সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

একজন কবি হুমায়ুন আজাদ : হোসনে আরা কামালী


প্রকাশিত:
৫ মে ২০২০ ২০:২৭

আপডেট:
৫ মে ২০২০ ২১:৩৫

হোসনে আরা কামালী

 

সীমাহীন আপেক্ষিকতাকে সঙ্গী করে কবির একাকী পথচলা । কবির ভ্রক্ষেপ শুধু কবিতার দিকে। ঊষর মৃত্তিকার মাঝে সজীব প্রাণের মূল গ্রোথিত করা তার গতি। কবি এক তীব্র গতিময় শকটের সারথী। বোধের তীব্রতায়, বেদনার দগ্ধতায় কবি কবিতায় আসলে  তাঁর নিজেরই প্রতিকৃতি আঁকেন। ধারণ করেন নিজের অন্তরাত্নার মধ্যে নিজেরই বিবিধ রূপ। সে রূপের সাতরং রংধনুতে দ্যোতি ছড়ায় ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে দেশ-সমাজ এবং সময়। অনেক সময় কবি চাইলেও তা অতিক্রম করতে পারেন না। একজন নিমগ্ন বহুমাত্রিক কাব্যসত্তার কবি আনন্দ-বেদনার চালচিত্র পাঠকের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পারেন পলকেই । এ জন্যই কবিরা অমৃতের পুত্র। কাব্যবোধের এ  অমৃতসুধা সাকীর মতই অনন্তযৌবনা ,সুরার মতই উদ্দীপক।

হুমায়ুন আজাদ বাংলাসাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান কবি।  সমসাময়িক কবিদের চেয়ে তিনি আলাদা। ব্যক্তিত্বে ও সাহিত্যে তিনি এক ধরণের আত্মবিশ্বাসী অহম বোধের চর্চা করেছেন। তাঁর আত্মবিশ্বাসকে আত্মম্ভর-উদ্ধত ভেবে তাঁর প্রতি  ভুল করেছেন অনেকেই। কবি-লেখক- সমালোচকরা হুমায়ুন আজাদের সৃষ্টিকর্মের চুলচেরা বিশ্লেষণে না গিয়ে, তাঁকে না ভেবেই নিস্পৃহ থেকেছেন। নিয়েছেন শৈল্পিক চাতুর্যের আশ্রয়। কারণ দেশ সমাজের দুরাচারী বোধভেদের দুর্গম দুবৃত্তপনার বিরুদ্ধে হুমায়ুন আজাদের অবস্থান ছিল সুদৃঢ়। আমৃত্যু তাঁর সে অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি। তাঁর গদ্যের বিষয়বস্তু ও ভাষা সমাজ-রাষ্ট্রিক অপঘাতকে চিত্রায়িতই করেনি,তার মর্মমুলেও চপেটাঘাত করেছে,  হুমায়ুন আজাদের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে, আত্মম্ভর, উদ্ধত কন্ঠস্বরে। ধর্ম ও সমাজ-রাষ্ট্রে তিনি অপরাধী। সে অপরাধের মূল্য তিনি দিয়েছেন জীবন দিয়ে। এ শূন্যতা একজন ব্যক্তি হুমায়ুন আজাদের কী ক্ষতি বা করতে পারে! আসলে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে বৃহত্তর মননের, প্রজ্ঞার, স্বাধীনতার, বৃহৎ আত্মবিশ্বাসের জায়গার সর্বোপরি শিল্পের স্বাধীনতার। পাঠকের জায়গা থেকে এটুকুর জবাবদিহিতায় কবি ও কবিতার আপেক্ষিকতার ওজর গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যদিও  চার চক্ষুর সম্মেলনে এমন ওজরের মুখোমুখি হতে হয় প্রায়শই। মিলিয়ে যাওয়া ভাবনায় ওঠে আসে ভাব ও বোধের কঙ্কাল। মৃতচোখ এবং বেহেশতি খোয়াবে হেরেমের হাতছানি দিশেহারা হয়ে বাঙালি পাঠক দিগবিদিক  ছুটে পাথর আসনের  খোঁজে। অতপর কারও কারও পেশী দ্বিগুণ হয়ে ঘাতকের আলখাল্লায় ভাষালাভ করে! আসলে তিনি কেমন  কবি--এ বোধের জায়গায় না গিয়েই বঙ্গসন্তানেরা  ওপথ মাড়ান না।  হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে লেখা হয় না শ্লোক, গাঁথা, বেদনা ভাষা পায় না ছন্দে, গদ্যে, সমালোচনা সাহিত্যে। কারণ তিনি অচ্ছুত । তাই বিভেদজলে ফোটে নীলপদ্ম। ললিত চারণযোগ্য হলেও অনাবাদী হুমায়ুন আজাদ নামের ফসলের মাঠ। আগাছায় বিপন্ন বীজতলা। অথচ অনেক সোনার ফসল নিয়ে পাঠ্যপুস্তক এবং  হুমায়ুন আজাদ নামীয় উচ্চশিক্ষার দুয়ারের তালা খোলাও বেশিকিছু কঠিন নয়।তাঁকে নিয়ে সমালোচনা সাহিত্য হয়ে উঠতে পারত আরও ঋদ্ধ। সে কথার আড়ম্বর আর না বাড়িয়ে বরং চোখ ফেরাই তাঁর দিকে, যিনি তাকিয়ে ছিলেন আমাদের দিকেই আত্মবিশ্বাসের অহমে, ক্ষুব্ধ, আহত, পতিত-বিবমিষায়। কিন্তু কক্ষচ্যুত হয়ে নয়।  আসুন তাঁকেই দেখি.......

