সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

বাংলার ঐতিহ্য নৌকা বাইচ: শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
২৭ মে ২০২০ ২২:২১

আপডেট:
২৮ মার্চ ২০২৪ ১৬:৫৮

 

নদীমাতৃক বাংলাদেশ। নদীর তরঙ্গভঙ্গের সঙ্গে এই মাটির মানুষদের শৈশব মিতালি। নদী তাই হয়ে উঠেছে এখানকার মানুষের প্রাণোচ্ছল ক্রীড়াসঙ্গী। এই প্রেক্ষাপটে নদীবক্ষে নৌকা শুধু যোগাযোগের মাধ্যমই নয়, হয়ে উঠেছে জলক্রীড়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নৌকা বাইচ তারই একটি দৃষ্টিনন্দন রোমাঞ্চময় দৃষ্টান্ত। আবহমানকাল থেকে বাংলার ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ নৌকা বাইচ। আবেগ উত্তেজনার নৌকা বাইচ হয়ে ওঠে আপামর মানুষের নির্মল আনন্দের সপ্রাণ প্রতিভূ।

বাংলাদেশের প্রচীন ঐতিহাসিক খেলাগুলোর মধ্যে নৌকাবাইচ অন্যতম। প্রাপ্ত রেকর্ড অনুযায়ী ধারণা করা হয়, খ্রীষ্টপূর্ব প্রায় ২০০০ বছর আগে মেসোপটেমিয়ার লোকেরা ইউফ্রেটিস নদীতে এক ধরনের নৌকা বাইচের আয়োজন করতো। এর কয়েক শতাব্দীর পর মিসরের নীলনদের জলে নৌকা প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এরপর ছড়িয়ে পড়তে থাকে এর প্রসার। অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা এখনও ব্যাপক জনপ্রিয়।

১৯০০ সাল থেকে অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় এ পর্যন্ত প্রায় ১৩৫ টি ফাইনাল হয়েছে। এর মধ্যে ২৬ বার যুক্তরাষ্ট্রে, ২৫ বার জার্মানি ও ১৪ বার যুক্তরাজ্য বিজয়ী হয় ‘বাইচ’ শব্দটি ফরাসী। ফরাসীদের সময় এই খেলার উৎপত্তি হলেও এর আধুনিক ছোয়া লাগে ব্রিটিশদের সময়। পরে ছড়িয়ে পরে ভারতবর্ষে। সর্বত্র জনপ্রিয় হতে থাকে খেলাটি। সেই ধারাবাহিকতায় এই জলপথে নৌকা বাইচ জনতার জনপ্রিয় প্রতিযোগিতা হিসেবে স্থান করে নেয়। সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে ইতিহাসের প্রসার ঘটে। বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জের ঐতিহ্য রক্ষার্থে ১৭ সেপ্টেম্বর মফস্বল শহর মুন্সীগঞ্জের পাশের নৌকা বাইচটি ছিল এই অঞ্চলের আলোচিত একটি বড় উৎসব। এই কর্মকান্ড নগন্য মনে হলেও এই জনপদের হারানো ঐতিহ্য নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার চেষ্টায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে। আয়োজকরা রেকর্ড পরিমাণ দর্শক সমাগম দেখে প্রতিবছরই এই উৎসব করার ঘোষণা দিয়েছে।

সমাজ বা রাষ্ট্রীয় ক্রান্তিলগ্নে জনসাধারণের মনমানসিকতা, অসমাজিক, অপসংস্কৃতি চর্চা, সামাজিক অবক্ষয় রোধ, বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার মধ্যে দিয়ে মানসিক উৎকৃষ্ট সাধনের জন্য সহায়ক।

