সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

গল্প - ঘরজুড়ে জ্যোৎস্না : সেলিনা হোসেন


প্রকাশিত:
২২ এপ্রিল ২০২০ ২১:০৬

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২০ ২১:১৭

সেলিনা হোসেন


ছোটবেলা থেকে শুনে আসা দোজখ সম্পর্কিত ধারণা শাজাহানের মনে গেঁথে আছে। এখনও ওর কাছের দুই নারীর চেহারায় দোজখ দেখতে পায় এবং ভাবলেই ওর মন থেকে দোজখের ভীতি একদম উবে যায়। ও স্বচ্ছন্দে নিজেকে অত্যন্ত পূত-পবিত্র ভেবে কবর খোঁড়ায় মনোযোগী হয়। ও ভাবে এ জায়গাটাই ওর জন্য বেহেশত।

সকালে একটা কবর খুঁড়েছে শাজাহান, ভেবেছিলো আর খুঁড়বে না, কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আর একটা লাশ এলো, আবার কোদাল হাতে নিতে হয়। আজ শরীর ভালো নেই, মনও খারাপ, থুতনির নিচে পাতলা দাঁড়ি বাতাসে ওড়ে। ও কোমরে হাত দিয়ে দু’পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে বড় করে শ্বাস নেয়, বুকের বাঁ দিকে সামান্য ব্যথা হচ্ছে। যে লাশটি এসেছে সেটি একটি ছোট বাচ্চার, জন্মের তিন দিনের মধ্যে মরেছে। সোজা হাসপাতাল থেকে মরা ছেলে কোলে নিয়ে চলে এসেছে বাবা। লোকটির যা বয়স তাতে এটি ওর প্রথম সন্তান হতে পারে, ইচ্ছে হয় জিজ্ঞেস করতে কিন্তু পরমুহূর্তে ভালো লাগে না। ওর মনে আছে ওর বারো বছর বয়সে ছোট একটি ভাই জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মারা গেলে ওর বাবা ওকে কলাপাতায় মুড়ে পুঁতে ফেলেছিল। ওর খুব কষ্ট হয়েছিল, এখনো সেই স্মৃতি খুব সজীব। ছোট্ট কবরটি খোঁড়া হয়ে গেলে মাটির গন্ধে ওর স্নায়ু নেতিয়ে আসে, পায়ের লম্বা ঘাস, লাল পিঁপড়ে কামড়ে দিয়েছে, ও তবু পা নড়াতে পারে না। দেখে তরুণ বাবা সন্তানকে কবরে নামিয়েছে। লোকটির মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখে ক্লান্তি, পরনে লুঙ্গি এবং ময়লা পাঞ্জাবি, শাজাহান ওর মুখে সন্তানের মৃত্যুর কোনো বেদনা খুঁজে পায় না। ওর ভালোই লাগে, বেশি কান্না দেখলে ওর শরীর খারাপ হয়ে যায়। ওর ভেতরে পবিত্র ভাব জাগে, কতো জনই তো আমার খোঁড়া কবরে শুয়ে থাকলো, নিজেকে একজন ভিন্ন ধরনের মানুষ মনে হয়। এসব শুনলে পূর্ণিমা মুখ বেঁকিয়ে বলতো, মানুষ না ভূত! রাতদিন কবরস্থানে থাকলে কেউ মানুষ থাকে? শাজাহান উত্তর দিত না, পূর্ণিমার গঞ্জনা নীরবে সইতো। আড়াল থেকে ওর মা ফোঁস ফোঁস করত, বউটা ছেলেটাকে ভেড়া বানিয়েছে। তারপর দুজনে বেধে যেত তুমুল। খিস্তি-খেউড় এবং অশ্লীল গালাগালিতে ঘরে তিষ্ঠানো অসম্ভব হয়ে যেত। ঘর ওর জন্য দোজখ। দুজনের মুখের রেখাগুলো সহস্র লিকলিকে সাপের মতো, চোখ আগুনের ভাঁটা। ও ভেবে পায় না এর তুলনায় দোজখের আগুন কি আরো প্রখর, দহন কি আরো তীব্র।

