সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

ইরানের নিষিদ্ধ চলচ্চিত্রকার জাফর পানহি : বাস্তব যার উপস্থাপনা : ড. আফরোজা পারভীন


প্রকাশিত:
১৪ জুলাই ২০২০ ২২:৪৫

আপডেট:
১৪ জুলাই ২০২০ ২২:৫৯

 

জাফর পানাহি ইরানি চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার ও চলচ্চিত্র সম্পাদক। জন্মেছিলেন ১১ জুলাই ১৯৬০ মিয়ান-এ। ইরানি নবকল্লোল চলচ্চিত্র আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন অল্পকাল। চলচ্চিত্র নির্মাতা আব্বাস কিয়ারোস্তামির সহকারি পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। এর পর নির্মাণ করেন তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র বাদকোনাকে সেফিদ (সাদা বেলুন, দি হোয়াইট বেলুন ১৯৯৫) । চলচ্চিত্রটি তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। কান চলচ্চিত্র উৎসব হতে ‘ক্যামেরা দর’ লাভ। এটি ছিল কোনো ইরানি চলচ্চিত্রের জন্য কান থেকে পাওয়া প্রথম প্রধান পুরস্কার। অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। আয়না (দি মিরর, ১৯৯৭) চলচ্চিত্রের জন্য লোকার্নো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব থেকে ‘সোনালি চিতা’, চক্র (দি সার্কেল ২০০০) চলচ্চিত্রের জন্য ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব থেকে ‘গোল্ডেন লায়ন’ এবং অফসাইডার (২০০৬) চলচ্চিত্রের জন্য বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব থেকে ‘রৌপ্য ভল্লুক’ পান।
তাঁর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র বাদকোনাকে সেফিদ (১৯৯৫), পরিচালক ও সহ-লেখক । আয়না(১৯৯৭) পরিচালক, প্রযোজক। দায়রা ২০০০), পরিচালক, সহ-লেখক, প্রযোজক। অফসাইডার (২০০৬), পরিচালক, লেখক, প্রযোজক। ইন ফিল্ম নিস্ত (২০১১), পরিচালক, লেখক, প্রযোজক। পার্দে (২০১৩) পরিচালক, লেখক, প্রযোজক। ট্যাক্সি (২০১৫), পরিচালক, লেখক, প্রযোজক। সে রোখ (২০১৮), পরিচালক, লেখক, অভিনেতা।
পানাহি অল্প সময়ে ইরানের সবচেয়ে প্রভাবশালী চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন হয়ে ওঠেন। তাঁর চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক ও সমালোচকদের কাছ থেকে প্রশংসা অর্জন করলেও চলচ্চিত্রগুলো নিজ দেশে নিষিদ্ধ হতে থাকে।
জাফর পানাহির জীবন বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্ভার। ১৯৮০ সালে ইরান ইরাক যুদ্ধে বাধ্য হয়েই তাঁকে অংশ নিতে হয়েছিল। ১৯৮৮ সালে যুদ্ধ থেকে ফিরে তিনি ইরান ব্রডকাস্টিং স্কুলে চলচ্চিত্র পরিচালনা বিশেষত তথ্যচিত্র নির্মাণ বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৯৪ সালে কিয়ারোস্তমির ‘থ্রু দি অলিভ ট্রিস’ চলচ্চিত্রে সহকারি পরিচালক হিসেবে যুক্ত হন। এছাড়া সম্পাদনা করেন অন্যান্য চলচ্চিত্রকারের কয়েকটি ছবি।
