সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

ভাষা আন্দোলনের মহান অর্জন ম্লান হবার নয়: মহিউদ্দিন আকবর


প্রকাশিত:
২৪ আগস্ট ২০১৯ ০১:০৭

আপডেট:
১৭ এপ্রিল ২০২০ ০৫:৪৮

মহিউদ্দিন আকবর

 

বাংলা ভাষা শুধু একটি ভাষারই নাম নয়, এটি এখন রক্তের আঁখরে লেখা একটি রক্তাক্ত ইতিহাস। বাংলা ভাষা মানে শাণিত সংগ্রাম এবং অনিবার্য বিজয়। বাংলাভাষাকে এখন আর উপেক্ষা করার দুঃসাহস কেউই রাখে না। বাংলাদেশে বাংলা ভাষা আন্দোলন একটি স্মরণীয় ও বহুবর্ণিল অধ্যায়। সে এখন নিজেই একটি স্বতন্ত্র উজ্জ্বল ইতিহাস।

১৯২০ সাল। কোলকাতার শান্তি নিকেতনে একটি সভা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় বাংলা ভাষার সপক্ষে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ একটি অনবদ্য প্রবন্ধ পাঠ করেন। এছাড়াও বাংলার বহু লেখক বুদ্ধিজীবী বাংলা ভাষার মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্নভাবে লেখা ও বক্তৃতা-ভাষণের মাধ্যমে চেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন। এভাবেই হাঁটি হাঁটি পা ফেলে চলছিল বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠার এক অমোঘ আন্দোলন।

দিন বদলের সাথে সাথে প্রচণ্ড গতিতে দুর্বার হয়ে উঠছিল কোটি বাঙালির ভেতরের সুপ্ত স্বপ্নগুলো। তারই এক অধ্যায় এলো ১৯৪৭ সালের ১৪আগস্ট। এই দিনে ইংরেজ বেনিয়া শোষকদের শোষণের নাগপাশ মুক্ত হয়ে আমরা পেলাম একটি অদ্ভূত ফেডারেল রাষ্ট্র। পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান নামে দু’টি প্রদেশ নিয়ে গঠিত হলো এই অদ্ভূত ফেডারেল রাষ্ট্র, যার নাম পাকিস্তান। মূলত এতে পশ্চিমারাই ছিল শাসনকর্তা। তাদের স্বৈরাচারি মনোভাব দেখে আমাদের পূর্ব বাংলার লেখক-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রসঙ্গটি আবার প্রচণ্ডভাবে সামনে চলে এলো। শুরু হলো আন্দোলন। ব্যক্তি থেকে পরিবার এবং সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়তে থাকলো ভাষার দাবি।

আমরা জানি যে, ইংরেজ শাসনামলে এদেশে চেষ্টা চলেছিল রাষ্ট্রভাষা হিন্দি করার জন্য। আবার পাকিস্তান অর্জিত হবার পর পশ্চিম পাকিস্তান চেষ্টা চালালো উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য। অথচ জন্ম নিয়েই আমরা যাদেরকে দেখি তাদের ভাষা বাংলা। আমরা কথা বলি, ভাব বিনিময় করি সে কেবল বাংলাতেই। তবে কেন বাংলা ছাড়া অন্য ভাষা এখানে রাষ্ট্রভাষা হবে?

প্রশ্নটি ছিল যুক্তিসঙ্গত। ফলে বাংলাভাষার দাবিকে পশ্চিম পাকিস্তান তুচ্ছজ্ঞান করলেও আন্দোলনের অব্যাহত গতিকে তারা থামিয়ে দিতে পারলো না। তারা যতই বাঁধার সৃষ্টি করতে থাকলো, ততোই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে শুরু করলো আন্দোলনের গতি। সুতরাং পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই পূর্ব বাংলায় জ্বলে উঠলো বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে এক প্রচণ্ড অগ্নিস্ফূলিঙ্গ। যদিও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই সোচ্চার হয়ে ওঠে বাংলাভাষার দাবি। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, মাওলানা আকরম খাঁ, আবুল মনসুর আহমদ, কবি ফররুখ আহমদ প্রমুখ সুধীজন বাংলার সপক্ষে লিখতে ও বলতে শুরু করেন।

১৯৪৭ সালের ১সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে গঠিত হয় পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস। এই প্রতিষ্ঠানই সর্বপ্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলে। তারাই প্রথমত উন্মোচন করে ভাষার দাবিতে সংগ্রামের উত্তপ্ত পথ। সুতীব্র বাতাস বয়ে চলে দেশের ছাত্র-শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবীর চেতনায়।

১৯৪৭ সালের ১৫সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস প্রকাশ করে বাংলাভাষা আন্দোলনের প্রথম পুস্তিকা। নাম “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু ?” এটি সম্পাদনা করেন প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম। এই পুস্তিকায় লিখেছিলেন অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, ইত্তেহাদ সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ ও আবুল কাসেম। তাদের লেখায় প্রমাণ করা হয় যে, বাংলা ভাষা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হবার উপযুক্ত। সুতরাং বাংলাই হবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা।

