সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

মধুময় মধুমাসঃ সম্রাট বাবর, মির্জা গালিব ও রবীন্দ্রনাথ : সাইফুর রহমান


প্রকাশিত:
১৮ জুন ২০২০ ২২:১০

আপডেট:
১৮ জুন ২০২০ ২২:১২

সাইফুর রহমান

 

চার্বাক দর্শনে একটি প্রবাদ বেশ প্রচলিত। প্রবাদটি এমন- 'ঋণ করে হলেও ঘি খাও'। জেনে বা না জেনে আমাদের সমাজে হয়তো অনেকেই এ দর্শনটির বেশ অনুরাগী ও অনুসারী। কিন্তু এ দর্শনের আর একজন ঘোর অনুসারী ছিলেন নাম মির্জা গালিব। হ্যাঁ, আমি বিখ্যাত কবি যিনি দিল্লির মসনদ মাতাতেন তার কবিতায় সেই মির্জা গালিবের কথাই বলছি। ব্যক্তিজীবনে মির্জা গালিব বেশ আয়েশি ও ভোগবিলাসী ছিলেন। তার ভোগবাদী জীবনের বেশির ভাগ অর্থের জোগানই হতো ঋণ করে। মির্জা গালিব অসম্ভব ভাগ্যবান মানুষ ছিলেন। যে কোনো আর্থিক সংকটে (অবশ্য সমস্ত জীবনটাই তার কেটেছে আর্থিক সংকটে) কেউ না কেউ তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন সহৃদয় চিত্তে। কিন্তু আর কত? সব কিছুরই একটা সীমা বলে কিছু থাকে, মানুষ তো তার পাওনা টাকা ফেরত চাইবেই। আর সেটাই স্বাভাবিক। মির্জা গালিব আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়েছিলেন ঋণের সমুদ্রে। জীবনে বহু দেনা করেছেন তিনি। এ ঋণের শৃঙ্খল থেকে তিনি কখনই বের হয়ে আসতে পারেননি। দিল্লির এক মহাজন, তিনিও টাকা ধার দিয়েছিলেন মির্জা গালিবকে। সময়মতো টাকা শোধ করতে না পারায় মহাজনটি গালিবের নামে মোকদ্দমা ঠুকে দিলেন কোর্টে। শাস্তিস্বরূপ গালিবকে গারদ খাটতে হলো বেশ কয়েক মাস। কারাগার থেকে বের হয়ে আসার পর তিনি একদিন তার বাড়ির উঠোনে বসে আম খাচ্ছিলেন, তখন তার এক বন্ধু তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ওহে গালিব! জেলখানায় দিনগুলো কেমন কাটল? মির্জা গালিব প্রতি উত্তরে বললেন, মন্দ নয়, তবে জেল খেটেছি বলে মনে তেমন একটা খেদ নেই, কিন্তু জেলার ব্যাটা যদি আমাকে আমের মৌসুমটি পার করে ছাড়ত তবে তাকে আমি কোনো দিনও ক্ষমা করতে পারতাম না। মির্জা গালিব আম ফলটির প্রতি এতটাই অনুরক্ত ছিলেন যে যদি তার কোনো কবিতাপ্রেমী কিংবা অনুরাগী তাকে কিছু একটা দিতে চাইত তবে তিনি অম্লান বদনে বলতেন, 'ভালো জাতের কিছু সুস্বাদু আম পাঠিয়ে দিও তাতেই আমি সন্তুষ্ট।' মির্জা গালিব পাকা আম টিপে টিপে তুলতুলে করে চুষে খেতে বেশ পছন্দ করতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মোগল সম্রাট বাবরও তুলতুলে আম চুষে খেতে পছন্দ করতেন। রবিঠাকুর যে কতটা আমভক্ত ছিলেন সে কথা অনেকেই হয়তো জানেন। আম আসক্তির ছিটেফোঁটা পাওয়া যায় তার নানা চিঠিপত্র আর কবিতায় যেমন- 'বেতের ডালায় রেশমি রুমাল টানা সোনার বরণ আমের সুবাস ছড়িয়ে আছে।' রবীন্দ্রনাথ আম যে শুধু খেতেই পছন্দ করতেন তা কিন্তু নয়। তিনি ছুরি দিয়ে আমের খোসাও ছাড়াতেন খুব শৈল্পিকভাবে। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, 'বাঁ হাতে শক্ত করে পাকা আম ধরে রেখে ডান হাতের ধারালো ছুরিটি দিয়ে কথা বলতে বলতে কবি সেই আমের খোসা ছাড়াতেন। খোসাটা আস্ত সুন্দর একটি মালা হয়ে খসে পড়ত মাটিতে।' মোগল সম্রাট বাবরও আমের দারুণ ভক্ত ছিলেন। তিনিও মির্জা গালিব ও রবীন্দ্রনাথের মতো আম টিপে টিপে তুলতুলে নরম করে খোসায় ফুটো করে চুষে খেতে বেশ পছন্দ করতেন। আমকে হিন্দুস্তানের সেরা ফল আখ্যা দিয়েও আবার তিনি বলেছেন আম ফলটি কাবুলের খরমুজার (বাঙি ও তরমুজের মাঝামাঝি ধরনের একটি ফল) প্রায় কাছাকাছি। এতেই বোঝা যায় তিনি খরমুজা ফলটিও বেশ পছন্দ করতেন। কথায় আছে না 'কুল রাখি না শ্যাম রাখি'। আম ও খরমুজা নিয়ে বাবরের হয়েছিল এমনতর অবস্থা। তবে আম ফলটিকে যে তিনি বেশ ভালোবাসতেন এতে কোনো সন্দেহ নেই আর সে জন্যই তিনি বিহারের দ্বারভাঙায় প্রায় এক লাখেরও বেশি আম গাছ রোপণ করেছিলেন। বাদশা বাবর শুধু আমই পছন্দ করতেন না, আমের টক-মিষ্টি আচারও বেশ ভালোবাসতেন। নানা স্বাদের আচার খেয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের আমকেই সেরা বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।

