সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশি ঈদ, প্রকৃতির মতোই নির্মল : রাশেদ রাফি


প্রকাশিত:
৫ আগস্ট ২০২০ ২১:১৯

আপডেট:
৫ আগস্ট ২০২০ ২১:৪৯

 

আমাদের পাশের গ্রাম সাতবাড়িয়ায় বিশাল ঈদ্গাহ ময়দান। চার গ্রামের মানুষ এ ঈদ্গাহে নামাজ পড়েন। এক সময় চারদিক থেকে পুরো ঈদ্গাহকে ছাতার মতো বেষ্টন করে রাখত বিশাল এক গাছ। বটবৃক্ষের ন্যায় বিশাল এই গাছটির নামের সাথে এর আকৃতির মিল নেই। কিন্তু এর স্বভাবের সাথে মিল আছে। লোকেরা বলতো শিশু গাছ। আমি বলতাম ঈদগাছ। বৃষ্টি এলে ঈদগাছ তার ছোট ছোট ঘন পাতা দিয়ে পানি ধরে রাখত অনেকক্ষন। এরপর যখন না পারত তখন ছেড়ে দিত, আর আমরা ভিজে জেতাম। ভিজে গেলে মনে হতোনা ভিজে গেছি, মনে হতো ঈদ  গাছের পানি গায়ে লেগেছে।

আমাদের ঈদ শুরু হতো ঈদের আগের দিন রাত থেকে। কে কোন রঙের জামাকাপড় কিনেছে তা বলা হতো শুধু কিন্তু কেউ কাউকে দেখাতাম না। কারন দেখালে ঈদ ভেঙ্গে যাবে। রোজার ঈদে আকাশ মেঘলা থাকলে মাঝে মাঝে চাঁদ দেখা নিয়ে সমস্যা হতো। তখন রেডিওর খবরের অপেক্ষায় থাকত সবাই। আমরা ছোটরা বাড়ির উঠানের মাঝখানে, এপাশে ওপাশে ঘুরে দেখতাম চাঁদ দেখা যায় কি-না। পড়ে বড়রা খবর শোনার পর নিশ্চিত করতেন  যে- কাল ঈদ হবে বা হবেনা। হবে শুনলেও মনে সন্দেহ থেকে যেত কারণ চাঁদতো দেখতে পারিনি। ভোর থেকেই আব্বা ডাকাডাকি শুরু করতেন গোসল করে তৈরী হওয়ার জন্য। আমি দেখতাম আমার পীঠাপীঠি ভাই ক্রীমরুল উঠেছে কিনা। ও না উঠলে আমিও উঠতাম না। এরপর হাশেম মাওলানা এসে ঈদ্গাহ থেকে যখন সুর তুলে চারগ্রাম জাগিয়ে দিত তখন আব্বার হাকডাকের আওয়াজও বেড়ে যেত। আর আমরা নিশ্চিত হতাম আজই ঈদ। কোরবানী ঈদে তো আর চাঁদ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকতোনা। তখন আমরা ব্যাস্ত থাকতাম গরু নিয়ে। ঈদের আগের দিন রাতে গরুটাকে ভালো করে দেখে নিতাম। আহারে কাল ওর নিশ্চিত মৃত্যু!

ঈদের দিন সকালে গোসল, পায়জামা, পাঞ্জাবি, খোশবু, সুরমা এসবের পর মা সেমাই নিয়ে এসে হাজির হতেন, আমি মুখ গোমড়া করে রাখতাম। কারণ এমনিতেই মিষ্টি পছন্দ করিনা তার উপড় আবার ঈদ্গাহে যাওয়ার মুহূর্তে! মা বলতেন এটা না খেয়ে ঈদ্গাহে গেলে ঈদ হবেনা। ঈদ হবেনা, বলে কি! এত অপেক্ষার ঈদ না হলে উপায় আছে? অগত্যা কয়েক চামচ খেয়ে নিতাম।