এই কুস্তিকা প্রকাশের পর- রাষ্ট্রভাষা বাংলার সপক্ষে বিপুল জনমত গড়ে তুলতে তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে এক স্বাক্ষরতা অভিযান পরিচালিত হয়। দেশের বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদসহ বহু ব্যক্তি এতে স্বাক্ষর করেন। মেমোরেন্ডামের একটি কপি সরকারের কাছে পেশ করা হয়। আর তার অন্য কপি পত্র-পত্রিকায় দেয়া হয় প্রকাশের জন্য।

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে আরো সোচ্চার ও বলিষ্ঠ করার জন্য একটি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর নূরুল হক ভূঁইয়া। প্রথমদিকে কিছুটা গোপনে। পরে অবশ্য প্রত্যক্ষ ও জোরালোভাবেই কাজ চলেছে। তখন তাদের কোনও ভয়ই আর বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি।

১৯৪৭ সালের ১৭নভেম্বর তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করা হয়। এতে উল্লেখ করা হয় যে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু নয়, বরং বাংলাই হতে হবে।

এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় প্রথম সংঘর্ষ বাধে ১২ডিসেম্বর ঢাকার পলাশী ব্যারাকে। এই দিনে বাংলা বনাম উর্দু বিতর্কে বাঙালি ও অবাঙালি কেরানীদের মধ্যে সংঘষের্র সৃষ্টি হয়। সংঘর্ষ এক পর্যায়ে তীব্রতর হয়। এতে ২০জন আহত এবং ২জন নিহত হয়। এর প্রতিবাদে ১৩ডিসেম্বর ছাত্র ও সেক্রেটারিয়েট কর্মচারীরা ধর্মঘট করে। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার লক্ষ্যে ঢাকা শহরে ১৫ দিনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।

পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ১১মার্চ রাষ্ট্রভাষার দাবি নিয়ে সংগ্রামের শুরু হয় নতুন আমেজে। কমরেড মোহাম্মদ তোয়াহা এ ব্যাপারে বলেছেন, ১৯৪৮-এর ১১মার্চই ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম সংগঠিত গণবিক্ষোভ। আর কামরুদ্দীন আহমদ বলেছেন, “এ আন্দোলন তৎকালীন সরকারকে রাষ্ট্রভাষার সপক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছিল। অথচ রক্ত দিয়েও ৫২ সালে সরকারকে টলানো যায়নি। ভাষার দাবি উঠাবার নৈতিক বল যতটুকু এসেছিল তা ১১ই মার্চের চুক্তির ফলে সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ চুক্তি লংঘিত হয়েছিল বলেই ৫২ সালের আন্দোলন মূলত ২১, ২২, ২৩ এবং ২৪শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত উত্তপ্ত ছিল। এরপর পুলিশী ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকার এটাকে তছনছ করে দেয়।”

১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন। সফরকালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনিসিয়াম মাঠে এক ছাত্র সভায় ভাষণ দেন। ছাত্রদের পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু)’র পক্ষ থেকে রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবি-সম্বলিত একটি গুরুত্বপূর্ণ মেমোরেন্ডাম পাঠ শেষে লিয়াকত আলী খানকে প্রদান করা হয়।

লিয়াকত আলী খান তার বক্তৃতার এক পর্যায়ে বলেন, It is not provincialism, then what is provincialism? তাঁর এ কথাগুলো শুনে মনে হয়েছিলো, তিনি হয়তো রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখবেন। কিন্তু না, তিনি কিছু বলেননি। গোটা প্রসঙ্গটাই এড়িয়ে যান।

১৯৫২ সালের ২৬জানুয়ারি পল্টনের এক জনসভায় খাজা নাজীমুদ্দিন পুনরায় ঘোষণা করেন, “উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে।” তার এই ঘোষণা ছিল ৪৮ সালের ১৫মার্চে গৃহীত রাষ্ট্রভাষা চুক্তির সরাসরি খেলাফ। ফলে তার এই ঘোষণার প্রতিবাদে ৩০জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

একই দিন বিকালে বার লাইব্রেরি হলে ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতা ও সংস্কৃতিকর্মীদের এক বৈঠকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য ৪০জনের অধিক সদস্য নিয়ে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ। এর আহ্বায়ক নিযুক্ত হন কাজী গোলাম মাহবুব। এই কর্মপরিষদের উদ্যোগে ৪ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ ঢাকা শহরে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা বিক্ষোভ মিছিল করে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক প্রতিবাদ সভায় মিলিত হয়। এই দিন বিকালে কর্মপরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় এক জনসভা। সভায় মাওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম ও অন্যান্য রাজনীতিক ও ছাত্রনেতা লীগ সরকারের চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের নিন্দা করেন। তারা বাংলা ভাষার দাবি সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। আরও ঘোষণা করা হয় যে, ২১ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট পালিত হবে। কিন্তু স্বৈরাচারি পাক সরকার ২০ফেব্রুয়ারি রাত থেকে পরবর্তী এক মাসের জন্য ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সকল প্রকার ধর্মঘট, সভা, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