এখন থেকে এক-দেড়শ' বছর আগে মানুষ আম যেমন খেত তেমনি খাওয়াতেও ভালোবাসত। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রাখাল দাশ এক গুণ খেতেন কিন্তু দশ গুণ আম মানুষকে খাওয়াতেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নিজে খেতে ভালোবাসতেন অন্যদেরও খাওয়াতেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আমগুলোকে সুন্দর করে ধুয়েমুছে নিজ হাতে কেটে খাওয়াতেন। কবি ভরতচন্দ্র ও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ছিলেন সে যুগের ভয়ানক রকমের আম খাইয়ে। মুর্শিদাবাদে এক প্রকার দুর্লভ ভুবন ভোলানো আম জন্মাত নাম 'কহিতুর'। তুলায় মোড়া সেসব আম জন্মানো হতো শুধু বাদশাহ ও নবাবদের জন্য। সেসব আমের গায়ে কালি দিয়ে নাম আর খাওয়ার নির্দিষ্ট তারিখ লেখা থাকত। আম খাওয়ার পর নবাব-বাদশাহরা সেসব আমের অাঁটি ফুটো করে দিতেন, যাতে সাধারণ মানুষ সে অাঁটি বুনে আম জন্মিয়ে খেতে না পারে।

শুধু ওপরে বর্ণিত হোমরা-চোমরারাই যে আম খেতে ভালোবাসতেন তা কিন্তু নয়, আসলে আম খেতে কম-বেশি আমরা সবাই পছন্দ করি। আমরা যে কী পরিমাণ আমখেকো তার একটি উদাহরণ দিচ্ছি। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান এ তিন দেশ সম্মিলিতভাবে পৃথিবীর মোট উৎপাদিত আমের তিন ভাগের দুই ভাগ উৎপাদন করে কিন্তু এ উপমহাদেশ থেকে বিদেশে রপ্তানি হয় মাত্র শতকরা এক শতাংশেরও কম। অর্থাৎ বিদেশে আমরা অনেক কিছু রপ্তানি করলেও আম নিজেরাই ভোগ করি।

আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আম বিক্রেতারাও কিন্তু বেশ হৃদয়চিত্তের অধিকারী হন। যেমন আমাদের পাবনা অঞ্চলে আমি কিছুকাল আগ পর্যন্তও দেখেছি আমের হালি চারটির পরিবর্তে পাঁচটি। আমার এক চাচা সামরিক বাহিনীতে মেজর ছিলেন। তখন তার পোস্টিং ছিল চট্টগ্রাম। তিনি ১০০ আম কেনার পর জানতে পারলেন আম বিক্রেতা ১০০ আমের দামে আসলে দিচ্ছে ১২৫টি আম। তিনি ভাবলেন ঢাকার সোয়ারীঘাটে আমের আড়ত থেকে আম কিনলে হয়তো আরো কিছু বেশি আম পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সোয়ারীঘাট থেকে আম কিনে বাড়ি ফিরে গণনা করে দেখলেন তাকে আম দেওয়া হয়েছে ১০০টিই। তিনি পুনরায় সেই আম বিক্রেতার কাছে গিয়ে বললেন, কী ব্যাপার! আপনার কাছ থেকে আম কিনলাম ১০০টি বাড়িতে গিয়ে গুনে দেখলাম আপনি ১০০টি আমই দিয়েছেন। প্রতি উত্তরে আম বিক্রেতা বললেন, আমি অন্যায়টা করলাম কী? আমার চাচা তখন চট্টগ্রামে আম কেনার কথা খুলে বললেন, তারপর ঢাকার সেই আম বিক্রেতা বললেন, চট্টগ্রামের আম বিক্রেতা মূর্খ ও নির্বোধ বলে আমিও কি তাই হব! ১০০ আম বিক্রির টাকা নিয়ে আপনাকে দেব ১২৫টি! আপনি তো দেখছি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। এতে স্পষ্ট বোঝা যায় পাবনা ও চট্টগ্রামের আম বিক্রেতারাই এ দেশে সবচেয়ে উদার।

আম কিন্তু একান্তভাবেই আমাদের নিজস্ব একটি ফল। নিজস্ব বললাম এ কারণে যে আমাদের দেশের অনেক ফলই বিদেশ থেকে আমদানি করা যেমন- আনারস, কামরাঙা, বাতাবিলেবু (জাম্বুরা) লিচু ইত্যাদি। আনারস, কামরাঙা এ দুটো ফল এসেছে ব্রাজিল থেকে। বাতাবিলেবু এসেছে ইন্দোনেশিয়ার জাভা থেকে। আর লিচু হচ্ছে চীনা ফল।

বিদেশ থেকে কীভাবে নতুন ধরনের ফলমূল আমদানি হয় তার একটা গল্প বলি। সম্ভবত উনিশ শতকের দিকে কলকাতা কি মুর্শিদাবাদ সঠিক করে এখন মনে পড়ছে না। সেখানকার কাগজকলে কিছু মুসলমান শ্রমিক কাজ করত। মুসলমান বলে দিনে তাদের বেশ কবার নামাজ পড়তে হয়। আর এতে বিঘ্ন ঘটে কাজের, সে জন্য কাগজকলের মালিক সেসব মুসলমান শ্রমিককে দিলেন কাগজকল থেকে ছাঁটাই করে। চাকরিচ্যুত হয়ে হতভাগা শ্রমিকগুলোর মধ্যে বেশকিছু লোক কাজের সন্ধানে জাহাজে চেপে ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীর নানা দেশে। তাদের মধ্যে আবার কজন গিয়ে পৌঁছাল ব্রাজিলে। সেখানকার আমাজান জঙ্গল বেশ বিখ্যাত। আর সেখানেই জন্মাত কাগজিলেবু। তো তারা বেশ ক'বছর পর চাকরিবাকরি শেষ করে বাড়ি ফিরে আসার সময় সঙ্গে করে নিয়ে এলো কাগজিলেবুর চারা। কাগজিলেবুর গন্ধ এতটাই মনোমুঙ্কর যে অচিরেই এ লেবু ছড়িয়ে পড়ল পুরো বাংলাদেশে। কাগজের কল থেকে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকদের হাত ধরে লেবুটি আমদানি হয়েছিল বলে সে লেবুটির নামই হয়ে গেল কাগজিলেবু। ভারত থেকেই খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ ও পঞ্চম শতকের দিকে আমের চাষাবাদ ছড়িয়ে পড়ে চীন ও এর প্রতিবেশী দেশগুলোয়। সম্ভবত অষ্টম ও নবম শতকের দিকে আরব বণিকদের বদৌলতে আম ফলটি গিয়ে পৌঁছে পূর্ব আফ্রিকায়। চতুর্দশ শতকের দিকে মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা আফ্রিকার মাদাগাস্কারে আম গাছ দেখেছিলেন বলে তার বইতে উল্লেখ করেছেন। তবে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় আমের আবাদ শুরু হয়েছিল পর্তুগিজ নাবিকদের হাত ধরে। ইংরেজি 'ম্যাঙ্গো' শব্দটির উৎপত্তি ভারতের মালায়লাম শব্দ 'মান্না' থেকে। কেরালার স্থানীয় লোকজন আমকে বলে 'মান্না'। আর সেই 'মান্না'কে পর্তুগিজরা তাদের মতো করে উচ্চারণ করত ম্যাংগা। পর্তুগিজ সেই 'ম্যাংগা' শব্দটি আরেকটু পরিবর্তিত হয়ে ইংরেজি শব্দ হয়ে গেল ম্যাঙ্গো। আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশে আম জন্মালেও ইউরোপের একমাত্র স্পেনেই আম জন্মে। তাও আবার শুধু মালাগা, আন্দালুসিয়া ও ক্যানারি আইল্যান্ডে।

