সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

কিশোর সুকান্ত হয়ে উঠলেন গণমানুষের কবি : আফরোজা পারভীন


প্রকাশিত:
২৮ মে ২০২০ ২২:০০

আপডেট:
২৮ মে ২০২০ ২৩:৪০

 

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের মৃত্যুদিবস চলে গেল নিঃশব্দে। দিনটা ছিল ১৩ মে। এটা ঠিক যে এই করোনাকালে শব্দ করে জন্মদিন, মৃত্যুদিবস পালনের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু করোনা না হলেও যে দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হতো তেমন মনে করি না। কারণ দিন দিন সুকান্ত চলে যাচ্ছেন বিস্মৃতির অতলে। আমাদের ছেলেবেলায় সুকান্ত যেভাবে স্মরিত হতেন এখন তা হন না। একালের খুব অল্প ছেলে মেয়েই তাঁর নাম জানে। লেখা পড়া তো পরের কথা।
সুকান্ত জন্মেছিলেন ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট কলকাতায়, মাতামহের ৪৩, মহিম হালদার স্ট্রিটের বাড়িতে। লোকান্তরিত হন ১৯৪৭ সালের ১৩ মে। সে হিসেবে তখন সুকান্তের বয়স মাত্র বিশ বছর আট মাস। বিশ বছর আট মাস বয়সের একজন মানুষকে কিশোর ছাড়া আর কিইবা বলা যায়! তাই সুকান্তকে অধিকাংশ মানুষ ‘কিশোর কবি’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। কিন্তু আসলে কি তিনি কিশোর কবি সেটা সত্যিই ভাবনার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা গানের কলি মনে পড়ে,
যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে
যে নদী মরুপথে হারালো ধারা
জানি গো জানি তাও হয় নি হারা।
এই লাইনগুলো সুকান্তর ক্ষেত্রে প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক। একুশ বছরের সুকান্ত ছিলেন একটা ফুলির কুড়িসম। কুড়ি আস্তে আস্তে দল মেলবে, প্রস্ফুটিত হবে, সুবাস ছড়াবে, চারদিক আমোদিত করবে এটাই তো নিয়ম। মানুষ বড় হবার সাথে সাথে তার চেনা জানার পরিধি বাড়ে, পঠন পাঠন বাড়ে, বিভিন্ন ধরণের মানুষের সাথে পরিচয়ের ফলে তার অভিজ্ঞতা বাড়ে, ঘুরে বেড়ানো, দেশভ্রমণ বা মানুষের মানসভ্রমণের ফলে সে নিজেকে ঋদ্ধ করে। আর এসবই একজন লেখকের পুঁজি। সুকান্তের ক্ষেত্রে এসবের কোনোটিই হয়নি । কুড়ি প্রস্ফুটিত হবার আগেই ঝরে পড়ল । তখন সুকান্তের বয়স মাত্র ২০ বছর আট মাস। আর তাঁর সৃজনকাল ৫-৬ বছর। তাও তিনি একেবোরেই অল্প বয়স থেকে লেখা শুরু করেছিলেন বলে। সুকান্ত যে বয়সে মারা যান তার থেকে তিনগুণ চারগুণ বয়সের কবি লেখকের অনেকে পরিমাণ ও গুণগত দিক থেকে তাঁর মতো লেখালিখি করতে পারেননি। অনেকে তো পয়তাল্লিশ পঞ্চাশের পরে লেখা শুরু করেন। তাহলে সুকান্তকে আমরা কিশোর কবি বলব কি করে? কিশোর সুকান্ত তো অনেক পরিণত ও পৌঢ় লেখকের চেয়ে অনেক বেশি এবং অনেক ভালো কাজ করেছেন। বরং তাঁকে বলা যেতে পারে কিশোর বয়সের কবি।
আমরা আসলে অনেককে অনেক অভিধা দিয়ে গন্ডিবদ্ধ করে ফেলি। কবি জসিমউদ্দিন পল্লীজীবন নিয়ে অনেক ভালো ভালো রচনা করেছেন। কাজেই তাঁর নাম হয়ে গেল পল্লীকবি। এভাবে একজন কবি সাহিত্যিককে বৃত্তবন্দি করে ফেলা ঠিক না । জসিম উদ্দিনের পল্লীজীবনভিত্তিক কবিতা ছাড়াও বিভিন্ন ধাঁচের অনেক কবিতা আছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কবিতা আছে। অথচ তিনি হয়ে গেলেন পল্লীকবি। এটা তার খন্ডিত পরিচয়মাত্র। বিষয়টি প্রাসঙ্গিক বলে উল্লেখ করলাম।