ফলে সাহসের সাথে সামনে এগুবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন নেতৃবৃন্দ। সিদ্ধান্ত নিলেন, যে কোনও মূল্যে ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে। এবং ২১ফেব্রুয়ারি প্রচ- কর্মসূচি পালিত হবে।

সে হিসেবে ২১ফেব্রুয়ারি ঘন কুয়াশা ঘেরা সকালে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-ছাত্রীরা দলে দলে জমায়েত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায়। বিপুল সংখ্যক উপস্থিাতির এই সমাবেশে সভাপতিত্ব করলেন ভাষা সৈনিক গাজীউল হক। দুপুর প্রায় সাড়ে বারোটায় সমাবেশ শুরু হলে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের শপথে সংগ্রামী ছাত্র-ছাত্রীরা উত্তাল হয়ে ওঠেন। চলতে থাকে ক্রমাগত প্রতিবাদী শ্লোগান এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রচেষ্টা। ছাত্র-ছাত্রীদের সংগ্রামের উত্তাল সমুদ্রের গর্জনে কেঁপে ওঠে শাসকের ভিত। দিশা না পেয়ে তারা পুলিশকে নির্দেশ দেয় গুলির। বিক্ষুব্ধ মিছিলের ওপর পুলিশের নির্বিচার লাঠি চার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও গুলিতে মুহূর্তই রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠলো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। মাটিতে ঢলে পড়লেন শফিক, সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সালাউদ্দিনসহ অনেকেই। আর এভাইে তাঁদের রক্তের আঁখরে লেখা হলো ২১ফেব্রুয়ারি।

এই সব মহান শহীদের তাজা খুনের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আমাদের বাংলা ভাষার মর্যাদা। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা এবং একই সাথে রাষ্ট্রভাষা।

কিন্তু পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনের এই ইতিহাসকে একটি বিশেষ মহল বিকৃত করতে শুরু করে। বাংলা ভাষা নিয়ে যেমন ছিনিমিনি খেলা হয়েছে, তেমনি ভাষা আন্দোলন ও ভাষা সৈনিকদের ইতিহাস নিয়েও চলছে এক ধরনের ঘৃণ্যতম ষড়যন্ত্র। প্রকৃত ভাষা সৈনিকদের আড়ালে রাখার এটা একটা ন্যক্কারজনক কূটকৌশল। সেইসাথে এমন অনেককেই ভাষা সৈনিক বানানো হয়েছে যারা বিতর্কিত। ভাষা আন্দোলনের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে এধরনের নিষ্ঠুর পরিহাস জাতির জন্য সত্যিই লজ্জার বিষয়! এ সম্পর্কে ভাষা সৈনিক এম. শামসুল আলমের (১৯২৬-১৯৯৪) বক্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত কিভাবে হয়েছিলো এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন : “ভাষা আন্দোলনের একুশে ফেব্রুয়ারির গুরুত্ব অপরিসীম। তাই বলে ভাষা আন্দোলনকে বায়ান্নোর একুশের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা উচিত হবে না। এই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ‘৪৭ থেকে। এমনকি দেশের শিক্ষাবিদগণ রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নটি বিভিন্নভাবে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কিন্তু কোন নির্দিষ্ট কর্মপন্থা এবং সংগঠন না থাকায় ভাষার প্রশ্নটি একটি আন্দোলনের রূপ পেতে পারেনি। এই দুরূহ কাজটি করতে এগিয়ে এসেছিলো ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামে একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান; ১৯৪৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাসেম ও অন্যান্য কয়েকজন অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রের উদ্যোগে এই মজলিস গঠিত হয়। তবে অধ্যাপক আবুল কাসেমই মূল উদ্যোক্তা ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ‘৪৮-এর এগারই মার্চের আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। সত্যি বলতে কি, এগারই মার্চের আন্দোলন না হলে, বায়ান্নোর আন্দোলন হতো না। এগারই মার্চ রাষ্ট্র ভাষার দাবি নিয়ে যে সংগ্রাম শুরু হয় বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারীতে তা পূর্ণতা পায়। বস্তুত’৪৮-এর এগারই মার্চ ছিলো ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম সংঘাত ও গণ বিক্ষোভ এবং এরই ফলশ্রুতিতে তৎকালীন সরকার বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। কাজেই বলা যায়, ভাষার দাবি উঠাবার নৈতিক বল যতটুকু এসেছিল, তা এগারই মার্চের চুক্তির ফলে সৃষ্ট। আর এই চুক্তি সংগঠিত হয়েছিল বলেই বায়ান্নোর আন্দোলনের সূত্রপাত্র।”