সতের শতকের দিকে ভারত থেকে যখন আম ইউরোপ, আমেরিকা ও এর ঔপনিবেশিক দেশগুলোয় রপ্তানি হতো তখন আম ফলটি দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র আবিষ্কার না হওয়ায় সেগুলো আচারের মতো করে রপ্তানি হতো। সেই সঙ্গে অন্যান্য ফলমূলও আচার বানিয়েই সেসব দেশে রপ্তানি হতো। হাস্যকর বিষয় হলো সেসব আচারী অন্যান্য ফলমূলকেও সেসব দেশের লোকজন 'ম্যাঙ্গো' বলে সম্বোধন করত। আচার জাতীয় আম এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে অষ্টাদশ শতকের দিকে 'আম' শব্দটি 'আচার' শব্দের ক্রিয়াপদ হিসেব ব্যবহৃত হতে লাগল। অর্থাৎ আম মানে হচ্ছে 'আচার তৈরি করা'। সত্যিই অদ্ভুত তাই না? যারা গ্রেট ব্রিটেনে বসবাস করেন কিংবা যাদের সেখানে নিয়মিত যাতায়াত আছে তারা অবশ্যই দেখেছেন যে প্রায় প্রতিটি প্রাচ্য দেশীয় রেস্তোরাঁয় এখনো খাবার টেবিলে আমের মিষ্টি আচার রাখা থাকে। এবার বাংলায় আম শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে দু-চার কথা বলা যাক। ভারতে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি জৈন নামেও একটি ধর্ম আছে। জৈনধর্মের উদ্ভব খ্রিস্টধর্মেরও ৬০০ বছর আগে। এ জৈনধর্মে একজন দেবী আছেন নাম 'আম্বিকা'। জৈনধর্মে উল্লেখ আছে যে আম্বিকা দেবী সব সময় একটি গাছের নিচে বসে ধ্যান করতেন। নির্দিষ্ট একটি গাছের নিচেই যেহেতু তিনি ধ্যান করতেন সেহেতু কালক্রমে সেই গাছের নামই হয়ে গেল আমবৃক্ষ। আর আমবৃক্ষের ফলের নাম আম হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।