তরুণ বাবা ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলে, যাই। মুহূর্তে ওর বুক কেমন করে। দৃঢ় কণ্ঠে বলে, দুঃখ করবেন না, দুঃখ কিসের? এইসব শিশুরাই বাবা-মাকে বেহেশতে নিয়ে যাবে।

ছোটবেলায় শোনা কথাটা যুৎসই বলতে পেরে ওর ভালোই লাগে। তরুণ বাবা করুণ মুখে বলে, আমার তিনটি ছেলে জন্মের পরপরই মরে গেল। ও অনাবিল প্রশান্তিতে বলে, দুঃখ কী আমার তো একটি ছেলেও হয়নি। বুঝলামই না বাবা হওয়া কী?

লোকটি আর কথা না বাড়িয়ে নীরবে চলে গেল। ও ভেবে দেখল, শেষের কথাটায় ও নিজেকেই সান্ত্বনা দিয়েছে। এভাবেই বুঝি মানুষ আর একজনের ভেতর দিয়ে নিজের মধ্যে প্রবেশ করে। ও ভেজা কবরের পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। শিশুটির কাছে কি এখন ফেরেশতা এসেছে? হয় তো নয়, ওর আর পাপ-পূণ্য কি? ওতো বেহেশতের ফুল, সেই ফুলের গন্ধে চারদিক ম ম করছে, স্ফটিকের মতো পানির নহর বইছে, হাত বাড়ালেই আঙুর এবং বেদনা। শাজাহানের চোখে জল আসে, ও হাত দিয়ে মোছে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আজিমপুরের পুরোনো কবরস্থানের ওপর দিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনে। কিছুদিন পর পর ভেঙে ফেলা হয় কবরগুলো, আবার নতুন লাশ ঢুকে যায়, পড়ে থাকে হাড়গোড়। কতো মানুষ এখানে শুয়েছে। কতো? না শাজাহান সে হিসাব করতে পারবে না। মাথার ওপর একগাদা চিল ঘুরপাক খায়। ও হাঁটতে হাঁটতে পূর্ব কোণে বকুল গাছটার নিচে এসে বসে। খানিকটা দূরে একজন লোক হয়তো সাত কিংবা দশ দিন আগের একটি কবরের পাশে বসে দোয়া পড়ছে। শাজাহানের বুকে এখন আর কথা নেই। ও গাছের কাণ্ডে হেলান দেয়। মনে পড়ে ডাকাতির আসামি ওর বাবা বেশির ভাগ সময় এই কবরস্থানে এসে লুকিয়ে থাকত। এটাই ছিলো তার জন্য নিরাপদ আশ্রয়। মনে আছে ওর বছর দশ বয়সে পুলিশের তাড়া খেয়ে ওরা প্রায়ই সন্ধ্যার আগে খাওয়া-দাওয়া সেরে হাঁড়ি-সানকি পুকুরের ঘাটে ডুবিয়ে রেখে এখানে এসে লুকিয়ে থাকত। তখন চারিদিকে বসতি ছিল না, বেশির ভাগ জায়গাই ছিলো জঙ্গল। রাতের বেলা শিয়াল এসে মুখ শুঁকত। ওর বাবা হাতের কাছে লাঠি রাখত, সেটা দিয়ে তাড়া দিত, মুখে কোনো শব্দ করতো না। ও এখানে আসতে না চাইলে বলতো, বোকা ছেলে পুলিশের অত্যাচারের চাইতে এটা অনেক ভালো রে। সেই ভালোই তো শাজাহানের সয়ে গেলো, জীবিকাও কবরস্থান হলো এবং প্রিয় জায়গাও। ও ট্যাক থেকে বিড়ি বের করে জ্বালায়। দেখে লাশ ধোয়ানোর জায়গার কাছে ছাতিম গাছের নিচে বসে আছে ওর মা, বিড়ি ফুঁকছে, সারাক্ষণই প্রায় বিড়ি টানে, ধোঁয়ায় ঠোঁট জ্বলে গেছে। শাজাহান জানে ওর মা’র বয়স এখন আটষট্টি, ওর নিজের বায়ান্নো। মা’র হিসেব অনুযায়ী মা’র ষোলো বছর বয়সে ও হয়েছে, প্রথম সন্তান। এখন ওর মা’র মাথার চুল ছোট করে ছাটা, কালো কুচকুচে শরীর, চামড়ায় ভাঁজ পড়ে অসংখ্য রেখা তৈরি হয়েছে, কণ্ঠস্বর পুরুষালি। আড়াল থেকে কথা বললে চট করে বোঝা যায় না নারী না পুরুষ। অবশ্য ওর মা’র কাজকর্ম, কথাবার্তা শুনলে মহিলা বলে ভাবা কষ্ট, এটা শাজাহানের বন্ধুরা বলেছে। যতোদিন ঘরে পূর্ণিমা ছিল না, ততদিন সমস্যা ছিল না, এখন ঘর এক অসম্ভব ব্যাপার। ওর অন্য দুই ভাই বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে, কালেভদ্রে দু একবার আসে, মা’র জন্য কোনো টান নেই। আড়ালে ওকে বলে, এই দোজখে আর কতোকাল থাকবে? পালাও না কেন? শাজাহান বোকার মতো বলে, পালাই তো। ওরা অবাক হয়ে বলে, কোথায়? এই কবরস্থানে, ঘরে টিকতে না পেরে এখানে এসে শুয়ে থেকেছি কতো রাত। ভায়েরা মুখ খিস্তি করে, এটা পালানোর জায়গা হলো? তোরা বুঝবি না, এখানে এসে আমি সব ভুলে যাই। তোরা বেঁচে থেকে বেহেশত দেখিসনি। আমি দেখেছি। আমি আর পালাবো কোথায়?