ইতিহাসের পাতায় দৃকপাত করেলে আমরা দেখতে পাই যে, বাংলা ভাষা নিয়ে যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে, সেই ষড়যন্ত্র আর কূটিলতার ঘূর্ণিপাকে এখনো সমান দোল খাচ্ছে আমাদের এই প্রিয়ভাষা বাংলা ভাষা। আমাদের হীনমন্যতা, অসচেতনতা, সম্যক উপলব্ধির অভাব এবং আত্মিক ও নৈতিক অধঃপতনের কারণে বাংলা ভাষা এবং ভাষা আন্দোলনের সঠিক চিত্রটিও আজ পর্যন্ত স্পষ্ট হতে পারলো না! এই ব্যর্থতা ঘুচাতে এখন জরুরি হয়ে পড়েছে সত্যানুসন্ধানী গবেষক ও ইতিহাসবিদদের এ ব্যাপারে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের জন্য এগিয়ে আসার।

বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস প্রণয়ন সম্পর্কে রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খান বলেন : “না, ভাষা আন্দোলনের শুদ্ধ ইতিহাস লেখা হয় নাই। শিল্পী সাহিত্যিক যারা একুশের পদক লাভ করেছেন, তাদের উচিৎ এ বিষয়ে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তা ছাড়া যারা অংশগ্রহণ করেছেন কিংবা প্রত্যক্ষদর্শী তারাও এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন।”

ভাষা আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব সম্পর্ক তিনি বলেন : “মূল নেতৃত্বের অনেকেই একদম বাদ পড়ে যাচ্ছেন ভাষা আন্দোলনের ইতিবৃত্ত বর্ণনাকারীদের হাতে। পক্ষান্তরে যাদের কোন উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল না তারা অনেকেই আজ প্রথম সারিতে এসে স্থান দখল করেছেন। প্রত্যেকেই নিজ নিজ মতবাদী লোকদের ঠেলে উপরে তুলে দিচ্ছেন। সত্যিকার যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের উল্লেখও নাই।... অনেকেই তখন জন্মগ্রহণ করেননি। ঘটনার কথা লোকমুখে শুনে কিংবা ভুল তথ্যের উপর নির্ভর করে বিকৃত ইতিহাস সৃষ্টি করার প্রয়াস পাচ্ছেন। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন বহু সংখ্যক লোক। নেতৃত্ব দিয়েছেন অপেক্ষাকৃত অনেক কম সংখ্যক লোক। বিদ্বেষবশত এদের অনেকেকেই ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বাইরে। তাদের অনেককেই কেউ আজ চেনে না। দুই এক যুগ পর আর সত্যিকার নেতৃত্বের খোঁজও পাওয়া যাবে না। ভূঁইফোঁড়েরাই তখন জায়গা দখল করে দাঁড়িয়ে থাকবে।”

ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিত এবং তার ইতিহাস সম্পর্কে বিচারপতি আবদুর হমান চৌধুরী বলেন :

“১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন ছাত্র হিসাবে আমি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলাম। তাছাড়া আমি ছিলাম সলিমুল্লাহ হল ইউনিয়নেরও সহ-সভাপতি। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙ্গালী হিসাবে আমাদের স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্য, নিজস্ব, ভাষা, কৃষ্টির প্রতিষ্ঠা করাই ছিলো বাঞ্ছিত লক্ষ্য ও উল্লেখ্য।”

ভাষা আন্দোলনের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে তাঁর অভিমত হলো : “ভাষা আন্দোলনের বৃহত্তর লক্ষ্য ছিল মানুষের সত্যিকারের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নিশ্চিত করা যা আজ পর্যন্ত অর্জিত হয়নি।”

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস প্রণয়ন সম্পর্কে তিনি বলেন : একই পটভূমির উপর ভাষা সৈনিক প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম বলেন : “১৯৪৮ সনের ভাষা আন্দোলনে সরকারের সংগে ভাষা সংগ্রাম কমিটির যে ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তাতে বাঙলা অফিস আদালতের ভাষা ও সর্বস্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে স্বীকৃতি পায়। তার বহুদিন পর ১৯৫৬ সনেও পাকিস্তানের সংবিধানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার প্রতিষ্ঠা লাভ ঘটে।

