সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

মিডিয়ার ম্যাজিক, ম্যাজিকের মিডিয়া (রম্য রচনা) : তন্ময় চট্টোপাধ্যায়                


প্রকাশিত:
৩০ জুলাই ২০২০ ০১:৫৩

আপডেট:
২৮ মার্চ ২০২৪ ২৩:১৪

 

ডেলিসিয়াস ডিস মানে নোলায় জল। মন আনচান করবে, ডান হাতে নিসপিস, পেট পাঠাবে টেলিগ্রাম - এটাই ছিল বরাবরের স্টাইল। ইদানীং সাথে জুড়েছে ক্যামেরার ক্লিক। 

পাশের ফ্ল্যাটের মিষ্টির কথাই বলি। সবে সিক্সটিন। ডুয়্যাল ক্যামেরা-ফোন হাতে ওঠার পর থেকে জীবনটাই বদলে গেছে মিষ্টির। মুখবন্দী হবার আগেই মন-কাড়া-মেনু মিষ্টির লেন্সবন্দী হয়ে যায়। যেমন আজ হয়েছে। ডান হাতের কাজ শুরুর আগেই সোশ্যাল মিডিয়ার হাত ধরে তাদের লাঞ্চের স্পেশ্যাল মেনু "বিরিয়ানি, মাটন কষা আর পাতুড়ীর" ছবি পৌঁছে গেল সাগরপারে তার পিসিমার কাছে। লস এঞ্জেলেসে তখন বেশ রাত। প্রবাসে পানের বিহনে পান-লজেন্স চুষছিলেন পিসি। চুষতে চুষতে কমেন্ট দিলেন, "আমার জন্য পাতুড়ীটা রাখিস মিষ্টি, আমি কিন্তু আসছি।" পোস্টটা চোখে পড়ল মিষ্টির সালকিয়ার কাকুর। বরাবরের পেটরোগা।  সবেমাত্র ঝোলভাত দিয়ে লাঞ্চ সেরে ত্রিফলা ফেলেছেন মুখে। মাটন চাপের ছবিতে মুখের টায়ালিন ক্ষরণ বেড়ে গেল। "লাইক" দিয়ে তিনি কমেন্ট দিলেন "ভেরি ভেরি টেস্টি টেস্টি।" অনলাইনে ছিলেন শেলী বৌদি। মিষ্টিদের পাশেই ফ্ল্যাট। ছবিটাকে জুম করে খুটিয়ে ভালো করে দেখলেন শেলী বৌদি, তারপর বিড়বিড়িয়ে বললেন," উঁউউ বেশি বেশি...! মেনু শেয়ারিং! যাঃ লাইক দেব না!"     

ডিজিট্যাল সামাজিকতা আছে। আছে ডিজিট্যাল জেলাসি! সোশ্যাল মিডিয়ায় কত কিছুই না মেলে! প্রেম ডানা মেলে, বিরহ ফেলে চোখের জল। 

হায়ার সেকেন্ডারিতে ডিগবাজি খেয়েছিল রতন। স্কুলের ফুটবলের রত্ন। মাঠে বিপক্ষের আতঙ্ক। পরীক্ষার ময়দানে কিন্তু ভূগোলের কাছে গোল খেয়ে গেল।  দুঃখী দুঃখী দেড়েল মুখের ছবি ফেসবুকে পোষ্ট করেছিল রতন। তা সেই ছবি যে দুশো লাইক, দেড়শো কমেন্ট ডেকে আনবে - তা কেই বা জানত? উপরি পাওনা হিসেবে অনুষ্কার কাছ থেকে এল ছোট্ট একটা রক্তিম হৃৎপিন্ড। সঙ্গে কমেন্ট, 'লুকিং স্মার্ট, জাস্ট লাইক বিরাট"। ব্যস সেই শুরু। ভূগোলের ধাক্কার পরে প্রেমের ছক্কা। "নেটিজেন" না হলে এই নেটে কীভাবেই বা জড়াত রতন? 

