সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

আব্বাস কিয়ারোস্তামির চলচ্চিত্রের সারকথা জীবনের পথে জার্নি : আফরোজা পারভীন


প্রকাশিত:
৩০ জুন ২০২০ ২৩:৪৬

আপডেট:
১ জুলাই ২০২০ ০০:০২

আব্বাস কিয়ারোস্তামি

 

জীবন মানেই এক ছকবদ্ধ জার্নি। প্রাকৃতিক নিয়মে শৈশব কৈশোর যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্য এবং অবশেষে মৃত্যু। এর বাইরে জীবজগতের কেউ যেতে পারে না। অনেকে আত্মঘাতী হয়ে এই যাত্রাপথটিকে হ্রস্য করে দিতে পারে, এতটুকুই। আর এই যে যাত্রাপথ, এ পথের কিছুটা নিয়তি, কিছুটা স্বনির্মিত। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, কাজ, পেশা, প্রেম বিরহ, বিবাহ, অবসর জীবন এবং মৃত্যু। এ জীবনে আছে সুখ- দুঃখের গল্পকথা। ঘাত- প্রতিঘাত অর্জন-বিয়োজনের অভিঘাত। কিন্তু এই যাত্রা, এই জার্নি এক অমোঘ গতিপথ।
আব্বাস কিয়ারোস্তামির চলচ্চিত্রে এ যাত্রাপথটি আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই। আমাদের দেশের চলচ্চিত্রেও এ যাত্রার অনেক নমুনা আছে। ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’, ‘গোলাপি এখন ট্রেনে’, ‘ইতিহাসকন্যা’সহ অনেক চলচ্চিত্রে এই যাত্রার রূপটি আমরা দেখি, যার মূল কথা জীবন অন্বেষণ। বাঁচা, বাঁচার ইচ্ছে এক অপরিমেয় আকাক্সক্ষা। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালি’ আর ‘অপরাজিত’, ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি তর্ক আর গপ্পো’, মৃনাল সেনের ‘ভুবন সোমে’ও এই জার্নি আমরা প্রত্যক্ষ করি। জন আব্রাহামের ‘আম্মা আরিয়ান’ও এর ব্যতিক্রম নয়। মারকেজের কাহিনিতে জার্নির বিস্তার ব্যাপক। আলেহো কারপেন্তিয়ারের ‘দি লস্ট স্টেপস’ থেকে মাচুপিচুর ‘শিখর থেকে’ পর্যন্ত আমরা জার্নির অপরিমেয় বিস্তৃতি দেখি। আব্বাস কিয়ারোস্তামির দ্য ট্রাভেলারস, হোয়ার ইজ মাই ফ্রেন্ডস হোম, এন্ড লাইফ গোস অন, টেস্ট অব এ চেরি, থ্রু দি অলিভ ট্রি’স, টেন, উইন্ড উইল কেরি আস, সার্টিফায়েড কপি, লাইক সামওয়ান ইন লাভ চলচ্চিত্রগুলিতে আমরা সেই যাত্রা আর যাত্রাশেষে জীবনকেই দেখি। চলচ্চিত্রগুলির নামেও সে আভাস আমরা পাই।
বিশ্ব চলচ্চিত্রে ইতিহাসে আব্বাস কিয়ারোস্তামির এক প্রবাদসম নাম। ১৯৪০ সালের ২২ জুলাই ইরানের রাজধানী তেহরানে জন্মগ্রহণ করেন এই কালজয়ী চলচ্চিত্রকার। চার দশকের অধিক সময় ধরে অবদান রেখে গেছেন সিনেমা রাজ্যে। তিনি ছিলেন একাধারে পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, চিত্রগ্রাহক ও আলোকচিত্রশিল্পী। ১৯৭০ সাল থেকে নিয়মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য, প্রামাণ্য ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন । ৪০টির মতো চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন তিনি। নিজ দেশ ছাড়িয়ে তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা বিশ্বে। ১৯৯৭ সালে ‘টেস্ট অব এ চেরি’ ছবির জন্য তিনি কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাম দ’ওর’ পুরস্কার অর্জন করেন। তিনিই একমাত্র ইরানি যিনি এই সম্মানজনক পুরস্কার অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। ইরানি চলচ্চিত্রকার হলেও তাঁর চলচ্চিত্র প্রভাব ফেলেছিল গোটা বিশ্বে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা জ্যঁ লুক গদার বলেছেন, ‘চলচ্চিত্র শুরু হয়েছে ডি ডব্লিউ গ্রিফিতকে দিয়ে আর শেষ হয়েছে আব্বাস কিয়ারোস্তামিকে দিয়ে।’
