সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

গণজাগরণের দিনগুলিতে : মোঃ ইয়াকুব আলী


প্রকাশিত:
১৪ জুলাই ২০২০ ২১:৩৮

আপডেট:
১৪ জুলাই ২০২০ ২১:৪৩

 

(১)

মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধাপরাধ নিয়ে তেমন কোনোই ধারণা ছিল না মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত। বরং উল্টো ধারণা পোষণ করতাম। এই উল্টো ধারণা অবশ্য আমি আমার পরিবারের কাছ থেকে পাইনি। পেয়েছিলাম আশেপাশের পরিবেশ থেকে। এমন ধারণা হবার প্রথম এবং প্রধান কারণ ছিল আমার মায়ের নাম।

আমার মায়ের নাম বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নামের সাথে মিল থাকাটাই ছিল আমাদের জন্য কাল। আমাদের এলাকায় একটা ছড়া খুবই প্রচলিত ছিল। সেটা হচ্ছে:

“হাসিনা লো হাসিনা

তোর নাচায় আর নাচিনা

তোর বাপের নাচায় নেচেছিলামু

ঘর বাড়ি ছেড়েছিলাম।”

এমনকরে আরো অনেক কাজের বর্ণনা দিয়ে আমাদের দেখলেই ছড়াটাকে সুর করে বলে উঠতো আমাদের পাড়ার কিছু ছেলে। তখনও জানতাম না শেখ মুজিবুর রহমান কে আর কেনইবা তার মেয়ের নাম হাসিনা। আর কেনই বা তাদের কারণে মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়েছিল। কিন্ত উনাদের উপর ভয়ংকর রাগ হতো আমাদের দুভায়ের। কিন্তু উনাদেরকে হাতের কাছে না পাওয়ার রাগটা মিটাতাম যে ছড়া বলতো তাকে ইচ্ছেমত ধোলাই দিয়ে। তবুও পরেরবার দেখা হলে আবারো ছড়া বলে কেটে পড়তো।

(২)

গ্রামের একজন মানুষ অন্যজনের সাথে একবার কথাচ্ছলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলাপ করছিল। একজন অন্যজনকে বলছিল, শোন দেশ স্বাধীন হবার আগে আমরা ভাত খেতাম আর ভারতের লোকজন ফ্যান (ভাতের মাড়) খেতো। আর দেশ স্বাধীনের পর আমরা ফ্যান খাই আর ওরা ভাত খায়। আমাদের নিম্নমধ্যবিত্তের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা ছিল। তাই উনাদের কথাবার্তা শুনে মনেহল ঠিকই তো কি দরকার ছিল শুধু শুধু যুদ্ধ করার। তা নাহলে আমরা সুখেই থাকতাম। পাশের গ্রামে একজন লোক একটা হোমিওপ্যাথি ডাক্তারখানা চালাতেন। মাত্র তিন টাকায় সেখানে রোগ দেখানো এবং ঔষুধ পাওয়া যেত। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পয়সা না থাকায় আমাদের পরিবারের সকল সদস্যই সেখানে কম বেশি যেতাম আর মনেমনে ভাবতাম কত ভালো লোক উনি। ডাক্তারদের কে বেতন দিচ্ছেন আমাদেরকে বিনামূল্যে ঔষুধ দিচ্ছেন। পরে জেনেছি উনি কুষ্টিয়ার সবচেয়ে বড় রাজাকারদের একজন।

(৩)

কলেজ জীবনে ছাত্র শিবিরের বড় ভাইদের নূরানী চেহারা খুবই ভালো লাগতো। উনাদের কথা বলার ধরণ আমাকে খুবই আকর্ষণ করতো। আর যেহেতু স্কুল জীবন থেকেই শিবির আমার পিছনে লেগেই ছিল তাই উনাদের প্রতি একটা সফট কর্নার ছিল মনেমনে। আর উনারা প্রত্যেকেই ভালো ছাত্র হওয়াতে আরো বেশি আকর্ষণ কাজ করতো। উনারা বই পুস্তক অনেক কিছুই পড়তে দিতেন। যেগুলো ভালো লাগতো সেগুলো পড়তাম আর যেগুলো ভালো লাগতো না সেগুলো আর দ্বিতীয়বার নিলেও পড়তাম না। উনারাও অবশ্য চাপাচাপি করতেন না। কারণ বুঝতেন এই ছেলেটা একটু বেয়ারা টাইপের। একে বেশি টাইট দিলে ভেগে যেতে পারে। উনারা ছিলেন বয়সে আমার চেয়ে সিনিয়র তাই উনারা আসলে সালাম দিয়ে যথাসম্ভব ভদ্রভাবে কথা বলার চেষ্টা করতাম। উনারা এই আচরণাটার সুযোগ নিয়ে বই খাতা গছিয়ে দিত। কিন্তু কখনওই উনাদের প্রতি আমাকে অনুরক্ত করতে পারেন নাই। তবে কলেজ জীবনের একেবারে শেষের দিকে এসে আমার হাতে একখানা বই আসে মেজর জলিলের “অরক্ষিত স্বাধীনতা”। এই বইটা পড়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার ধারণা আরো বিরূপ আকার ধারণ করে।