ভাষা আন্দোলনের ফলে কাগজে-কলমে বাঙলা শিক্ষার মাধ্যম, আইন-আদালতের ভাষা ও রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করল বটে, কিন্তু প্রতি বছর ভাবপ্রবণতার মধ্যে মহাসমারোহে একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালন সত্ত্বেও পাকিস্তান আমলে এমনকি যুক্তফ্রন্টের আমলেও এই স্বীকৃতিকে কার্যকরী করার কোন লক্ষণ দেখা যায় নাই। ’৪৮-এর আন্দোলনের ফলে প্রতিষ্ঠিত বাংলা একাডেমিতে এবং আইন সভার কার্যক্রম ও কার্যবিবরণীও ইংরেজীতে পরিচালিত হত। বাংলা একাডেমির কার্যকরী সংসদের সদস্য হিসাবে আমি এই প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় বাঙলার মাধ্যমে কাজকর্ম পরিচালনার প্রস্তাব পাস হয়। ১৯৫৪ সনে আমি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলাম। তখন বারবার চেষ্টা সত্ত্বেও আইন সভার কার্যবিবরণী বাংলায় পরিচালনা করতে ব্যর্থ হওয়ায় যুক্তফ্রন্টের নেতাদের অনিচ্ছা ও বাধা সত্ত্বেও ১৯৫৬ সনের সেপ্টেম্বর মাসে অবিলম্বে সর্বস্তরে শিক্ষার মাধ্যম ও সরকারী ভাষা হিসাবে বাংলাকে চালু করার আমার প্রস্তাব আইন সভায় সর্বসম্মতিক্রমে পাস করাতে সমর্থ হই। অবশ্য এর সাথে ১৯৫৪ সনে শেরে বাঙলা ফজলুল হক ও মাওলানা ভাসানীর মুখবন্ধ সমৃদ্ধ “একুশ দফার রূপায়ণ” নামক আমার বইটিতে সর্বস্তরে বাংলাকে চালু করার সমস্যা ও তার সমাধান প্রদর্শন করেছিলাম। এতকিছু সত্ত্বেও শিক্ষা বিভাগ কিংবা অফিস-আদালতে বাংলা চালু না হওয়ায় বহু চিঠিপত্র ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সরকারের কাছে রাষ্ট্রভাষারূপে বাঙলাকে সর্বত্র চালু করার জন্য তাগিদ দিতে থাকি। তাছাড়া ১৯৪৯ সন থেকে আমার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র ‘সাপ্তাহিক সৈনিকেও’ এজন্য বারবার কঠোর সমালোচনা করে সর্বত্র বাংলা প্রচলনের দাবি জানাতে থাকি।

মন্ত্রীসহ সরকারী মহল যে সময় বাংলাকে সর্বস্তরে শিক্ষার মাধ্যম ও রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চালু করার অনুপযুক্ততা আলোচনা করে বলতেন : বাঙলায় তো এখনো পর্যন্ত উচ্চতর ক্লাসগুলো বিশেষ করে বিজ্ঞানের উপযুক্ত পাঠ্য বইও রচিত হয় নাই; এ ছাড়া টাইপ রাইটিং ও টেলিপ্রিন্টিং-এর মত অত্যাবশ্যকীয় কাজে বাঙলাকে সঠিকভাবে চালু করা যায় না। সেই সংগে তারা উপযুক্ত পরিভাষার অভাবের কথাও উত্থাপন করতেন। তার উত্তরে আমি মাতৃভাষা চালুর ব্যাপারে বিদেশের উদাহরণ ও অন্যান্য যুক্তি দিয়ে তাদেরকে বুঝাবার চেষ্টা করতাম : বৈজ্ঞানিক বিষয়সহ সবকিছু দৈনিক পত্র-পত্রিকায় বাঙলায় রিপোর্ট আকারে প্রকাশের ক্ষেত্রে পরিভাষার সমস্যা দেখা দেয় না; কলেজ হাসপাতাল, আওয়ামী লীগ, ইত্তেফাক, অক্সিজেন, টেবিল, চেয়ারসহ হাজার হাজার অন্য ভাষার শব্দ যে বাংলা ভাষার শব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে তো বাংলাকে সমৃদ্ধই করছে। আর সহজ-সুন্দর বাংলা প্রতিশব্দ না থাকলে যে বিদেশী শব্দকে সহজরূপে বাংলায় ব্যবহার করা উচিত, সে যুক্তি প্রদর্শন করে বলতাম : আপনাদের ওসব খোঁড়া যুক্তি দিয়ে বাংলা প্রচলনকে বাধা দেয়া কোনমতেই উচিত নয়। কিন্তু আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ও উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের যুক্তির ব্যবহারিক প্রমাণ না থাকায় মন্ত্রী ও সরকারী আমলারা তাকে আমল দেয়া সংগত মনে করতেন না।”

ভাষা সৈনিক নূরুল হক ভূঁইয়া ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস প্রসঙ্গে বলেন :

“ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সঠিকভাবে লিখিত হয় নাই। এ কথা মনে রাখতে হবে যে, ১৯৪৭-৪৮ সনের আন্দোলনে যে সমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্রপাত ও সুদূরপ্রসারী সফলতা অর্জিত হয়, তাকে সঠিকভাবে প্রতিফলিত করা হয় নাই। আমি এখানে ১৯৪৭-৪৮ সালের আন্দোলনের সাথে ১৯৫২ সালের আন্দোলনের একটা তুলনামূলক বিবরণ দিচ্ছি।