প্রেমের জ্যামের মত আছে বিরহের জেলি। সোশ্যাল মিডিয়ায় জমে ওঠে অনেক কিছুই! বিশু আর বিশু-গিন্নীর সম্পর্ক মাঝে মধ্যেই ভারত-পকিস্থান হয়ে যায়। শ্বশুর শ্বাশুড়ী যতদিন ছিলেন রাষ্ট্র-পুঞ্জের ভূমিকা সামলেছেন। এখন সে দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। এই গত সপ্তাহেই  বিরহ পর্ব কাটিয়ে উঠেছে বিশু। গিন্নী রাধারানী রাগ করে উঠেছিল কেষ্টপুরে মাসির বাড়ি। মান ভাঙাতে "মেনি"র কথা মনে পড়ল বিশুর। বৌয়ের পছন্দের প্রানী। হুমদো থেকে মিনি - প্রায় শ 'খানেক মেনির ছবি পোস্ট বিশু পোস্ট করল মিডিয়ায়। আগেরবার মেনি মান রেখেছিল। ওপার থেকে কমেন্ট এসেছিল "কিউট পিকস"। এবারে মেনি ফেল। শেষমেশ সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে নেমে পড়ল বিশু। শনিবারের বারবেলায় স্পিরিটেড হয়ে খুলে ফেলল বিয়ারের বোতল। হাতে বোতল, গ্লাসে তরল - লাল চোখের ছবি পোস্ট হল মিডিয়ায়। ওপার থেকে কমেন্ট ভেসে এল, "বড্ড বেড়েছ! তোমার হবে।" 

সোশ্যাল মিডিয়ায় কত কিছুই না হয়! নাতি কোলে ঘরে বসে রাজনীতি হবে - তা কে আর কবে ভেবেছিল। এখন অবশ্য হয়। বেতো পায়ে পদযাত্রার দিন শেষ। ট্র্যাকের গুঁতোয় পদযুগলে ক্র্যাক হওয়ার উপায়টুকু নেই। ভাঙতে হবে না,  গুঁড়োতে হবে না। জিন্দাবাদ, মুর্দাবাদ বলে সারাদিন আকাশে হাত ছুঁড়ে দিনশেষে ভোলিনির জেল - কিস্যু লাগবে না। এসেছে ঘরে বসে জনমত গড়ে তোলার দিন। সামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক লড়াই এখন উংলি কা খেল। মধুবাবু রিটায়ারমেন্টের পরে কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজনীতিতে জড়িয়ে দিব্যি আছেন। রাজা মারছেন, উজির মারছেন। একে খুলছেন তো ওকে পরাচ্ছেন। দেখা হলেই প্রশ্ন, দেখেছিলেন নাকি?- কি দেখব দাদা? পরশুর পোস্টটা, পড়ে একবার দেখবেন - জ্বালিয়ে দিয়েছি। মধুবাবুরা দুই ভাই। বিধুর কথায় চাবুক। মধুর ফেসবুক।

জ্বালা হয়েছে আসল রাজনীতিকদের। "স্লিপ অব টাঙ" হবার উপায়টুকু নেই। বেফাঁস হলেই হাঁসফাঁস করতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রোলড হয়ে যাবেন। দুঃখ করছিলেন বয়স্ক এক কেউকেটা- "সুদিন গেছে রে ভাই। সেকালে বদনাম রটলে বলতাম "কন্সপিরেসি"। এখন তো শালা ঘরে ঘরে সাংবাদিক। বক্তৃতা দিতে গিয়ে প্রাণ খুলে যে দু-চারটে "শ'কার-ব'কার" চালাব তারও উপায় নেই। এই তো সেবার ভোটের আগে কেস খেয়ে গেলাম। বলার মধ্যে বলেছিলাম - বিরোধী চামচা- বেলচাদের বাড়াবড়ি দেখলে হালকা করে পালিস করে দিস। আরে সমর্থকদের চাঙ্গা করতে এটুকু বলব না! কিন্তু বিধি বাম, কোন 'মদনার বাচ্ছা' ভিডিও বানিয়ে মিডিয়ায় ছেড়ে দিল!" বলেই মা কালির মত জিভ কেটে বললেন, "এই দেখ, ভুল করে আবার "বাচ্ছা" লাগিয়ে ফেললাম। দেখিস ভাই এটা যেন আবার ভাইরাল করে দিস না"

ভাইরালের গুঁতো আছে, আছে আশীর্বাদও। সুবল বসুর পোষা ময়না যে কবিতা জানে তা অল্প বিস্তর জানা ছিল। সেই কবিতা রেকর্ড করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাড়া মাত্রই ময়নার কবিতা ভাইরাল হয়ে গেল। "লাইক" পড়ে গেল কয়েক লাখ। সেই থেকে সুবল বাবু সেলিব্রিটি। সুবলবাবু পেশায় মাস্টারমশাই। দু চারটে ছাত্র ছাত্রীও পড়ান। এখন পড়ানো শিকেয় উঠেছে। দেশি বিদেশি ফোন আসছে মিনিটে মিনিটে। পাখীর টিউটর হিসেবে সবাই সুবল বাবুকে চাইছেন। ফোন আসছে, "আপনি কী শুধু ময়নাকে ট্রেন করেন? টিয়া, শালিখ, পেঁচা বা কাককে ট্রেন করাতে পারবেন না?" ইংরেজী প্রশ্ন আসে, "আর উ এন অন-লাইন ট্রেনার?" সুবল বাবু দোটানায়। মাদুর-ব্যবসা গুটিয়ে "তোতা-ময়না কোচিং" এ নামবেন কিনা ভেবে পাচ্ছেন না।