(৪)

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আর শিবিরের ছায়া মাড়াতে হয় নাই। তবে আমার কাছের বন্ধুদের মধ্যে একেবারে উচ্চমাত্রার কয়েকজন শিবির করতো। কিন্তু তারা যেটা মেনে চলতো সেটা হচ্ছে কখনওই আমাদের সামনে রাজনৈতিক আলোচনা করতো না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির একটু আগে আগেই একজন মানুষের সাথে পরিচয় হয়। তার নাম সোহরাব গণি দুলাল। এই মানুষটা আমার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সব প্রশ্ন শুনে একেএকে সবগুলোই অনেক সুন্দরভাবে খন্ডণ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে উনার সরাসরি অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতার আলোকে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই মানুষটার সাথে আমার কোন ছবি তোলা নাই। এরপর থেকে মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধ এবং রাজাকার শব্দগুলোর আসল মানে আমার সামনে উন্মুক্ত হতে থাকলো। তারপর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অনেক বই খাতাও পড়া শুরু করলাম ধারণা আরো বেশি পরিষ্কার করার জন্য। এমনকি হলে আমাদের রুমে জর্জ হ্যারিসনের সেই বিখ্যাৎ “বাংলাদেশ বাংলাদেশ” গানটার বাংলা অনুবাদের একটা পোস্টার পর্যন্ত লাগিয়েছিলাম নিজেদের মানসিকতা বুঝানোর জন্য।

(৫)

স্কুল থেকে কলেজ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সবখানেই ছাত্র রাজনীতি বা জাতীয় রাজনীতি নিয়ে আমার মনে একটা ধারণা ছিল রাজনীতিবিদ মানেই খারাপ মানুষ। সত্যি কথা বলতে এই ধারণা দিনে দিনে আমার আরো প্রকট হয়েছে। বিশেষকরে সিডনি আসার পর বুঝতে পারলাম বাংলাদেশি রাজনীতিবিদগণ এই মহাবিশ্বের যেখানেই যান না কেন উনাদের চরিত্র বদলাতে পারেন না। সিডনি আসার পর বেশকজন রাজীনীতিবিদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছে। এবং তাদের দুইটা চরিত্রই এখন আমার কাছে জলের মত পরিষ্কার। তবে উনাদের নোংরামিগুলোর জন্য এখানকার কমিউনিটির লোকজন খুবই বিরক্ত। কিন্তু সবাই চুপচাপ থাকে বলে উনাদের ধারণা উনাদের এইসকল কুকর্মকে মানুষ সহজভাবেই নিয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে মোটেও তা না। রাস্তায় নোংরা পড়ে থাকলে মানুষ যেমন অন্য রাস্তা দিয়ে যায় ঠিক তেমনি উনাদেরকে এড়িয়ে চলেন। অবশ্য কিছু মানুষ আছেন যারা উনাদের সমস্ত কুকর্মের সাথে যুক্ত থেকে উনাদের পদলেহন করে চলেন। এই রাজনীতিবিদের মধ্যে ক্ষমতাবান বা ক্ষমতাপ্রত্যাশী সবাই আছেন। যাইহোক ফিরে আসি আসল প্রসঙ্গে। মোদ্দাকথা হচ্ছে আমি রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদের যারপরনাই ঘৃণা করি। তাই এখন পর্যন্ত কোনপ্রকার রাজনৈতিক দলের ছাতার নিচে মাথা দেয় নাই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে মনের গভীরে এখনও অনেক সম্মান কাজ করে। তাই কোন মুক্তিযোদ্ধাকে কাছে পেলে যেচে যেয়ে পরিচিত হয়। উনাদের ধন্যবাদ দেই আমাদেরকে একটা স্বাধীন দেশ উপহার দেয়ার জন্য। পারলে উনাদের সাথে ছবি তুলে রাখি স্মৃতি ধরে রাখার জন্য।