ভেড়া একটা, ভায়েরা গালি দিয়ে চলে যায়, যেমন গালি দেয় পূর্ণিমা। ওর দারুণ শরীর, টানটান, মেদহীন, ধনুকের ছিলার মতো। শাজাহানের মনে হয় ওর শরীরের প্রতিটি অঙ্গ কথা বলে, ভুরু, চুল, নাক, ঠোঁট এবং তর্জনীর আলাদা ভাষা আছে। ও তর্জনী তুললেই শাহাজানের চোখ নূয়ে আসে এবং ভুরু নাচালে ওর বন্ধুদের দৃষ্টি প্রখর হয়, ওর বিচূর্ণ কুন্তল কপালে লুটালে কবরস্থানে অন্য লোকেরা চোখ ফিরাতে পারে না, ওর ঠোঁট নড়লে ওর মা’র মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।

 

 

শাজাহান একান্তভাবেই পূর্ণিমার বশ। তারপরও ওর জন্য ঘর নেই। ওর মা’র অহংবোধ আছে- ডাকসাইটে ডাকাতের বউ বলে। সেসব দিনের গল্প করতে ভালোবাসে। এই গল্প পূর্ণিমার পছন্দ নয়। ও শুনলে তেড়ে ওঠে। মেজাজ তিরিক্ষে, ছেলেপুলে হয়নি, লোকে বলে ও বাঁজা মেয়েমানুষ বলে এমন রগচটা। ওর মাও এই খোঁটা দেয়, তখন পূর্ণিমার পক্ষে ওর মেজাজ ঠিক করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। দড়াম করে এক লাথিতে উল্টে ফেলে ভাতের হাঁড়ি। ওর মা ছুটে এসে চুলের মুঠি চেপে ধরে। শুরু হয় দুজনের চুলোচুলি, তারস্বরে চিৎকার এবং অশ্রাব্য গালাগাল। আশেপাশের লোক জমে যায়। শাজাহান নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। এই কবরস্থানে শুয়ে থাকা মানুষগুলোর সঙ্গে ও একাত্মতা বোধ করে। কতোকাল আগে এখানে জঙ্গল ছিল, তারপর বসতি হলো, এ জায়গাটা ঠিক হলো মানুষের ঘুমের জন্য। আহ্ শান্তি, ও লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। আকাশের তারা দেখে, বাতাসের স্নিগ্ধ পরশ অনুভব করে, প্রিয়জনের স্মরণে কারো লাগানো হাসনাহেনা ফুলের গন্ধ বুক ভরে টেনে নিয়ে ও এই পৃথিবী থেকে চলে যেতে চায়। ও আকুল হয়ে মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা করে। ও জানে এরপর ঘরে ফিরলে মা বলবে, একটা হারামজাদা ছেলে পেটে ধরেছি। মা’র জন্য একটুও দরদ নেই। পূর্ণিমা তখন রাস্তার মোড়ের দোকানে দাঁড়িয়ে উচ্ছল হাসিতে মেতে উঠবে ইসহাক কিংবা ইউসুফের সঙ্গে। ওকে দেখে হাসি আরো বেড়ে যাবে। শাজাহানের কিছুতেই সাহস হবে না যে পূর্ণিমার হাত ধরে বলে, চলো, ঘরে চলো। ও শুধু দেখতে পারে, পূর্ণিমার পুরো শরীরে নরকের আগুন। এভাবেই ওর নরক দেখা হয়। তখন নিজের সঙ্গে কথা বলে, ও বোঝে না কার কণ্ঠস্বরের ও উত্তর দিচ্ছে, ও কি কবরের ভেতরের ফেরশতা, নাকি তার পিতা, নাকি অন্য কেউ যার জন্য ও কোনো একদিন কবর খুঁড়েছিল?

