সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১

ভাষাসৈনিক হালিমা খাতুন: শিশু সাহিত্যের জাদুকর : আফরোজা পারভীন


প্রকাশিত:
৪ জুলাই ২০২০ ২১:০৫

আপডেট:
৪ জুলাই ২০২০ ২১:০৫

ভাষাসৈনিক হালিমা খাতুন

 

হালিমা খাতুন একাধারে ছড়াকার, ছোটগল্পকার, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন ভাষাসৈনিক। তিনি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন।
হালিমা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ২৫ আগস্ট বাগেরহাট জেলার বাদেকাড়াপাড়া গ্রামে তাঁর জন্ম। । তাঁর বাবা মৌলভি আবদুর রহমান ও মা দৌলতুন্নেসা। বাবা ছিলেন তৎকালীন গুরু ট্রেনিং স্কুলের শিক্ষক। শিক্ষক বাবা তার সাত মেয়ে ও এক ছেলেকে শিক্ষিত করে তুলেছিলেন মনের মতো করে।
হালিমা খাতুনের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বাদেকাড়াপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মনমোহিনী গার্লস স্কুল থেকে ১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন তিনি। এরপর ভর্তি হন বাগেরহাট প্রফুল্লচন্দ্র কলেজে। সেখান থেকে ১৯৫১ সালে বিএ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩ সালে ইংরেজীতে এমএ এবং পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাস করেন। এছাড়া তিনি বিএড অর্জন করেন। ১৯৬৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্দান কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি খুলনা করোনেশন স্কুলে শিক্ষকতা করেন । এরপর যোগ দেন পিকে গার্লস কলেজে। এরপর কিছুদিন রাজশাহী গার্লস কলেজে অধ্যাপনা করেন। সবশেষে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে। ১৯৯৭ সালে অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন
তিনি। ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত গণবিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। ২০১৭ সালের ২৬ জুলাই থেকে হালিমা খাতুন গণবিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও জাতিসংঘের উপদেষ্টা হিসেবেও দুই বছর দায়িত্বপালন করেন তিনি।
তিনি ১৯৫৫ সালে অধ্যাপক শামসুল হুদার সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁদের এক মেয়ে প্রজ্ঞা লাবণী। প্রজ্ঞা একজন নামকরা আবৃত্তিকার।
হালিমা খাতুন শিক্ষক । শিক্ষক হিসেবে তাঁর অনেক খ্যাতি। শিক্ষকতা ও ভাষা সংগ্রামের বাইরে হালিমা খাতুন শিশু সাহিত্যের জন্য অমর হয়ে থাকবেন। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম একজন শিশু সাহিত্যিক। বিভিন্ন বয়সের বাচ্চাদের উপযোগী অসংখ্য বই রয়েছে তাঁর। অসাধারণ ছন্দ আর লেখায় সমৃদ্ধ সেসব বই। বইগুলোতে রঙে- রেখায় বিন্যাসও অপূর্ব । হালিমা খাতুনের লেখা বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৫০টি। এসবের মধ্যে রয়েছে আত্মজীবনী, উপন্যাস, কবিতা, কিশোর উপন্যাস, শিশুতোষ রচনা ও বিজ্ঞান কল্পকাহিনি। পাখির ছানা, বাঘ ও গরু, বাচ্চা হাতির কান্ড, কাঁঠাল খাবো, হরিণের চশমা, সোনা পুতুলের বিয়ে, বেবি ফ্রক গায়, ছবি ও পড়া, শিশুদের নিয়ে ভাবনাসহ অসংখ্য শিশুতোষ রচনা তিনি লিখেছেন। এর মধ্যে পাখির ছানা, কাঁঠাল খাবো, হরিণের চশমা, সোনা পুতুলের বিয়ে ঢাকার মারি কুরি স্কুলে পাঠ্যবই হিসেবে পড়ানো হয়। লেখালেখির পাশাপাশি হালিমা খাতুন প্রচুর বই পড়তেন। শোয়ার ঘরের আলমারিগুলো ছিল বইয়ে ঠাসা। নিজেকে প্রস্তুত করেই তিনি লিখতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, না পড়লে লেখা যায় না। অসাধারণ মেধা ছিল। দিন-ক্ষণ-মাস-বছর উল্লেখ করে সবিস্তারে ঘটনার বর্ণনা করতে পারতেন।
হালিমা খাতুন ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর নানা দেশ ভ্রমণ করেছেন। যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই সাধারণ মানুষের সাথে মিশেছেন। তাঁদেও কৃষ্টি সংস্কৃতি জানতে চেষ্টা করছেন। তাঁর চিন্তা-ভাবনা ছিল সরল সোজা। অতি সাধারণ জীবন যাপন করতেন তিনি। যেমন সহজ সরল ছিলেন তেমনই ছিলেন প্রচন্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন । অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকতেন। নিজের যা কিছু ছিল, তা নিয়েই ছিলেন তুষ্ট। প্রায়ই বলতেন, একজন মানুষের থাকার জন্য দরকার একটা কামরা ও একটা ছোট্ট খাট।
হালিমা খাতুনকে তাঁর এক বিবাহবার্ষিকীতে স্বামী একটি কাঁসার মগ উপহার দিয়েছিলেন। স্বামীর দেওয়া এই উপহারটি তিনি সব সময় মাথার কাছে রাখতেন। মগটি ছিল তাঁর কাছে অমূল্য। এ থেকে স্বামীর প্রতি তাঁর ভালবাসার প্রগাঢ়ত্বও বোঝা যায়।