(৬)

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে সকল বই পুস্তক পড়েছি তার মধ্যে মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া সম্পাদিত “জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা” সিরিজ এবং “স্বাধীনতা” সিরিজ অন্যতম। আপনি যদি মুক্তিযুদ্ধের এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অনুভুতির কিছুটা অনুভব করতে চান তাহলে অবশ্যই পড়ে দেখতে পারেন।

এর বাইরে মুনতাসীর মামুনের “রাজাকারের মন” সিরিজটাও অনেক সাহায্য করবে মুক্তিযুদ্ধে রাজাকারদের বিরোধিতার কারণ বুঝতে। এর বাইরে আমি নিজে উদ্যোগি হয়ে দুইটা বই পড়েছি কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের আত্মজীবনী “জীবনে যা দেখলাম” আর দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর “নন্দিত জাতি নিন্দিত গন্তব্যে”। এই দুইটা বই পড়ার কারণ হচ্ছে এদের লেখনিতে এদের চিন্তা চেতনার কিছুটা হলেও ছাপ আছে। গোলাম আযম খুবই সুচতুরভাবে তার ৭১ সালের কর্মকান্ডের ফিরিস্তি দেয়া থেকে বিরত থেকেছেন। উনি শুধু ইনিয়ে বিনিয়ে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সাথে উনার ঘনিষ্টতার কথা বলে গেছেন ফলাও করে। আর সাঈদীর বইটার মাথামুন্ডু আমি আসলে কিছুই বুঝি নাই। তবে বাংলাদেশের মত এমন একটা সুন্দর সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের দেশে থেকেও উনার চিন্তাভাবনার ধরণ আপনার চিন্তাভাবনার অনেক খোরাক জোটাবে। তবে রাজাকারদের কুকীর্তি নিয়ে সবচেয়ে তথ্যসমৃদ্ধ লেখাগুলো পড়েছি সাপ্তাহিক পত্রিকা “সাপ্তাহিক”-এর পাতায়। এছাড়াও সাপ্তাহিকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো আপনাকে বুঝতে সাহায্য করবে কেন এই সকল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার দরকার ছিল। কারণ অনেকেই বলে থাকেন তারা ৪০ বছর আগে কি করেছে সেটা না ভেবে সবাই মিলে দেশের জন্য কাজ করলেই হয়। এমন ধারণা যারা পোষণ করেন তারা আসলে পক্ষান্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন। আমি এদেরকে বলি সুবিধাবাদী। কারণ একবার যে রাজাকার সে সারাজীবন রাজাকার। কখনওই তার ভাবনা বদলাবে না। ইদানিং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেক লোকও সামাজিক সুবিধা আদায়ের জন্য রাজাকারদের দলে ভিড় করছে।

(৭)

এরপর যখন থেকে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হল তখন থেকে নিয়মিতভাবে পত্রিকার মারফত খবর রাখতাম। কসাই কাদের মোল্লার রায়ের পর যখন শাহবাগে জনস্রোত তৈরি হল আমি আর বন্ধু জর্জিস সিদ্ধান্ত নিলাম তার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করবো। কারণ সেটা ছিল একেবারে অরাজনৈতিক প্লাটফর্ম। একদিন অফিসে ফাঁকি দিয়ে দুপুরের পর ঢাকারই কোথাও কাজ নিয়ে আমি আর জর্জিস চলে গেলাম শাহবাগে। যেয়ে খুবই ভালো লাগলো একসাথে এত মানুষ কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে স্লোগান দিচ্ছে। গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী লাকি স্লোগান দিচ্ছে “জয় বাংলা”তার সাথে তাল মিলিয়ে হাজার হাজার মানুষ স্লোগান দিচ্ছে “জয় বাংলা”। রাজাকারের, বিচার চাই। প্রহসনের বিচার, মানি না মানবো না। তবে ঐদিন আমরা বেশ কিছু ঘটনার স্বাক্ষী হয়ে গেলাম। এরপর আমি আর জর্জিস আরো বেশ কয়েকদিন গেছি। ওখানে যেয়ে ক্যাম্পাস জীবনের রুমমেট ফরহাদ, পাশের রুমের সুমনকেও পাওয়া গেল। অবশেষে এক ছুটির দিনে আমি আমার তিন বছরের মেয়ে তাহিয়াকেও নিয়ে গেছি। সেইদিন সে জনতার সাথে তাল মিলিয়ে যে স্লোগান দিয়েছিল তার রেশ ছিল অনেকদিন। শাহবাগ থেকে ফেরার পরও আমরা বাসায় স্লোগান দিতাম। বিশেষকরে অফিস থেকে ফেরার পর দরজা খোলার সাথে সাথে সে দৌড়ে এসে স্লোগান দিত, রাজাকারের। আমি বলতাম বিচার চাই। অথবা কখনও আমি বলতাম রাজাকারের তাহিয়া বলতো বিচার চাই। এভাবে কতদিন চলেছিল মনে নেই কিন্তু গণজাগরণের দিনগুলোতে আমরা শাহবাগের পাশে ছিলাম এখনও আছি।

