সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

নচাং যেবার এই জাগান ছাড়ি : আসিফ মেহদী


প্রকাশিত:
৩০ জুন ২০২০ ২২:৪৯

আপডেট:
৩০ জুন ২০২০ ২৩:১৪

(ছবি সত্ত্বঃ আনিসুল কবীর)

 

এক.

কোম্পানির চট্টগ্রামের গেস্ট হাউসে এলেই ফরহাদ এই খেলাটি খেলে। বাবুর্চির সঙ্গে খেলা। এই খেলার একটি নামও দিয়েছে সে-‘এক্সট্রা খাতির খেলা’! বাবুর্চি সুরঞ্জন পূর্বপরিচিত কারও সঙ্গে ফরহাদকে গুলিয়ে-মাখিয়ে একাকার করে ফেলেছে। স্মৃতির প্রতারণা সবচেয়ে ভীতিকর। দুর্ভাগ্যবশত এটিই ঘটেছে সুরঞ্জনের ভাগ্যে। স্মৃতি তার সঙ্গে প্রতারণা করছে। বাইরের প্রতারণা এড়িয়ে চলা সম্ভব কিন্তু যেটির সৃষ্টি নিজের মধ্যেই, তা এড়ানো অসম্ভব।

উত্তর খুলশীর এই গেস্ট হাউসটি একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির। ফরহাদ সেই কোম্পানির সিভিল ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। অফিশিয়াল কাজে আগেও পাঁচ-ছ’বার চট্টগ্রামে এসে এই গেস্ট হাউসে থেকেছে। এখানকার বাবুর্চির হাতের রান্না অতুলনীয়। তার ওপর, ফরহাদের ভাগ্যে জোটে এক্সট্রা খাতির। এক্সট্রা যেকোনো কিছুর প্রতিই মানুষের এক্সট্রা আকর্ষণ থাকে আর তা যদি হয় এক্সট্রা খাতির, তাহলে তো সোনায় সোহাগা আনলিমিটেড!

ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসতে রাত হয়ে গেছে। রাতের খাবার খেতে বসেছে ফরহাদ। যথারীতি সুরঞ্জন ফরহাদকে তার সেই পূর্বপরিচিত ব্যক্তি ভেবে যত্ন-আত্তিতে ব্যস্ত। রাতের মেন্যুতে আছে বাঁশমতি চালের ভাত, মুরগি রান্না, রূপচাঁদা ফ্রাই, সবজি, ঘন ডাল আর সালাদ। সুরঞ্জনের এই মেন্যু দেখলেই ফরহাদের জিভে রীতিমতো পানি চলে আসে। সুরঞ্জন খাবার পরিবেশন করতে করতে বলল, ‘স্যার, আপনার মেয়ে তিনটা ভালো আছে?’

যে মানুষ বিয়েই করেনি, তার কাছে একটি নয়, দুটি নয়, তিন-তিনটি মেয়ের খবর জানতে চাওয়া হচ্ছে! এই পথে আলোচনা বেশিদূর এগোতে দেওয়া যাবে না। ফরহাদ সংক্ষেপে উত্তর দিল, ‘হুম’। সংক্ষিপ্ত উত্তর আলোচনা সংক্ষিপ্ত করে কিন্তু সুরঞ্জনের জন্য এই বাক্য প্রযোজ্য নয়। সংক্ষেপে উত্তর দিলেও প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে তার আগ্রহের ঘাটতি ঘটে না। তাই অনেকসময় ফরহাদকে একটু কৌশলে উত্তর দিতে হয়। যেমন: সুরঞ্জন প্রশ্ন করে বসল, ‘স্যারের ছোট মেয়েটা এবার কোন ক্লাসে উঠল?’

