সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

পঞ্চাশ বছরেও পুংলি ব্রিজের কাছে হয়নি স্মৃতিস্তম্ভ! - সালেক খোকন


প্রকাশিত:
১৫ মার্চ ২০২১ ২১:২৭

আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২১ ২১:২৮

সালেক খোকন

 

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সাহেবের ভক্ত ছিলাম আমরা। তার সঙ্গে সঙ্গেই থাকতাম। তাকে আমরা ‘হুজুর’ বলে সম্বোধন করতাম। ছাত্র ইউনিয়ন করতাম তখন। টাঙ্গাইল জেলা শাখার সহসভাপতি ছিলাম। ফলে সকল আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত থেকেছি।

ওইসময় প্রতিদিনই মিটিং আর প্রতিবাদ সভা হতো টাঙ্গাইলের ভেগের দালান, নিরালা মোড়ে। মিছিল নিয়ে আমরা মার্চ করে শান্তিনগর মোড় হয়ে এসডিও সাহেবের বাড়ির কাছে অবস্থান নিতাম। ১৯৬৯-এর গণআন্দোলন চলছে তখন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে এসডিওর কাছে স্মারকলিপি দিতে গিয়ে অ্যারেস্ট হই আমি, আতোয়ার রহমান, বালা, রক্কু, হামিদুল হক মোহনসহ কয়েকজন ছাত্রনেতা। ফলে প্রায় পনের দিন কাটাতে হয়েছে টাঙ্গাইল জেলখানায়।

১৯৭০ সাল। নির্বাচন হবে সারাদেশে। ভাসানী সাহেবের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নির্বাচনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। কিন্তু সেটা হলো না!

কেন?

হুজুর একদিন ডেকে পাঠালেন সন্ধ্যায়, সন্তোষের বাড়িতে।

আমাকে দেখেই বললেন– ‘তোফাজ্জল তুমি থাকবে।’

শ্রমিক নেতা সবুর খানসহ অনেকেই ছিলেন। রাত বারো বা সাড়ে বারোটা হবে তখন। হঠাৎ দেখলাম বঙ্গবন্ধু, সঙ্গে ক্যাপ্টেন মনসুর, তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবসহ অনেকেই আসলেন। তাদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক চলল অনেকক্ষণ।

হুজুরকে বঙ্গবন্ধু বোঝাতে সক্ষম হলেন যে, এদেশের মানুষের স্বাধিকার আনতে হবে। দুইটা দলে ভাগাভাগি হয়ে নির্বাচন করা ঠিক হবে না। এতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নষ্ট হবে।

হুজুর তখন বললেন: ‘মুজিব তুমি এককভাবেই নির্বাচন করো। আমার নেতাকর্মীরা তোমারই নির্বাচন করবে।’

টাঙ্গাইলে ঐতিহাসিক সন্তোষে হুজুরের বাড়িতেই ফয়সালা হলো নির্বাচন কে করবে? মওলানা সাহেব নির্বাচন বয়কট করলেন বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে একেকভাবে জেতানোর জন্যই। ঐতিহাসিক ওই সময়টাতে সেখানে উপস্থিত ছিলাম। এটাই পরম সৌভাগ্য বলে মনে করি।

ছবিঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. তোফাজ্জল হোসেন ভূঁইয়া

 

একাত্তর পূর্ববর্তী ইতিহাসের নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. তোফাজ্জল হোসেন ভূঁইয়া। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই আলাপ চলে যুদ্ধদিনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে।

পাঁচ ভাই ও পাঁচ বোনের সংসারে তোফাজ্জল বাবা-মায়ের অষ্টম সন্তান। তার বাবার নাম আবুল কাশেম ভূঁইয়া এবং মা আসমাতুন্নেছা। তাদের বাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলার মহেলা গ্রামে।

তোফাজ্জলের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি ফটিকজানি প্রাইমারি স্কুলে। অতঃপর এলেঙ্গা হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ওই কলেজেই ডিগ্রিতে ভর্তি হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ডিগ্রি ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র।