তাঁর প্রথম ছবি ‘দি হোয়াইট বেলুন’ (১৯৯৫) দেশের মাটিতে মুক্তি পায়নি । কিন্তু বিদেশের মাটিতে প্রদর্শিত হয়ে বিপুল প্রশংসা পেয়েছে। পানাহির নির্মাণের খ্যাতি ছড়িয়ে গেছে চারদিকে। ১৯৯৭ সালে নির্মিত ‘দি মিরর’ সম্পর্কেও একই ঘটনা ঘটে । দেশ বিদেশ থেকে প্রচুর খ্যাতি আর সম্মান বয়ে আনে তার জন্য। কিন্তু পানাহি এতে মোটেও তৃপ্ত ছিলেন না। তার দুঃখ ছিল, নিজের নির্মিত ছবি তিনি নিজ দেশের ফার্সি ভাষা-ভাষাদির দেখাতে পারছেন না। ২০০০ সালে নির্মিত হয় ‘দি সার্কেল’। ছবিটি ইরানে নিষিদ্ধ করা হয়।
মায়দে, আর্জু, পারি আর নার্গিস পালাতে চেয়েছিল বাড়ি থেকে, পরিবার থেকে। কেন তারা পালাতে চেয়েছিল? অকারণে নিশ্চয়ই নয়। একজন দরিদ্র মা তার ছয় বছর বয়সী সন্তানকে রাস্তায় ফেলে গিয়েছিল যাতে কোনো ধনী পরিবার তাকে গ্রহণ করে। নিদেনপক্ষে রাষ্ট্র যেন তার দায়ভার নেয়। যেন সে খেয়ে পরে বাঁচতে পারে। একটি মেয়ে কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ার অপরাধে পরিবার থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। একজন যৌনকর্মী জীবিকার তাড়নায় গভীর রাতে পথে বেরিয়েছিল । কাহিনির শেষে এদের সবাইকে আমরা দেখি কারাগারের জেনানা সেলে। এদের সবারই কমন অপরাধ। পুরুষ সাথি ছাড়া এরা রাস্তায় বেরিয়েছিল। অর্থাৎ নারী সত্তা কোন একক সত্তা নয়, খন্ডিত সত্তা। পুরুষ সাথে না থাকলে সে সম্পূর্ণ নয়। এই আরজু, পারি, নার্গিস, এদের কাহিনি নিয়েই আবর্তিত ‘দি সার্কেল’। এক চক্রে বন্দি ওরা। স্কুল কলেজ বাজার ঘাট জন¯্রােত সর্বত্র ওদের ওপর কঠোর দৃষ্টি রাখছে পুলিশ। ওরা জন¯্রােতে হারিয়ে যেতে চায়, কিন্তু পারে না। পুলিশের শ্যেন দৃষ্টি ওদের অনুসরণ করে। শাসকদের চোখে মেয়েদের স্বাধীনতা বোঅইনি। তাই ধূর্ত নেকড়ের মতো ওদের খুঁজে চলেছে পুলিশ।
দরিদ্র মা শিশুটিকে একটা দামি রেস্তোরাঁর সামনে বসিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে কে তার সন্তানটিকে নিয়ে যায় দেখার জন্য। এক বেলুনঅলা এসে বাচ্চাটাকে আদর করে। একসময় পুলিশ এসে বাচ্চাটাকে সরকারি হেফাজতে নিয়ে যায়। ঘটনাক্রমে পারির সাথে দেখা হয়ে যায় ওই বাচ্চা আর ওই নারীর। বিপন্ন বিধ্বস্ত ক্লান্ত সন্তান হারানো মা হাঁটছে রাস্তা দিয়ে। কিন্তু সব শেষে পারি, ওই মা, নার্গিস সবাই আটকা পড়ে কারাগারের অভ্যন্তরে ।
জাফরের পরের ছবি ‘ক্রিসমাল গোল্ড’। ছবিটি পিৎজা শ্রমিকের জীবন নিয়ে নির্মিত। ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছেন আব্বাস কিয়ারোস্তামি। হুসেন ও আলি একটা পিৎজা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক। তারা বাইকে করে বিভিন্ন বাড়িতে পিৎজা পৌঁছে দেয়। হুসেনের খুব ইচ্ছে ক্রিসমাসে স্ত্রীকে দামি গয়না কিনে দেবে। কিন্তু পর্যাপ্ত পয়সা না থাকায় সে পিস্তল নিয়ে গয়নার দোকানে ঢোকে। সবশেষে হতাশা ও ক্রোধে সে আত্মহহনন করে। ছবিতে এই অংশটুকু দেখানো হয়েছে মাত্র তিনটে ফ্রেমে। গোটা ছবি জুড়ে আমরা দেখি হুসেনের নানান অভিজ্ঞতার কাহিনি । হুসেনের কণ্ঠে সংলাপ ছিল খুব কম। হুসেন শুধু চোখ দিয়ে দেখেছে চারপাশের কঠিন বাস্তব। সমাজের একটা অংশ অত্যন্ত ধনী, মানুষকে তারা মানুষ মনে করে না। ক্ষমতা আর অর্থের দম্ভে মোহগ্রস্ত তারা । আর একটি অংশ বড্ড দরিদ্র। কিছুই নেই তাদের। কিন্ত এই যে সামাজিক ভারসাম্যহীনতা এ বিষয়ে সরকার আর প্রশাসন নিস্পৃহ। হুসেন দেখে চারপাশের এই মেকি দুনিয়াকে। দেখে ধনীদের নিষ্ঠুরতা। ক্ষয়ে যাওয়া সমাজ ব্যবস্থা তার চোখে প্রতিকারহীনতায় একটু একটু করে আলো হারায় । ঢেকে রাখা সত্যগুলো বেরিয়ে আসে । হুসেনের নিজেকে একা আর বিচ্ছিন্ন মনে হয়। সে কেউ না, এদের কেউ না। অবশেষে সে আত্মঘাতী হয়।
জাফর পানহির ‘ক্রিসমাস গোল্ড’ চলচ্চিত্রটিতে আমরা শ্রেণিসম্পর্ক প্রত্যক্ষ করি। আব্বাস কিয়ারোস্তমির চিত্রনাট্যে সেটা সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়। ইরানে শোষক আর শাসিতের মধ্যে যে অর্থনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক ব্যবধান তা প্রতিভাত হয়েছে ফ্রেমে ফ্রেমে। হুসেন পিৎজা বিক্রির সুবাদে বড়লোকের অন্দর মহল, বিত্তশালীর আলো ঝলোমলো এপার্টমেন্টে যাতায়াত করে হরহামেশা । দেখে চোখ ধাঁধানো পণ্যের সমাহার। এ যেন তার কাছে এক অলীক জগৎ। এই জগৎটিকে সে নৈর্ব্যক্তিক চোখে ভাবলেশহীনভাবে দেখে। সে আর তার বাগদত্তা একখানা গয়না কেনার জন্য চোখ ঝাঁঝানো দোকানগুলোর মহামূল্যবান গয়নার শোকেসের সামনে দিয়ে হাঁটতে থাকে । একখানা গয়না সে কিনতে চায়, প্রত্যাখ্যাত হয়। তখন এক ধরনের হতাশা আর অনিশ্চয়তা তাকে ঘিরে ধরে। সে পিৎজা দিতে যায় এক বাড়িতে। বাড়ির মালিক রাতে তাকে থেকে যেতে আর শেষ পিৎজাটা খেতে বললে সে থেকে যায়। রাতে সে ঘুরে ঘুরে দেখে বাড়ি বোঝাই মূল্যবান সামগ্রী, আসবাবপত্র, ঝাড়বাতি, সুইমিংপুল। এক সময় নিজেকে তার নিতান্তই তুচ্ছ আর অকিঞ্চিৎকর মনে হয়। এতটাই তুচ্ছ মনে হয় যে, সে মনোভাব তাকে আত্মহননের পথে নিয়ে যায়।
হুসেন বাধ্যতামূলকভাবে ইরান-ইরাক যুদ্ধে অংশ নেয়া একজন মানুষ। এই যুদ্ধ শেষে অনেকেই হয়ে গেছে ট্রমাগোরস্ত স্কিতজফ্রেনিক। যুদ্ধের দাবদাহে অনেক মানুষ বিকলাঙ্গ হয়ে গেছে। অনেকের শরীরে ঢুকে গেছে গোলাগুলি থেকে নির্গত বিষ। যুদ্ধ শেষে যে সমাজে তারা ফিরেছে সে সমাজও কোনো অনুকূল সমাজ নয়। রক্ষণশীলতা আর গোঁড়ামি যে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সামাজিক ভারসাম্যহীনতা সে সমাজে প্রকট। শুধু তাই নয়, মরাল পুলিশিং-এর দাপট তাদের জীবন রাহুগ্রস্ত করে তুলেছে। হুসেনের জীবনে এর সাথে যুক্ত হয়েছে সীমাহীন দারিদ্রের কষাঘাত।