কবি সুকান্ত আসলে গণমানুষের কবি। কীভাবে? আমরা একটু কবির পারিবারিক পরিমন্ডল সম্পর্কে আলোকপাত করি। কবির আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশের মাদারিপুরের কোটালিপাড়া উপজেলার উনশিয়া গ্রামে। বাবার নাম নিবারণ ভট্টাচার্য, মায়ের নাম সুনীতি দেবী। দারিদ্র এবং দুঃখকষ্টে কবির পিতা-পিতামহ কলকাতায় চলে যান। সুকান্ত তাঁর বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান। বাবার প্রথম স্ত্রী একটা ছেলে সন্তান রেখে মৃত্যুবরণ করেন। সেই দাদা মনমোহন ভট্টাচার্য ও বৌদি সরযূ দেবীর সঙ্গে অনেক ঘনিষ্ঠ ছিলেন কবি, গভীর সম্পর্ক ছিল । তাদের ¯েœহধারায় সিক্ত ছিলেন সুকান্ত । সুকান্ত ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয়; অন্যরা হলেন মনমোহন, সুশীল, প্রশান্ত, বিভাস, অশোক ও অমিয়। বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবারে, পঠন-পাঠন এবং প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য ও শাস্ত্রচর্চার মধ্য দিয়ে বড় হন সুকান্ত। বাড়িতে রবীন্দ্রকাব্য, কল্লোল, কালিকলম, প্রগতি-র আধুনিক সাহিত্য পাঠ ও শোনা হতো নিয়মিত। এভাবেই কবির সাহিত্যবোধের হাতেখড়ি। কবির জীবনে তাঁর জেঠতুতো দিদি রাণী দি-এর প্রভাব ছিল অসামান্য। সুকান্তর সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন তিনি। ছোট্ট সুকান্তকে গল্প-কবিতা শুনিয়ে তাঁকে সাহিত্যের প্রথম ছোঁয়া দেন তিনি। সুকান্তকে কোলে নিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতেন। মা তাঁকে রামায়ন-মহাভারত পড়ে শোনাতেন। সে সময়ের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ‘রমলা’ খ্যাত মণীন্দ্রলাল বসুর ‘সুকান্ত’ গল্পটি পড়ে রাণীদিই কবির নাম রেখেছিলেন ‘সুকান্ত’। কবির জীবন মসৃণ ছিল না। তাই এত যে প্রিয় রাণীদি, তিনি অকস্মাৎ মারা গেলেন। প্রবলভাবে একা হয়ে গেলেন কবি। ১৯৩৭ সালে এগারো বছর বয়সে ক্যান্সারে মারা গেলেন মা। এর এক বছর পরেই সবচেয়ে বড় জ্যাঠতুতো দাদা গোপাল ভট্টাচার্য মারা যায়। একের পর এক মৃত্যুশোক ১১-১২ বছরের সুকান্তকে করে তুলেছিলো হতাশাক্রান্ত। বিষাদাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন তিনি । নিঃসঙ্গ থেকে নিঃসঙ্গতর হয়ে ওঠেন। ব্যথার ভার বহন করা তখন কবির কাছে দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। এসময় কবিতাই ছিল তাঁর একাকীত্বের সঙ্গী। কিশোর সুকান্ত হঠাৎ করেই বড় হয়ে গেলেন যেন। কৈশোরেই হয়ে গেলেন কৈশোরোত্তীর্ণ। রচনা করে চললেন একের পর এক কবিতা।
সুকাান্তর বাবার ‘সারস্বত লাইব্রেরি’ নামে একটা বইয়ের দোকান ছিল। এই বিষয়টি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তাঁর বাবা কাপড়ের ব্যবসা করতে পারতেন, মনিহারি দোকানদারি করতে পারতেন বা করতেন পারতেন অন্য কোনো ব্যবসা। কিন্তু তা না করে সেই আমলে যখন বইয়ের ব্যবসা এমন কোনো অর্থকরি ব্যবসা নয়, তখন তিনি বইয়ের দোকান করলেন। অর্থাৎ তিনি বই ভালবাসতেন। সুকান্তর বাবা পন্ডিত আর রসজ্ঞ মানুষ ছিলেন। লাইব্রেরি থেকে নানা ধরণের বই এনে পড়তেন কবি, যৌথ পরিবারের অনেক ভালো ভালো বিষয় কবি আত্মস্থ করেছিলেন। তাঁর অন্যতম রবীন্দ্রচর্চা। তাছাড়া একজন ভালো লেখক অবশ্যই একজন ভালো পাঠক। এই বৈশিষ্ট্যটিও সুকান্তর ছিল। প্রচুর বই পড়তেন তিনি। তাঁর প্রিয় বইয়ের তালিকায় বিভূতিভুষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’-র ছিল বিশেষ স্থান । বইটি সম্পর্কে সুকান্ত বলেছিলেন, “ধর্মগ্রন্থের সঙ্গে সমান আদরে এই বই সকলের ঘরে রাখা উচিত”। তাঁর মনে ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি গভীর অনুরাগ । একবার শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথকে দেখার জন্য কলকাতায় মহাজাতি সদনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে চলে গিয়েছিলেন!