বর্তমান সময়ের এই বিজলিবাতি, কম্পিউটার ও ব্যস্তময় আধুনিক সমাজে বিভিন্ন ফলটলের প্রভাব হয়তো ব্যক্তিজীবনে তেমন একটা পড়ে না কিংবা এসব নিয়ে কারও ভাবার বা মাথা ঘামানোর সময়ও হয়তো নেই; কিন্তু ৫০ থেকে ১০০ বছর আগে, যখন ব্যক্তিজীবনে আধুনিক কোনো উপকরণই ছিল না, তখন মানুষ এসব ছোট ছোট জিনিস নিয়েই মেতে থাকত। আম কিংবা নানা পদের ফলফলাদি নিয়ে জমিদার, সম্পন্ন গৃহস্থ কিংবা গ্রামের আটপৌরে ঘরের পুরুষ বা বউ-ঝিরা যে কী রকম আমোদ-আহ্লাদ ও হ্যাংলামি করত তা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। তার পরও সে যুগে আম নিয়ে মানুষের আদিখ্যেতার দু-একটি নমুনা বর্ণনা করছি। সে সময় আম নিয়ে 'পাল্লাদার' নামে একটি খেলার বেশ চল ছিল। খেলাটির মর্মবস্তু হলো : একজন আম খাইয়ের চোখ বেঁধে দেওয়া হবে তারপর তার পাতে একটার পর একটা আম তুলে দেওয়া হবে আর সে খেয়ে খেয়ে সেগুলোর নাম বলে দেবে- এটা হাঁড়িভাঙা, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ইলশেপেটি ইত্যাদি। এ খেলায় বেশির ভাগ সময় সাধারণত অংশ নিত পেশাদার আম খাইয়েরাই। মাঝে মাঝে তারা ভাড়াও খাটত অর্থাৎ গালভরা শব্দে যাকে বলে সম্মানী, তা দিয়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হতো খেলায় অংশ নেওয়ার জন্য। সেসব আম খাইয়ে এতটাই দক্ষ ছিল যে তারা জীবনে ভুল করত কদাচিৎ। আম খাওয়ার সেই খেলা দেখার জন্য প্রচুর লোক জমত। গৃহস্থবাড়ির লোকজন আড়ত কিংবা ফলপট্টি থেকে চটের থলি ভর্তি করে যখন আম কিনে বাড়ি ফিরত, ঘরের বউ-ঝিরা সেসব আম প্রথমে পিতলের বালতি কিংবা গামলায় অন্তত এক ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখত। তারপর বোঁটা কেটে গুনে গুনে সেগুলোয় নম্বর বসাত। সবচেয়ে ভালো ও সরস আমগুলোর গায়ে লেখা হতো ১ নম্বর। তুলনামূলকভাবে একটু কম ভালোগুলোর গায়ে ২ নম্বর। আর শিলপড়া দাগি ও ফাটা আমগুলোর গায়ে লেখা হতো ৩ নম্বর। এসব বাছাই করা আম গৃহিণীরা কাটত বাখারি (বাঁশের ফালি বা চটা) কিংবা তাল নারিকেল গাছের সবৃন্ত পাতার ছুরি দিয়ে। কারণ ইস্পাতের ছুরি-বঁটি দিয়ে কাটলে আমে দাগ ধরে আর ফলের স্বাদও নাকি নষ্ট হয়ে যায়। তবে সাধারণ ঘরের মেয়েরা আম সাধারণত বঁটি দিয়েই কাটত।

পাঠক একটি বিষয় জেনে অবাক হবেন যে সে সময় এক এক জাতের ভালো আম কাটার জন্য ভিন্ন ভিন্ন বঁটির ব্যবস্থা থাকত। প্রতিবার আম কাটার পর বঁটি ধুয়েমুছে সেগুলো গৃহিণীরা লুকিয়ে রাখন পাছে অন্য কোনো ফল সেই বঁটিতে কাটা হয় এ ভয়ে। আমাদের দেশের গ্রামের মেয়েরা এখনো ঝিনুক ঘষে ঘষে তার মাঝখানে বড় একটি ছিদ্র তৈরি করে সেই ছিদ্রযুক্ত ঝিনুকটিকে ছুরি হিসেবে ব্যবহার করে আমের খোসা ছাড়ানোর জন্য।

অন্য কোনো জায়গার কথা বলতে পারি না কিন্তু পাবনায় ছেলেমেয়েরা এখনো প্রয়োজনে এভাবে বেশ ভালোভাবেই আমের খোসা ছাড়িয়ে নেয়। ভেবেছিলাম মধুমাসের আরও অন্যান্য ফল যেমন- লিচু, কাঁঠাল, তালশাঁস, তরমুজ ইত্যাদি বিষয়ে দু-চার কথা লিখব, কিন্তু আমের প্রতি স্বজনপ্রীতিটা একটু বেশি রকমেরই হয়ে গেল মনে হয়। আমের গল্প শোনাতে শোনাতেই বেলা শেষ। কাঁঠাল-লিচু ও অন্যান্য ফলের বিষয়গুলো তোলা রইল ভবিষ্যতের জন্য। সময় ও সুযোগ পেলে দুই কলম অবশ্যই লিখব।

 

ব্যারিস্টার সাইফুর রহমান
গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top