সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

করোনাকালের গল্প - মিঁয়া-ও : আবিদা সুলতানা


প্রকাশিত:
১৭ এপ্রিল ২০২০ ০১:১৬

আপডেট:
২১ এপ্রিল ২০২০ ২১:৫৯

 

মিসেস আয়েশা বেগম ডাইনিং টেবিলে খাবারগুলো সাজিয়ে রাখলেন। চিকেন বিরিয়ানী, ডিমের কোরমা আর শসা-টমেটোর  সালাদ। সুন্দর করে খাবারগুলো টেবিলে সাজিয়ে রাখার পর আঁচলে হাত মুছতে যাচ্ছিলেন। তক্ষুণি মনে পড়ে গেলো এ সময়ের অনবরত সতর্কবানী,“পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকুন,সতর্ক থাকুন। মূহুর্ত দেরি না করে তিনি তাড়াতাড়ি বেসিনে লিকুইড সোপ দিয়ে  অনেকটা বেশি সময় নিয়ে হাত ধুযে নিলেন। 

“রাহাত,রাহাত, ছেলেকে বেশ কয়েকবার ডাকলেন। মিসেস আয়েশা বেগম আজ ছেলের পছন্দের খাবার রেঁধেছেন। বেশি আইটেম করেননি, দু’জন  মাত্র মানুষ...মা আর ছেলে! তাই রাহাতের পছন্দের চিকেন বিরিয়ানীকেই প্রাধান্য দিয়েছেন তিনি।

ডেকে ডেকেও ছেলে আসছে না দেখে,তিনি নিজেই ডাইনিং রুম থেকে ছেলের রুমের দিকে গেলেন। করোনা কালে “Work from home” করতে করতে ছেলেটাকে আরো বেশিই খাটতে হচ্ছে। দিন নাই রাত নাই ডেস্কটপ নিয়ে পড়ে আছে।

রাহাত বলে,“ডেস্কটপে কাজ করলে মনে হয় আমি অফিসে আছি, অফিসের ধরনটা হঠাৎ পাল্টে গেছে। অফিস আর বাড়ির এক যুগপৎ মোহময় আবহ তৈরি হয়েছে.. .. ..। 

“হয়েছে হয়েছে, বাড়ি বাড়িই, আর অফিস হচ্ছে অফিস, পাগল কোথাকার! কাজপাগল ছেলেটা বলেই চলে,“কম্পুটারটা না থাকলে মনে হতো, শুধু ঘুমিযে থাকি, আর তোমার সাথে বসে বসে গল্প করি। ফাঁকে ফাঁকে একটু টিভি দেখা। ছেলের কথায় হেসে উঠেন মিসেস আয়েশা বেগম। তাঁর মুখে মৃদু হাসি। আজ ছেলে খুশী হবে চিকেন বিরিয়ানী দেখে। রাহাতের ঘরের দরজার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন মিসেস আয়েশা বেগম। একি! বিশাল বড় একটা বিড়াল রাহাতের লাল গেঞ্জি আর হাফ প্যান্ট পরে বসে আছে কম্পিউটার টেবিলের চেয়ারে, এক মনে তাকিয়ে আছে  স্ক্রিনের দিকে! আয়েশা বেগম চোখ কচলালেন। উনি কি ভুল দেখছেন?
নাহ! চোখ কচলে হাতে চিমটি কাটার পরও দেখলেন বিড়ালটাকেই, রাহাতকে নয়।
“কতক্ষণ ধরে ডাকছি, শুনছিস না কেন রাহাত?” রলে অনেক উঁচু গলায় ডাকলেন ছেলেকে, যদি হ্যালুশিনেশন কাটে! তিনি আবারো জোরে চিৎকার করে উঠলেন,“রাহাত, এই রাহাত!
কিন্তু ঘোর লাগা তো কাটলোই না, উল্টো বিড়ালটা পাশ ফিরে একটু মুচকি হাসি দিয়ে বললো, “মিঁয়া-ও, মিঁয়া-ও! 
আর অমনি সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আয়েশা বেগম, জ্ঞ্যান হারালেন।

যখন তিনি চোখ মেলে তাকালেন, দেখলেন নিজের খাটের উপর শুয়ে আছেন। তার দিকে গভীর উদ্বেগ নিয়ে তাকিয়ে আছে রাহাত। আয়েশা বেগম এক সময় বলে উঠলেন,“তুই দূরে যা, তুই দূরে সরে যা, তুই রাহাত না, বিড়াল!

রাহাতের মুখে হাসি ফুটলো। সে হেসে ফেললো। মা’র কপালে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,“এই কথা! তুমি তাহলে আমাকে না দেখে বিড়াল দেখতে পেয়েছিলে?

“হ্যাঁ, ঠিক তাই, আয়েশা বেগম স্বগতোক্তি করে উঠলেন। তারপর উনি যা দেখেছিলেন রাহাতকে তা খুলে বললেন।

রাহাত হেসে বললো,“মা তুমি আরেক দিন টিভিতে সংবাদ শুনতে শুনতে চিৎকার করছিলে, করোনা আসছে, করোনা আসছে। বড় করোনা, ছোট করোনা, সব দলবল সহ ছুটে আসছে। 

রাহাত বলে চললো,“পরে তাকিয়ে দেখি,তোমার প্রিয় বিড়াল টুসি তার বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে হেলতে দুলতে তোমার দিকে এগোচ্ছে। সেদিন কিন্তু তুমি অজ্ঞান হয়ে যাওনি, মা। তাই কিছুক্ষণের মধ্যে তোমার ভুল ভেঙ্গে গিয়েছিলো।

রাহাত বেশ গভীর আবেগে মা’কে বুঝাতে থাকলো, এই কোয়ারেন্টাইন সময়ে তুমি আর আমি ছাড়া বাসায় আর কেউ নাই। আর আছে  তোমার প্রিয়  বিড়াল টুসী ও তার ছানাপোনারা। আমি বাসায়, তবে প্রায় সারাদিনই অফিসের কাজ নিয়ে থাকি। আর তুমি তোমার রান্নাবান্না ছাড়া বাকি সময় কাটাও বিড়ালগুলোর সাথে কিংবা টিভি দেখে। তাই তোমার সমস্ত জগৎ জুড়ে এখন আছে করোনা, বিড়াল আর বিড়ালছানা।

আয়েশা বেগম এবারে মাথা ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকালেন। বললেন,“ হ্যাঁ রে,আসল বিড়ালগুলো কই? ওদের দেখছি না তো!

“তোমার এই অবস্থায়, টেনশনে আমার মাথা খারাপ। এর মধ্যে ওরা এমন ম্যাঁও ম্যাঁও শুরু করলো যে রাগ করে ওদের সব কটাকে বারান্দায় আটকে রেখেছি।İ 

আয়েশা বেগম ছেলের কথা শুনে উঠে বসলেন।

তুই-ও অনেক জোরে মিঁয়া-ও করে উঠেছিলি, তা শুনেই তো জ্ঞান হারালাম! বলে হো হো করে হেসে উঠলেন তিনি। ছেলেও তার সাথে তাল মেলানো হাসি হাসতে হাসতে বললো, আমি একটু জোরেই বলে ফেলেছিলাম,“মা, মা আমি আসছি।

মা-ছেলের হাসির শব্দে মুখরিত হলো চারিদিক। করোনা কালের সে হাসিতে বিষন্ন প্রকৃতি কিছুটা হলেও স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেললো। কিছুটা হলেও বুকের বিষাদ ভার যেন হালকা হলো।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top