সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

নেকড়ে : জোবায়ের মিলন


প্রকাশিত:
২৬ মে ২০২০ ২৩:০৬

আপডেট:
২৭ মে ২০২০ ০২:৪৬

 

কনকনে শীত। শিশু অর্জিতা সন্ধ্যায় স্কুল থেকে বাসায় ফিরে গায়ে ঊলের জ্যাকেট জড়িয়ে মায়ের কাছ ঘেঁষে জলসা টিভি দেখতে বসেছে। ‘জল নূপুর’ সিরিয়লটা তার খুব পছন্দ। পাড়িবু’র চরিত্রটা আরও পছন্দ। ‘পাড়ি’ যখন ভারসাম্যহীন শরীরটা নিয়ে কথা বলে তখন অর্জিতা দুই চোখ এক করে একচোখে তাকিয়ে থাকে আর মায়ের কাছে প্রশ্ন করে, ‘‘আম্মু, পাড়ি’বু পাগল হলে এমন সুন্দর সুন্দর কথা বলে কী করে? পাগল মানুষ কি সুন্দর কথা বলতে পারে? গান গাইতে পারে?’’ এরকম অনেক প্রশ্ন। অর্জিতার মা কাবেরী রায় কোন উত্তর করেন না। মেয়ের পাশে বসে তিনিও সিরিয়ালটা দেখেন। পাড়ি’র চরিত্রটা এলেই মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকেন। কেন তাকিয়ে থাকেন তা তিনি জানেন না। কিন্তু তাকিয়ে থাকেন।
অর্জিতা কোন উত্তর না পেয়ে মায়ের শরীর ঘেঁষা থেকে একটু সরে আবার প্রশ্ন করে, ‘‘আম্মু, শুক্লা আপুও তো পাগল, তবে আপু কেন পাড়ি’বুর মতো সুন্দর করে কথা বলে না। আম্মু, আপু কি সত্যিই পাগল? জানো, আপুকে সবাই যখন পাগল বলে আমার তখন খুব কান্না পায়। আমার কষ্ট হয়। সবাইকে আমার বলতে ইচ্ছে করে ‘‘আপু পাগল না, শুক্লা আপু আমার আপু , তাকে পাগল বলবে না?’’ কিন্তু আমি বলতে পারি না। পাশের বাড়ির আন্টিও সেদিন আপুকে পাগল বলে ক্ষেপিয়েছে। আন্টিকে আমাদের বাসায় আসলে আর জায়গা দিয়ো না আম্মু।’’ অর্জিতার কথায় কাবেরী রায় কোন কথা বলেন না। উঠে গিয়ে পাশের বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা বড় মেয়ে শুক্লার কাছে বসেন। ঘুমন্ত শুক্লা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কী যেন ভাবেন কাবেরী রায়! তার চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা জল। সে জল মোছার কোন চেষ্টা দেখা যায় না মধ্যবয়সী কাবেরী রায়ের অবয়বে। নির্দ্বিধায় গড়িয়ে পড়তে থাকে আরও কয়েক ফোঁটা জল।
শুক্লার বয়স পনের। অর্জিতার সাত। সনাতন পোদ্দারের এ দু’টোই মেয়ে। শুক্লার যখন জন্ম হয় তখন সারা পাড়ায় ডাক পরে গিয়েছিল, ‘সনাতনের ঘরে পরী হইছে’রে. . . পরী।’’ আর শুক্লার মা কাবেরী রায়- সনাতন পোদ্দারকে আড়ালে ডেকে কানেকানে বলেছিলেন, ‘‘তোমার মতো হলেও আপত্তি ছিল না। রঙ দিয়ে কি কিছু হয়!’’ সনাতন পোদ্দার স্ত্রীর কথায় লজ্জা পেলেও ভালোই লেগেছিল তার, যে, তার মতো শ্যাওলা রঙ পায়নি মেয়েটা। মেয়েটার রঙ হয়েছে দুধে-ফর্সা। যদিও সনাতন পোদ্দারের কিছুটা সন্দেহ ছিল এই ভেবে, জন্মের পর পর সব বাচ্চাকেই ফর্সা দেখায়, পরে রঙ বদলায়। কিন্তু মাসি পিসিরা তাদের আদি চোখ দিয়ে আদি কিছু পরীক্ষা নীরিক্ষা করে জানিয়ে দিয়েছিল, ‘‘সনাতন তোর মেয়ে ফর্সাই হবে রে।’’ অপ্রকাশ্য হলেও শান্তি পেয়েছিল সনাতন পোদ্দারের মন। কৃষ্ণ বর্ণের না হয়ে অসস্থি থেকে বাঁচিয়েছে বলে প্রথম কন্যা শুক্লার প্রতি টানও ছিল অনেক। তিনি মেয়েকে ছেড়ে কোথাও এক বিন্দুও যেতে চাইতেন না। সবসময় খেলনার মতো মেয়ের সাথে সাথে ছায়া হয়ে লেগে থাকতেন। এখনও থাকেন। তবে আগের মতো উৎফুল্লতা নেই।