সত্তরের নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা দিতে টালবাহানা শুরু করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। ফলে দেশের মানুষ রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়। তোফাজ্জল মনে করেন এর ফলে পাকিস্তান থেকে এ দেশ স্বাধীন হওয়ার রাস্তাটাও ধীরে ধীরে খুলে যেতে থাকে। তবে সে রাস্তায় রক্ত ঝরে লাখো মানুষের।

২৫ মার্চের পরের ইতিহাস তুলে ধরেন তিনি। বলেন-

‘আর্মিরা টাঙ্গাইলের দিকেও মার্চ করে। আমরা তখন ওদের ঠেকানোর প্রস্তুতি নিই। ছাত্রনেতা আতাউর রহমান, হামিদুল হক মোহন, কাদের সিদ্দিকীসহ অনেকের সঙ্গে যোগযোগ হয়।

দুইজন পুলিশের ইনস্ট্রাক্টরের কাছ থেকে প্রথম থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালানো শিখি, পারচরের মাঠে। তারা পালিয়ে এসেছিলেন রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে। দুইটা রাইফেল ছিল সম্বল। আব্দুর রহমানসহ আমরা ১০-১২ জন ট্রেনিং নিই।

পাকিস্তানি সেনারা টাঙ্গাইল ঢুকে ময়মনসিংহের দিকে রওনা হয়। ওই সময় কালিহাতির হামিদপুর ব্রিজের ওখানে ওরা প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ইপিআরের বাঙালি সদস্যদের একটা গ্রুপ ওখানে ডিফেন্স নেয়। ওটা ছিল প্রথম ডিফেন্স। আমরাও যুক্ত ছিলাম। তিন থেকে চার ঘন্টা যুদ্ধ হয়। ফুলতলার আজিজ ওই যুদ্ধে আহত হন। আর কাছের বন্ধু আলী আজগরকেও হারাই ওইদিন।’

কাদের সিদ্দিকী তখন ধলাপাড়ার পাহাড়ে। তোফাজ্জলও তার দলে যুক্ত হয়। হাতে ছিল থ্রি নট থ্রি রাইফেল। স্থানীয় অস্ত্রগুলোও মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে চলে আসতে থাকে। কাদের সিদ্দিকী তোফাজ্জলকে বললেন– ‘তুমি রাতে পুংলি ব্রিজ অপারেশন করবা। কে মারা গেল, কয়জন মারা গেল– এটা বিষয় না। জানান দিতে হবে যে আমরা সরব আছি।’ তোফাজ্জলরাও তাই করলেন।

তার ভাষায়– ‘তখন শান্তিকমিটির লোক ও রাজাকাররা প্রত্যেকটা ব্রিজ ও রাস্তা পাহারা দিত। ফটিকজানি স্কুলের পরে একটা রাস্তা ছিল। ৫-৬ জন নিয়ে ওই রাস্তার ওপর বালুর বস্তা দিয়ে দুইটা রাইফেল রেডি করি। জ্যোৎস্না রাত ছিল। ওদের দেখা যায় স্পষ্ট। আমরাই ফায়ার ওপেন করি। গুলিতে এক রাজাকারও মারা পড়ে। পরে জেনেছি সে ছিল মধুপুরের নুরু রাজাকার। ওরাও অসংখ্য গুলি করে। কিন্তু সব চলে যায় মাথার ওপর দিয়ে। এভাবেই ছোটখাট অপারেশন করি রসুলপুর, কদমতলিসহ নানা জায়গায়। কাদের সিদ্দিকী ভারতে চলে যাওয়ার আগে নির্দেশ দিয়ে যান আরও মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহের।’

যুদ্ধে যাওয়ার জন্য গ্রামে গ্রামে গিয়ে ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করতে থাকেন তোফাজ্জলরা। তিনি, হাসান ডাক্তার, আতাউর রহমানসহ নেতৃস্থানীয়রা এক রাতে বৈঠক করেন বাশিতে, এক বাড়ির উঠানে। সিদ্ধান্ত হয় যারা যুদ্ধে যেতে আগ্রহী তারা সাধ্যমতো চাল, আলু, শুকনা মরিচ, পেয়াজ সঙ্গে নেবে। সবাই একত্রিত হবে আনাহোলার চরের এক ধনীর বাড়িতে।