ছেলেবেলায় ছবি আঁকতেন আব্বাস। ১৮ বছর বয়সে পান ছবি আঁকায় গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার। কিছুদিন পর বাড়ি ছেড়ে চলে যান তিনি। উদ্দেশ্য ইউনিভার্সিটি অব তেহরানে চারুকলায় শিক্ষালাভ । কিন্তু চিত্রকলায় ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি । যোগ দেন ট্রাফিক পুলিশের চাকরিতে। কিন্তু নিরুৎসাহিত হননি এক মুহূর্তের জন্যও। আবারো পরীক্ষা দিয়ে কৃতকার্য হন। এরপর যোগ দেন একটা বিজ্ঞাপনী সংস্থার চাকরিতে। চিত্রকর, নকশাবিদ ও অংকনবিদ হিসেবে ষাটের দশক থেকে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করেন। ১৯৬৯ সালে পারভিন আমির- গোহলির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৮২ সালে তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। আহমাদ ও বাহমান নামে তাঁদের দুটি ছেলে রয়েছে।
আব্বাস কিয়ারোস্তামি ইরানি নবতরঙ্গ আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ । এই আন্দোলন ৭০ এর দশক থেকে শুরু হয়। আন্দোলনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন ফারুগ ফারোখ্জদ, সোহরাব শহিদ সলেস, মোহসেন মাখমালবফ, বহরম বেইজাই এবং পারভেজ কিমিয়ভি।
১৯৭৯ সালে ইরানি বিপ্লবের পর অনেক চলচ্চিত্রনির্মাতা পশ্চিমা দেশগুলোতে পাড়ি জামান। যারা থেকে যান তাঁদের অন্যতম আব্বাস কিয়ারোস্তামি। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশে থেকে যাওয়া তাঁর ক্যারিয়ারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও ভালো সিদ্ধান্ত ছিলো। নিজের দেশ এবং পরিচয় আঁকড়ে ধরার কারণে তাঁর জীবন মহিমান্বিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘মূলোৎপাটিত করে একটি গাছকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে গেলে সে ফল দেবে না। অন্তত আপন স্থানে সে যত ভাল ফল দিত নতুন স্থানে তত ভালো ফল দেবে না। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আমি মনে করি দেশ ছেড়ে গেলে আমার অবস্থা হতো সেই গাছের মতো।’
শুরু করেছিলোম আব্বাস কিয়ারোস্তামির চলচ্চিত্রে জার্নি বিষয়ে। কিয়ারোস্তামির প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্য ছবি দ্য ট্রাভেলার( ১৯৭৪)। ছবির কাহিনি আবর্তিত হয়েছে কাসেম জুলায়ি নামের এক কিশোরকে ঘিরে। কাসেম ফুটবল খেলতে খুব পছন্দ করে। কাসেমের স্বপ্ন সে তেহরানের আমজাদি স্টেডিয়ামে বসে একটি ফুটবল ম্যাচ দেখবে। টাকা চুরি আর পুরোনো ক্যামেরা বিক্রি করে সে তার স্বপ্ন পূরণ করে। সে টিকেট কেটে আমজাদি স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে গিয়ে পৌঁছায়। খেলা দেখা শুরু করে। কিন্তু ক্লান্তির কারণে কিছুক্ষণ পরেই সে ঘুমিয়ে পড়ে। যখন ঘুম ভাঙে সে দেখে পুরো স্টেডিয়াম ফাঁকা। গ্যালারিতে সে একা বসে আছে।
