নাট্যকার ও মহাপরিচালক এ কে এ কবীরের বাড়ির আঙিনায় শুরু হয় খেয়ালীর পথচলা।

ধর্মান্ধ সমাজের  অপবাদ রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে  একদল তরুণ তরুণীকে সাথে নিয়ে সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে সমাজের অবক্ষয় আর অসংগতির বিরুদ্ধে শুরু হয় স্রোতের বিপরীতে পথচলা। এই যাত্রা পথের নাবিক ছিলেন খেয়ালীর কর্ণধার এ কে এ কবীর। তাঁর সহযোগী  ছিল একদল উদ্দম, স্বপ্নময় তরুণ।
খেয়ালীর পরিচালক নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে নিজেকে বলেছেন, "কাঙাল কবীর"। সব সময় তিনি বলতেন, প্রেমের কাঙাল আমি।
প্রেমে খুঁজেছেন মুক্তি। প্রেমে খুঁজেছেন পথ।
অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা, চাতুর্য, ভয় দিয়ে নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রেম দিয়ে, প্রেমের আলো দিয়ে বদলে দেয়া যায় অসুন্দর, অনিয়ম।
তাই তো প্রেমের পথেই ছিল তাঁর আন্দোলন।
স্বৈরশাসকের  আমলে সারা দেশ যখন অগ্নিগর্ভ। নানামুখী আন্দোলনে রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠনগুলো যখন সোচ্চার  তখন নাটক নিয়ে খেয়ালী পুরোটা সময় থেকেছে মঞ্চে, পথে, গাইড হাউজ, মহিলা সমিতি, শিল্পকলার  মঞ্চে, শহিদ মিনারের চত্বরে, পথ নাটক নিয়ে শহরের, গ্রামের পথে সরব উপস্থিতি ছিল সব সময়।
খেয়ালীর রূপক নাটক "এই অরণ্যে"।  স্বৈরশাসক বিরোধী নাটক। এই নাটকে শাসক এবং তার সহযোগীদের  হিংস্র পশু হিসাবে দেখানো হয়েছে। পশু রাজত্বে প্রেম বিহীন  নির্মমতা, হিংস্রতাকে তুলে ধরে দেখানো  হয়েছে তৎকালীন সমাজকে।
এই পশু রাজ্যে মানুষের রাজত্ব কায়েম করতে স্বর্গ থেকে নেমে আসে লাইলী- মজনু। প্রেমের বার্তা নিয়ে তারা অরণ্য রাজ্যের বাঘ, সিংহের মুখোমুখি হয়।

প্রেমের শক্তির কাছে পশু শক্তির, হিংস্রতার পরাজয়ের মাধ্যমে অরণ্যের অবসান হয়ে  মানুষের বসবাসযোগ্য আবাসভূমি সৃষ্টি হয়।
এই নাটক তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের চেতনার জগতে নাড়া দিয়েছিল। ভয়ও ছিল শাসকগোষ্ঠীর রক্ত চক্ষুর, রোষানলের।
ঐ সময়ে মিছিলে, শ্লোগানে, হরতালে সারাদেশ যখন উত্তাল তখন অখ্যাত এলাকার কিছু তরুণ যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কিন্তু স্বৈরশাসক বিরোধী আন্দোলনে তাদের নাটক নিয়ে, তাদের বার্তা নিয়ে ছুটে চলেছে নানা জায়গায়।
হাঁটাহাঁটি পা পা করে আজ খেয়ালী একটি পরিচিত নাম নাট্যজগতে। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এই সংগঠন।
একদা ডোনেশনের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে। নারী অভিনেত্রীর জন্য অনুরোধ করতে হয়েছে অভিভাবকদের। এখন আর সেইদিন নেই। খেয়ালী এখন পরিনত।
যখন দেশ পরাধীন ছিল তখন স্বাধীনতার জন্য আকাঙ্খা ছিল।  আন্দোলন ছিল। যখন স্বৈরশাসক ছিল তখন গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন ছিল।
এখন আন্দোলন মানবিক মানুষ তৈরির।
এখন আন্দোলন আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন জাতি গঠনের।
এখন আন্দোলন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার।
এখন আন্দোলন মানুষে মানুষে সমতা রক্ষার।

এই আন্দোলন অস্ত্র দিয়ে,  ভয় দেখিয়ে অথবা চতুরতা দিয়ে নয়।এই আন্দোলনে সফলতার জন্য প্রয়োজন অতীতকে জানা।প্রেমের আলোয় মানুষের মাঝে ভালোবাসার আলো জ্বালানো। মানুষের সুপ্ত সুকুমার বৃত্তির উন্মেষ ঘটিয়ে মানুষে মানুষে বৈষম্য দূর করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার।
বর্তমান সময়ের এই প্রয়োজনকে উপলব্ধি করেই অতীতের মতো খেয়ালী তার প্রেমের মশাল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে দেশময়।
বিভাগীয় শহরসহ দেশময় খেয়ালীর  সাংস্কৃতিক জাগরণের যাত্রা শুরু  হয়েছে ৬ ই ফেব্রুয়ারী ২০২১ থেকে।
যা চলবে সারা বছর ব্যাপী।

এ জাতির সম্মূখে এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। একদিকে জাতির জনকের জন্ম শতবার্ষিকী,  অন্যদিকে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ নানা কর্মসূচী পালন করতে যাচ্ছ।
এক সময় অবজ্ঞা ভরে যারা এদেশকে "তলাবিহীন ঝুড়ি" আখ্যায়িত করতো আজ তারা  বিস্ময় নিয়ে দেখছে এদেশ খাদ্য, বস্ত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে বিদেশেও খাদ্য, বস্ত্র রপ্তানী করে।
চাইলেই যে একটা জাতি উঠে দাঁড়াতে পারে তার প্রমান ইতিমধ্যে আমরা দিয়েছি।