‘ক্রিসমাস’ গোল্ড একজন বাস্তববাদি পরিচালকের গভীর সামাজিক ভাবনার প্রতিফলন। এ ছবিতে আছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক তিক্তকার অনুুভূতি। আছে বিচ্ছিন্নতাবোধ। ‘দি সার্কেল’ চলচ্চিত্রও সামাজিক জীবনের প্রতিফন। তবে সে ছবিতে বিচ্ছিন্নতাবোধের প্রকাশ সেভাবে নেই। বরং মায়দে, পারি, নার্গিস এই মেয়েগুলি গভীরভাবে একীভূত। সে ছবির প্রতিটি ফ্রেমই চলমান জীবনকে ধারণ করে এগিয়ে যায়। এমনকি শেষ দৃশ্যে যখন তারা জেনানা ফাটকে তখনও তারা একীভূত। তাদের মাঝে রয়েছে ঐক্য, বিচ্ছিন্নতা নয় মোটেও। সেদিক দিয়ে ‘ক্রিসমাস গোল্ডে’ পানহি এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক তিক্ত অভিঘাতের সৃষ্টি করেন। যা কখনো কখনো দমবন্ধকর মনে হয়।
আব্বাস কিয়ারোস্তামি ও জাফর পানহি দুজনই সমাজ সচেতন পরিচালক । কিন্তু দুজন সমাজকে দেখেছেন দুভাবে। পানাহির দেখা ব্যক্তিকেন্দ্রিক। তিনি ব্যক্তির মধ্য দিয়ে সমাজকে দেখেছেন। আর আব্বাস অনেক মানুষ নিয়ে যে সমাজ তাদের একত্রিত করে দেখেছেন। দেখেছেন সামাজিক মানুষকে । আর সে মানুষ প্রধানত নারী। তিনি উচ্চ দর্শন এড়িয়ে সাধারণ জীবন তুলে আনতে চেয়েছেন বাস্তবতার নিরিখে।
‘দ্য মিরর’ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র ৭ বছরের বালিকা মিনা মোহাম্মদখানী। অন্যান্য দিনের মতো মা আজও তাকে স্কুল থেকে নিতে আসবে। সে স্কুল গেটে অপেক্ষমান। কিন্তু মায়ের আজ দেরি হচ্ছে। এবার নিজেই সে বাড়ি ফেরার উদ্যোগ নেয়। তার বা হাত ভেঙে গেছে। সে হাতে প্লাস্টার বাধা। সে অসুবিধা সত্ত্বেও এক ভদ্রলোকের বাইকের পেছনে চেপে বাসস্টপেজে পৌঁছায়। বাসে ওঠে। একটু একটু ভয় করে তার । তারপরও অপার কৌতূহল আর উপস্থিত বুদ্ধি সম্বল করে চলতে থাকে। এই অচেনা নগর, এর মানুষ, চলমান জীবনের খুঁটিনাটি, প্রতিটি শব্দ, ধ্বনি, সংলাপ তাকে আকৃষ্ট করে। সে গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখতে থাকে। কিন্তু এই শহর, এই শহরের মানুষেরা এই ছোট্ট বালিকার প্রতি নিতান্তই নিস্পৃহ । এর ব্যাপারে তাদের কোন চিন্তা নেই, প্রশ্ন নেই , কৌতূহল নেই। মিনার দৃষ্টিতে আমরা নগর সভ্যতার অবক্ষয়িত চিত্র দেখি। দেখি এ সমাজ, এ শহর একেবারেই নিরেট, কঠোর। ছোট্ট একটা বালিকার ব্যাপারেও তাদের কোন আগ্রহ নেই।
একসময় রেগে যায় মিনা। টান দিয়ে নিজের হাতের প্লাস্টার খুলে ফেলে সে । ঘোষণা দেয় এ ছবিতে সে আর অভিনয় করতে আগ্রহী নয়। সে যথেষ্ট বড় হয়েছে। সে পরিচালকের অভিভাবকত্ব মানবে না। নিজের বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। জাফর পানাহি ও তাঁর ক্রুরা ছবি নেয়ার জন্য অপেক্ষমান। কিন্তু কীভাবে? এখন তো আর কোনো স্ত্রিপ্ট নেই। তারা আনুসরণ করে মিনাকে। তাহলে এ ছবি কি কাহিনিচিত্র তথ্যচিত্র অন্য কিছু? এ প্রসঙ্গে জাফর পানহি বলেছেন, when I see my picture the picture ( in a mirror) resembles me. অর্থাৎ চলচ্চিত্র তাঁর কাছে আয়নার মতো। যা বাস্তবের প্রতিবিম্ব গঠন করে। তাঁর এ ছবির উদ্দেশ্য উপস্থাপনা আর বাস্তবের মধ্যে অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক স্থাপন।