এই চলচ্চিত্রটিতে আমরা খুঁজে পাই সেই যাত্রা আর জীবনকে। কিশোরের জার্নি শুরু হয়েছিল এক ম্যাচ ফুটবল খেলা দেখার জন্য। ওটাই ছিল তার আকাঙক্ষা, তার জীবনের আরাধ্য। সে জন্য সে চেষ্টার কোনো কমতি করে নি। টাকা চুরি করে, ক্যামেরা বিক্রি করে। সে ঠিকই তার আকাঙক্ষার কাছে পৌঁছে যায়। সে গ্যালারিতে পৌঁছে খেলা দেখা শুরু করে। কিন্তু ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে যায়। তাতে কোন সমস্যা নেই। তার জার্নি ছিল ফুটবল খেলা দেখা। সে জার্নি সে শেষ করেছিল।
দ্য রিপোর্ট (১৯৭৭) এর কাহিনি আবর্তিত হয় চাকরি থেকে বরখাস্তকৃত এক যুবককে ঘিরে। চাকরি হারোনোয় তার জীবন দুর্বহ হয়ে ওঠে। স্ত্রীর সাথে প্রতিনিয়ত ঝগড়া হয়। শেষে স্ত্রী সন্তানকে ফেলে রেখে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায় সে। এখানেও সেই জার্নি। অজানাই তার গন্তব্য। চাকরি হারানো তার ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে যে প্রভাব ফেলেছিল তাতে তার মনে হয়েছিল, সে না থাকলে তার স্ত্রী সন্তানের জীবন সুখে কাটবে। তাই শুরু হয়েছিল তার জার্নি আর একইসাথে আরেক জার্নিতে ছিলেন তার স্ত্রী আর সন্তান। কিন্তু তার একা থাকার যে জার্নি শুরু হয় সে জার্নি তাকে জীবনকে চেনায়।
হোয়ার ইজ মাই ফ্রেন্ডস হোম (১৯৮৭) একটি কাব্যিক ব্যঞ্জনাময় অথচ বাস্তবের মাটিতে দাঁড়ানো ছবি। চলচ্চিত্রটির নাম নেয়া হয়েছে ইরানি কবি সোহরাব সেফেরির একটি কবিতা থেকে। চলচ্চিত্রে ছড়ানো আছে শিশুর সরলতা আর গ্রামবাসীর নৈতিকতার কথা।
আট বছরের বালক আহমেদ বন্ধুর খোঁজে অচেনা এক গ্রামে যাত্রা করে। নিজের বাড়ি, চেনা চারধার ছাড়িয়ে গ্রামের আঁকাবাঁকা পথে আহমেদের এই প্রথম যাত্রা। শঙ্খিনী সাপের মতো বাঁকানো পথ পেরিয়ে, নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাছ পেরিয়ে, ঘাসে ঢাকা টিলা পেরিয়ে ও পৌঁছে যায় পাশের গাঁয়ে। গ্রামের পাথুরে সরু পথ, ছোটছোট কাঠের বাড়ি আর অজানা অচেনা মানুষের সাথে দেখা হয় তার।
শৈশবে আমরা সবাই কল্পনায় পঙখীরাজ ঘোড়ায় সওয়ার হয়েছি। কিন্তু মজার ব্যাপার, আহমেদের সাথে আমরাও সওয়ারি হই তার এই যাত্রায়। আর অনির্দিষ্ট পথে চলতে চলতে বুঝি, গন্ডিতে আটকে না রেখে স্বাধীনভাবে বাঁচতে দিলে জীবন কত সুন্দর আর বর্ণীল।
কোনদিকে বন্ধুর বাড়ি
শুধায় ঘোড়সওয়ার
নিঃশব্দ গোধূলির আকাশ।
মুখ থেকে আলোর লতাপাতা সন্ধ্যার বালিতে নামিয়ে
পথিক নির্দেশ করে একটা পপলার গাছের দিকে,
‘গাছের সামনে পাবে
ফুলে ঢাকা পথ, ঈশ্বরের স্বপ্নের চেয়েও সবুজ।
সেখানে ভালোবাসা বিস্তৃত নীলডানার মতো চওড়া
চলে যাও ও পথের শেষে, সে তোমাকে পার করে দেবে
শৈশবের সীমানা ।
তারপর বাঁক নিলে ফুলেদের নির্জনতা,
তার দুকদম আগে পার্থিব পুরাণকথার মত এক ঝর্ণা ,
সেখানে দাঁড়াও।
কাকচক্ষু জলের মত ভয় আর বহমান আন্তরিক আকাশ
তোমার চারপাশ ঘিরে থাকবে,
শুনবে হালকা চলার শব্দ।
এক বালক পাইন বনের পথে চলেছে
আলোর বাসা খুঁজে পাখি ধরতে।
জিগ্যেস করে তাকে, কোথায় বন্ধুুর বাড়ি?’