(ক) ১৯৪৭-৪৮ সাল। বদরুদ্দীন উমর লিখিত “পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি” নামক পুস্তকের বিবরণ অনুযায়ী ১৯৪৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ছাত্র ও অধ্যাপকের উদ্যোগে তমদ্দুন মজলিস নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। (২) ১৫ই সেপ্টেম্বর তারা “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু” এই নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। (৩) ১লা অক্টোবর প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক নিযুক্ত করা হয়। সেই মাসে ফজলুল হক হলে এ ব্যাপারে এক বিরাট সভা অনুষ্ঠিত হয়। (৪) ৬ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সাধারণ ছাত্র-সভা অনুষ্ঠিত হয়। (৫) ৭ই ডিসেম্বর রেল কর্মচারীদের সভায়, এ. কে. ফজলুল হককে সভাপতি করার ব্যাপারে বাঙ্গালী-অবাঙ্গালীদের মধ্যে দারুণ গণ্ডগোল হয়। (৬) ১২ই ডিসেম্বর ভাষা আন্দোলন বিরোধিরা পলাশী ব্যারাক ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে এসে ছাত্রদের লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ও কয়েক রাউণ্ড গুলী ছুঁড়ে। এর প্রতিকার দাবিতে এক বিরাট মিছিল মন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করতে সেক্রেটারিয়েট যায় এবং মন্ত্রী আবদুল হামিদ ও সৈয়দ আফজলের সমর্থন আদায় করে। (৭) ১৩ই ডিসেম্বর সেক্রেটারিয়েট কর্মচারীরা পূর্ণ হরতাল পালন করেন। সেদিন থেকে ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। (৮) ২৩শে ফেব্রুয়ারী ’৪৮ পাকিস্তানের গণপরিষদে উর্দুর সংগে বাংলাকে পরিষদের ভাষা করার ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের প্রস্তাব বাতিল হয়। ফলে (৯) উক্ত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ২৬শে ফেব্রুয়ারী ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছাত্র ধর্মঘট পালন করা হয়। (১০) ২৬শে ফেব্রুয়ারী তমদ্দুন মজলিসের ডাকে পূর্ব পাকিস্তানের ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালন ও ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়। সে দিনই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপে বহু ছাত্র-জনতা আহত হয় এবং কিছু সংখ্যক লোককে জেলে প্রেরণ করা হয়। এই বিক্ষোভ ও গ্রেফতারের সংবাদ পেয়ে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীগণ তমদ্দুন মজলিসের সংগে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে আসেন। (১১) ২রা মার্চ ফজলুল হক হলে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। (১২) ১১ই মার্চ সমগ্র পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ঢাকায় পুলিশের সংগে ছাত্র জনতার তীব্র লড়াইয়ে গুলী, লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও পুলিশের অত্যাচারে ২০০ আহত ৯০০ জন ধৃত ও ৬৯ জনকে জেলে বন্দী করা হয়। (১৩) ১২ থেকে ১৫ই মার্চ পর্যন্ত ঢাকা ও অন্যত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে পূর্ণ হরতাল পালন করা হয়। (১৪) ১৫ মার্চ সংগ্রাম পরিষদের সাথে তথ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন সাহেবের ৮ দফা ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। (১৫) উক্ত দিনে ছাত্র-জনতার এক বিরাট মিছিল জগন্নাথ হলে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের সভার দিকে পুলিশের বেরিকেড ভেদ করে অগ্রসর হয় ও পরে উক্ত চুক্তির কথা জানতে পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। (১৬) ১৯শে ’৪৮ মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিরাট জনসভায় জিন্নাহ সাহেব রাষ্ট্রভাষা ‘উর্দু হবে’ বলায় বিভিন্ন দিক থেকে নানা প্রতিবাদ ধ্বনি উচ্চারিত হয়।

২৪শে মার্চ কার্জন হলেও জিন্নাহ সাহেবের বক্তব্যের প্রতিবাদে ‘নো’ ‘নো’ ধ্বনি উচ্চারিত হয়।

এরপর ১৯৪৯ এবং ৫১ সালে ১১ই মার্চ দিনটি রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। বস্তুত নাজিমউদ্দিন সাহেব চুক্তির ৩নং দফায় পরবর্তী প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভায় “বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপনের” অঙ্গীকার করায় ভাষা আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে।

এই চুক্তিতে ২৯শে ফেব্রুয়ারী ’৪৮ থেকে ভাষার প্রশ্নে গ্রেফতারকৃত সকলকে মুক্তিদান অর্থাৎ আমাদের সকল দাবি মেনে নেওয়ায় ছাত্র-জনসাধারণ অনেকটা স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে। বস্তুত এ ছিল এক অনন্য বিজয়। এ ব্যাপারে তৎকালে কলকাতার আবুল মনসুর আহমদ সাহেবের “ইত্তেহাদ” পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পকদীয় নিবন্ধ থেকে আন্দোলনের প্রমাণ মিলে। তিনি লিখেছিলেন : “যে বিরাট শক্তি ও দুর্জয় বিরোধিতার মধ্যে সংগ্রাম করিয়া বাংলা ভাষা আন্দোলনকারীগণ যে সাফল্য লাভ করিয়াছেন তাহা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকিবে।”

১৯৪৭-৪৮ সালের উপরোক্ত আন্দোলনের সাথে ১৯৫২ সনের আন্দোলনের তুলনা করা যাক।

(খ) ২৬শে জানুয়ারী ’৫২ নাজিমুদ্দিন সাহেব পল্টন ময়দানে আবার ঘোষণা করলেন যে উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, এরপর-