ব্যাধি রূপান্তরিত হয়েছে মুক্তোয়

হুমায়ুন আজাদের ভাষায় তছনছ হয়েছে  আমাদের সনাতন মধ্যবিত্তীয় সমাজ রাষ্ট্র কাঠামোর, ধর্ম, বাঙালিয়ানার সীমাবদ্ধতার গতানুগতিক মুন্সীয়ানা। যদিও, উন্মত্তঘৃণায়  হুমায়ুন আজাদও পেয়েছেন তার প্রতিত্তোর। তাঁর মাথার দাম চড়েছে দিনকে দিন। ঘুণে ধরা সমাজের প্রতিটি পরতে পরতে জেগে উঠেছে খঞ্জরের খুন পিপাসা। হৈ রৈ হল্লায়, বর্বরতায়  চাপা পড়েছে আত্মার কলরব। কান্না ফেরত গেছে কণ্টক হয়ে। বিধেঁছেও প্রচন্ডতায়। স্বাধীন চিত্তবৃত্তির মর্মগভীরে আঘাত হয়ে, ক্ষত হয়ে, পচন ধরেছে। ডামাডোলের মধ্যে হুমায়ুন গদ্যের প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ হয়েই থেকেছেন। অবশ্য হাতে গোনা দু একজনেরই লেখায়- বিশ্লেষণে। তখন মনে পড়ে যায়-বাংলাসাহিত্য চর্চার ধ্যানী কবি–লেখকদেরই সীমাবদ্ধতার অনুপাত নির্ণয় (সীমাবদ্ধতার সূত্র) করেছেন  স্বয়ং হুমায়ুন আজাদ! কারণ উনিশশতকীয় সাহিত্যাঙ্গিকের প্রায় সবক’টিতে ( লোক সাহিত্য ছাড়া) বাঙালি লেখকরা নিজস্ব উদ্ভাবনীশক্তির পরিচয় দিতে ব্যর্থ  হয়েছেন। এ সময়ে সৃজিত সব সাহিত্য আঙ্গিকে পাশ্চাত্য সাহিত্যেরই কাছেই ধার করা। বাংলাসাহিত্যে সেটা দোষ নয়, গুণের আকর হয়েছে সত্য, তবে তা বাংলা সাহিত্যের জন্য; উনিশশতকীয় বাঙালি নব্যাধুনিক লেখককুলের জন্য নয়। সে যাত্রায়ও মুক্তচিন্তায় হুমায়ুন আজাদ  হয়ে উঠেছেন একজন আত্মম্ভর–নিঃসঙ্গ-একাকী কবি ও গবেষক। সংগত কারণেই তাঁর এ পথ মাড়ান বড়ো বিপজ্জনক  মনে হয়েছে অনেকের কাছে! কাব্যচর্চায় একাকী মনের সোচ্চার অভিনিবেশে  হুমায়ুন আজাদ আরও  বেশি একাকী। তীক্ষ্ণ-তীর্যক প্রথাবিরোধী হয়েও আবার কোথাও কোথাও তাঁর কবিতার ভাষা শান্ত-কান্তিময়। প্রেম এখানে শুধু ধ্বংসপিয়াসী, কদর্য ও উদোম নয়। নরম রোদের মত ঈপ্সিত উত্তাপে কাঙ্ক্ষিতও। এ হুমায়ুন আজাদ গতানুগতিক পাঠকের কাছে বড়ো অচেনা অথচ  আবিষ্টপাঠে  বড়ো বেশি আপন। আপাতদৃষ্টিতে এ বৈশিষ্ট্যে অন্য একজন হুমায়ুন আজাদ প্রতিবিম্বিত হয়ে উঠলেও ভাবনায় তিনি অখণ্ড সদাশয়। কিন্তু এন্তার বৈপরীত্যের মধ্যেও তিনি  অন্য এক নতুন সময়ের কবি হয়েই থাকলেন। যে হুমায়ুন আজাদের জন্য তাঁর সমাজ তৈরি নয়  এমনকি খোদ বোদ্ধাসমাজও তাঁকে গ্রহণকরার পারঙ্গমতা বা সাহস কোনটিই অর্জন করতে পারেন নি। অবশ্য সমকাল বড়ো ভয়ানক !