সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

একা এবং একা (পর্ব সাত) : আহসান হাবীব


প্রকাশিত:
২৭ জুলাই ২০২০ ২২:৩৫

আপডেট:
৪ আগস্ট ২০২০ ২২:৩৯

 

মফস্বল শহরের মানুষের বিস্ময় খুব বেশী। নতুন কিছু ঘটলেই তারা আগ্রহ নিয়ে খেয়াল করে। যেমন সরযুবালা বিদ্যানিকেতনের ইংরেজী শিক্ষক রফিক স্যারের পাগল হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা, রফিক স্যার এখন খালি গায়ে সারা শহরে ঘুড়ে বেড়ান; ময়লা শার্টটা কোমড়ের কাছে বাধা থাকে। আর বিড় বিড় করে কি সব বলেন। কিছু কর্মহীন লোক, এর মধ্যে বাচ্চাদের সংখ্যই বেশী; তারা পিছে পিছে ঘুরে। আর মাঝে মাঝে রফিক স্যারের কোন কথায় হেসে উঠে।  রফিক স্যারের পরিচিত কেউ দেখলে ধমক দিয়ে তার পিছনের মিছিলকে বিদেয় করেন। কোমল স্বরে বলেন

-ভাই বাসায় যান। শার্টটা গায়ে দেন।

রফিক স্যার ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে বির বির করে বলেন ‘কমন মিসটেক ইন ইংলিশ ক্লাশটাতো নেয়া খুব জরুরী ... ছাত্রদের পরীক্ষা চলে আসছে। এটা ওদের খুব কাজে লাগবে’

- অবশ্যই ক্লাশ নিবেন। এখন বাসায় যান, শার্টটা পড়েন।

- বাসায়তো কেউ নাই। মরিয়ম চলে গেছে

- ভাবী কোথায় গেছে?

- ওর ভাইরা এসে নিয়ে গেছে। আচ্ছা কমন মিসটেক ইন ইংলিশ ক্লাশটা নেওয়ার কোন ব্যবস্থা করতে পারেন? আজকে আমি ফ্রি আছি...

 

রফিক স্যার মাঝে মাঝেই বিকেলের দিকে সরযুবালা বিদ্যানিকেতনের গেটে এসে হাজির হন। স্কুলের নতুন বুড়ো দারোয়ান স্যারকে চেনে। তিনি এসেই ঢোকার চেষ্টা করেন, স্কুলে দারোয়ান আটকায়।

- স্যার আপনে ঢুইকেন না

- এই শাহজাহান তুমি আমাকে আটকাচ্ছ কেন? রেগে উঠেন রফিক স্যার। 

- স্যার আমি শাহজাহান না। আমি তৈয়ব

- আচ্ছা শাহজাহানকে ডাক। বল যে আমার একটা জরুরী ক্লাশ নিতে হবে। আজকে ফ্রি আছি।

- স্যার চা খাইবেন?

- না না চা সিঙ্গারা কিছু খাব না। এরা সিঙ্গারার মধ্যে গান্ধি পোকা দেয়। এই সময় মনিকা ম্যাডামকে দেখা যায়। রফিক স্যার তাকে চিনতে পারলেন না। বললেন ‘এই যে আপু, আমার একটা ক্লাশ নিতে হবে কমন মিসটেক ইন ইংলিশ ক্লাশটা... একটু হেড স্যারকে বলুন; এরা আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না।’  মনিকা ম্যাডামের চোখে পানি চলে আসে। কি বলবেন তিনি?    

 

অবশ্য রফিক স্যার বিড় বিড় করতে করতে ফের হাঁটা দেন শহরের দিকে। তার ধূলি ধূসরিত নগ্ন পায়ের নিচে এলোমেলো ভাবে ছুটতে থাকে এই মফস্বল শহরের রাস্তাগুলো।

ফের কিছু ছেলে পেলে জুটে যায়; তারা রফিক স্যারের পিছু নেয়, হি হি করে হাসে! রফিক স্যার বিরক্ত হন না। মাঝে মাঝে দাড়িয়ে পড়েন, পিছন ফিরে বলেন

-বাবারা বাসায় যাও, বাসায় যাও...

 

মজিদ স্যার বিষয়টা নিয়ে বিশেষ চিন্তিত। সরযুবালা বিদ্যানিকেতনের একজন এক্স শিক্ষক পাগল হয়ে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, হাস্যকর সব আচরন করছে; এটা স্কুলের জন্য বেশ অসন্মানজনক। ব্যাপারটার একটা জরুরী ফয়সালা হওয়া দরকার। মেয়র সাহেব অবশ্য একটা পরামর্শ দিয়েছেন সেটাই মনে হয় করতে হবে। তিনি বেল টিপলেন। কুদ্দুস ঢুকলো।

- স্যার?