জন্মের কয়েক বছর পরই শুক্লার ভারসাম্যহীনতা চোখে পড়ে সনাতন পোদ্দারের। ‘মা-মনি’ বলে ডাকলে অন্য বাচ্চারা যেমন চোখের দিকে তাকায়, হাসে, সাড়া দেয়, হাত বাড়ায় শুক্লা তা করতো না। হাত পা ধরতে চাইলে কখনো বাড়িয়ে দিত না নিজ থেকে। নানান জন নানান পরামর্শ দিলেও শুক্লা বড় হয় মানসিক জড়তা নিয়েই। ডাক্টার, কবিরাজ. মন্দির, মসজিদ, পীর. মাজার দেখিয়েও আর কাজ হলো না। জানা গেল, অসুখটা এটা জন্মগত। সারবে না। তবে মানসিক প্রতিবন্ধকতা কোন অসুখ না, সঙ্গতা, পরিচর্যাই এর ওষুধ। শুক্লা সেই থেকে চোখে চোখেই থাকে।
অর্জিতার ডাকে কাবেরী রায়ের তন্দ্রা ভাঙ্গল। অর্জিতা আবার প্রশ্ন করে, ‘‘আম্মু, আপু কি আর ভালো হবে না? আপুর কী অসুখ আম্মু?’’
-অসুখ না।
তবে আপুকে যে অনেক ওষুধ খেতে দাও। পাড়ি’বু তো কোন ওষুধ খায় না। আপু খায় কেন?
-আপুর জ্বর হয়েছে।
কী জ্বর?
অর্জিতার শেষ প্রশ্নের কোন উত্তর দেন না কাবেরী রায়। শুক্লার দিকে চেয়ে থাকেন একপলকে। অর্জিতা ‘পাড়ি’ চরিত্রটা দেখলেই শত শত প্রশ্ন করে, কেনো করে তা অর্জিতা যেমন জানে না তেমনি তার উত্তর কি তাও জানেন না কাবেরী রায় । তার চোখে কেবল কালোমেঘ- শ্রাবণের মেঘের মতো জটলা বেঁধে সে মেঘ উড়ে যায় কাকের ডানার মতো! তার কানে কেবল সেই দিনের একটা শব্দ, ‘‘মা আমি ব্যতা পাচ্চি, মা অক্ত।’’ এক থোক কুয়াশার চাকা তার চোখে! অর্জিতার শত প্রশ্নের উত্তর হয়তো কাবেরী রায় জানেন কিন্তু কোন উত্তর তার মুখ দিয়ে আসে না। কেবল ভিতরে ভাসে, ‘পাড়ি’ অভিনয় ‘শুক্লা’ সত্য। এ সমাজ শুক্লাদের মেনে নেয় না, সুযোগ পেলে শুক্লাদের ছিবড়ে খেতেও ছাড়ে না। তাই শুক্লাদের ওষুধ খেতে হয়, ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হয়। তাই অর্জিতার মতো ছোট্ট শিশুটিকেও মা হয়ে মিথ্যে বলতে হয়, ‘আপুর জ্বর হয়েছে’!
আট সপ্তাহ যাবৎ ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হয় শুক্লাকে। জেগে উঠলেই অনবরত কাঁদতে থাকে, ‘‘মা ব্যতা. . .ব্যতা। আমিকে মেলেতে, তয়তানটা মেলেতে।’’ সহজে কান্নাটা থামানো যায় না। কয়েকদিন আগেও শুক্লা সুস্থ্য ছিল। প্রতিবন্ধী হলেও কখনো জ্বলাতন করতো না। এলোমেলো কথা বলতো, কাউকে আঘাত করতো না। কিছু নষ্ট করতো না। অর্জিতার সাথেই সব সময় খেলা করতো। বাড়ির বাহিরে যেত না। গেলে অর্জিতার সাথেই যেত, আবার ফিরে আসতো একটু পরই। কিন্তু ওই দিন অর্জিতার মিডটার্ম পরীক্ষা ছিল বলে কাবেরী রায়কে অর্জিতার সাথে যেতে হয়েছিল স্কুলে। সনাতন পোদ্দারও অফিসের কাজে ছিলেন ঢাকার বাহিরে। শুক্লাকে সাথে নিয়ে যাবেন ভেবেও কাবেরী রায় মেয়েকে বাসায়ই রেখে গেলেন। একটু পরেই তো ফিরে আসছি; এই ভেবে। শুক্লাকে ঘরে রেখে বাহির থেকে টিপ তালা লাগিয়ে গেলেও কাবেরী রায় ভুল করে চাবিটা ফেলে গিয়েছিলেন গ্রিল করা বারান্দার কাছে ডাইনিং টেবিলের উপর! পথেই স্মরণ হলেও পরীক্ষার সময় বেশি বাকি না থাকায় ফিরে আসা হয়নি। কিন্তু যখন ফিরে এলেন তখন দেখেন ঘরের দরজা খোলা! একি! আতকে উঠে কাবেরী রায়ের মন। বড় হয়ে যায় চোখ- দরজা খোললো কী করে! শুক্লা বাইরে বের হয়ে যায়নি তো! দৌঁড়ে ঘরে ঢুকেই দেখেন, না, শুক্লা আছে কিন্তু মেয়েটা কোকিয়ে কাঁদছে নিচপেটে হাত দিয়ে! চুল এলোমেলো! জামাটা মোড়ানো! চোখে মুখে ক্লান্তি! কাবেরী রায় জানতে চাইলেন, ‘‘দরজা খুলেছে কে, কী করে দরজা খুললো? তুমি বাইরে গিয়েছিলে তালা খুলে?’’ শুক্লা কোনো উত্তর দেয় না, অষ্পষ্ট ভাষায় কী যেন বলে কাবেরী রায়কে। কাবেরী রায় বুঝতে পারেন না। আবার জানতে চান, ‘‘কী হয়েছে?’’ শুল্কা এবার হাত দিয়ে দেখায়! রক্তের ছোপ দেখা যায় বিছানায়! কাবেরী রায় নিজেই শুক্লার উরুতে হাত দেন! শুক্লা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে। কাবেরী রায় শুক্লাকে পাঁজাকোল করে পাশের রুমে নিয়ে যান। পায়জামার ফিতাটা খোলাই ছিল; ভালো করে দেখে ফের শিউড়ে উঠেন কাবেরী রায়! চিৎকার করে উঠেন অর্ধপাগলের মতো, ‘‘এ- কী করে হলো! কে এসেছিল? দরজা খুললো কী করে? হায়, এ কী সর্বনাশ হলো!’’ তখন শুক্লার পা গড়িয়ে রক্তের দাগ। . . .আটদিন হসপিটালে থেকে যখন শুক্লাকে নিয়ে বাসায় ফিরল কাবেরী রায় তখন জানা গেল, বাড়িওয়ালা আউয়াল শেখ শুক্লাকে চকলেট, সম্পাপ্ড়ি দেখিয়ে তার হাতেই সেদিন চাবিটা হাতে নিয়েছিল! তালা খুলে ঘরে ঢুকেছিল! তারপর...
সনাতন পোদ্দার প্রতিবেশিকে জানালে তার উপরই সবাই চড়াও হলো। কেউ কেউ বলছিল, ‘‘এসব বিষয়ে শব্দ না করাই ভালো।’’ কেউ কেউ বলছিল, ‘‘আপনি বরং বাসাটা ছেড়ে অন্য মহল্লায় চলে যান!’’ দু’এক জন মহিলা কাবেরী রায়কে ফিসফিস করে বলেছিল, ‘উঠতি মাই্য়া নিয়া এই বাড়িতে উঠছিলেন ক্যান, জানেন না, আউয়াল শেখ একটা কুত্তা। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটাইছে। এই জন্যই তো দেখেন না বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা। কেউই এই বাড়িতে থাকতে পারে না। কেউ কিচ্ছু কইতেও পারে না। ক্ষমতা আর ট্যাকা দিয়া সবমুখ কিনা ফ্যালে। . . .শুনছি, হ্যার মাইয়ারাও নাকি হ্যারে ভয়ে ভয়ে চলে!’’ কাবেরী রায় থানা পুলিশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু সনাতন পোদ্দার চাননি বিক্ষত মেয়েটাকে আরেকবার করাতের নিচে ফেলতে; তিনি জানেন, এই কেইস প্রমান করতে হলে সাক্ষাৎ যন্ত্রণার চেয়ে অধিক যন্ত্রণার মুখোমুখি হতে হয় সব ভিকটিমকে। পুরুষেরাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এসব মামলার। সে যন্ত্রণা; যন্ত্রণার চেয়েও অপমানের।
বাসাটা ছেড়ে আসার সময় আউয়াল শেখকে সামনে পেয়ে কাবেরী রায় দাঁতে দাঁত চেপে শুধু বলেছিলেন, আপনি একটা পশু, নেকড়ের চেয়েও হিংস্র পশু!!
এখন বিকাল। শুক্লা ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। কাবেরী রায় মেয়েকে বুকের কাছে জড়িয়ে রেখেছেন পশমী পুতুলের মতো। আর শুক্লার মুখ থেকে বের হচ্ছে, মা ব্যতা. . .ব্যতা।

 

জোবায়ের মিলন
সহকারী বার্তা প্রযোজক, বার্তা বিভাগ, এনটিভি

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top