ঈদ্গাহে যেতাম বাড়ির সবাই দলবেঁধে। এরপর বড়রা আমাদের ছেড়ে মাঠে গিয়ে বসতেন। আমরা ছোটরা বেলুন কিনে ফুলিয়ে মাঠের চারদিকে ঘুরতাম। মাঝে মাঝে বেলুন ফুটে ঠাস করে শব্দ হতো। এরপর আবার নতুন বেলুন ফুলাতাম। মাঠের একপাশে বিক্রি হতো বড়ুই আচার, চানাচুর, চকলেট। মাঝে মাঝে চানাচুর ও বড়ুই আচার খেতাম। এসব করতে করতে সময় কেটে যেত। নামাজ শেষে বড়রা আমাদেরকে খুঁজে বের করে নিয়ে যেতেন। রাস্তায় তখন মানুষের ঠেলাঠেলি আর ডাকাডাকি। এরমধ্যেই শোনা যেত হারিয়ে যাওয়া কোন কোণ বাচ্চার কান্নাকাটি। মোনাজাত শুরু হলে আমি আর ক্রীমরুল আমাদের বাড়ির লোকেরা যে পাশে বসেছেন ওখানে গিয়ে দাঁড়াতাম। তাই আমরা হারিয়ে যেতামনা। আব্বা ও বড় ভাই আমাদের হাতে টাকা দিতেন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দরিদ্রদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য। আমরা ওঁদের টাকা দিয়ে খুব আনন্দ পেতাম। আসার সময় অনেক করে বেলুন কিনে নিয়ে আসতাম। সারাদিন ঐসব বেলুন ফুলাতাম। ফুটে শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঈদের দুই-তিন দিন ধরে চলতো বেলুন ফুলানো আর ধাক্কা দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার খেলা। এটা ছিল অতি শৈশবের ঈদ। কৈশোর এলে কিছুটা পরিবর্তন আসে। যেমন বড়দের পাশাপাশি আমরাও নামাজে দাড়াতাম। খেলার সামগ্রিতেও আসে পরিবর্তন। বেলুনের বদলে হাতে আসে বারুদ ফুটানো খেলনা পিস্তল। আর আসে টিনের তৈরী জাহাজ। এর ভিতরে থাকত একটা ছোট্ট তেলের ইঞ্জিন। ওটাতে আগুন ধরিয়ে পুকুরে ছেড়ে দিলে জাহাজটা নিজে নিজে চলতে শুরু করত। এ জিনিস এখনো আছে, তবে বিরল।    

শৈশবের সেইসব স্মৃতির কারণেই মনে হয় ঈদ এত দামি, এত গুরুত্বপূর্ন একটা উৎসব। দেশের যেখানে যে অবস্থায় থাকিনা কেন বছর ঘুরে ঈদ এলে গ্রামে সেই ঈদগাছের নিচে নামাজ পড়তে হবেই নয়তো ঈদকে ঈদ বলে মনে  হবেনা। তাই ঈদ এলেই গ্রামে চলে যেতাম আমরা সবাই।

কিন্তু সময়ের আবর্তে জীবনের পট পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলে যায় অনেক কিছু।  একবার ইউরোপে গিয়ে থাকতে হল অনেক বছর। ওখানে গিয়ে দেখলাম ভিন্ন এক ঈদের চিত্র। ঈদের দিন নাই সরকারি ছুটি। কাজ পড়াশুনা এসবের সাথে তাল রেখে সম্ভব হলে নামাজ পড়ো আর না হলে নাই। লন্ডনে অনেক বাংলাদেশী, ভারতীয় ও পাকিস্তানি মুসলমান থাকায় ইতোমধ্যে কয়েকটা বড় বড় মসজিদ হয়েছে। তবে ঈদের নামাজের জন্য ইস্ট লন্ডন মসজিদ ও রিজেন্ট পার্ক মসজিদই উল্লেখযোগ্য। ইংল্যান্ডসহ পুরো বৃটেনের যেসব অঞ্চলে মসজিদ নেই সেখানে চার্চের কোন বড় হলরুম ভাড়া নিয়ে মুসলমানরা ঈদের নামাজ পড়ে। একটা রুম ভাড়া করে ঈদ উদযাপনটা অনেকের কাছেই ন্যাকা ন্যাকা মনে হয়। তাই তারা বরং ঐদিন কাজ করে সময়টা কাটিয়ে দিতেই পছন্দ করে। তবে লন্ডনে যারা থাকেন তাদের বেশীরভাগই ঈদের ষোলকলা পুষিয়ে নিতে চেষ্টা করেন যদিও এর সবকিছুতেই  থাকে কৃত্রিমতার ছোঁয়া। লন্ডনের ব্রিকলেন, হোয়াইট চ্যাপেল, গ্রীনস্ট্রিট প্রভৃতি অঞ্চলে ঈদের সময় কেনাকাটার একটা আমেজ দেখা যায়।  অবিবাহিত তরুনদের মধ্যে যারা মেসে থাকেন তারা সবাই চেষ্টা করেন ঈদের দিন ছুটি নিতে। ঈদের দিন সম্ভব না হলে এর পরের দিন। মেস মেম্বারদের মধ্যে অনেকেই থাকেন পাকারু রান্নাবাজ যাদের রান্না মহিলাদের চেয়ে কম স্বাদের না বরং বেশীই। আমাদের মেসে এমন দুইজন ছিলেন এরা হলেন মামা সোহেল ও খোকন মামা। ঐ দিনটাতে ঐ রান্নাবাজদের সাথে আমরা সবাই মিলেমিশে সেমাই, খিচুরী, পোলাও, মাংস, পায়েস ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের রান্নাবান্না করতাম। বিলেতি প্রবাসীদের ঈদ কর্মসূচীর মধ্যে আরেকটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো দেশে ফোন করে মা-বাবা ও আত্মীয় স্বজনদের সাথে কথা বলা। সাধারণত লন্ডনে ঈদ হয় সৌদি আরবের হিসেবে, একদিন আগে। তাই ঈদ উপলক্ষে কে কি কেনা কাটা করলো, আগামীদিন ঈদের জামাত কখন কোথায় হবে এইসবই থাকে আলোচনার মূল বিষয়বস্তু। এইসব আলাপের মাধ্যমে দেশের ঈদের সাথে নিজেকে একটু সম্পৃক্ত করার একটা চেষ্টা চলে আর আর কি। এইতো গেল প্রবাসী বাংলাদেশীদের কথা। আর ইংল্যান্ডেই যাদের জন্ম, বিশেষতঃ যারা সিলেট অঞ্চলের তারা ঈদ করেন আত্মীয় স্বজনদের সাথে নিয়ে। এদের মধ্যে যারা তরুন তাদেরকে দেখা যায় ঈদের দিন দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে বন্ধু বান্ধব নিয়ে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করতে। সিনিয়রদের মধ্যে যারা দেশীয় সংস্কৃতির তোয়াজ করেন তারা ব্রাডি সেন্টারে হলরুম ভাড়া করে কোন রবিবার ছুটির দিনে ঈদ পূনর্মিলনী করে ঈদের স্মৃতি ও আমেজ উদযাপন করেন। ইউরোপের সর্বত্র কম-বেশী এভাবেই ঈদ উদযাপিত হয়।      