(১) বার লাইব্রেরীতে ৩০ শে জানুয়ারী ’৫২ সর্বদলীয় সম্মেলনে পুনরায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং কাজী গোলাম মাহবুব এর আহ্বায়ক নিযুক্ত হন। এই সভায় ‘২১শে ফেব্রুয়ারী প্রতিবাদ দিবস’ পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। (২) ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ’৫২ স্কুল কলেজ ধর্মঘট পালিত হয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ সভা হয়। (৩) ১২ই ফেব্রুয়ারী পতাকা দিবস পালন করা হয়। (৪) ১৯শে ফেব্রুয়ারী ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। ২০শে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারী হয়। সেই দিন সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু পরদিন ২১শে ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ হয় ও পুলিশ গুলী বর্ষণ করে। এ গুলী বর্ষণে সেদিন ও পরের দিন রফিক, বরকত, জব্বার ও সালামসহ কয়েকটি অমূল্য প্রাণ শাহাদাত বরণ করেন। উপরোক্ত ঘটনায় স্পষ্টই বুঝা যায় যে ১৯৪৭-৪৮ সনের ৬-৭ মাসের আন্দোলনের ইতিহাস কত ঘটনাবহুল এবং কি বিরাট সাফল্য অর্জন করেছিল। অন্যদিকে, ১৯৫২ সনের আন্দোলনে শুধু ২১শে ফেব্রুয়ারী ছাড়া বিরাট আন্দোলন বা ঘটনাবহুল দিন নেই। ঐদিন ছাত্র-জনতার বিক্ষুব্ধ মনোভাব যা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে ও পরে শহীদের রক্তে বিস্ফোরণ ঘটে। কাজেই আসল আন্দোলন ছিল ১৯৪৭-৪৮ সনে এবং তাই-ই পরিণতি পায় ১৯৫২ সনের কয়েক দিনের আন্দোলন ও ২১শে ফেব্রুয়ারীর বিস্ফোরণের মাধ্যমে। তবে একথা বলে আমি ‘৫২-এর আন্দোলনকে অবশ্যই ছোট করতে চাইছি না। বস্তুত ’৫২-এর আন্দোলনের ফলেই বাংলা রাষ্ট্রভাষা হয়েছিল। কিন্তু উল্লেখ্য ইতিহাসে ১৯৪৭-৪৮ সালের আন্দোলনের গুরুত্বকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় নাই। এ ব্যাপারে সেদিনের আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্য নিয়ে সঠিক ইতিহাস রচনা করা আজো সম্ভবপর।”

১৯৪৭ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিসের প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ নামক বইটিতে ২নং প্রস্তাব ছিল ‘পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রভাষা হবে দু’টি : বাংলা ও উর্দু।”

ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে নূরুল হক ভূঁইয়ার একটি স্মৃতি এ রকম : “দু’একটা ঘটনা আজও খুব মনে পড়ে। যেমন ১৯৪৮ সনের ১৯শে ফেব্রুয়ারী বেলা ১১ টার দিকে যখন পুলিশ হরতালকারী ছাত্র-জনতাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের (বর্তমান মেডিকেল কলেজ) পূর্ব গেটের সম্মুখে লাঠিপেটা করে গ্রেফতার করছিল তখন জনৈক রাজনৈতিক নেতা (পরে বার্মার রাষ্ট্রদূত) তার কয়েকজন সঙ্গীসহ ঘোড়ার গাড়ী থেকে লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় নামছিলেন। তখন আমি বলেছিলাম “আসুন অমুক সাহেব, গ্রেফতার হয়ে নেতা হওয়ার এই তো সুযোগ”। তখন তিনি বলেছিলেন “নূরুল হক সাহেব, আপনি একথা বললেন”? আমি বলেছিলাম “কি করব ভাই? ৪/৫ মাস ধরে তো বহু অনুরোধ করেছিলাম আমাদের সঙ্গে কাজ করতে, তখন তো আসেন নাই”? এতে উনার মুখ মলিন হয়ে যায়।”

ভাষা সৈনিক গোলাম মাহবুবের মতে : “ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি। ভাষা আন্দোলনের যে সমস্ত ঐতিহাসিক দলীল রয়েছে, যেসব ঘটনা ঘটেছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে নিরপেক্ষভাবে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে হবে। যাদের যে ভূমিকা ছিল তাদের সে সম্মান দিতে হবে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে গেলে মনে রাখতে হবে যে, এ দেশের মানুষ আন্তরিক আবেগ-অনুভূতি নিয়েই আন্দোলনে নিবেদিত হয়েছিল দলমত নির্বিশেষে তারই ফল হলো ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন যা আমাদের জাতি সত্তার বিকাশে মূল চালিকাশাক্তি হিসাবে কাজ করেছে এবং প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারী উদযাপনের মাধ্যমে এ চেতনাকে ধরে রাখার একটি প্রয়াস চলছে।