‘দেখি, আরেকটু ডাল নিয়ে আসেন।’-এই হলো ফরহাদের জবাব; যদিও পড়াশোনার সঙ্গে মসুরের ডালের কোনো সম্পর্ক নেই। যাহোক, ঘোর-প্যাচের প্যাঁচাল ও খাওয়াপর্ব শেষে ফরহাদ রুমে এসে শুয়ে পড়ল। কাল ভোরেই রওনা দিতে হবে রাঙামাটির প্রত্যন্ত কয়েকটি অঞ্চলের উদ্দেশে। খুব সুন্দর নাম জায়গাগুলোর-বিলাইছড়ি, বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি, লংগদু, রাজস্থলী! ফরহাদের জীবনে এটিই প্রথমবারের মতো রাঙামাটি-ভ্রমণ। রাঙামাটির অনেক গল্প শুনেছে সে কিন্তু যাওয়া হয়নি কখনো। শোয়ার পর ভ্রমণ নিয়ে ভেতরে উত্তেজনা দানা বাঁধতে শুরু করলেও সেটিকে বেশি প্রশ্রয় দিল না ফরহাদ।  

দুই.

ভোর ছ’টায় অফিসের মাইক্রো এসে হাজির। মাইক্রোবাসে অন্য চার ডিপার্টমেন্টের আরও চারজন আগেই উঠেছে। তাদের সবার পোস্টিং চট্টগ্রামেই। সবাই মূলত একটি টেলিকম কোম্পানিতে কাজ করে। রাঙামাটির প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিষ্ঠানটির মোবাইলসেবা এখনো চালু হয়নি। সেখানে টাওয়ারসহ বেসস্টেশন স্থাপনের প্রাথমিক কাজগুলো করতে এই দল যাচ্ছে। রাঙামাটি শহরের একটি হোটেলে উঠবে তারা। শহর থেকেই একেক দিন একেকটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাবে আর কাজ শেষে আবার সেদিনই ফিরে আসবে শহরের হোটেলে। এভাবে কাজ চলবে সপ্তাহজুড়ে।

সবার গল্প যখন জমে উঠেছে, তখন মাইক্রোবাস রাঙামাটির পথে ঢুকল। গাড়ির মধ্যে বেজে উঠল চিরপরিচিত গান, ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ, আমার মন ভুলায় রে’। অন্যরা গল্পগুজবের মধ্যে থাকলেও ফরহাদ একটু আলাদা-চুপচাপ ও ভাবুক প্রকৃতির। এই পথে কখনো কোনোদিন আসেনি ফরহাদ; অথচ তার কাছে মনে হচ্ছে, পরম আপন এই পথ দেখার জন্য তার আত্মা জন্ম থেকে অপেক্ষা করেছে! পাহাড়ি পথ যেন তার হৃদয় রাঙিয়ে তুলেছে!

ফরহাদের চোখ দুটো ছলছল করছে। মানুষের চরিত্রের এ এক অদ্ভুত দিক-হৃদয়ছোঁয়া প্রকৃতির মাঝে গেলে কোনো সুখস্মৃতি বা প্রিয়মুখ মনে করে এক অসীম হাহাকার অনুভব করে! সেই সুখস্মৃতি বা প্রিয়মুখ ফিরে পেতে আশ্চর্য আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠে হৃদয়ভূমি। পাহাড়ি ভূমিরূপের উত্থান-পতন বুঝি হৃদয়ের মাঝেও উত্থান-পতন তৈরি করে! অসীম সমুদ্র, গহীন অরণ্য বা তারাভরা আকাশ মানুষকে টানে। কিন্তু পাহাড়ি পথের মধ্যে কী এমন মায়া আছে, দুই পাহাড়ের মাঝের গভীরতায় কী এমন শূন্যতা আছে যে সেগুলোর আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য মনে হচ্ছে ফরহাদের কাছে? মানুষের মনের শূন্যতাগুলোও তো এমনই সুগভীর ও আকর্ষী! 

তিন.