-রবীন্দ্রনাথ –নজ্রুলকেও সমকালে অনেক বিরোধিতা ও সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে  । তাই হুমায়ুনও তাঁর পথে ও সময়ে সম্পৃর্ণ একাকীই থেকে গেছেন। বাঙালি পাঠকবোদ্ধা তাঁকে বিশ্লেষণে অপরিপক্ষ, কৃপণ বলে, তাঁর  সাহিত্যসম্ভারের তেতোস্বাদে বিবর্ণ হয়েছেন। এ দায় কবির নয়। আর দায় যতটা না ব্যাক্তি পাঠকের, তার চেয়ে বেশি  সমাজ-ধর্মের, রাষ্ট্রের; উন্নাসিক স্পর্শকাতর লেখক বুদ্ধিজীবীর। তাই এ যাবৎ কবি হুমায়ুন আজাদ খুব একটা আদরনীয় হয়ে উঠতে পারেননি বাংলাকবিতায়। সমসাময়িক কবিদের গোত্রচর্চায় হুমায়ুন আজাদ পারঙ্গম ছিলেন না অথবা আপোষহীন ছিলেন না বলেই  স্বকালে হুমায়ুন আজাদ এতটা বেমানান রয়ে গেলেন! গোটা হুমায়ুন আজাদই যেখানে অবহেলিত, নিন্দিত সেখানে আক্ষেপ করার চেয়ে কবি হুমায়ুনকে পঠনপাঠনই  আজকে মূখ্য হওয়া বাঞ্চনীয়। তিনি নিজে ছিলেন পঠনে-পাঠনে প্রাগ্রসর বিজ্ঞানমনস্ক লেখক-চিন্তক। তবে কবিতার প্রতি তাঁর পক্ষপাত ছিল বেশি। তাই অলোচ্য প্রবন্ধে কবি হুমায়ুন আজাদকেই নির্মাণের চেষ্টা করা হয়েছে। কবির উদ্ধৃতি থেকেই কবিকে ভাবার প্রেরণা পাওয়া যেতে পারে----

খ্যাতি, সমাজবদল এবং আরও বহু উদ্দেশ্যে কবিতা আমি লিখিনি বলেই মনে হয়; লিখেছি সৌন্দর্যসৃষ্টির জন্য, আমার ভেতরের চোখ যে শোভা দেখে, তা আকাঁর জন্য; আমার মন যেভাবে কেঁপে ওঠে, সে কম্পনধরে রাখার  জন্যে।-----জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা আমি করিনি; যদিও আমার কবিতা অপ্রিয় নয়।-----নিজের কবিতা সর্ম্পকে কিছু বলতে চাই না। শুধু বলি এটা আমাকে সুখি এবং আমার বেঁচে থাকাকে সুখকর করেছে –অন্য কিছু এতোটা করেনি। [ হুমায়ুন আজাদ, ভূমিকা, কাব্য সংগ্রহ, ১৯৯৮ ]