তখন বর্ষাকাল। কোনো পাকা রাস্তা ছিল না। রাতে রওনা হয় সবাই। ঠান্ডু নামে এক ছেলে ছিল টাঙ্গাইলের নামকরা ফুটবলার। সে এবং বাসাইলের দুইজন ছেলে তোফাজ্জলের সঙ্গী হয়। তারা রাতেই আনাহোলার চরের গন্তব্যে পৌঁছায়। এভাবে প্রায় ৫শ মতো যুবক একত্রিত হয় সেখানে।

পুরো প্রস্তুতিটা নিতে তোফাজ্জলদের সময় লেগেছিল ১৫-২০ দিন। এর মধ্যে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় ছুটিতে আসা সেনাবাহিনীর বাঙালি সেনা, ইপিআর আর পুলিশের লোকেরাও। কিন্তু নেতৃত্বটা ছিল ছাত্রনেতাদের হাতে। বড় দুটি গয়নার নৌকা ভাড়া করা হয়। রাত দুইটার দিকে মোল্লার চর থেকে নৌকা ছাড়ে মাইনকার চরের উদ্দেশে।

খরচ জোগাড় করলেন কীভাবে?

‘অর্থ জোগান দিলেন আমার মা। তাকে শুধু বললাম– ‘পাঁচশ ছেলেকে ভারত নিয়ে যেতে হবে। বড় গয়নার নৌকা ভাড়া করতে হবে, সকলের খাবার-দাবারের ব্যাপারও আছে। এখন কি করি।’ আঁচল থেকে খুলে মা তিনশ টাকা আমার হাতে দিল। ওই সময়ে এটা অনেক টাকা। মায়ের ওই টাকাটা পেয়ে মনে হলো যুদ্ধে অর্ধেক জয়লাভ করে ফেলেছি। তবে যাওয়ার সময় তিনি শপথ করিয়ে বলেছিলেন– ‘যুদ্ধে শুধু গেলেই হবে না বাবা। দেশটা স্বাধীন করতে হবে। দেশকে হানাদার মুক্ত করতে হবে। আর তুমি বাবা দেশ স্বাধীন করে ঘরে ফিরবা। কথা দাও।’ ওইদিন মাকে কথা দিয়েছিলাম এবং দেশ স্বাধীন করেই ঘরে ফিরেছিলাম। ভাই, লাখো মায়ের দোয়াও ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে।’

নদী পথে একাত্তরে তোফাজ্জলদের যাত্রাও ছিল শঙ্কার, আতঙ্কের আর ঝুঁকির। সেটা ছিল আরেক যুদ্ধ। পথে পথে গানবোট নিয়ে টহল দিত পাকিস্তানি সেনারা। সারারাত তাই নৌকা চলত। দিনের বেলা নোঙ্গর করা হতো নদীর চরে, কাশবনের ভেতরে। এভাবে পাকিস্তানি সেনাদের চোখ এড়িয়ে তারা জগন্নাথগঞ্জ ও সরিষাবাড়ি ঘাট পাড়ি দেয়। কিন্তু বাহাদুরাবাদ ঘাটের কাছাকাছি যেতেই আর্মিদের সার্চ লাইটের কবলে পড়ে। তখন বড় গয়নার নৌকা ছেড়ে ছোট ছোট ডিংগি নৌকায় ধীরে ধীরে এগোয় তারা।

পথ চলতে গিয়ে সবাই ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত। সঙ্গে আনা খাবারও শেষ। কয়েকদিন কেটে যায় নদীর পানি খেয়েই। এরপর দূরে একটি চরের দেখা মেলে। সেদিকে এগিয়ে যায় তোফাজ্জলের ছোট্ট নৌকাটি।

তার ভাষায়– ‘যমুনা মানেই তখন সাগর। দূর থেকে চরটাকে রেখার মতো দেখায়। ওখানে ছিল মাত্র পাঁচ-ছয়টা ছনের ঘরের বসতি। সবাই খুবই গরীব। সংকোচ হলেও বললাম– ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধা। দুইতিন দিন ধরে খাই না, তোমাদের কাছে কি কোনো খাবার আছে?