প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে হালিমা খাতুন অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১), বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৯), অনন্যা সেরা দশ পুরস্কারসহ (২০০৫)
মোট ৩৪টি পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
। ভাষা আন্দোলনে অনন্য অবদানের জন্য তিনি একুশে পদক (মরণোত্তর) লাভ করেন।
হালিমা খাতুন ছিলেন কাজের মানুষ। কাজ ছাড়া একমুহূর্ত থাকতে পারতেন না তিনি। তিনি শিশুবান্ধব ছিলেন। শিশুদের প্রচন্ড ভালোবাসতেন। শিশুদের জন্য নানান কাজ করেছেন। বিনা পারিশ্রমিকে পথশিশুদের ইটের ছোট্ট টুকরো দিয়ে মাটিতে লিখে অ আ ক খ শেখাতেন। অনেক শিশুর কাজের সংস্থান করে দিয়েছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের জন্ম প্রথম বিজ উপ্ত হয়েছিল বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর থেকেই হালিমা খাতুন রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন । ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামেও জড়িয়ে পড়েন তিনি । ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ চত্বরের আমতলায় সমাবেশে তিনি জড়ো করেন ছাত্রীদের। মুসলিম গার্লস স্কুল ও বাংলা বাজার গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের আমতলায় নিয়ে এসেছিলেন তিনি।
১৪৪ ধারা ভেঙে প্রথম বের হওয়া মিছিলে মেয়েদের দলে জুলেখা, নূরী, সেতারার সঙ্গে ছিলেন হালিমা খাতুন। মিছিলে গুলি চালায় পাকিস্তানের সামরিক জান্তা। সে মিছিলে ছিলেন অকুতোভয় হালিমা খাতুন।
শেষ জীবনে খানিকটা একা হয়ে পড়েন তিনি। কন্যা প্রজ্ঞা লাবণী তার ছেলে তেপান্তরকে নিয়ে কানাডায় চলে যান। নাগরিকত্ব পেলেন। যাওয়া-আসা করতেন, মাকে দেখতেন।
হালিমা খাতুন ৩ জুলাই ২০১৮ সালে ঢাকায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তখন তাঁর বয়স ৮৬ বছর। হৃদরোগ, কিডনি জটিলতা, রক্তদূষণের মতো নানা জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি।
ভাষাসৈনিক, শিশুপ্রেমী এই মানুষটি আমাদের স্মরণে থাকবেন চিরদিন। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই।

 

আফরোজা পারভীন
কথাশিল্পী, কলামলেখক
অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top