সিডনী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১

কিঞ্চিৎ শিক্ষামূলক : আহসান হাবীব


প্রকাশিত:
২৬ এপ্রিল ২০২০ ২১:২৫

আপডেট:
১৪ জুন ২০২১ ২১:০৪

 

ক্লান্ত চোখ ক্লান্ত চোখের পাতা
তারও চেয়ে ক্লান্ত আমার পা
মাঝ উঠানে সাধের আসন পাতা
একটু বসি?
জবাব আসে না, এখানে না...”

এই কবিতাটি হুমায়ূন আহমেদের প্রিয় একটি কবিতা। তার কয়েকটি লেখাতেই সে ব্যবহার করেছে। তরুণ বয়সে সে প্রায়ই বাসায় আবৃত্তি করত (গভীর রাতে ভাইবোনদের জাগিয়ে আবৃত্তি করা তার একটি শখ ছিল)

 

কবিতাটি এখন পড়লে মনে হচ্ছে যেন আমরা ঘরের ভিতর থাকতে থাকতে বা হাঁটতে হাঁটতে, ক্লান্ত হয়ে ঘরের মাঝ উঠানে বসতে চাচ্ছি। কেউ হয়ত বলছে না এখানে না (হয়ত ওখানে মুহুর্তে পারিবারিক কোনো কর্মযজ্ঞ হচ্ছে) আসলে সত্যিই কি আমরা ক্লান্ত? তাহলে অন্য একটা গল্প শোনা যাক -

১৬৬৫ সাল, প্লেগের কারণে ইংল্যান্ডে তখন লকডাউন। ইংল্যান্ডের এক তরুণ ছাত্র তার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ দেখে বই পত্র নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে গেল। শুরু হল সেই বাড়ীতে তার লকডাউন জীবন। আমাদের মত কোয়ারেন্টাইন্ড অবস্থা আরকি। একদিন দু দিনের কোয়ারেন্টাইন না, টানা দুই বছর। ভাবা যায়? কিন্তু দুই বছরে সেই তরুণ কিন্তু বোর হল না। অংক করে, জ্যামিতির আঁক-ঝোক করে, তিনটি সূত্রের প্রাথমিক চিন্তা করে ফেলেন। প্রিয় পাঠক, বুঝতে পারছেন এই তরুণ কে? হ্যাঁ, তিনি স্যার আইজ্যাক নিউটন আর তিনটি সূত্র হল মহাকর্ষ বলের সেই জগৎ বিখ্যাত তিনটি সূত্র। এছাড়াও ক্যালকুলাসের প্রাথমিক চিন্তাও তিনি করেন আর প্রিজমের সেই বিখ্যাত এক্সপেরিমেন্টটাও প্লেগের ওই কোয়ারেন্টাইন কালেই পর্যবেক্ষণ করেন।

বলা হয়ে থাকে এখন পর্যন্ত মস্তিষ্কের সর্বাধিক ব্যাবহার করেছেন মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন।
এখন কথা হচ্ছে নিউটনের মাথায় যে ১৪০০ গ্রামের ব্রেনটা ছিল, সেই একই ওজনের ব্রেন কিন্তু কোয়ারেন্টাইনে থাকা আমাদের মাথায়ও আছে। উনি মস্তিষ্কটাকে ব্যবহার করেছেন, আমরা করছি না। আমরা হয়ত মহাকর্ষ সুত্র আবিস্কার করতে পারব না (ওটাতো আবিস্কার হয়েই গেছে), অন্য কোন কাজেতো লাগাতে পারি নাকি? গল্প লিখুন, ছবি আঁকুন... ক্রিয়েটিভ যেকোনো কাজই করতে পারেন। সময়টা কাটবে, কিছু একটা সৃষ্টিও হয়ে যাবে ফাঁক দিয়ে। ফেসবুকের মিম জেনারেশন কিন্তু ভাল মন্দ বেশ অনেক কিছুই দিয়ে চলেছে। এটাও এক ধরনের ক্রিয়েশন। যারা একটু বেশী বয়স্ক তাদের এটা ভাবার কারণ নাই যে তিনি ফুরিয়ে গেছেন, তারা জীবনী লেখা শুরু করুন। প্রতিটি মানুষের জীবনে এত ঘটনা আছে যে লিখে ফেললে চমৎকার একটা উপন্যাস হয়ে যাবে। মনে রাখবেন আজ যেটা উপন্যাস, ৫০ বছর পর সেটাই ইতিহাস হয়ে যবে