পরিচয় শুনেই সবার চোখেমুখে যেন আনন্দের ঝলক। ঘরের মহিলারা ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। মনে হলো ওদের কলিজা ছিড়ে আমাদের দিয়ে দেবে। দ্রুত ডাল, চাল আর চালকুমড়া দিয়ে খিচুরি রান্না করে তারা। আমাদের কাছে তা অমৃতের মতো মনে হয়। চরের ওই সাধারণ মানুষগুলোকে আজও স্যালুট জানাই। মুক্তিযুদ্ধে কত মানুষ যে কতভাবে যুক্ত ছিল! তাদের সেই ছোট ছোট অবদানের কথাগুলোও ইতিহাসের অংশ।’

সেখানে পৌঁছেই তোফাজ্জলরা দেখা করে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে। তার নির্দেশেই তারা চালু করে কাকরিপাড়া ট্রানজিট ক্যাম্পটি। এটা ছিল মাইনকারচর থানার একটু দক্ষিণে। তিন বা চারদিনের মধ্যেই ক্যাম্প রেডি হয়ে যায়। এর পরই তার ডাক পড়ে মরনটিলায়, অপারেশনাল ক্যাম্পে।

তোফাজ্জল বলেন– ‘আমার সঙ্গে ছিল সিরাজগঞ্জের আবুল হোসেন, গাইবান্ধার আফতাব ও হাবিলদার আজম, নাগরপুরের দুইটা ছেলে। সি লেভেল থেকে প্রায় দেড় হাজার ফিট উপরে ছিল মরনটিলার অপারেশনাল ক্যাম্পটি। ইন্ডিয়ার আর্মিদের সাথে রাত আটটা বা নয়টায় বর্ডারের এসে সারারাত ফায়ার চালাতাম। থ্রি ইঞ্চ মর্টার, এলএমজি, এসএমজি, স্টেনগান, গ্রেনেড–এগুলো হাতেকলমে ট্রেনিং হয় ওখানেই। রৌমারি, চিলমারি, লালমনি– এসব সীমান্তে গোলাগুলি চলত। ভোর হলে আবার ফিরে আসতাম।’

হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য সেপ্টেম্বর মাসে তুরা চলে যান মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জল। সেখানে পনের দিনের থ্রি ইঞ্চি মর্টারের কোর্সটা সম্পন্ন করেন তিনি। অতঃপর ফিরে আসেন অপারেশনাল ক্যাম্পে।

অক্টোবর মাসে মরনটিলায়ও নতুন চারটা ব্যাচ তৈরি হয়ে যায়। ঘাটাইল, গোপালপুর, টাঙ্গাইলের বহু মুক্তিযোদ্ধা সেখানে ট্রেনিং নেন। তখন তোফাজ্জলকে কাদেরীয়া বাহিনীরই ২৪ নম্বর তোফাজ্জল কোম্পানির কমান্ডার করা হয়। প্রায় ২০০ মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে তিনি কুড়িগ্রাম হয়ে আসেন অলিপুরে। সেখান থেকে পায়ে হেটে জামালপুর হয়ে ভুয়াপুরে পজিশন নেন। নভেম্বরের দিকে নারিন্দায় একটি অপারেশন শেষ করে তারা আবার ভুয়াপুরের উত্তরে পিকনা স্কুলে অবস্থান নেন।

রণাঙ্গনের কথা উঠতেই এ কোম্পানি কমান্ডার অকপটে বলেন– ‘ভারত স্বীকৃতি দেয় ডিসেম্বরের ৪ তারিখ। কাদের সিদ্দিকী তখন খবর পাঠালেন ইন্ডিয়ান প্যারা বিগ্রেড এইট টাঙ্গাইলে প্যারা জাম্প করবে। তাদের সহযোগিতা করতে হবে আমাদের। আমরা প্রস্তুতি নিতে থাকি। ১০ ডিসেম্বর ফুলতলা যুদ্ধ করলাম। এর পর এলেঙ্গার দিকে এগোই।

ইন্ডিয়ান প্যারা বিগ্রেড তখন খল্লদ বাড়ি, ভুক্তা, বানিয়াপুর এলাকায় নেমে পড়ে। ওরা পজিশনে গিয়েই পুংলি ব্রিজের ওপরে ৬টা পাকিস্তানি কনভয় ম্যাসাকার করে দেয়। আমরাও শেলিং করি। প্যারা বিগ্রেড এইট খালি রাস্তার দিকে শেলিং করে। ফলে এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে পুংলি ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তার দুইধারে শত শত হানাদার বাহিনী মারা পড়ে। পুংলি নদীর দুইধারেও পড়েছিল ওদের লাশগুলো।’