কাজেই এহেন পরিবারের ছেলে লেখক হবে, কবি হবে এটা আর বেশি কথা কি। বলা হয়ে থাকে, সকালের শুরু দেখেই বোঝা যায় দিনটা কেমন যাবে। সুকান্তর ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। শৈশবেই তাঁর সাহিত্যানুরাগের স্ফুরণ ঘটে । আট-নয় বছর বয়স থেকেই লিখতে শুরু করেন তিনি। স্কুলের হাতে লেখা পত্রিকা ‘সঞ্চয়’ এ একটি ছোট্ট হাসির গল্প লিখে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর বিজন গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিখা’ কাগজে প্রথম ছাপার মুখ দেখে তাঁর লেখা ‘বিবেকানন্দের জীবনী’। মাত্র এগার বছর বয়সে ‘রাখাল ছেলে’ নামে একটি গীতিনাট্য রচনা করেন। এটি পরে তাঁর ‘হরতাল’ বইতে সংকলিত হয়। শুধু লেখা নয়, পাঠশালাতে পড়ার সময়েই ‘ধ্রুব’ নাটিকার মূল চরিত্রে অভিনয় করেন সুকান্ত । সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাল্যবন্ধু লেখক অরুণাচল বসুর সঙ্গে মিলে হাতে লেখা কাগজ ‘সপ্তমিকা’ সম্পাদনা করেন। সুকান্তর জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছিল কলকাতার বেলেঘাটার ৩৪ হরমোহন ঘোষ লেনের বাড়িতে। শৈশব কাটিয়েছেন বাগবাজারের নিবেদিতা লেনের বাড়িটিতে। সেখানকারই কমলা বিদ্যামন্দিরে তাঁকে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ভর্তি করা হয়। কমলা বিদ্যামন্দিরেই সুকান্তের সাহিত্যের হাতেখড়ি। কমলা বিদ্যামন্দিরে লেখাপড়ার পাঠ চুকবার পর সুকান্ত ভর্তি হন বেলেঘাটা দেশবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়ে। পড়াশুনা ভালো লাগতো না কবির, ভালো লাগতো না বাধা ধরা নিয়ম-কানুন।
সুকান্ত সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯৪২ সালে যোগ দেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে। ১৯৪৪ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৪৫ এর আগে তিনি বামপন্থী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন।
তিনি যখন বেড়ে উঠছেন তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। কিন্তু রয়ে গেছে তার অভিঘাত। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করে শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের ন্যায্য আন্দোলনকে দাবিয়ে রাখা হয়েছে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ-আগ্রাসন চলছে। বিজ্ঞান-শিক্ষা-বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশ ও উদারনৈতিকতাকে গ্রাহ্য না করে শোষক শ্রেণি নেতিবাচক অর্থে প্রচার করছে। অলৌকিকতা, আধ্যাত্মিকতা, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, সংকীর্ণবাদ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দিয়ে বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন চালু রেখেছে ফ্যাসিবাদী-শক্তিসমূহ। জার্মানি, ইতালিতে নাৎসিবাদ, ফ্যাসিবাদ শক্তিশালী হচ্ছে। অন্যদিকে কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে সংঘটিত দুনিয়া কাঁপানো ‘অক্টোবর বিপ্লব’-এর মাধ্যমে প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন আত্মপ্রকাশ করেছে । ঔপনিবেশিকদের পদানত অঞ্চলগুলোতে গড়ে উঠেছে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাব। গভীরভাবে ভাবিত হয়ে লেখনি ধারণ করেছেন অনেক শিল্পী-সাহিত্যিক। এ দলে ছিলেন ম্যাক্সিম গোর্কি, রম্যা রঁলা, টমাস মান, আন্দ্রে মালরো, ফস্টার, স্ট্যাটি প্রমুখ। ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সরোজিনী নাইডু, মুনশী প্রেমচন্দ প্রমুখ । এরকম যুগ ও সমাজ পরিবেশে জন্ম নেন সুকান্ত, বেড়ে ওঠেন একটু একটু করে।