ফরহাদরা রাঙামাটি শহরের একটি হোটেলে উঠেছে। সেখানে সকালের নাশতা সেরে আর সময় নষ্ট করেনি। ইঞ্জিন বোট ভাড়া করে ইতিমধ্যে জুরাছড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। পানিপথে জুরাছড়িতে পৌঁছতেই লেগে যায় প্রায় চার ঘণ্টা। যাওয়া-আসায় সাত-আট ঘণ্টা লাগে বলে সকাল-সকাল রওনা না দিলে কাজ করার সময় পাওয়া যায় না। ফরহাদের ধারণা ছিল, ঘণ্টার পর ঘণ্টা নৌকায় থাকা খুবই যন্ত্রণার ব্যাপার। কিন্তু রাঙামাটির হ্রদ দিয়ে জুরাছড়িতে যাওয়ার পথটা যেন এক টুকরো স্বপ্নপুরী! হ্রদের দু’পাশে গাছগাছালিতে ভরা ছোট-বড় টিলা-পাহাড়। পানিপথে পাহাড় আর অরণ্যের মিতালি দেখতে দেখতে কীভাবে যে চারটি ঘণ্টা কেটে গেল, টেরই পায়নি ফরহাদ! স্থানীয় একজন সরকারি কর্মচারী মোবাইল কোম্পানির দলটিকে নির্ধারিত স্থানে নিয়ে গেল। আগে থেকেই তার সঙ্গে কথা বলে রাখা হয়েছিল। জায়গাটি বেসস্টেশন ও টাওয়ার করার উপযুক্ত বলে ফরহাদদের মনে হলো। সেখানেই ফরহাদের নজর কাড়ল একটি দৃশ্য! কাছেই একটি ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে এক পাহাড়িকন্যা মোবাইল ফোনে প্রাণোচ্ছ্বলভাবে কারও সঙ্গে কথা বলছে। কথা বলার সময় মোবাইলের নেটওয়ার্ক যে বেশ সমস্যা করছে, তা বোঝা যাচ্ছে। ফরহাদ সরকারি কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে মোবাইলে কি নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়?’

‘শুধুমাত্র টেলিটকের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়; তাও ওই মেয়েটা যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, ওই জায়গাটুকুতেই। শুভলংয়ের একটা পাহাড়ের টাওয়ার থেকে এই নেটওয়ার্ক পাচ্ছে।’

হঠাৎ ফরহাদ শুনতে পেল, মেয়েটি গান গাচ্ছে! এত মানুষের উপস্থিতি তোয়াক্কা না করে পাহাড়িকন্যা তার ভালোবাসার মানুষের মন রাঙাতে গান গাইছে। ফরহাদ ভাবতে লাগল-ওপাশের মানুষটা হয়তো জানেও যে তার প্রেয়সী তার সঙ্গে খানিক কথা বলার জন্য কতটা কষ্ট স্বীকার করছে! এই এতটুকু জায়গা ছাড়া অন্য কোথাও নেটওয়ার্ক নেই। তাই কথা বলার জন্য তাকে এখানেই আসতে হয়।

পাহাড়ি মেয়েটির গানের কথাগুলো শোনার চেষ্টা করল ফরহাদ। বাকিদের এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তারা নিজেদের মধ্যে অন্য বিষয় নিয়ে আলাপ করছে। গানের লাইনগুলোর অর্থ বুঝতে পারছে না ফরহাদ; তারপরও শুনতে চমৎকার লাগছে।

‘নচাং যেবার এই জাগান ছাড়ি

ইদু আগং জনমান পরি

এই জাগাগান রইয়েদে,

ম মনান জুরি।’

ফরহাদ সঙ্গে থাকা সরকারি লোকটিকে বলল, ‘গানের কথাগুলো শুনতে তো বেশ ভালো লাগছে! অর্থ জানা আছে আপনার?’

ভদ্রলোক জবাব দিলেন, ‘পুরোপুরি অর্থ জানি না। এ অঞ্চলের বেশ জনপ্রিয় গান এটা। চাকমা ভাষায় জন্মভ‚মির প্রতি ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে এই গানে। যেমন: প্রথম লাইন, নচাং যেবার এই জাগান ছাড়ি এর অর্থ-এই জায়গা ছেড়ে আমি যেতে চাই না।’

‘বাহ, বেশ দারুণ তো!’