ইতিহাসের অজানা একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে এই বীর যোদ্ধা দুঃখ নিয়ে বলেন– ‘আমরা সারাদেশে শহীদদের স্মৃতিরক্ষায় স্তম্ভ নির্মাণ করতে পারিনি। জাতি হিসেবে এ বড়ই লজ্জার। ভারতের মিত্রবাহিনীও আমাদের স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছে। একাত্তরে এলেঙ্গার পুংলি ব্রিজের কাছে শহীদ হয় ইন্ডিয়ান প্যারা বিগ্রেডের ৯ জন সেনা। অথচ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও সেখানে একটা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়নি। যেখানে ওদের চিতা দাহ করা হয়েছে, সেখানে তাদের নামগুলো লিখেও স্তম্ভ করা যেত। পুংলি ব্রিজের দক্ষিণ পূর্বকোণায় নদীর ধারে নয় জনের চিতায় আমি নিজে অংশ নিয়েছি। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে গার্ড অব অনার করা ও শ্রদ্ধা জানায়া ফায়ারও দিসি। আজ বেঁচে আছি বলেই বলতে পারছি। কিন্তু আর দশ বছর পরে তো কেউ এই ইতিহাস বলতে পারবে না। একাত্তরের প্রকৃত ইতিহাস তো এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে! মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাদের অবদান অম্লান করে রাখতে শেখ হাসিনা সরকারের উচিত পুংলি ব্রিজের পাশে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা। অন্তত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সরকার সেটা করতে পারে।’

যে দেশের স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করলেন, সে দেশ কি পেয়েছেন?

মুচকি হেসে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা উত্তরে বলেন– ‘দেশ তো স্বাধীন হয়েছে। তবে স্বপ্নের দেশ এখনও পুরোপুরি হয়নি। মানুষের আরেকটু অধিকারের প্রয়োজন, সুশাসনের প্রয়োজন।’

তখনকার রাজনৈতিক নেতা ও এখনকার নেতাদের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরেন এই যোদ্ধা। তার ভাষায়– ‘তখন রাজনীতি করেছি মাটি, মানুষ ও দেশের জন্য, দেশকে ভালবেসে। মা আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন এমন– ‘যদি দণ্ড সহিতেও হয়, তবু মিথ্যা কর্ম নয়। সত্য, সত্য, সত্যের জয়।’ আমরা তাই বাড়ি থেকে পয়সা নিয়ে রাজনীতি করেছি। এখন তা নাই। নেতাকর্মীদের বুঝতে হবে পয়সা কামাইয়ের জন্য রাজনীতি নয়। মানুষ আমাদের দেখলে বুক পেতে দিত। এখন অনেক ছাত্রনেতাকে দেখলেই মানুষ ভয় পায়। এটা দূর করতে হবে। আমাদের দেশে কি নাই বলেন। সবই আছে। খালি সততার একটু অভাব।’

প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জল। তার ভাষায়– ‘বীরত্বের ইতিহাস না জানলে প্রজন্ম বীরত্বপূর্ণ কাজও করতে পারবে না। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। আমার বয়স সত্তরের ওপর। জীবিত আছি বলেই আপনাকে সব বলতে পারছি। এটাই আমার ভাগ্য। আর দুই তিন বছর পর কতজন মুক্তিযোদ্ধাকে আপনারা পাবেন?

সঠিক কাউন্সিলিং করতে পারলে নিউ জেনারেশন দেশটাকে এগিয়ে নিতে পারবে– এমনটাই মত দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. তোফাজ্জল হোসেন ভূঁইয়া। তাই প্রজন্মের উদ্দেশেই তিনি বললেন শেষ কথাগুলো– ‘তোমরা নিজের কাজে সৎ থেকো। দেশটাকে ভালবেস। পূর্বপুরুষদের রক্তঝরা একাত্তরের ইতিহাসটা তোমরা জেনে নিও। ওই গর্বের ইতিহাসই তোমাদের পথ দেখাবে।’

 

সালেক খোকন
লেখক গবেষক
www.salekkhokon.net

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top