ফার্সি আধূনিক কবি ও চিত্রকর সোহরাব সেপেরি’র এই কবিতার ছায়া অবলম্বনে ছবি।
তাঁর ‘ব্রেড এন্ড অ্যালি’, ‘দি ট্রাভেলার’ ও ‘হোয়ার ইজ মাই ফ্রেন্ডস হোম’ চলচ্চিত্র তিনটিতে আমরা দেখি, তিন বালক বাবা মায়ের হাত ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে প্রথম একা পথ চলছে। একটা জার্নি তাদের পার করে দিয়েছে শৈশবের গন্ডি। কৈশরে প্রবেশ করেছে তারা। তাদের সামনে উন্মোচিত হয়েছে এক রহস্যময় নতুন দুনিয়া ।
জার্নি প্রসঙ্গে আমরা বলতে পারি ‘টেস্ট অব চেরি’(১৯৯৭) চলচ্চিত্রটির কথা। আব্বাস কিয়ারোস্তামির অন্যতম সেরা কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই চলচ্চিত্রটিকে। এই ছবির কারণে কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাম দ’ওর’ পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। অবশ্য ছবির বিষয়বস্তুর কারণে নিজ দেশ ইরানে নিষেধাজ্ঞা ও সমালোচনার শিকার হন। ছবির একটা লক্ষণীয় দিক হচ্ছে, শেষ দৃশ্য ছাড়া কোথাও সংগীত ব্যবহার করেননি পরিচালক।
টেস্ট অব চেরি চলচ্চিত্রের নায়ক বাদি আত্মহত্যা করতে চায়। কিন্তু ইসলাম ধর্মানুসারে আত্মহত্যা মহাপাপ। কেউ আত্মহত্যা করলে ইসলাম ধর্মাবলম্বী কেউ তার কবরে মাটি দেবে না। বাদি আত্মহত্যা করতে চায় কিন্তু তার ইচ্ছে মারা যাবার পর একজন কেউ তার কবরে মাটি দেবে। সেই লোকটির খোঁজে গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে যায় বাদি। গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। শহরের সীমানা ছাড়িয়ে গাড়ি চলেছে। পথে বাদির দেখা হয় একদল শ্রমিকের সাথে। তারা তাজের সন্ধান করছে। গাড়ি থামাতেই ওরা জানালার কাঁচের কাছে এসে কাজ চায়। বাদি তাদের একজনকে কাজটা বুঝিয়ে দিয়ে বলে, এ কাজ করলে সে অনেক টাকা পাবে। নিতান্তই গরীব মানুষ তারা। সস্তা শ্রমের বিনিময়ে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু এত টাকার প্রলোভনেও কেউ কাজটা করতে রাজি হলো না। এরপর বাদির দেখা হলো কুর্দিস্তানের এক গ্রাম থেকে আসা হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান এক সেনা সদস্যের সাথে। বাদি তাকে বলল, কাজটা করলে তাকে এত টাকা দেবে যে বাকি জীবন তাকে আর কিছুই করতে হবে না। সেনা রাজি হলো না। বরং ত্বরিত গতিতে পালিয়ে গেলো।
গাড়ি এগিয়ে চলেছে সেই মানুষের খোঁজে। মাঠের মাঝে নির্মাণ কাজ চলছে। সেখানে একটা ওয়াচ টাওয়ারে রক্ষির কাজ করে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে আসা এক শ্রমিক। ওয়াচ টাওয়ারের কাঁচঘেরা ঘরে আসে বদি। ঘরে চলছে সিনেমার গান। বাইরে যান্ত্রিক ল্যাডার মাটি সরাচ্ছে। বাদি তাকে জানায় পরিকল্পনার কথা। কিন্তু ফলাফল একই । বরং ওই ব্যক্তি আলাচনা করেন আফগান যুদ্ধ আর ফকির আলি শাহ্র মাজার বিষয়ে। বাদি কাঁচঘেরা ঘর থেকে নেমে এসে যাত্রা শুরু করেন আবারো। এরপর বাদির সাথে দেখা হয় ওই রক্ষীর বন্ধুর। সেও রাজি হয়না। সে আফগানিস্তানের মঠ বিদ্যালয়ের দরিদ্র শিক্ষক। কিন্তু সেও বলে কোরআনে এটা গুনাহ হিসেবে উল্লেখ আছে। কাজেই সে পারবে না আত্মহত্যাকারীর কবরে মাটি দিতে। বাদি তর্ক করে তাকে বুঝাতে চায়, আত্মহত্যার অধিকারও তো আল্লাহতায়ালারই দেয়া। কিন্তু শত তর্কেও নিজের মূল্যবোধে অটুট থাকে ওই লোক।