- শোন দরজাটা ভিড়িয়ে দাও, তোমার সাথে জরুরী কথা আছে। দরজা ভিড়িয়ে কুদ্দুস ফিরে এল।

- স্যার বলেন

- শোন তোমাকে একটা কাজ করতে হবে, কেউ যেন না জানে।

- কি কাজ স্যার?

মজিদ স্যার গলা নামিয়ে ফিস ফিস করেন, ‘রফিক স্যারকে ধরে বেধে দূরে কোথায় ছেড়ে দিয়ে আসবে। এই শহরে যেন না থাকে। কি পারবা না?’  

- পারব স্যার

- কেউ যেন না জানে

- জি স্যার

- এই নাও টাকা। আজ বৃহস্পতিবার। কাল শুক্রবার। কালই যাও, সন্ধ্যার দিকে রওনা দিবা। খুব সাবধান, কাক পক্ষিও যেন টের না পায়!

- জি স্যার।

 

মনিকা ম্যাডামের মনটা সকাল থেকেই বিক্ষিপ্ত। আজ স্কুল ছুটির পর মেয়র মোরতাজুল সাহেব মনিকাকে একা ডেকে পাঠিয়েছেন। মনিকা কি করবে  ঠিক বুঝতে পারছে না। যেতে হবে, কিন্তু ... মনিকা ম্যাডাম অস্বস্থি নিয়ে বিজ্ঞান বইটা হাতে নেন। আজ পড়ানোর কথা সৌরজগৎ। মনিকা ম্যাডাম ছাত্রদের দিকে তাকালেন। সব পরিচিত মুখ তারপরও মনে হচ্ছে এরা যেন সব অচেনা।

- সৌরজগতে গ্রহ কয়টি?

- ম্যাডাম নয়টি

- কি কি? তুমি বল

ছেলেটা সবগুলি নামই বলল...সবার শেষে বলল প্লুটো। প্লুটো কি এখনো গ্রহ আছে?

- প্লুটো কিন্তু এখন আর গ্রহ নেই। গ্রহ হলে তিনটা নিয়ম মানতে হবে সেই গ্রহকে। যেমন নক্ষত্রের চারিদিকে ঘুরতে হবে। দুই, যথেষ্ট ভর থাকতে হবে। তিন... নিজ কক্ষপথের আশে পাশে অন্য কোনো জ্যোতিষ্ক থাকতে পারবে না

- ম্যাডাম জ্যোতিষ্ক কি?

- জ্যোতিষ্ক হচ্ছে... মনিকা ম্যাডাম যন্ত্রের মত ক্লাশ নিতে লাগলেন; তিনি নিজেও জানেন না কি বলছেন ঠিক বলছেন না ভুল বলছেন। বিজ্ঞান ভুল-ভালের বিষয় নয়। তারপরও তার মনে হচ্ছে আজ তিনি সব ভুল-ভাল বলে যাচ্ছেন...!

 

মেয়র মোরতাজুলের অফিসে মনিকা যখন পৌঁছালেন তখন অফিস মোটামোটি ফাকা। মেয়র সাহেব একাই বসে আছেন তার রুমে। বেশ ঠান্ডা বাতাস আজ মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে।

- মনিকা আস আস। মনিকা অস্বস্থি নিয়ে বসল।

- কি খাইবা? গরম না ঠান্ডা?

- কিছু খাব না।

- আরে কি বল খাইবা না, এই জিকু ডাবল ডিমের মোগলাই আন দুইটা। আর ঠান্ডা আন দুইটা। মেয়র সাহেব কাজের মানুষ খুব শিগ্রী মূল আলোচনায় চলে আসলেন।

- শোন তোমারে একা ডাকছি কারণ বিষয়টা তোমার বাবারে নিয়া। তোমার বাবাতো আর আমার ট্যাকা ফেরৎ দিল না। এতগুলা ট্যাকা ব্যাংকে রাখলেতো এদ্দিনে ...

- এখন আপনি কি চাচ্ছেন চাচা?

- আমি আমার টাকা ফেরৎ চাই। বোঝতো দিন কাল খারাপ, মেয়র আর কয়দিন আছি, তিন বছর পর পর থাকলাম। আগামী বছরেই আর আমি নাই। আমার ছেলে তাজুল নাকি ইলেকশন করব... আমি কই কর, আমরা আর কয়দিন। দেখি নতুন প্রজন্ম জাতিরে কি দেয়। আমিতো এই কয় বছরে কম দিলাম না... কি বল?

- চাচা আমি তাহলে বাবার সাথে কথা বলি। ব্যাপারটা আমি শুনেছিলাম পরিস্কার জানি না।

- কথা বইলা আর কি হবে? তার অবস্থাতো আমি জানি, রিটায়ার করছে। একটা রাস্তা অবশ্য আছে।

- কি রাস্তা?