সুকান্ত চারপাশের নিরন্ন মানুষের কথা ভাবতেন। ভাবতেন খেটে খাওয়া ক্ষুধার্ত মানুষের কথা। শোষক আর শোষিতের বৈষম্য তাঁর মনে গভীরভাবে বাজতো। পরাধীন ভারতবর্ষের মুক্তির আকাঙক্ষা তাঁকে উদ্বেল করত। আর তাই তাঁর লেখনি হয়ে উঠল শাণিত, ক্ষুরধার, অচঞ্চল । সে লেখনির শক্তি হারিয়ে দিলো বোমা বন্দুকের আওয়াজ, তীব্রতা। এমনই প্রদীপ্ত আর ধারারো ছিল তাঁর লেখনি যে যেন ঘুমান্ত মানুষ জেগে ওঠা কোনো কঠিন কাজ নয়।
বন্ধু, তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।
সুকান্তর এই কবিতা পরাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীন হবার আকাঙক্ষা আর মাটির শক্তির ইঙ্গিত করে। সত্যিই তো বাংলার মাটি যে দুর্জয় সেটা তো প্রমাণিত হয়েছে বহুবার, বহুভাবে।
অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি
জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি।
অবাক পৃথিবী! আমরা যে পরাধীন।
অবাক, কী দ্রুত ক্রোধ জমে দিন দিন;
অবাক পৃথিবী! অবাক করলে আরো-
দেখি এই দেশ অন্ন নেইকো কারো।
(অনুভব, ছাড়পত্র)
দেশ পরাধীন। ইংরেজের শাসন, অত্যাচারে বঞ্চিত, লাঞ্ছিত ক্ষুব্ধ। মানুষ নিরন্ন । তারা ক্ষুধার নিবৃত্তি চায়, স্বাধীন স্বদেশ চায়।
হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়
এবার কঠিন, কঠোর গদ্য আনো,
পদ-লালিত্য ঝঙ্কার মুছে যাক
গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো!
প্রয়োজন নেউ কবিতার ¯িœগ্ধতা-
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,
ক্ষধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়:
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।
( হে মহাজীবন, ছাড়পত্র)
আজ আর এই বুভুক্ষু নিরন্ন ক্ষুধার্ত পরাধীন পৃথিবীতে কোনো কবিতা নেই। নেই কোনো গান বাজনা মুর্ছনা। পেটে ক্ষুধা থাকলে কোনো পদ্য আসে না। সারাটা দুনিয়া হয়ে পড়ে গদ্যময়। পূর্ণিমার চাঁদকেও তখন ঝলসানো রুটি মনে হয়। চাঁদের চেয়েও ওই ঝলসানো রুটির জন্য মানুষের আকাক্ষা বেড়ে যায়। এই যে ভাবনা, এই যে ক্ষুধার চিত্রকল্প রচনা এটা সুকান্তের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল তিনি মানুষকে ভালোবেসেছিলেন বলেই।
আমরা তো সবাই ডাকপিয়নকে দেখেছি। আমাদের ছেলেবেলায় ডাকপিয়ন সাইকেলে চিঠি বিলি করত। সুকান্তর সময়ে ডাকপিয়ন পিঠে বোঝা বেধে দৌড়াতো। সে বোঝায় চিঠি থাকতো, টাকা থাকতো, থাকতো মানিঅর্ডার। অথচ ওই রানার বা ডাকপিয়নের পেটে যে খাবার ছিল না তা আমরা কেউ ভাবিনি। ভেবেছিলেন সুকান্ত।
ঘরেতে অভাব, পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালো ধোঁয়া,
পিঠেতে টাকার বোঝা তবু এ টাকাকে যাবে না
ছোঁয়া,
(রানার)