খেলাধুলা শুধু সমাজের জনগণের বিনোদন আর রোগ নিরাময় হিসেবেই কাজ করে না, এটা হতে পারে একজন ব্যক্তি, সমাজ তথা রাষ্ট্রের পরিচয়। অনুসন্ধানে দেখে গেছে, পৃথিবীতে অনেক জাতি আছে, যারা শুধু তাদের ঐতিহ্যগত খেলাধুলা খেলেই আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তাদের পরিচিতি। যেমন ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইতালি ইত্যাদি।

এই বাংলায় প্রচলিত আছে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা যেমন নৌকা বাইচ, হা-ডু-ডু, ফুটবল, কানামাছি, দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট ইত্যাদি। এই সমস্ত খেলাধুলা সমাজের একে অপরের সঙ্গে যেমন পরিবারিক বা সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়ন করে, বিনোদনের ও তেমনি সর্বোত্তম মাধ্যম। তার মধ্যে অন্যতম খেলা আমরা ধরতে পারি নৌকা বাইচ। এই আয়োজনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের মেলা, মানুষের মাঝে এক আনন্দময় মুহূর্ত সৃষ্টি করতো, বাড়ত এক গ্রাম হতে অন্য গ্রামের হৃদ্যতা। সবাই মিলেমিশে কাজ করতো, একে অপরে সহযোগিতায় এগিয়ে আসতো, একে অন্যের বিপদে এগিয়ে আসতো। যার ফলে সমাজে সুখ শান্তি বিরাজ করতো এবং সেই সময়ের যুব ছেলেমেয়েদের সংস্কৃতি, খেলাধুলার চর্চার মধ্যেদিয়ে তারা সামাজিক ব্যাধি থেকে দূরে থাকত।

কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে নৌকা বাইচের আয়োজন চলছে। এই আয়োজন অব্যাহত থাকলে নৌপথের খেলা দীর্ঘদিনের হারানো ঐতিহ্য নৌকা বাইচ পুরোপুরি স্বরূপে ফিরে না আসলেও অন্তত টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। এই খেলাকে সারাদেশে আগের অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার পথ আমরা নষ্ট করে ফেলেছি। বিভিন্নভাবে নদী দখল ও কল কারখানার বর্জ্যরে মাধ্যমে নদীকে মেরে ফেলেছি নষ্ট করে ফেলেছি নদীর পানি। নদী হারিয়ে ফেলেছে তার স্বাভাবিক গতি। ফলে পানি শুকিয়ে এমনিতেই হারিয়ে যাচ্ছে নৌপথের খেলা নৌকা বাইচ। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও ইছামতি নদীতে তাই এখন আর নৌকা বাইচের আয়োজন দেখা যায় না।

প্রমত্তা নদীবক্ষে সঙ্গীতের তাল লয়ে দাঁড়ীদের ছন্দময় দাঁড় নিক্ষেপে নদীজল আন্দোলিত করে যে মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের অবতরণা হয় তা অতুলনীয়। মাঝিদের একত্রে জয়ধ্বনিতে এবং একই লয়ের গানে তালে ঝোকে ঝোকে বৈঠার টানে এক সঙ্গে পানিতে এক অপূর্ব সুরলহরী সৃষ্টি হতে থাকে।

গায়েন বা পরিচালকের কাসির শব্দ এই বৈঠার এবং গানের গতি বজায় রাখতে সাহায্য করে। অন্য সব নৌকাকে পেছনে ফেলে নিজেদের নৌকাকে সবার আগে যাওয়ার চেষ্টার প্রয়োজন বোধে কাঁসির শব্দের মাধ্যমে বৈঠার গতি বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয় এবং সেই সঙ্গে গানের গতিও বেড়ে চলে। এ ছাড়া এই সময় গানের মধ্যে হৈ হৈয়া এই ধরনের শব্দের ব্যবহার ও দেখা যায়। এটিই সারি গানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। মাল্লাদের কণ্ঠ যখন দরাজ হয়, তখন বিশাল নদীবক্ষই যেন উন্মনা হয়ে ওঠে।

 

শাহান আরা জাকির পারুল 
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top