গান গেয়ে, নেচে-কুঁদে, চুমু খেয়ে, চোখ টিপে ভাইরাল হয়ে যাচ্ছেন অনেকেই। নাক টিপে ছোট বয়সে গিটার বাজাতাম আমরা। একদিন চোখে পড়ল সেই নাকি-গিটারের ভাইরাল হওয়া ভিডিও। নাকের কারসাজিতে বাজছে পুরনো সব গান! বাদকের বিবরন পড়ে জানা গেল এইট পাশ দেওয়ার পরে মা সরস্বতী আশীর্বাদ উইথড্র করে নিয়েছেন। এখন নাকের গুনে মা লক্ষী হাত রেখেছেন মাথায়। চারপাশের জলসাতেও নাকি ডাক পড়ছে এই নাক-বাজিয়ের।

 

কদর বেড়েছে পাড়ার শান্তি পিসির। তার মোচা আর থোড়ের ওপর বানানো "প্রসেসিং কাম কুকিং" ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর থেকে এদিক সেদিক থেকে ঘনঘন ডাক আসছে। সৌখীন গিন্নীরা হাঁফ ছেড়েছেন। ম্যানিকওর হাতে থোড়-মোচার কস মাখতে হচ্ছে না। রান্নাঘরে শান্তি পিসি যেন সাক্ষাৎ বিপত্তারিনী। মোচা-থোড়ের কল্যাণে আমদানী বেড়েছে শান্তি পিসির। ডিজিট্যাল ক্যাস ঢুকছে একাউন্টে। হ্যান্ড-ক্যাসও মন্দ না। লক্ষ্মী-গণেশের পাশাপাশি তাই "জয় গুগুল বাবা" বলে স্মার্ট ফোনকে নিত্য গড় করেন শান্তি পিসি। বেশ কয়েক হাজার সাবস্ক্রাইবার। মনে তাই বেশ জোর পেয়েছেন তিনি। আগামীদিনে আসছে তার মালাইকারী আর পাতুড়ীর ভিডিও।

 সব দেখেশুনে খুবই স্পিরিটেড আমাদের পাড়ার মদনদা। নামকরা "গুল" শিল্পের কারিগর তিনি। পাড়ার চায়ের দোকানে দুবেলা তার "গুল" এর গুনে বেশ কিছু খদ্দের টানেন মদন দা। আর তাই সকাল সন্ধ্যে শঙ্করের চা এর দোকানে বিনি পয়সায় চা মেলে তার। সেই "গুল"কে এখন গুগুলে তুলতে উঠে পড়ে লেগেছেন তিনি। চা এর মত লাঞ্চ আর ডিনারটাও যদি "গুল" এর হাত ধরে ফ্রি তে মিটে যায় -  তবে মন্দ কী? তার ধারাবাহিকের জুতসই একটা নাম এখন থেকেই ঠিক করে রেখেছেন মদনদা - "গুল- ই-মদনদা"। মদনদার এই "গুল" শিল্প যদি একবার ভাইরাল হয়, তাহলে কিন্তু প্রেরনা পাবেন অনেকেই। আলসেমিতে শিল্প চলবে - এর চেয়ে বড় পাওনা আর কী আছে? লাল সুতোর বিড়ি ধরিয়ে গুলের সাতকাহন নিয়ে আসর জমাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন মদনদা। তার "গুল" শিল্পকে লেন্সবন্দী করার প্রতিশ্রুতি এসেছে ভাই-ভাই সংঘের অনেক ভাই এর কাছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই শিল্পের শিলান্যাস কবে হয় - এখন শুধু তারই প্রতীক্ষা। বেশ একটা বিপ্লব আসবে তাহলে। বেকারীর অভিযোগ কমবে। কিছু না হোক "গুল" দিয়ে টিকে থাকার একটা উপায় তো হবে। অভাগার ভাগ্য খুলবে, আর চারপাশে শ্লোগান উঠবে "জয় গুল, জয় গুগুল"       

 

তন্ময় চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top