আমাদের ঈদ্গাহে এখন সেই ঈদ্গাছটা নেই। অন্যদের মতো আমাদেরও একটা পাকা মিম্বার চাই, আর তা করতে হলে গাছটা কাটতে হবে। অন্যকে অনুকরনের নেশা যে কিভাবে নিজেকে হত্যা করে তা বুঝলোনা কমিটি, বুঝলোনা গ্রামবাসী। এটা ভাবলেই একটা বড় দীর্ঘশ্বাস আসে আমার! শিশুগাছ নেই, হাশেম মাওলানা নেই, আব্বা নেই, মা নেই, ক্রীমরুল নেই, সেই ঈদও নেই। কিন্তু আমার মনে এঁরা সবাই আছেন।  

 আমি যখন ইউরোপে ছিলাম তখন ঈদ এসেছে এটা শুনলেই আমার মনে ভাসত আমার শৈশবের একটা নির্মল চলচ্চিত্র; যার প্রথম ভাগের দৃশ্যপটে একে একে আসত- ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠার জন্য আব্বার হাঁকডাক ও হাশেম মাওলানার সুরেলা আওয়াজ, তাড়াহুড়ো করে গোসল, এরপর  পায়জামা-পাঞ্জাবী খোসবু, সুরমা; অতঃপর জোর করে ধরিয়ে দেয়া মায়ের হাতের সেমাই-পায়েস। ঐ চলচ্চিত্রের দ্বিতীয়ভাগের দৃশ্যপটে আসত সেই স্বর্গীয় শিশুগাছ, ঈদ্গাহের চারপাশ জুড়ে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের হৈহুল্লোড়, বড়ুই আচার, চানাচুর বানানোর ঢপঢপ শব্দ, টাকায় দশটা বেলুন ও হাতের ধাক্কায় মুক্ত বাতাসে সেই বেলুন ওড়ার দৃশ্য।

চলমান করোনাক্রান্তির কারণে ঈদ উদযাপনে এসেছে বেশ পরিবর্তণ। পরিবর্তনটা এতই বেশী যে বাংলাদেশের গত কয়েকশত বছরের ইতিহাসে ঈদকে এমন জাকজমকহীন ও জৌলুসহীন হতে দেখা যায়নি। লন্ডনে যে ঈদ হয় তাকে আমি বলতাম বিলেতি ঈদ। করোনাক্রান্তির কারণে এবার মনে হয় সবার কাছেই ঈদটা আমার দেখা সেই বিলেতি ঈদের মতো প্রাণহীন ও কৃত্রিম।  তবে একথাতো ঠিক যে আমাদের সবারই মননে ও মগজে এখনো  জ্বলজ্বল করছে আমাদের শৈশবের সেই প্রাকৃতিক ঈদের নির্মল চিত্রাবলী যা আমাদেরকে  দিতে পারে সমরুপ আনন্দ।

এই লেখার মাধ্যমে করোনা আক্রান্ত পৃথিবীর সব দেশের সব ধর্মের, সব বর্ণের সব মানুষকে শিশুগাছ সমেত বাংলাদেশী ঈদ্গাহ ও প্রাকৃতিক ঈদের শুভেচ্ছা।

 

রাশেদ রাফি 
প্রধান নির্বাহি - ফুল-পাখি-চাঁদ-নদী রিসার্চ এন্ড এডভোকেসি ফোরাম

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top