কি নির্মম প্রহসন মানুষের জীবনের! ঘরে খাবার নেই। অভাবে পৃথিবীটা অন্ধকার মনে হচ্ছে। কিন্তু পিঠেতে যতই টাকা বাধা থাকুক ও টাকায় হাত দেবে না রানার। কারণ এ টাকা মানুষের, রানারের নয়। এই যে সততার বোধ, রানারের প্রতি ভালবাসা এটা আমরা বার বার সুকান্তে পাই।
সুকান্তর নিজের জীবনেরও একটা গল্প আছে। একবার সুকান্ত চট্টগ্রাম এসেছিলেন একটা অনুষ্ঠানে। ফেরার সময় খুব কষ্ট পেয়েছিলেন ক্ষুধায় । তাঁর কাছে খাবার মতো নিজের টাকা ছিল না। কিন্তু তাঁর কাছে পার্টি ফান্ডে জমা দেবার জন্য দশ টাকা ছিল। সেটা ফান্ডে জমা দিতে ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। সে সময় দশ টাকা অনেক টাকা। কিন্তু দুদিন ধরে ক্ষুধায় কষ্ট পেলেও ওই টাকা তিনি ভাঙেননি। অথচ ভাঙলে যে এমন বড় অপরাধ হতো তাও না। তিনি পরে টাকাটা পূরণ করে দিতে পারতেন। তিনি তা করেননি। এমনই সৎ ছিলেন সুকান্ত।
চলে যাব-তবু আজ
যতক্ষণ এ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব
জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর
বাসযোগ্য করে যাবো আমি
নবযাতকের কাছে এ
আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
(ছাড়পত্র, ছাড়পত্র)
গোটা পৃথিবী কলুষিত । জঞ্জালে বোঝাই। ১ম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয বিশ্বযুদ্ধের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে । সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা জলছে। দুর্ভিক্ষ আসন্ন। মারি মড়ক মহামারি ধেয়ে আসছে। পৃথিবীব্যাপী একই অবস্থা। এ পৃথিবী এখন আর নবযাতকের বাসযোগ্য নয়। তাই কবি প্রাণপণে জঞ্জাল সরিয়ে পৃথিবীকে নবযাতকের বাসযোগ্য করার অঙ্গীকার । এ অঙ্গীকার তিনি করছেন নবযাতকের কাছে। এখানে কবি ভেবেছেন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট।
সুকান্ত সব শ্রেণি পেশার মানুষের কথা ভেবেছেন, ভেবেছেন পেশাহীন বেকারের কথা। তাঁর সহমর্মি মন সব সাধারণ আর খেটে খাওয়া মানুষকে জড়িয়ে থেকেছে।
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে
লিখি কথা,
আমি যে বেকার,
পেয়েছি লেখার স্বাধীনতা।
(দেয়ালিকা)
এ কবিতা শুধুমাত্র এক বেকার বা বেকার সম্প্রদায় নিয়ে নয়। বেকার মানুষের কারো কাছে কোনো দায়বদ্ধতা নেই। সে যা অন্যায় মনে করে তারই প্রতিবাদ করতে পারে, লিখতে পারে। সুকান্ত কারো চাকরি করতেন না। তাই তিনি হাত খুলে লিখতে পেরেছিলেন মুটি মজুর কুলি শ্রমজীবী আর উৎপাদন যন্ত্রের সাথে জড়িত মানুষের কথা । যাদের শ্রমে অন্যের বিত্ত বাড়ে আর তাদের থালা থাকে শূন্য।
সুকান্ত সূর্যের কাছে ‘রাস্তার ধারের উলঙ্গ ছেলেটিকে’ উত্তাপ দেবার জন্য পরম আকুতি জানিয়েছিলেন। তিনি সিগারেট, সিঁড়ি, একটি মোরগ এদের রূপক করে আপামর জনতার ক্ষুধা দারিদ্র বঞ্চনার কথা বলেছেন। পদ্য কী করে গদ্যের চেয়েও বেশি সত্য হয়ে ওঠে, সুকান্ত তা বারবারই দেখিয়ে দিয়েছেন। কবিতা শুধু অদেখা, অছোঁয়া, বিমূর্ত বা ভাবের বিষয় নয়- সুকান্তর কবিতা পড়লে তার মূর্ততা পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা যায়। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে চারপাশের চেনা চিত্র দেখে।
সুকান্ত সমগ্র-তে লেখা সুকান্তর চিঠিগুলির বেশিরভাগই বন্ধু অরুণাচল বসুকে লেখা। অরুণাচল বসুর মা কবি সরলা বসু সুকান্তকে পুত্রের মতো স্নেহ করতেন। ছেলেবেলায় মাতৃহারা হলেও সরলা বসু তাঁর সেই অভাব কিছুটা পূরণ করে দিতেন।