শাজাহান মিয়া?

জি।
কেমন আছো?

মনে হয় ভালোই আছি।

দুঃখ নেই?

না।
মিথ্যে বলছ?

না।
তাহলে ঘর থেকে পালাও কেন?

শাজাহান মিয়া চুপ করে থাকে। উত্তর খোঁজে, কোনটা ঠিক। ঘর থেকে পালাই নিজের জন্য, স্বস্তির জন্য। না পালিয়ে উপায় নেই বলে পালাই। আসলে ভয়ে পালাই। ওদের সামনে দাঁড়ানোর সাহস আমার নেই। ওদের দেখলে আমার পুণ্য করার আকাঙ্ক্ষা বেড়ে যায়, পবিত্র হতে ইচ্ছে করে। পবিত্র হওয়ার জন্য একটাই ভালো জায়গা।
শাজাহান মিয়া এ প্রশ্ন থাক। বলো নিজের জন্য তোমার ভালোবাসা আছে?

আছে।

বউকে ভালোবাসো?

শাজাহান মিয়া চুপ করে থাকে।

বউ ইউসুফের সঙ্গে হাসাহাসি করলে রাগ হয়?

শাজাহান মিয়া চুপ করে থাকে। ওর ঠোঁট নড়তে চায় না, শক্ত হয়ে আছে।

শাজাহান মিয়া তুমি পুরুষ? প্রশ্নের উত্তর দাও?

আহ্ বিরক্ত করো না।

বুঝেছি। ঠিক আছে উত্তর দিতে হবে না। বলো, মা’কে ভালোবাসো?

ছোটবেলায় বাসতাম।

এখন?
শাজাহান মিয়া চুপ করে থাকে।

তুমি জানো না মার পায়ের নিচে বেহেশত।

কেবল উপদেশ দিচ্ছো। এবার চুপ করো।

বলো তুমি কী ভালোবাসো?

কবরের নীরবতা।

আর কী?