 এ  ভাব কবিকে, সব কবিকেই প্রাণিত করে বলেই তাঁরা লিখেন। তবে প্রত্যকের সুর আলাদা আলাদা। হুমায়ুন ব্যাতিক্রমেরও ব্যতিক্রম হয়ে উঠেছিলেন তাঁর জীবনাচরণ ও সৃষ্টিকুশলতায়। তাঁর জীবনবোধের কারণেই  তিনি পোশাকী হয়ে ওঠেননি। বিষয়বস্তুর চয়ন ও বিন্যাসের চেয়ে তাঁর প্রকাশের ধার অনুসন্ধানী পাঠককে সচকিত করে তোলেছে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ (১৯৭৩) কবির মমতার জায়গা জুড়ে আছে। প্রথম প্রেমের মতোই –

‘যদি তুমি আসো তবে এ শহর ধন্য হবে / জ্বালো মোমবাতি/ সব গাছে মসজিদে অ্যাভিন্যুতে গোলাপ পাপড়িতে/ আমার বক্ষে যদি তুমি আস/---- তোমার অভাব বড়ো বোধ করে এ শহর/ তোমার অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে/ পুরনো শহরের সমস্ত স্থাপত্যকর্ম ভেঙ্গে যাচ্ছে/ সমস্ত নতুন প্ল্যান সুনিবিড় শিল্পের আকুতি/ ময়লা জমেছে বাল্বে পার্কে ট্রাফিক পুলিশের চোখে/ আমার বক্ষে তোমার অভাবে/’  ( যদি তুমি আস, পূর্বোক্ত )

কবি হুমায়ুন আজাদের প্রেমের কবিতার বেশির ভাগই এমনবোধে আক্রান্ত যেখানে কবি সমর্পিত প্রেমের কাছে, শুধুমাত্র প্রেয়সীর কাছে। এখানে কবিআত্মায় কোন দম্ভ নেই, অহমবোধের দ্বন্দ্ব নেই, আছে নির্ভরতার আশ্রয়। কবির কান্তিময় লালিত্য। সাধারণ পাঠক তার খোঁজ পেয়েছে কিনা সে চিন্তা অবান্তর। কারণ এ কান্তিময় কবি চিত্তের বাণী মাঠে ঘাটে ধবনিত হওয়ার তো কথাই নেই, যেখানে হুমায়ুন আজাদ চিন্তন নাজায়েজ এবং তাঁর উচ্চতা ভীত করে তোলে  প্রায় সব প্রাজ্ঞজনকেই। যদিও জানি-কবি একমাত্র তাঁর কাছেই শুধু নত। তবু জীবন শক্তির আধার খোঁজেন তিনি শুধু সে নারীর কাছেই----

‘একবার তাকাও যদি পুনরায় দৃষ্টি ফিরে পাবো।/ বড়ো বেশি ছাইপাশ দেখে দেখে দু চোখে ছানি পড়ে গেছে/ যদি চোখ ফিরে পাই/ তবে শুধু একবার তাকাবো তোমার মুখের দিকে/ তারপর পুনরায় অন্ধ হয়ে যাবো/ একবার তাকাও যদি লোকত্তোর অসহ্য গর্বে/ আমি আর কোন দিকে তাকাব না/ যদি একবার তাকাও তবে/ বাঙলা কবিতার ওপর তার পাঁচশো বছর ধরে প্রভাব পড়বে/ (একবার তাকাও যদি, আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে)

খাপ না খাওয়া মানুষ

কবি হুমায়ুন আজাদের কাব্য গ্রন্থের নামকরণের  দিকে যদি তাকাই তবে তাঁর কাব্য চরিত্র ও দশর্নের ভাবই শুধু মনোগ্রাহ্য হয় না বরং তার একটি প্রায় বস্তুগত অবয়ব পাঠকের সামনে দিয়ে সাঁই করে চলে যায়। এবং অতি দ্রুততার সঙ্গে পাঠককে বাজঁখাই এক অনুভবের সাক্ষী করে তোলে। অলৌকিক ইস্টিমার, জ্বলো চিতাবাঘ, সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে, যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল, আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে, কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থে চিত্রপটের যে ব্যবহার কবি করেছেন তাঁর কায়িক জীবন্ত একটি রূপ চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কিন্তু অতি অল্পসময়ের জন্য হলেওতো কবি প্রেমের কাছে ক্লান্তি বলি অথবা স্বস্তিই বলি তাঁর আবেগ নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। মুলত তিনি খাপ না খাওয়া মানুষই। মানবিকবোধের জায়গা থেকে তিনি খাপ খাওয়াতে ব্যার্থ হয়েছেন নিজেকে--