১৯৪৪ সালে কবি ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ’ এর প্রকাশনা ‘আকাল’ নামে একটি সাহিত্য সংকলন সম্পাদনা করেন। ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থি রাজনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হওয়ায় ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হবার পরই তাঁর শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটে।
কবি একদিকে পার্টির কাজ করছেন, অন্যদিকে লিখছেন। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় চৌদ্দ বছরের বালক সুকান্তের কবিতার খাতা পড়ে বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁকে সুকান্ত কবিতা দেখাতেন, পরিমার্জন আশা করতেন। এক স্মৃতিচারণে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লেখেন, ‘কীভাবে কবিতা লিখতে হবে তার জন্য সুকান্ত তাঁর কাছে আসতেন, কিন্তু কী লিখতে হবে সেই সংকট তার কখনোই ছিল না।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা এসে পড়ে কলকাতায়ও। যুদ্ধের তান্ডব চোখের সামনে না দেখলেও ভয়াবহতা অনুমান করে সবাই শঙ্কিত। এ সময় সুকান্ত বেশ কিছু কবিতা লেখেন। ‘পূর্বাভাস’ গ্রন্থে এসব কবিতা সংকলিত হয়েছে। সুকান্ত গভীর সংবেদনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন তাঁর এসব কবিতায়। কবিতায়, চিঠিপত্রে, নাটিকা, গল্প-গানে সর্বত্র তাঁর স্বাধীনতা আর শোষণমুক্তির কথা ছিল উচ্চকিত ।
১৯৪১ সাল থেকে সুকান্ত কলকাতা রেডিও-র গল্পদাদুর আসরে যোগদান করেন। সেখানে প্রথমে তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর সেই আসরেই নিজের লেখা কবিতা পাঠ করে তাঁকে শ্রদ্ধা জানান। গল্পদাদুর আসরের জন্য সেই বয়সেই তাঁর লেখা গান মনোনীত হয়েছিল। তাঁর সেই গানে সুর দিয়ে গেয়েছিলেন সেকালের অন্যতম সেরা গায়ক পঙ্কজ মল্লিক। আনন্দবাজার পত্রিকার সভ্যতালিকাতেও ছিল সুকান্তর নাম। সুকান্ত শুধুমাত্র কবি ছিলেন না। সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রে তাঁর ছিল অবাধ বিচরণ। তিনি লিখেছেন কবিতা ছাড়াও গান, গল্প, নাটক এবং প্রবন্ধ। তাঁর ‘ছন্দ ও আবৃত্তি’ প্রবন্ধটি পাঠ করলেই বেশ বোঝা যায় ঐ বয়সেই তিনি বাংলা ছন্দের প্রায়োগিক দিকটিই শুধু আয়ত্বে আনেন নি, সে নিয়ে ভালো তাত্ত্বিক দক্ষতাও অর্জন করেছিলেন।
তবে তিনি যাইই করেন না কেন, যাইই লেখেন না কেন, কমিউনিজম ছিল তাঁর প্রেরণা, ধ্যান-জ্ঞান। কলম ছিল তাঁর সংগ্রামের সাথী। খেটে-খাওয়া মেহনতি মানুষ ছিল তাঁর বেঁচে থাকার জীবনীশক্তি ও সৃষ্টির মৌলিক উপাদান। মার্কসবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি হিসেবে সুকান্ত কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান করে নেন। অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ের স্বার্থে ধনী মহাজন, অত্যাচারী প্রভুদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সক্রিয়। যাবতীয় শোষণ-বঞ্চনার বিপক্ষে সুকান্তর ছিল দৃঢ় অবস্থান। দূর করতে চেয়েছেন শ্রেণি বৈষম্য। চেয়েছেন মানবতার জয়। সাম্রাজ্যবাদীদের চিহ্নিত করে সাহিত্যকে শোষণমুক্তির হাতিয়ারে পরিণত করতে চেয়েছেন। অবস্থান নিয়েছেন মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, যুদ্ধের বিরুদ্ধে। উদ্যোগ, অনুভব, লেনিন, রবীন্দ্রনাথের প্রতি, ছাড়পত্র, জনরব এসব কবিতায় আমরা তাঁর নিদর্শন পাই।