দোজখের আগুন।

তুমি একটা ঘোড়েল বদমাশ। তুমি দুই মেরুর দুই প্রান্তের কথা কেমন করে বলো।

জানি না, জানি না।

শাজাহান মিয়া চেঁচিয়ে ওঠে।

বুঝেছি, আসলে তোমার কোনো কিছু ভালো লাগে না। তুমি নিজেই একটা দোজখ।

ঠিকই বলেছো।

শাহজাহান মিয়ার বুক খালি হয়ে যায়। কবরের কাঁচা মাটি ছুঁয়ে আসা ঠান্ডা বাতাস ওকে স্পর্শ করে। ঘাসের গুচ্ছের ভেতর জোড়া পা ঢুকিয়ে দেয়। তখন গেটের কাছ থেকে কান্নার শব্দ আসে। ও চমকে উঠে থিতিয়ে যায়। ওর ডান হাত পুরনো একটা কবর ছুঁয়ে থাকে। মাথার ওপর বকুল গাছের ছায়া, দু’একটা ফুল টুপ করে গায়ের ওপর পড়ে। সকালে ফুল কুড়িয়ে নিয়ে যায় ছোট ছেলেমেয়েরা। বকুলের গন্ধে মাথা ঝিমঝিম করে শাজাহানের। ওর উঠতে ইচ্ছে করে না। এক সময় কান্নার রেশ কমে আসে, হয়তো গুনগুন করছে। লোকজনের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। এখন একটা নতুন কবর খোঁড়া হবে। কে মারা গেলো? নারী না পুরুষ? যুবক না বৃদ্ধ? নাকি শিশু? ওর ছোটবেলায় একবার কবর থেকে কিভাবে যেন শেয়াল লাশ বের করে ফেলেছিল। বাবার সঙ্গে লুকোতে এসে মাংস পঁচা গন্ধে সারারাত জেগেছিল ও। সেদিন ছিলো পূর্ণিমা, যতোদূর চোখ যায় খোলা প্রান্তর হা হা করে। এলোপাতাড়ি বাতাস এসে ঝাপটা মারে চোখ মুখে। আর সেই বাতাসের সঙ্গে গলগলিয়ে গন্ধ ঢুকে যাচ্ছিল ওর বুকের ভেতর। ওর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। ওর খুব কান্না পাচ্ছিল। ও জানতো শব্দ করা নিষেধ? তবু কেঁদে ফেলেছিল শব্দ করে। সঙ্গে সঙ্গে বাবার প্রচণ্ড থাবা এসে পড়েছিল মুখের ওপর।

বিচ্ছু, শয়তান একটা, ঘুমো।

ঘুম তো আসে না বাবা।

দেবো একটা থাপ্পড়। চুপ করে শুয়ে থাক।

শুতে কষ্ট হয়।

কেবল কথা।

বাবা চুল ধরে টেনে পাশে শুইয়ে দিয়েছিল। ভারী একটা পা উঠিয়ে দিয়েছিল ওর গায়ের ওপর। চারদিকে পূর্ণিমার ফুটফুটে আলো, বুকের ভেতর পচা মাংসের গন্ধ, মাঝে মাঝে শেয়াল ডেকে ওঠে, ও শব্দ করে না, দুচোখ বেয়ে জল গড়ায়। দেখতে পায় কেমন করে রাত পোহায়, কেমন করে ভোরের বাতাস স্নিগ্ধ হয়, নড়ে ওঠে গাছের পাতা। এখনো সেই রাতের কথা ভুলতে পারে না ও। আজ এই বয়সে অন্যপাশে যখন নতুন কবর খোঁড়া হচ্ছে, এ-পাশে ও তখন নির্বিবাদে ঘুমিয়ে পড়ে।

 

 

দুদিন পর একদিন দুপুরে বাড়ি ফেরার পর পড়শিদের কাছ থেকে জানতে পারে যে পূর্ণিমা ইউসুফের সঙ্গে পালিয়েছে। ওর মা তখনো ফেরেনি। চারদিক নীরব, ও বাড়িটা ঘুরে দেখে, কোথাও পূর্ণিমার চিহ্ন নেই। শাড়ি-কাপড়, চুলের কাঁটা-ফিতা, স্নো-পাউডার সব নিয়ে চলে গেছে পূর্ণিমা, রেখে গেছে হা-হা শূন্যতা। পড়শিরা এক-দুয়ে সরে পড়ে। ও কারো সঙ্গে কথা বলে না। বাতাসের ঘূর্ণিতে উঠোনে শুকনো পাতা ওড়ে। জাম গাছের নিচে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে নেড়ি কুকুর। শাজাহান ধীরে সুস্থে গেঞ্জি খোলে। ভীষণ খিদে পেয়েছে। ঘরের কোণে গিয়ে দেখে সব হাঁড়ি শূন্য, সকালের এঁটো থালা বাসন যথাস্থানে পড়ে রয়েছে। সেগুলোর ওপর একগাদা তেলাপোকার অবাধ রাজত্ব। শাজাহানের গা ঘিনঘিনিয়ে ওঠে। কুয়োর কাছে এসে গোসল সেরে পাশের ঘরে আসে।
চাচি একমুঠ ভাত দেন। ভীষণ খিদে পেয়েছে।