কারো সাথেই খাপ খেলাম না। এ ঠোঁট আঙুল/ পা থেকে মস্তক ও মধ্যবর্তী যখন যেখানে রাখি/ সেখানেই শান্তিশৃংখলার মধ্যে জন্ম নেয় ঝড়-ত্রাস- বিপর্যয়/ বাতাস লাফিয়ে ওঠে, লকলকে জিভ দেখা দেয় আগুনের/ গোলাপ রূপান্তিত হয় বারুদ স্তুপে, শত্রু গ্রহের হিংস্র রবোটের মতো ঝাঁপ দেয় চাঁদ/ ( খাপ না খাওয়া মানুষ, সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে)

অথবা –

অবশ্য কারো বন্দনা দিতে  পারে না তৃপ্তি/ কোন অনির্বচন দেয় না দীপ্তি/ আমি শুধু সংকলিত মলভাণ্ড সামনে রেখে / ( স্নানের জন্যে,অলৌকিক ইস্টিমার)

কবির তৃষ্ণা মেটানোর জন্য কোন নদী সরোবর খুঁজে পান নি। এই তৃষ্ণাই তাঁকে করেছে কর্কশ, অধিকার চেয়ে শিরদাঁড়া টানটান উদ্ধত এক কবিতে রূপান্তরিত করেছে। চিৎকার করতে করতে কন্ঠে রক্ত উঠে এসেছে, কোথাও কোথাও নারী এসেছে কবির নিমগ্নতার আশ্রয় হয়ে। নারীর প্রতি কবি বিবমিষা নন, ঘৃণা থেকে বাঁচতে তিনি নারীকেই অবলম্বন করেছেন। কিন্তু তা এত ম্রিয়মান ক্ষীণস্বরের যে পাঠক তার শিরোনাম জানেন না। যে সমাজ কবিকে বিদ্ধ করছে প্রতিনিয়ত এ নারী সে সমাজের হয়েও কিছু সময়ের জন্য এমন কী চিরসময়ের জন্য কবিকে প্রাণিত করেছে। এ নারী কবির দেশ, এ নারী কবির খেশ, এ নারী কবির পলিমাটি ভেদকরে জেগে ওঠা উর্বর মৃত্তিকাভূমি। কবির ক্ষোভ, দুঃখ-কাতরতা এবং নির্মমতার আঘাতে রক্তাক্ত হয়েও এ নারী জীবন্ত—

আমার স্বপ্নকে আলিঙ্গনে বেঁধে ঠোঁট রেখে/  নিঃশব্দে জানতে চাইঃ কেমন রয়েছো প্রিয়তমা?/ নিঃশব্দে জানায় সেঃ পঙ্গু। ( পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে,সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে)

তবু সে নারী---

 —হে নারী অবিদ্যাময়ী, পাঠ দাও সুপ্রসন্ন বিদ্যানিকেতনে;/ অগ্নিতে বিলুপ্ত হোক শত শত মনীষার রটিত দর্শন/ (আত্মজৈবনিক,একুশ বছর বয়সে,অলৌকিক ইস্টিমার)

 নারীতেই কবি ভেঙ্গেছেন। নতুন গড়ার প্রত্যয়ে, বার বারই মরেছেন---

তোমাকে ছুঁলে/ দেখলে এমনকি তোমার নাম শোনালে/  আমার ভেতরে লক্ষ লক্ষ আমি আত্মহত্যা করি। ( আত্মহত্যার অস্ত্রাবলি,পূবোর্ক্ত)

দুর্বৃত্তপনার স্বেচ্ছাচারী কবির স্বদেশের মতোই কবিতার অমৃত ও বিষের আধার তিনি রমনীয় একজনা----

তুমিই সৌন্দর্য আজো দুই চোখে, তোমার ধ্যানেই মগ্ন আছি অহর্ণিশ।/ পরিমাপ করে যাই অনন্ত দ্রাক্ষার উৎস ঢালতে পারে কতখানি বিষ। ( এক বছর, জ্বলো চিতাবাঘ)

কবিতার কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু

কবি হুমায়ুন আজাদের অনেক কবিতায় যেন কবি নন ব্যক্তি হয়েই নিজেকে প্রকাশ করেছেন। নিজেকে কবিতার কাব্যময়তায় নয়, সরাসরি হুমায়ুন আজাদই কথা বলেছেন কবির কবিতায়। এখানে তিনি কিশোর বালক পরাধীনতা  আবেগ ভাবাবেগ উচ্ছ্বাস ইত্যাদির প্রকাশ করেছেন ছাঁচছোলা বয়ানে –