- রাতারগুলের কাছে আমি একটা বাংলো বানাইছি শুনছো বোধ হয়। খুবই সুন্দর; ঢাকা থাইকা আর্কিটেক্ট আইনা ডিজাইন করছি। দেড় কোটির উপরে খর্চা গেছে, এমপি সাহেবের দিয়া উদ্ভোধন করাইছিলাম। টিভিতে দেখাইছিল। 

- জি

- চল একদিন বেড়াইবা আমার সাথে... বাগান বাড়ীতে দুই দিন থাকবা

স্পষ্ট ইঙ্গিত। কান গরম হয়ে উঠে মনিকার। সে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাড়ায়।

- কি হইল? কই যাও? মোগলাই আসতাছে তো

- চাচা আমি পরে কথা বলব

- আগে পরে কথা বলার আর কিছু নাই। হয় ট্যাকা দিবা নাইলে আমার সাথে বেড়াইবা, বেশী না দুই দিন। জায়গা তোমার পছন্দ হইব। বেলী ফুলের বাগান করছি... কি ঘ্রান গেলেই বুঝবা।

- আমি যাই

- আরে কই যাইবা বস। ঝট করে মনিকার হাতটা ধরে ফেলেন মরতাজুল ইসলাম। মনিকার শরীরটা ঘিন ঘিন করে উঠে। ‘মজিদরে সরায়া তোমারে হেড মিস্ট্রেস বানায়া দিমু, সেই ক্ষমতা আমার আছে’ ফিস ফিস করেন মেয়র সাহেব।

- হাত ছাড়ুন

- কথা ফাইনাল কর। বেশী না দুইদিন। তাইলে কইলাম তোমার বাপের সাথে হিসাব নিকাশ সব ক্লোজ হয়া যাইব... আমার এক কথা...

 

মনিকা টলতে টলতে বের হয়ে আসে।  দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করছে, কিন্তু হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে তার, মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে পরে যাবে। রাস্তাটা একবারে ফাকা। তার কেন যেন অসম্ভব ভয় হচ্ছে। মনে হচ্ছে মেয়রের লোকজন তার পিছু নিয়েছে। এখনি তাকে তার বাংলোয় ধরে  নিয়ে যাবে... তারপর আর ভাবতে পারে না মনিকা। একটু বসতে পারলে হত ... কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে... মনিকার মাথাটা এবার সত্যি সত্যি ঘুরে উঠল, আশেপাশের পরিবেশটা ঘুরতে থাকে তার চারপাশে... মনিকা কিছু একটা ধরার চেষ্টা করে, পারে না... এই সময় কেউ একজন ঝপ করে তাকে ধরে ফেলে!

- আপনার কি হয়েছে ম্যাডাম?

- কে? কে??

- আমি মারুফ

- মা- মারুফ স্যার! আমাকে একটু বাসায় পৌঁছে দিবেন ... প্লিজ!

- অবশ্যই। আপনার বাসা কোথায়?

- জুবিলি রোড, বাড়ির নম্বার ১৮/৭ । মারুফ পাজাকোলে করে তুলে নিল মনিকা ম্যাডামকে, মনিকা ততক্ষনে জ্ঞান হারিয়েছে। একটা রিক্সা দরকার। কোন রিক্সা নেই। এই সময় ঝম ঝম করে বৃষ্টি শুরু হল।

 

দৃশ্যটা সুন্দর। ফাকা রাস্তায় একজন শক্তসমর্থ পুরুষের কোলে এক অসহায় নারী, তার দীর্ঘ কালো চুল বৃষ্টি ভেজা পিচের রাস্তা ছুই ছুই করছে; অনেক উপরে এক খন্ড ধুসর চাঁদ দেখা যাচ্ছে, তারপরও বৃষ্টি হচ্ছে ঝম ঝম করে। কালো মেঘের দল অবশ্য ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে  চারদিক থেকে এগিয়ে আসছে চাঁদটার দিকে, তারা নিশ্চয়ই এখনি ঢেকে ফেলবে চাঁদটাকে... কারণ বৃষ্টি আর চাঁদ একসাথে থাকার কথা না। যেমন থাকার কথা না মনিকা আর মারুফের, একসাথে!  যেটা বার বার ঘটে সেটাই প্রকৃতি, কিন্তু যেটা হঠাৎ একবার ঘটে সেটা মিরাকল, অবিশ্বাস্য...!

 

(চলবে)


একা এবং একা - পর্ব এক
একা এবং একা - পর্ব দুই
একা এবং একা - পর্ব তিন
একা এবং একা - পর্ব চার
একা এবং একা - পর্ব পাঁচ
একা এবং একা - পর্ব ছয়
একা এবং একা - পর্ব সাত
একা এবং একা - পর্ব আট

 

লেখক: আহসান হাবীব
কার্টুনিস্ট/ সম্পাদক
উম্মাদ, স্যাটায়ার কার্টুন পত্রিকা
 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top