অনেকে সুকান্তকে অবজ্ঞা করেছেন, স্লোগানসর্বস্ব কবি বলেছেন। সমালোচকরা বলেছেন, তিনি কবিতাকে স্লোগানে উচ্চকিত করেছেন। এ কথা সত্য, সুকান্তের অধিকাংশ কবিতা সরাসরি রাজনৈতিক কবিতা, শ্রেণি চেতনায় সমৃদ্ধ, বিদ্রোহ ও বিপ্লবের অঙ্গিকারে বলিষ্ঠ এবং সর্বোপরি মার্কসবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত। সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু সুকান্তের বর্ণনা দিয়েছেন এমন করে-“গর্কীর মতো, তার চেহারাই যেন চিরাচরিতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কানে একটু কম শোনে, কথা বেশি বলেনা, দেখামাত্র প্রেমে পড়ার মতো কিছু নয়, কিন্তু হাসিটি মধুর, ঠোঁট দু’টি সরল”। বুদ্ধদেব বসু সুকান্তের কথা আরো বলেছেন, “ যে চিলকে সে ব্যঙ্গ করেছিলো, সে জানতো না সে নিজেই সেই চিল; লোভী নয়, দস্যু নয়, গর্বিত নিঃসঙ্গ আকাশচারী, স্খলিত হয়ে পড়লো ফুটপাতের ভিড়ে, আর উড়তে পারলো না, অথবা সময় পেলো না। কবি হবার জন্যই জন্মেছিলো সুকান্ত, কবি হতে পারার আগে তার মৃত্যু হলো”।
বুদ্ধদেব বসুর এই উক্তির সাথে আমরা মোটেও একমত নই। কবি হবার আগে সুকান্তের মৃত্যু হয়নি। তিনি কবি হয়েছেন। তাই তাঁকে নিয়ে আমরা লিখছি। তিনি চিলকে কখনই ব্যঙ্গ করেননি, প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করেছেন। বুদ্ধদেব বসু, সুধীন দত্ত এরা মনে করতেন ‘আর্টস ফর আর্টস সেক’। অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেছেন বুদ্ধদেব বসুর সাথে। যেমন বিখ্যাত সাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায়। তিনি ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’ এই তত্ত্বের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘আর্টের ধোঁয়ায় এদের চোখ কটকট করে না, শিল্পীর কর্তব্য সম্বন্ধে এদের দ্বিধাও নেই। দুর্বলতাও নেই।’ বুদ্ধদেব বসু, সুধীন দত্তরা প্রগতির সাহিত্যের প্রগতির ধারাকে বুঝতে পারেননি এমন সমালোচনা সবসময়ই ছিল। মানুষ না থাকলে যে আর্ট হয় না কবি না হয়েও এটুকু বুঝি।
কবি নজরুলও সাম্যবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ‘মানুষ’, ‘কুলি মজুর’-এর মতো অনেক কালজয়ী কবিতা লিখেছেন। তাদের দুঃখ কষ্ট শোষণ বঞ্চনার কথা বলেছেন। প্রতিবাদ করেছেন, প্রতিকার চেয়েছেন। কিন্তু সুকান্ত আর নজরুলের মধ্যে এই জায়গাটিতে যেমন মিল আছে, কিছু অমিলও আছে। সুকান্ত মার্কসবাদে বিশ্বাসী ছিলেন, রাজনীতি করতেন। নজরুল তা করেননি। মানুষের দুঃখ কষ্টে তাঁর প্রাণ কেঁেদছে। আর সেই তাড়নাতেই এই অমর কবিতাগুলি লিখেছেন।