আমি পাকিস্তানের সমান বয়সী/  স্বাধীনতা আমার কোনো  দরকার ছিল না ১৯৫৭ পর্যন্ত/ ১৯৫৮ তে যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি/ হাফ প্যান্ট ছাড়াছাড়ি করি, হঠাৎ একলা দুপুরে আমার/ স্বাধীনতা দরকার হয়/ চিৎকার করে বলি, স্বাধীনতা চাই।/ ঘাটে মাঠে সারা বঙ্গে দেখি স্বাধীনতা নাই/             ( হুমায়ুন আজাদ,অলৌকিক ইস্টিমার)।

কারণ  হুমায়ুন আজাদ বিশ্বাস করেন---

কেবল কবিই বেরুতে পারে নিরুদ্দেশে/ নীলিমা মাতাল লালনৌকা নিয়ে অধীর উন্মাদ সব চিরনিরুদ্দেশ/ নাবিকের মতো, ছুঁড়ে ফেলে নকশা কম্পাসকাঁটা, বেরিয়েছি গন্তব্যবিহীন/ যদিও সময় আজ উপযুক্ত নয় সমুদ্রযাত্রার। (একাকী কোরাস,জ্বলো চিতাবাঘ) ।

হুমায়ুন আজাদ যে সমাজ ও স্বদেশে জন্ম নিয়েছিলেন, যে স্বদেশকে স্বপ্নে  উন্নীত করতে গিয়ে কবি হোঁচট খেয়েছেন বারবার, মুখ ফুটেছে অস্ফুট শ্বাশত সময়। কষ্ট দলাপাকিয়ে উঠেছে গলা পর্যন্ত। টলমল করেছে সমগ্র কবিতা। বাংলাদেশের কেন গোটা পৃথিবীরই সন্তান হুমায়ুন আজাদ ---

পৃথিবীতে একটি বন্দুকও থাকবে না, পৃথিবীতে থোকায় থোকায় জলপাই থাকবে/ কিন্তু জলপাই রঙের পোশাক থাকবে না/ (পৃথিবীতে একটিও বন্দুক থাকবে না, সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।)

বাঙালি, বাংলাদেশ, মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালির চেতনা-স্বপ্ন সবকিছুই নিজের মত করে ভেবেছেন হুমায়ুন আজাদ। মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধাকে এক স্বপ্নের বীজবোনা দিগন্তবিস্তৃত মাঠের কবি ভাবতে পারেন তিনি, যার রাইফেল থেকে ৪৫টি গোলাপ বেরুতে দেখেন কবি। কবির ভাবনায় এই  নষ্ট হৃদপিন্ডের মত বাংলাদেশের চির অপ্রতিষ্ঠিত পুত্রদ্বয়ের একজন কবি ও অন্যজন কৃষক। এই কবি এবং কৃষকই স্বদেশের কথা রটিয়ে যাচ্ছেন নিরবধি। নারীবাদ নিয়ে লেখার জন্য হুমায়ুন আজাদের খ্যাতি ও অখ্যাতি আছে। তবে তাঁর লেখার প্রিয় একটি বিষয় হচ্ছে নারীবাদ। কবি হুমায়ুন আজাদ কে অশ্লীল বলেও দূরে সরিয়ে রাখার বাতিকে বাঙালি কম দুস্তর নয়। বাংলাভাষার উপর তাঁর কাজ শুধু যে ভাষাবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে, তা নয় সাধারণের জায়গা থেকেও উন্মুক্ত করে দিয়েছে এক অনাস্বাদিত পারিজাতের ঘ্রাণ। পাঠককে বাংলাভাষার শুত্রুমিত্রকে চিনিয়ে দিলেন  হুমায়ুন আজাদ (বাংলাভাষার শত্রুমিত্র), কত নদী সরোবর, লাল নীল দীপাবলী, সীমাবদ্ধতার সূত্র,  প্রবচন গুচ্ছ, তাঁর অনুদিত বিশিষ্ট গ্রন্থাবলি ও অন্যান্য গদ্যগ্রন্থ গুলোও নামে, বিষয়ে, পরিবেশনায় এক অনবদ্য কবিতার স্বাদ এনে দেয়। যে কবিতা হয়ে ওঠে স্বয়ং হুমায়ুন আজাদ শিরোনামেরই। এ মোটাদাগের শিরোনামের মানুষ হুমায়ুন আজাদই বিবমিষা সময়কে অগ্রাহ্য করে আগামীর অথবা অন্য সময়ের হয়ে  ওঠেছেন। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, তিরিশের পঞ্চপাণ্ডব খ্যাত  আধুনিক কবিরা হুমায়ুন যাঁদের বলেছেন ‘আদিম দেবতা‘ এবং ষাটের দশকের শামসুর রাহমান হুমায়ুনের কবিভাবনার বিশাল এলাকা জুড়ে দ্যুতি ছড়িয়েছেন। অকবিদের চিনিয়ে তিনি বাংলা কবিতার শুচি-শুদ্ধিকেই ত্বরান্বিত করেছেন।