(৮)

এরপর শাহবাগ নিয়ে শুরু হয়ে গেল অপপ্রচার। আসলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা এতটাই দোদুল্যমান যে কোন ভালো উদ্যোগই আর বেশিদিন ভালো বলে পরিগণিত হয় না। গণজাগরণ মঞ্চের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হল না। তবে শাহবাগ নিয়ে আমার অভিজ্ঞতাগুলো অনেক সুন্দর। প্রথম যেদিন শাহবাগ গেলাম যেয়ে দেখি লাকী স্লোগান দিচ্ছে। আমরা একটা জায়গায় বসে গলা মেলাতে শুরু করলাম। আর চারপাশের মানুষকে দেখতে লাগলাম। এক মা তার স্কুল পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে এসেছে। উনি রাজি ছিলেন না মেয়ের জেদের কাছে পরাজিত হয়ে অবশেষে এসেছেন। এখন খুবই ভালো লাগছে উনার। আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম বয়স আর কতই বা হবে দশ কি বারো। ঘাড়ের রগ টান করে স্লোগান দিচ্ছে। আর এক মা এসেছেন একজন বাচ্চাকে কোলে নিয়ে। আমি জিজ্ঞেস করলাম এমন ন্যাদা বাচ্চা নিয়ে না আসলেও তো পারতেন। উনি যে উত্তর দিলেন সেটা ছিল আশাতীত। উনি বললেন মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা আমার চেয়েও খারাপ অবস্থায় থেকে যুদ্ধ করেছিল আর আমি এতুটুকু করতে পারবো না। আর এক মা এসেছেন উনার বিবাহযোগ্য কন্যাকে নিয়ে। উনি বললেন মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে ছেলে ভালো। আর এরই মধ্যে এ কি শুরু হল।

(৯)

অন্য একদিনের ঘটনা আমাদের পাশে বসা চাচা পাশের বাদামওয়ালার কাছে থেকে এক কেজি বাদামভাজা কিনে নিয়ে এসে আমাদের সবাইকে খেতে দিলেন। উনার থেকে যারা দূরে ছিলেন তাদের দিকে মুঠো মুঠো করে বাদাম ছুড়ে দিচ্ছিলেন। সবাই রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে সেই বাদাম খাচ্ছিলো। সেদিনই হঠাৎ স্লোগনের জায়গাটাকে উত্তপ্ত মনেহল। আমরা ঘাড় উঁচু করে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর দেখতে পেলাম আওয়ামীলীগের মোহাম্মদ হানিফের হাতে মাইক্রোফোন। উনি সবে তিনটা শব্দ উচ্চারণ করেছেন, আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা। সাথে সাথে শত শত পানির বোতল উনার দিকে চলে গেল ঠিক যেমন চুম্বকের দিকে লোহার গুড়ো ধাবিত হয়। সারা এলাকাজুড়ে মূহুর্মূহু স্লোগান চলতে থাকলো প্রহসনের বিচার মানি না মানবো না। উনাকে ঘিরে ছাত্রলীগের কর্মীরা দাড়িয়ে উনাকে সে যাত্রায় রক্ষা করলেন। একটু পরেই শুনি লাকীকে ছাত্রলীগের গুন্ডারা মাথার পিছনে আঘাত করেছে হানিফের কাছ থেকে মাইক্রোফোন কেড়ে নেয়ার জন্য। তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল।

(১০)