অবশেষে এক বৃদ্ধ রাজি হন। তবে তিনি বললেন, এজন্য বাদিকে একটা গল্প শুনতে হবে। বাদি রাজি হলেন। তিনি বাদিকে তার নিজের জীবনের একটা গল্প বললেন। একদিন তিনিও আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। পাশে স্ত্রী আর সন্তান ঘুমিয়ে ছিলেন। তারপরও নিজেকে তার নিঃসঙ্গ মনে হয়েছিল। তিনি শেষ রাতে একগাছা দড়ি হাতে দূরের একটি মালবারি গাছির নিচে এসে দাঁড়ালেন। গাছের উপর উঠে দড়ি বাধার সময় কয়েকটা মালবেরি মুখে দিলেন। খুব ভালো লাগলো তার। এ সময় চারদিকে আলো ফুটতে শুরু করল। কয়েকজন শিশু স্কুলে যাবার পথে গাছের নিচে এসে তাকে মালবেরি পেড়ে দিতে বলল। তিনি দিলেন। তার আর অত্মহত্যা করা হলো না।
গল্প বলা শেষে ওই বৃদ্ধ বাদিকে বললেন, তুমি বোধহয় অনেকদিন শিশুদের দল দেখনি, পাকা চেরির স্বাদ আস্বাদন করোনি, সকালের হলুদ সূর্য ওটা দেখোনি। গ্রীষ্মের লাল সূর্যাস্ত, মায়াবী চাঁদ আর পাখিদের ঘরে ফেলা দেখোনি।
বাদির মনে হলো, তাইতো চারদিকটা তো অনেকদিন চোখ মেলে দেখা হয়নি। ওইতো দেখতে পাচ্ছি মাঠে কিশোরদল, পপলার গাছের শীর্ষে বসে ওইতো পাখি ডাকছে । এখনইতো সূর্যাস্ত দেখার সময়।
টেস্ট অব চেরি চল”িত্রে ফটোগ্রাফ, আঁকা ছবি আর একাকী গাছকে বারবার দেখি । একা অর্থ নিঃসঙ্গতা, বিচ্ছিন্নতা। এই একাকীত্ব বা বিচ্ছিন্নতা যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক তাও নয়। মনে রাখতে হবে, এমন একটা সাংস্কৃতিক সময়ের প্রতিনিধি আব্বাস যে সংস্কৃতিকে জন্মলগ্ন থেকেই লড়াই করতে হয়েছে স্বৈরাচারী শাসকের বেধে দেয়া সীমানার বিরুদ্ধে। সেখানে ‘মুক্তি,’ ‘স্বাধীনতা’ এসব শব্দ উচ্চারণ করা ছিল রীতিমতো দুঃসাহস। যেখানে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় শাসক মিলে ঠুলি পরিয়ে রাখতে চাইত সমাজকে। আব্বাসের বা তাঁর চলচ্চিত্রগুলির চরিত্রের বিচ্ছিন্নতার প্রধান কারণ হল, তাঁর চিন্তা ভাবনা যে স্তরে কাজ করে দেশের মানুষের চিন্তাÑভাবনা সে স্তরের কাছাকাছিই আসতে পারে না। এর মুল কারণ হচ্ছে,সেদেশে সাংস্কৃতিক আধুনিকতা যে স্তরে পৌঁছেছে রাজনৈতিক ও সামাজিক আধুনিকতা তার থেকে অনেক পেছনে পড়ে রয়েছে। ইরানিদের মুক্তিসংগ্রাম বার বার ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই তারা প্রবল বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত।
দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস (১৯৯৯) চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু জীবন মৃত্যুকে ঘিরে আবর্তিত। একজন চলচ্চিত্রকর্মী চলেছেন একটি প্রত্যন্ত কুর্দি গ্রামের দিকে একজন বৃদ্ধার মৃত্যুর পর তার সৎকার আর রিচুয়াল রেকর্ড করার জন্য। এখানেও সেই যাত্রার কথা এসে যায়। চলচ্চিত্রটির শুরু থেকেই দর্শকের শোনা আর দেখার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় যাত্রাপথ। আঁকাবাঁকা পাহাড়ের গা বেয়ে উঁচু থেকে নিচুতে নামে গাড়ি। দূরে একাকী গাছ, অপূর্ব নৈসর্গ। গাড়ির ভেতরের কাউকে চোখে পড়ে না, শুধু তাদের কবিতা শোনা যায়। একসময় সমতলে এসে দাঁড়ায় গাড়ি। এবার শুধু নিসর্গ নয়, মানুষ দেখি আমরা। দেখি একজন পাঠশালা ফেরত কিশোরকে, কৃষিকাজ করা গ্রামের এক নারীকে। গাড়ি গ্রামে আসে। এরপর গাড়ির প্রধান চরিত্র গ্রামের পথে হাঁটে, টিলায় ওঠে। এ যেন তার অনন্ত যাত্রা। এই যাত্রার মাধ্যমেই তিনি পৌঁছে যান জীবন আর মৃত্যু সম্পর্কে এক অদ্ভুত উপলব্ধিতে।