কেবল কবিই বেরুতে পারে নিরুদ্দেশে

কবিতার মন্ময়তা হুমায়ুনের কবিতার প্রাণ। সব কবির ক্ষেত্রেও তা-ই সত্য। কিন্তু হুমায়ুন কাব্যের সারস্বত ব্যবধান আত্মম্ভর উন্নাসিক নয়, শৈলীর ক্ষেত্রেও নিজস্ব দৃষ্টিবাদ ধবনিত হয়েছে। হুমায়ুন আজাদের ভাষা নিরুত্তাপ নয়, কোমলতায় আচ্ছন্ন নয়, তাঁর ভাষা সোজাসাপ্টা সহজ। সাধারণ পাঠক কে কবিতার মর্ম উদ্ধারের জন্য কষ্ট নিতে হয় না। কারণ –

নানারকম সুর উঠে চারপাশে/ কিছু কিছু সুর গোলগাল/ কিছু সুর চার কোণা, ত্রিভূজ আর সরল রেখার মতো সুর শোনা যায় কখনো কখনো/......আমি দেখেছি প্রায় সব সুরই আমার ভেতরে ঢোকে, শুধু প্রথা ও প্রতিক্রিয়ার কালো দানবিক সুরগুলি কিছুতেই আমার ভেতরে ঢোকে না। (কিছু সুর আমার ভেতরে ঢোকে না)

তাই সংগত কারণেই হুমায়ুনের ভাষা বেসুরে বেজেছে–

কে বলে আমার আণবিক বিস্ফোরণের ছাই হয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই? অভিজ্ঞতা নেই তুষারধসের/  আকণ্ঠ গরলপানের অভিজ্ঞতা কে বলে আমার নেই/ কোব্রার দংশন কে বলে আমি জানি না? (কোন অভিজ্ঞতা বাকী নেই,আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে)

কোব্রার দংশনের বিষই উগরে দিলেন কবি আর পাঠক বিষে নীল হয়ে অমৃতের সন্ধান করেন। কবির উপমা ও চিত্রকল্পের ব্যবহার, রূপকের নিশ্চেষ্ট অথচ অন্বিষ্ট ব্যবহার কবির অনুভূতির আকর হয়ে ওঠেছে। কবির কবিতায় শৈলীর চেয়ে বিষয়ভাবনা প্রকরণই প্রাধান্য পেয়েছে। গদ্যশৈলীর মত তাঁর কাব্যভাষাও খরতাপে উত্তপ্ত, কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হলো এই খরতাপের ভাষার মধ্যেও কোন এক সময় একধরণের পেলবপরশের স্পর্শ খুঁজে নিতে কষ্ট হয় না।–

১. যেখানে দাঁড়াও তুমি সেখানেই অপার্থিব আলো।

২. আমাদের মা ছিলো অশ্রুবিন্দু দিনরাত টলমল করতো/ আমাদের মা ছিলো বনফুলের পাঁপড়ি সারাদিন ঝরে ঝরে পড়তো/ আমাদের মা ছিল ধানক্ষেত- সোনা হয়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকতো/ আমাদের মা ছিলো দুধভাত তিনবেলা আমাদের পাতে ঘন হয়ে থাকতো/ আমাদের মা ছিলো ছোট্টপুকুর-আমরা তাতে দিনরাত সাঁতার কাটতাম/ (আমাদের মা)