দু:খের বিষয়, ভাষা আন্দোলনের যে কয়টি ইতিহাস বা দলিল প্রকাশিত হয়েছে তা পড়লে আমাদের বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়।”

ভাষা সৈনিক ও সাংবাদিক সানাউল্লাহ নূরী বলেন : “১৯৪৭ সালের শেষের দিকে বাংলা ভাষা আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে এবং ১৯৪৮ সালে এটি গোটা বাংলাদেশে (তদানীন্তন পাকিস্তান) ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে স্কুল, কলেজে ধর্মঘট, ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় হরতাল এবং তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান আইনসভা অফিস ঘেরাও হয়। ১৯৪৮ সালে হাজার হাজার ছাত্র, শিক্ষক, রাজনৈতিক কর্মী হরতালের সময় পিকেটিং, মিছিল জনসভা করাকালে কারাবরণ করেন। ঐ সময় কেন্দ্রীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। যার আহ্বায়ক ছিলেন নূরুল হক ভূঁইয়া। ১১ই মার্চকে বাংলা ভাষার প্রতিবাদ দিবস হিসাবে সারা দেশব্যাপী আন্দোলন সূচিত হয়েছিলো। তারই প্রেক্ষাপটে ১১ই মার্চকে ভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৫২ পর্যন্ত এই ১১ই মার্চ ভাষা দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছিলো।”

সঙ্গতকারণেই একথা আজকে বুক চিতিয়ে বলতে হচ্ছে যে, ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাসকে বিকৃত করতে চাইলেও সেটা সম্ভব নয়। মিথ্যার অন্ধকার থেকে সত্য উদ্ভাসিত হবেই হবে। আমাদের দায়িত্ব হলো সামগ্রিক চৈতন্যবোধকে আরো শাণিত করা এবং তাকে প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া।

ভাষার জন্যে সংগ্রাম করা আর জীবন দেবার ঘটনা এই পৃথিবীতে একটি বিরল ইতিহাস। এই ইতিহাসের স্রষ্টা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাদী লড়াকু, সংগ্রামী মানুষ। তারা বাংলা ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছে এবং অকাতরে নিজেদের জীবনকে বিলিয়ে দিয়ে বাংলা ভাষাকে এদেশে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে। একইসাথে জাতিগত বৈষম্য ও দুরাচারি শাসন-শোষণের শিকার হয়ে অবশেষে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ছিনিয়ে এনেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

বাংলা ভাষাকে তার আপন মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এদেশের মানুষ জীবনসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ভাষার জন্য এই সংগ্রাম ছিল অনিবার্য।

কিন্তু কি পেলাম? একটি রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে ভাষাকে আমরা স্বাগত জানিয়ে আপন বুকে স্থান দিতে চেয়েছিলাম, সেই বাংলা ভাষা এই দেশেই তৃতীয় ভাষা হিসাবে উঠোনে স্থান পেল।

কাগজে-কলমে বাংলা ভাষা এখন ‘রাষ্ট্রভাষা’ মর্যাদা পেলেও মূলত এটা আমাদের জন্য একটি মারাত্মক প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রতারণা বলছি এই কারণে যে, একদিকে আমাদের অফিস-আদালতে প্রচলিত রয়েছে ইংরেজী ভাষা। আর অন্যদিকে আমাদের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সম্রাটের মতো বসে আছে ‘সংস্কৃতর্নিভর বাংলা।’এই সংস্কৃত ভাষার দাপট এমনি যে, তার মধ্য থেকে আমাদের বাংলা ভাষাকে সনাক্ত করাই দুরূহ কাজ হয়ে পড়েছে। আমাদের শিশুদেরকে এখনো বর্ণজ্ঞান দিতে হয় বাংলা অক্ষরের সামনে-পেছনের সংস্কৃত শব্দ এবং বাক্যের মাধ্যমে।

একটি স্বাধীন দেশের ‘রাষ্ট্রভাষা’ যখন বাংলা, তখন সেই বাংলা ভাষারই এই করুণ অবস্থা দেখে বুকের ভেতর হু-হু করে কেঁদে ওঠাই স্বাভাবিক।

তাই আমরা মনে করি, বাংলা ভাষা এখনো শত্রুমুক্ত নয়। এখনো নিরাপদ নয়। তবু তো আমাদের থেমে থাকলে চলবে না। সকল অবাঞ্ছিত শত্রুতাকে পদদলিত করে বাংলা ভাষাকে তার আপন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এদেশের ঐতিহ্যপ্রিয় জাগ্রত বিবেকদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। সুপরিকল্পিত কর্মপন্থা এবং সুসংহত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এগুতে হবে। তবে তার জন্যে প্রয়োজন :  বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা থাকতে হবে এবং বিশ্বাস করতে হবে বাংলা ভাষায় যে অমূল্য রত্নভাণ্ডার আছে তা নগণ্য নয়; সমৃদ্ধ। আমাদেরকে বুঝতে হবে, রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং ভাষার স্বাধীনতা সমান গুরুত্বপূর্ণ।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top