৫৯ বছর বয়সের পর থেকেই মৃত্যু নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেন আব্বাস কিয়ারোস্তামি। যা তার বক্তব্য ও কাজের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। ইরানের গুরুত্বপূর্ণ কবি ফারুঘ ফাররোখাজদেলের কবিতা থেকে চলচ্চিত্রটির নামকরণ করা হয়েছে। চলচ্চিত্রটিতে ওমর খৈয়ামের কবিতাও ব্যবহার করা হয়েছে। বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি প্রদর্শিত হয়ে প্রশংসিত হয়। ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি সিলভার লায়ন পুরস্কার জিতেছিল।
টেন ( ২০০২)। ২০০০ সালের পর থেকেই নিরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন আব্বাস কিয়ারোস্তামি। টেন তেমনই একটি নিরীক্ষাধর্মী নারীকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র। ছবির চরিত্র একজন তালাকপ্রাপ্ত নারী। তিনি গাড়ি চালান । গাড়ির যাত্রীদের সাথে তার কথোপকথেনের বেশ কিচছ দৃশ্য রয়েছে ছবিটিতে। আব্বাস কিয়ারোস্তামি অন্যতম সফল ছবি হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই ছবিটিতে। ২০০২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাম দ’ওর ’ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল চলচ্চিত্রটি।
সার্টিফায়েড কপি (২০১০) আব্বাস কিয়ারোস্তামির প্রথম ছবি। এ ছবির সম্পূর্ণ দৃশ্যায়ন হয়েছে ইরানের বাইরে। ছবিটির প্রিমিয়ারও হয় ইরানের বাইরে। আব্বাস কিয়ারোস্তামির দীর্ঘদিনের বান্ধবী অভিনেত্রী জুলিয়েট্টে বিনোচে এই চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করেন। এর আগে তাকে তাঁর ‘শিরিন’ (২০০৮) ছবিতে অল্প সময়ের জন্য দেখা গিয়েছিল। ফার্সি ভাষার পাশাপাশি ফরাসি ইতালীয় ও ইংরেজি ভাষায় ছবিটির ডাবিং করা হয়। ভালোবাসা নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন পরিচালক এ চলচ্চিত্রে। ভালোবাসা কীভাবে আসল ও নকল হয় তা তিনি দেখিয়েছেন নিজস্ব ভঙ্গিতে। একটি দিনের গল্প নিয়ে ছবিটি সাজানো হয়েছে।
এন্ড লাইফ গোস অন, উইন্ড উইল ক্যারি আস, সারটিফায়েড কপি ও টেন চলচ্চিত্রগুলি যেন এক সুতোয় গ্রন্থিত করা। এই ছবিগুলোকে কালানুক্রমে সাজালে মনে হবে একটি গল্পই বলছেন তিনি। এ যেন এক অনন্ত যাত্রা । যার শেষে আছে জীবন। প্রকৃতি, মানুষ, সমাজ, কাব্য, শিল্প, রুচিবোধ ছবিগুলোর গায়ে লেগে আছে। এ ছবিগুলোর বেশিরভাগ স্যুটিং হয়েছে পথ চলতে চলতে গাড়ির মধ্য থেকে। এন্ড লাইফ গোস অন চলচ্চিত্রে গাড়িটি এগিয়ে যায় তেহরাান তেকে ভুমিকম্প বিধ্বস্ত খোকের নামের গ্রামে। যেখানে বাস করে হোয়ার ইজ মাই ফ্রেন্ডস হোম চলচ্চিত্রের সেই দুই কিশোর অভিনেতা। এই বিপদের দিনে, বিপর্যয়ের মধ্যে কেমন আছে তারা! চলতিপথে বিধ্বস্ত গ্রাম থেকে আসা মানুষদের সাথে দেখা হচ্ছে। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হচ্ছে, কেমন আছে খোকের গ্রামের মানুষেরা, কেমন আছে সেই দুই কিশোর!