৩. অজস্র জন্মধরে আমি তোমার দিকে আসছি/ তোমার দিকে আসতে আসতে আমার এক একটা দীর্ঘ জীবন ক্ষয় হয়ে যায়/ পাঁচ পয়সার মোমবাতির মত/.....আমার দু;খ তোমার স্বপ্ন দেখার জন্য/  আমি মাত্র একটি জন্ম পেয়েছিলাম/ ( তোমার দিকে আসছি)

৪. বুদ্ধিতে বিশ্বাস নেই, বোধ আর বোধি জানি অন্বিষ্ট আমার/ হে নারী তমিস্রাময়ী, নীল মেঘ, হে ক্রন্দসী, চিত্রান্বিত গতি/ পল্লবে বিলীন হবো চারপাশে কোনো সাগর আসে না/ উলঙ্গ আমাকে নাও নীলতট সু আত্মীয় হৃদয়ের কাছে/  ( আত্মজৈবনিক, একুশ বছর বয়সে )

কবির ভাববোধের জাগায় যে চিত্রপট পাঠকের সামনে চলে আসে তাতে কবির বিভিন্ন রূপান্তরে কাল জেগে ওঠে, কালবিচ্ছিন্ন হয়, ভাবজাগায় আবার ভাবভারাক্রান্তও করে তোলে। কবি হুমায়ুন আজাদের বড়ো বৈশিষ্ট্য এই যে তিনি তাঁর জন্য একটি আলাদা সময় নির্মাণ করতে পেরেছিলেন। যে সময়ের জন্য তৈরি ছিল না বাঙালি সমাজ ও পাঠক। তবে সে সময়ের কবি হয়েও তিনি এ সময়ের মধ্যেই বাস করেছেন। এটা তাঁর নির্বাসন। স্বরচিত নির্বাসন, স্বচেষ্ট নির্বাসন।----

আমি জন্মেছিলাম অন্যদের সময়ে/ আমার খাদ্যে ছিলো অন্যদের আঙুলের দাগ/ আমার পানীয়তে ছিলো অন্যদের জীবাণু / আমার বিশ্বাসে ছিলো অন্যদের ব্যাপক দূষণ/ আমি জন্মেছিলাম আমি বেড়ে উঠেছিলাম/ আমি বেঁচেছিলাম অন্যদের সময়ে/ (আমি বেঁচেছিলাম অন্যদের সময়ে)

সৃষ্টিশীল মানুষের  বিচ্ছিন্নতাবোধ, ব্যতিক্রমী-বোধ তাঁকে আক্রান্ত করে, তাঁকে পোড়ায়। তাঁরও সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। কিন্তু তিনি যদি হোন প্রতিভার অহমে ক্ষমতাবান, তাঁকে মনে যদি না-ই নেওয়া যায়, মেনে নেওয়া কি সৌজন্য নয়! তা না হওয়াই হুমায়ুন আজাদের দগ্ধানুভব অমিত চিৎকারে রাষ্টধর্মের বিপক্ষে তাঁকে দাঁড় করিয়েছে। রাষ্ট্রতো কবির জন্য কোন পদ রাখেনি যেমনটি দশতলার মালিকের জন্য রেখেছে! তাই হুমায়ুন এক্ষেত্রে  ব্যতিক্রমতো হবেনই। ক্ষেপোমিতেও তাঁর তুলনা তিনি নিজে এবং তাঁর সীমা পরিসীমাও মাপা সহজ নয়। এই অসীম তেজই তাঁকে তাঁর সময়কে অতিক্রম করতে সাহসী করে তুলেছে। এই সময়ের হুমায়ুন আজাদের প্রকৃতপাঠককে সেই সময়ের স্বপ্নে নিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করেছে। আজকের বাংলাদেশে না হোক আগামীর বাংলাদেশে হুমায়ুন আজাদের সময় কথা বলে উঠবে এমনটি প্রত্যাশা করা যৌক্তিক না হলেও  বলার সাহস রাখতে চাই!

তথ্যসূত্র

  • হুমায়ুন আজাদ, কাব্যসংগ্রহ, আগামী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮
  • হুমায়ুন আজাদ, সীমাবদ্ধতার সূত্র, আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৩
  • হুমায়ুন আজাদ, শামসুর রাহমানঃ নিঃসঙ্গ শেরপা, আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৭

 

 

হোসনে আরা কামালী
কবি, প্রাবন্ধিক, বিভাগীয় প্রধান বাংলা, মদনমোহন কলেজ, সিলেট।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top