শাহবাগের আন্দোলন চলছে। একে একে সবাই এসে একাত্মতা প্রকাশ করছে। এরমধ্যে খবর পেলাম একদিন মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার আসছেন শাহবাগের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করার জন্য। আমি মনেমনে ঠিক করে রাখলাম যেভাবেই হোক আজ আমাকে যেতেই হবে কিন্তু গিন্নীর বাধার কাছে হার মানতে হল। অবশেষে টিভির পর্দায় উনার ভাষণ লাইভ দেখে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো হল। শাহবাগ নিয়ে এরই মধ্যে অপপ্রচার শুরু হয়ে গেছে। যে অপপ্রচারের সাথে আমার শৈশবের দিনগুলোর মিল খুজে পেলাম। আসলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জামাতিরা এমনভাবে অপপ্রচার চালিয়েছিল যে সবাই একসময় তাদের কথাতেই বিশ্বাস স্থাপন করতে শুরু করেছিল। আসলে একটি মিথ্যাও যদি আপনি বারবার বলতে থাকেন সেটাকে সত্য মনেহয়। জামাতিরা ঠিক সেই কাজটাই করেছিল। যারফলে মুক্তিযোদ্ধারা হয়ে গিয়েছিল ঘৃণিত আর রাজাকারেরা হয়ে উঠেছিল পূজনীয়। শাহবাগের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটলো। আমারদেশ পত্রিকা একেবারে শুরু থেকে এটাকে বেলেল্লাপনার কারখানা বানিয়ে দেশের মানুষের কাছে উপস্থাপন করতে লাগলো। বাংলাদেশে আপনি ধর্মের রেফারেন্স দিয়ে যদি কোন মিথ্যা কথাও বলেন সেটা খুবই দ্রুততার সাথে সত্যিতে পরিণত হয়। এমনকি প্রথম আলোর মত পত্রিকার সাহিত্য পাতায় লাকীকে নিয়ে কোন এক হাসনাত আব্দুল হাই একটি অশ্লীল কাল্পনিক গল্প ‘টিভি ক্যামেরার সামনের মেয়েটি’ লিখে ফেললো এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রথম আলো সেটা প্রকাশও করছিল। আমি শুরু থেকেই এই পত্রিকার পাঠক তাই এমন কাল্পনিক গল্প প্রকাশে খুবই মর্মাহত হয়েছিলাম।

আমি তখন দেশ ছাড়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। ভিসার কাগজপত্র জমা দেয়ার জন্য উত্তরা ডি এইচ এল অফিসে গিয়েছি কুরিয়ার করতে। রিসেপশনে বসা স্মার্ট ভদ্রমহিলা অন্য একজনের সাথে শাহবাগের বেলেল্লাপনার বিষয়ে আলাপ করছিলেন। আমার কানে যেতেই আমি প্রতিবাদ করে বললাম লোকের কথায় কান না দিয়ে নিজে সময় করে একবেলা যেয়ে দেখে আসেন না কেন ওখানে কি হচ্ছে। পরে একদিন এক বড় ভাইয়ের অফিসে গিয়েছি একটা কাজে। জোহরের নামায শেষ করে খাওয়াদাওয়ার সময় উনি আমাকে বললেন শাহবাগে তো অশ্লীলতা চলছে। আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম উচ্চশিক্ষিত একজন মানুষের কাছ থেকে এমন রেসপন্স পেয়ে। এরপরে শাহবাগ এবং গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে অনেক কিছুই হল। এতে কারা লাভবান হল আর কারা ক্ষতিগ্রস্থ হল জানি না কিন্তু একটা বিষয় জানি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনের নিভু নিভু করে জ্বলা আশার প্রদীপটা নিভে গেল। শাহবাগই প্রথম মানুষকে বিশ্বাস করতে শিখিয়ে ছিল অপরাধ করে কেউ পার পাবে না সেটা অপরাধ করার ৪০ বছর পরে বিচার হলেও। তাই আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি একদিন সত্যের জয় হবেই। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে কার কি অবদান সেটা ইতিহাস মনে রাখবেই এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরবে দেশ থেকে দেশান্তরে। আর সেটা করার দায়িত্ব আমার আপনার সকলের। আমরা যদি আমাদের পরবর্তি প্রজন্মকে সামান্য হলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারণা দিয়ে যেতে পারি তাহলেই এখনার গুগুলের যুগে বাকিটা ওরা নিজেরাই জেনে নিবে।

 

মো: ইয়াকুব আলী

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top