পরিবর্তিত সময়ের সাথে সাথে চিন্তা এবং শ্লোগান দুটোই পাল্টায়। এই সংগঠনটির এক সময় শ্লোগান ছিল,  "নাটক হোক সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার।"
এখন এই সংগঠনের শ্লোগান, "সংস্কৃতির ছোঁয়ায় অবক্ষয় ঘুচে জাগ্রত হোক মানবতা।"

খেয়ালী তার নিমন্ত্রন পত্রে লিখেছে----
মর্যাদাবোধ সম্পন্ন  মানবিক আলোকিত এক জাতি গঠনের লক্ষ্যে খেয়ালী নাট্যগোষ্ঠী দলমত নির্বশেষে -' 'সংস্কৃতির ছোঁয়ায় অবক্ষয় ঘুচে জাগ্রত হোক মানবতা' শ্লোগান নিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী  উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ উপলক্ষে খেয়ালীর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক ---
"কদমতলী আর্মিক্যাম্প"  মঞ্চায়নের মধ্যদিয়ে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানানোর প্রয়াসে বিভাগীয় শহরসহ দেশময় সাংস্কৃতিক জাগরণের আয়োজন করতে যাচ্ছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ন জয়ন্তীর অনুষ্ঠানের সূচনা হবে।
আসুন দেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত এই আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মাদক, দুর্নীতি মুক্ত ও অসাম্প্রদায়িক  বাংলাদেশ গড়ে তুলি।"

খেয়ালী তার কার্যক্রম নিয়ে ছুটে চলছে ৬ ই ফেব্রুয়ারি থেকে এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে। এক জেলা থেকে অন্য জেলায়। সংগে আছে বিভিন্ন জেলার সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো।
"কদমতলী  আর্মি ক্যাম্প" মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটক। খেয়ালীর নাট্যকার এবং মহাপরিচালক এ কে এ কবীরের রচনায় এই  নাটকটি মুক্তিযুদ্ধের এক বাস্তব চিত্র।
নাট্য শিল্পীদের অভিনয়ে তা আরো বাস্তব রূপ পেয়েছে। হয়েছে অনবদ্য।দর্শক প্রিয় এই নাটকটির সঙ্গে দর্শক একাত্ম হয়ে যায়। নিজেদের আবিস্কার করে ঐ সময়ে।

মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনবাজি রেখে নিম্চিত মৃত্যুর মুখে হেঁটে যাওয়া, তাদের দেশপ্রেম, অমানবিক নৃশংস অত্যাচার সহ্য করেও লড়ে যাওয়া, জয়বাংলা শ্লোগানে পাকিস্তানিদের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেয়ার অনবদ্য চিত্ররূপ এই কদমতলী আর্মি ক্যাম্প।
সেইসাথে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে রাজাকার আর পাকিস্তানি মিলিটারীর অমানবিক, হিংস্র অত্যাচারের কাহিনী। যা দেখে মনে হবে চোখের সামনেই ঘটছে নৃশংস সব ঘটনা।

স্বাধীনতা পাগল একটি জাতির দেশপ্রেম,ত্যাগ আর তাদের নেতার প্রতি ভালোবাসার অসাধারণ এক বাস্তব চিত্র পরিস্ফুটিত হয়েছে এই নাটকে।

খেয়ালীর প্রায় প্রতিটি নাটকেই থাকে মুক্তিযুদ্ধের কথা।
দেশপ্রেমের কথা। মানবতার কথা। সমতার সমাজ আর মানুষের কথা। তবে স্বাধীনতার সুবর্ণ  জয়ন্তী  আর মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে এই নটকটি  সময়ের সাথে মিলে গেছে। সময়োপযোগী   এক নাটক কদমতলী আর্মি ক্যাম্প।  বর্তমান প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বাস্তব হয়ে ধরা দেবে  খেয়ালীর কলা কৌশলী আর শিল্পীদের শৈল্পিক উপস্থাপনায়।

পবিত্র রমজানে বিরতির পর আবার ঈদ উল ফিতরের পর শুরু হবে পূর্ব নির্ধারিত কার্যক্রম। মানুষের মানবিক হয়ে  গড়ে ওঠার এই  প্রেমের আলোকময় যাত্রা পথে  সবার অংশগ্রহনে,  সবার ভালোবাসায়  খেয়ালীর ভিন্নধর্মী  এই কার্যক্রম এগিয়ে যাবে বাংলার প্রতিটি জেলায়, প্রতিটি জনপদে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বর্তমান প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস পৌঁছে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর এই অভিনব, ভিন্নধর্মী আয়োজনকে সাফল্যমন্ডিত করা  সবার দায়িত্ব।

একটি অনুন্নত পিছিয়ে পড়া জনপদে ১৯৭৫ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি নাটক পাগল চির সবুজ মানুষটি প্রেমের আলো জ্বেলেছিলেন একঝাঁক শিষ্যকে নিয়ে।এখন সেই সংগঠন তাঁরই প্রেমের আলোর মশাল হাতে ছুটে চলছে দুর্বার গতিতে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।

এ কে এ কবীর নেই।আছে তাঁর স্বপ্নের সংগঠন আর তাঁর যোগ্য উত্তরসূরীবৃন্দ। মানুষ বাঁচে তার সৃষ্টিতে। খেয়ালীর প্রতিষ্ঠাতা তাঁর সৃষ্টির মাঝে বেঁচে থাকবেন। রয়ে যাবেন তাঁর  প্রেমের আলোক শিখায় অম্লান, উজ্জ্বল।



শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
সাবেক সহসভাপতি
খেয়ালী নাট্যগোষ্ঠী, ঢাকা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top