সুকান্তর সংসারে বিত্ত কোনোদিনই ছিল না। অসুস্থতা ছিল, অর্থাভাব ছিল। এসব তাঁকে কখনো দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি সারা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন মানুষকে জাগাতে, পার্টির জন্য কাজ করেছেন, পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, প্রচুর পোস্টকার্ড লিখেছেন। সভা-সমিতিতে গেছেন, মিটিং মিছিল করেছেন। একহাতে দশদিক সামলেছেন। তিনি ছিলেন ‘কিশোর বাহিনী’র সক্রিয় সংগঠক ও নেতা। তাঁরই উদ্যোগে শহরে-নগরে-সর্বত্র গড়ে উঠল ‘কিশোর বাহিনী’। একই সঙ্গে ‘জনযুদ্ধ’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। কঠিন খাটুনিতে আস্তে আস্তে ভেঙে পড়েছে তাঁর শরীর। ম্যালেরিয়া কালাজ্বর আগেই হয়েছিল। এবার তাকে ছেঁকে ধরে প্রাণঘাতী যক্ষা।
সুকান্তর জীবদ্দশায় তাঁর একটি গ্রন্থও প্রকাশিত হয়নি। তবে তাঁর কবিতা সমাদৃত হচ্ছিল । পত্র-পত্রিকায়, দেশে-বিদেশে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। অনুদিত হয়েছে। অসুস্থাবস্থায় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের আয়োজন চলছিল, মৃত্যুর কয়েকদিন আগে এই বইয়ের সমস্ত কবিতা হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে যখন সুকান্তর হাতে দেয়া হয়, তখন আনন্দে উঠে বসেছিলেন। কিন্তু সপ্তাহখানেক যেতে না যেতেই তাঁর আকস্মিক প্রয়াণ ঘটে। ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘ছাড়পত্র’ । তাঁর অন্যান্য রচনাবলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য : পূর্বাভাস (১৯৫০, কাব্যগ্রন্থ), মিঠেকড়া (১৯৫১, ছড়া), অভিযান (১৯৫৩, নাটিকা), ঘুম নেই (১৯৫৪, কাব্যগ্রন্থ), হরতাল (১৯৬২, গল্প), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫, গানের সংকলন) প্রভৃতি। দুই বাংলা থেকে সুকান্তসমগ্র নামে তাঁর রচনাবলি প্রকাশিত হয়েছে।
শুরুতে বলেছিলাম সুকান্ত হারিয়ে যাচ্ছেন কালের অতলে। কথাটা সর্বাশেং সত্য নয়। আদর করে তাঁকে স্মরণ না করলেও তাঁকে বিস্মরণও সম্ভব নয়। সুকান্ত এমন কবি যিনি হারান না। তিনি সবসময় সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে তরুণ আর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সুকান্ত প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। এবং আমি নিশ্চিত দেশের যে কোনো ক্রান্তিকালে সুকান্ত আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেন। হয়ে উঠবেন উদ্দীপনার উৎস। কারণ সুকান্তর কবিতায় আছে মেসেজ। তাঁর কবিতার সহজ সরলতা অনেককে আশ্চর্য ও মুগ্ধ করেছে, সেই সরলতার সমগ্র তাৎপর্য সকলের কাছে ধরা পড়েনি; কারণ আমরা শুধু প্রকাশভঙ্গিটাই বুঝতে চাই-বার্তাটি নয়!
১৯৪৭ সালের ১৩ মে কলকাতায় যাদবপুর টি বি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন গণমানুষের কবি সুকান্ত।
মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ কবি সুকান্ত বাংলা কাব্যধারার প্রচলিত প্রেক্ষাপটকে আমূল বদলে দিতে পেরেছিলেন। তাঁর কবিতায় অনাচার ও বৈষ্যমের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ পাঠকদের সংঘঠিত করে তোলে। চারপাশের মানুষকে নিয়ে সুকান্তর যে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি ছিল, তাই তিনি ঢেলে দিতেন কলমে-কাগজে। তিনি কবিতায় যতটা গণমানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছেন তা অনেক কবি পারেননি। তাই তিনি গণমানুষের কবি।



আফরোজা পারভীন
কথাসাহিত্যিক, প্রবন্ধকার, কলামলেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top