বিধ্বস্ত গ্রামের প্রতিটি মানুষের প্রতি সংলাপে, আচরণে প্রবল শ্রদ্ধাবোধের পরিচয় রয়েছে চলচ্চিত্রটির প্রতিটি ফ্রেমে। যেন ওরাই চলচ্চিত্রটির মূল চরিত্র। আর সব কিছু ছেড়ে গাড়ি যখন সেই বিধ্বস্ত গ্রামটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, গ্রামের মানুষেরা তখন এগিয়ে যাচ্ছে সামনে, মৃত্যুকে অতিক্রম করে জীবনের সন্ধানে।
সিনেমার পরতে পরতে স্বাভাবিকতা চাইতেন আব্বাস কিয়ারোস্তামি। ছবিকে যতটা সম্ভব বাস্তবতায় মুড়িয়ে দিতেন। তাঁর চলচ্চিত্রের চরিত্ররা যেন কখনোই অভিনয় করেনি, এমনই ন্যাচারাল ছিল তাদের অভিনয়। চলচ্চিত্র সম্পর্কে দর্শকদের চিন্তার জগতে নিয়ে যেতে চাইতেন আব্বাস। তাই চলচ্চিত্রের কোন উপসংহার বা শেষ সীমারেখা টানতেন না। এক একজন দর্শক তাদের ভাবনা অনুযায়ী একেকভাবে উপসংহার টানতেন। চলচ্চিত্র সম্পর্কে দর্শকদের চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগানোর এটাই ছিল তাঁর কৌশল।
আব্বাস কিয়ারোস্তামি সম্পর্কে বিখ্যাত জাপানি চলচ্চিত্রনির্মাতা আকিরা কুরোসাওয়ার বলেছেন,
বাক্যের ক্ষমতা নেই আমার অনুভূতিকে প্রকাশ করার। আমি শুধু বলি তাঁর চলচ্চিত্রগুলি দেখুন। সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর আমি ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু আব্বাস কিয়ারোস্তামির ছবি দেখার পর ¯্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়েছি সত্যজিৎ-এর অভাব পূরণের জন্য যথার্থ এক মানুষকে পাঠানো জন্য।
আমোদ বা বিনোদন না ভেবে যে কজন নির্মাতা চলচ্চিত্রকে জীবনের পাঠ হিসেবে নিয়েছিলেন আব্বাস কিয়ারোস্তামি তাঁদের অন্যতম। চলচ্চিত্রের মাঝে জীবনের অর্থ খুঁজে বেড়ানো কিংবা জীবনকে স্থ’ূল বা অর্থহীন ভাবার পরও শেষ পর্যন্ত জীবনের কাছেই ফিরে যাবার যে জার্নির কারিগর ছিলেন তিনি। জীবনের প্রতি বিতশ্রদ্ধ হতাশাগ্রস্ত মানুষকে জীবনকে ভালবাসার, বেঁচে থাকার মুহূর্ত তৈরি করতেন এক একটা জার্নি দিয়ে। আর এমন অনেক মুহূর্ত তৈরি করে নিজেই তিনি চলে গেলেন। কারণ এই চলে যাওয়া অমোঘ। সব জার্নির শেষে এ এক অবাধারিত গন্তব্য।
তথ্যসূত্র: আইএমডিবি,উইকিপিডিয়া।

 

আফরোজা পারভীন
কথাশিল্পী, কলামলেখক
অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top