বাকি সময়টুকু ফরহাদদের অবশ্য দারুণ কাটল না। কারণ, ইউএনও স্যার পরে আরেকদিন আসতে বললেন। সরকারি ওই জমি মোবাইল কোম্পানিকে দেওয়া নিয়ে একটু সমস্যা দেখা দিয়েছে। জায়গাটিতে জনবসতি আছে। টাওয়ারের সঙ্গে যেহেতু রেডিয়েশনের মতো ক্ষতিকর বিষয় জড়িত, তাই এ ব্যাপারে এখনই তিনি সিদ্ধান্ত দিতে প্রস্তুত নন। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতে তার আরও সময় প্রয়োজন। তাই তিনদিন পর ফরহাদদের আবার আসতে হবে।

ফেরার পথে পানি-পাহাড়-অরণ্যের মাঝে ফরহাদের মাথায় শুধু একটি লাইনই ঘুরতে থাকল, ‘নচাং যেবার এই জাগান ছাড়ি। নচাং যেবার এই জাগান ছাড়ি।’ কী চমৎকার বাক্য! মেয়েটাও বেশ দরদ দিয়ে গাচ্ছিল। কী বিচিত্র এই পৃথিবী! দেশের একটি প্রত্যন্ত দুর্গম অঞ্চলে, যেখানে যাওয়ার কথা ফরহাদ কোনোদিন কল্পনাও করেনি, সেখানেও এক তরুণী তার প্রিয় মানুষের জন্য ভালোবাসার পসরা সাজিয়ে বসে আছে! ভালোবাসার কোনো স্থান নেই, কাল নেই, পাত্র নেই। মানুষের নাম ‘মানুষ’ না হয়ে ‘ভালোবাসা’ হলে কি খুব ভুল হতো? জীবন ও প্রকৃতি নিয়ে এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ফেরার পথের দীর্ঘ সময়টিও কেটে গেল, তা ফরহাদ টের পেল না। 

চার.

তিনদিন পর ফরহাদরা আবার জুরাছড়ি পৌঁছল। আজকের সংবাদ খারাপ না। ইউএনও স্যার জায়গাটিতে কাজ শুরু করার ব্যাপারে সম্মতি দিলেন। কাগজপত্রগুলো তৈরি করতে খানিক সময় লাগল। স্থানটিতে বেসস্টেশন ও টাওয়ার স্থাপন করা গেলে স্থানীয়দের মোবাইল যোগাযোগের জন্য আর দুর্ভোগ পোহাতে হবে না।

দাপ্তরিক কাজ শেষে সবাই বাঁশ-বেতের আসবাবপত্র কেনার জন্য বাজারে যাওয়ার পরিকল্পনা করল। ফরহাদ তাদের সঙ্গে না গিয়ে টাওয়ার স্থাপনের জন্য নির্ধারিত জায়গাটিতে যেতে চাইল। সেই পাহাড়িকন্যার মুখে আরও একবার গান শোনার আগ্রহ তাকে তাড়িত করছে। ফরহাদকে ওই স্থানটিতে গিয়ে অপেক্ষা করতে বলে বাকিরা রওনা হয়ে গেল বাজারের দিকে। 

ফরহাদ একাই এল সেই জায়গায়। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, আজকেও পাহাড়িকন্যা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে মোবাইল হাতে কথা বলছে। কিন্তু আজ তাকে খুব বিক্ষিপ্ত ও অস্থির দেখাচ্ছে! মুগ্ধতা ছড়ানো সেদিনের দৃশ্যটিকে খুব মিস করছে ফরহাদ। মোবাইলে কথা বলতে বলতে হঠাৎ মেয়েটি চিৎকার করে কেঁদে উঠল। তারপর আকস্মিকভাবে মেয়েটিকে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়তে দেখে ফরহাদের বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। ভালোবাসার মানুষটি কি তবে প্রতারণা করেছে? 

ফরহাদের মনে যেন বেজে উঠল পাহাড়িকন্যার সেদিনের কণ্ঠ, ‘নচাং যেবার এই জাগান ছাড়ি’। কী পবিত্র এর অর্থ-এই জায়গা ছেড়ে আমি যেতে চাই না! রাজকন্যা তার স্বপ্নের রাজকুমারের হৃদয়ের জায়গাটিও আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু জীবন থেকে ফরহাদ শিখেছে-কোনো কিছু আঁকড়ে ধরে রাখার ক্ষমতা মানুষকে দেওয়া হয়নি! 

 

লেখক: আসিফ মেহ্দী
কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top