এক বিদেশী বাচ্চা দেখলাম ঘরের ভিতর সময় কাটানোর জন্য ১৬টা পদ্ধতি বের করেছে। প্রথমটা হচ্ছে, বাসার সামনের মাঠের ঘাস গোনা (একটা ছবিও দিয়েছে সে উপুর হয়ে শুয়ে ঘাস গুনছে) আর ষোল নংটা হচ্ছে ফ্রিজের সব পনিরের টুকরো বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে রাখা এবং ক্ষিদে লাগলে খুঁজে খুঁজে বের করে খাওয়া। একটা পনিরের টুকরা দেখলাম সে লুকিয়েছে বাবার জুতোর ভিতর

আরেক বিদেশী বাচ্চা, তারা দুই ভাই। তারা বাবা-মাকে জানিয়েছে তাদের বাসায় আর ভাল লাগছে না, তারা রেস্টুরেন্টে যেয়ে খেতে চায়। বাবা-মা সঙ্গে সঙ্গে বাসার ভিতরেইমাম-ড্যাড রেস্টুরেন্টখুলে ফেললেন; যেখানে মা ওয়েটার, বাবা সেফ। দুই বাচ্চা গম্ভীর হয়ে বসে আছে ডাইনিং টেবিলে, মা মেন্যু দিল বাচ্চা অর্ডার করল। সঙ্গে সঙ্গে সেফ বাবা খাবার নিয়ে হাজির। সব শেষে তাদের হাতে বিল ধরিয়ে দিল। অবশ্য বিল তাদের দিতে হল না আফটার অলমাম-ড্যাড রেস্টুরেন্টযে!

আরেকদল দেখি পৃথিবী বিখ্যাত সব শিল্পকর্মগুলো রিমেক করছে নিজের বাসার তৈজসপত্র দিয়ে, নিজেরাই মডেল হয়ে। খুব খারাপ কিন্তু হচ্ছে না, বেশ মজার জিনিষই হচ্ছে। বেশ অনেক আগের একটা ঘটনা বলি, একদল তরুণ যাদের একটা ব্যান্ড দল আছে, তাদের খুব শখ একটা গানের এ্যালবাম বের করবে। কিন্তু রেকর্ডিং করার টাকা-পয়সা তাদের নেই। তখন তারা একটা বুদ্ধি করল, শহরের বিভিন্ন সি সি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে গান করল। তারপর মেয়রের কাছ থেকে সেই ফুটেজ চেয়ে নিয়ে এডিটিং করে দিব্যি তাদের নিজেদের গানের একটা এ্যালবাম হয়ে গেল। তাদের সেই এ্যালবামও নাকি সুপার ডুপার হিট। তো এরকম হতে পারে ঘরে বসে সেলফি না তুলে বরং ফোন দিয়ে বাসায় বাসায় ছোট খাট নাটক তৈরী করা যেতে পারে। পাত্র-পাত্রি হবে কোয়ারেন্টেইন্ড আর্টিস্টরা, মানে বাবা, মা, ভাই, বোন, চাচা, খালা, সবাই। মন্দ কি! বেশ একটা পারিবারিক ড্রামা হয়ে যাবে, মেলোড্রামা হলেই বা ক্ষতি কি! (চ্যানেলগুলো চাইলে এসব ব্যাবহার করতে পারে, তারা যেহেতু নতুন কিছু আর তৈরী করতে পারছে না।)
মোবাইল ফোন দিয়ে মুভি বানিয়ে এক আমেরিকান ইন্ডি ডিরেক্টর নাকি হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে। তো আমরাই বা পিছিয়ে থাকি কেন? কে জানে কার ভিতর কি প্রতিভা আছে। হয়ত এই কোয়ারেন্টাইন টাইমে সেই প্রতিভার স্ফুরন ঘটবে। যে একটা কথা আছে নাতুমি হয়ত নিজেও জান না তোমার ভিতরে আগুন আছে না পানি... যেটাই থাকুক সঠিক সময়ে বের করে আনাটাই হচ্ছে ক্রিয়েটিভিটি...!” অতএব আর দেরী কেন?

ওয়াসা নাকি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে এখন পানি আগের চেয়ে তিনগুন বেশী ব্যবহার হচ্ছে। হতেই পারে, এখন আমরা সবাই বাসায় ঘন ঘন হাত ধুচ্ছি। তাই এক কাজ করা যেতে পারে, রান্না ঘরের শাক-সব্জি, বাসন-পত্র ধোয়া-মোছার পানি ফেলে না দিয়ে বাগানে পানি দেয়া যেতে পারে। সবার বাসায় কম বেশী গাছপালাতো আছেই

 

লেখক: আহসান হাবীব
কার্টুনিস্ট/ সম্পাদক
উম্মাদ, স্যাটায়ার কার্টুন পত্রিকা
 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top