আমরা আসি ‘দ্য হোয়াইট বেলুনে’। দ্য হোয়াইট বেলুনের রাজিয়া একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের সাতবছরের বালিকা। নওরোজের দিন সে বায়না ধরে একটা বাহারি মাছ কেনার। মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সে দোকানের দিকে দৌড় দেয়। পথে একটা লোহার জালের ভিতর দিয়ে টাকাটা পড়ে যায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাষণের একটা শুকনো নালার অনেক গভীরে। রাজিয়া ও তার দাদা আলি টাকা তোলার ব্যাপারে বিভিন্ন মানুষের কাছে যায়। অনেকরকম মানুষের সাথে তাদের দেখা হয়। একজন বৃদ্ধ, দুজন পৌঢ় দোকানদার, এক বৃদ্ধা, একজন পথচারী দম্পতি আরো কিছু মানুষ। কিন্তু এদের কারোরই ওই ছোট্ট বালিকার সমস্যাটি নিয়ে কোন সংবেদনশীলতা নেই। নেই টাকাটা খুঁজে দেয়ার চেষ্টা। পানাহি আসলে এমন এক সমাজ দেখাতে চাইতেন যেখানে অধিকাংশ মানুষ শুধু নির্লিপ্ত আর নিরাসক্তই নয়, দায়িত্বজ্ঞানহীন। এরা সমুখে বড় বড় বুলি আওয়াড়। কিন্তু আপাদমস্তক সুবিধাবাদি, নীতিবাগিশ, আত্মকেন্দ্রিক আর সুযোগসন্ধানী ।
‘দ্য হোয়াইট বেলুনে’র শেষাংশে আমরা দেখি, এক আফগান শরণার্থী বেলুনওয়ালা বালকের সাহায্যে রাজিয়া নালার মধ্যে পড়ে যাওয়া টাকাটা উদ্ধার করে। টাকা পাওয়ামাত্র রাজিয়া আর তার দাদা দৗড় দেয় বাহারি মাছের দোকানের দিকে। পেছনে একা পড়ে থাকে ওই বালক। এতক্ষণ আমরা রাজিয়ার চোখ দিয়ে চারধার দেখছিলাম। এবার ক্যামেরা অনুসরণ করে ক্লান্ত বিধ্বস্ত ওই আফগান শরণার্থী বালককে । তারপর গমণোদ্যত ওই বালকের ইমেজের ওপর ফ্রিজ করে। কে এই বালক? কোথায় এর ঘর? এর কি কোনো ঘর-বাড়ি আছে? কেন সে আফগান ছেড়ে তেহরানে? ওরা তো চলে গেল এবার এই বালক যাবে কোথায়? সে তো শরণার্থী। উত্তর খুঁজবে এবার দর্শক।
আব্বাস কিয়ারোস্তমির চলচ্চিত্রে যেমন কোনো সমাপ্তি আমরা পাই না, প্রতিটি ছবির শেষ হয়েছে প্রশ্ন রেখে। জাফর পানহির চলচ্চিত্রেও সেই একই ব্যাপার দেখি। চলচ্চিত্রের শেষে কাহিনির পরিণতি মেলাতে বসে দর্শক। তবে পানহির চলচ্চিত্রের যেটা প্রধান বৈশিষ্ট্য তা হলো, উপস্থাপনা আর বাস্তবের মধ্যে সাজুয্য। যেটা তিনি করতে চেয়েছিলেন এবং পেরেছেন।
তথ্যসূত্র: Jake wilson, ‘ A mirror under the veil-and inside the stadium’, The Age, sepetember 26,2006

 

ড. আফরোজা পারভীন
কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক, কলামলেখক
অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top