বসো বাবা।

চাচি ওকে পিঁড়ি এগিয়ে দেয়। রান্নাঘরে যেতে যেতে বলে, মেয়েটা ভালো না বাবা। তুমি যে কী করে এতোদিন ওর সঙ্গে ঘর করলে।

তখন ওর মনে হয়ে ছোটবেলার সেই পঁচা মাংসের গন্ধ ওর বুকের সবটুকু জায়গা দখল করে রেখেছে, ওর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। চাচী ওর জন্য একথালা ভাত এবং মাংস নিয়ে আসে। ভাতের থালা রাখতে রাখতে বলে, গেছে যাক। আমি তোমাকে ভালো একটি মেয়ে দেখে দেবো, লক্ষ্মী মেয়ে।

মেয়ে?
শাজাহানের চোখ কপালে ওঠে। ভাতের গ্লাস হাতেই থেকে যায়।

হ্যাঁ, তোমাকে আবার আমরা বিয়ে দেব।

শাজাহানের বুকের ভেতর নাড়িভুঁড়ি গুলিয়ে ওঠে, ওর বমি পায়। যা অল্প কিছু ভাত খেয়েছিলো সেটাও পেটে রাখা যায় না। ও দৌড়ে গিয়ে জাম গাছের নিচে বসে বমি করে। তারপর ঘরে ফিরে শুয়ে থাকে। অনেকদিন পর প্রচণ্ড নিরিবিলি ঘর পাওয়া গেছে। ওর মনে হয় ঘরজুড়ে জ্যোৎস্না, কিছুতেই ঘুম আসে না।

সাত দিনের মাথায় একদিন ঘুমের মধ্যে মারা গেলো ওর মা। সকালে মা’র সাড়াশব্দ না পেয়ে গায়ে হাত দিয়েই চমকে উঠল ও, অসম্ভব শীতল শরীর, বোজা চোখের পাতায় প্রশান্তি, যেন ঘুমিয়ে আছে, ঘুম ভাঙলে বিছানায় শুয়ে একটা বিড়ি ধরায় রোজকার মতো। ডাক্তার এসে বললো, হার্ট ফেলিউর।

লাশে কাফন পরানো হয়েছে। নিজের হাতে কবর খুঁড়ছে শাজাহান। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরে। ভেজা মাটিতে মাখামাখি হয়ে আছে শরীর, বুকে কোনো কান্না নেই। দুপুর গড়িয়ে গেছে। বকুল গাছের ডালে বসে কাক ডাকছে একটা। কালু মিয়া এসেছিলো কবর খোঁড়ায় সাহায্য করতে, ও রাজি হয়নি। কালু তবু বলে, আজ কবর নাই বা খুঁড়লে। আজ তোমার মন খারাপ।

কোদালটা মাথার উপর উঠিয়ে দুহাত থেমে যায় ওর। বিস্ময়ে বলে, কে বললে মন খারাপ?

না চাচি মরে গেলো।

কালু আমাত আমতা করে। হো-হো করে হাসে শাজাহান। হাসতে হাসতে মাটিতে কোপ দেয়। কালুর সঙ্গে কথা বলে না। কালু চলে যায়।

এক সময়ে কবর খোঁড়া হয়ে যায়। ও কোদালটা পাশে রেখে একটুখানি জিরিয়ে নেয়। ওর চারদিকে সুবাতাস। শরীরে এক বিন্দু ঘাম নেই, মনে কোনো ক্লান্তিও না। ওর দৃষ্টিতে স্বর্গীয় দ্যুতি। পায়ের নিচে ঝরনার জল, ও চারদিকে কুলকুল শব্দ শুনতে পায়।

প্রচণ্ডভাবে অনুভব করে যে ওর চারপাশে কোথাও দোজখের উত্তাপ নেই।

 

সেলিনা হোসেন
প্রখ্যাত সাহিত্যক, স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত ঔপন্যাসিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top