সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১

চা-পান সভ্যতার সাতসতেরো : শান্তনু কুমার


প্রকাশিত:
১০ আগস্ট ২০২০ ২১:৩১

আপডেট:
১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:৪১

 

১৬৬২ সালের মে মাস। ইংলান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের রাজগৃহে ভাবী সম্রাজ্ঞী পর্তুগালের রাজকন্যা ক্যাথেরিন ব্রাগেঞ্জা পদার্পণ করবেন।   ইতিমধ্যে বিবাহ-চুক্তি পর্ব সারা হয়ে গেছে। চুক্তি অনুযায়ী রাজকুমারীর বিয়ের যৌতুক  হিসেবে ১৫৩৪ সাল থেকে পর্তুগীজদের কব্জায় থাকা ভারতের বোম্বাইয়ের দ্বীপগুলি পাঁচশো পাউণ্ডের বিনিময়ে ইংল্যাণ্ডের রাজার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। রাজকুমারীর শুভাগমনে রাজার চিত্তচাঞ্চল্য বেড়েছে। শুভেচ্ছা জ্ঞাপনের পর চার্লস ভাবী রাণীকে জিজ্ঞাসা করলেন যাত্রাপথের ক্লান্তি দূর করতে তিনি কি ধরনের পানীয় গ্রহণ করতে ইচ্ছুক। ক্যাথেরিন বললেন এক গেলাস চা হলেই যথেষ্ট। চার্লসের মাথায় হাত ! আদৌ চা বস্তুটি তিনি দেখেছেন কিনা মনে করতে পারছেন না। ইতস্তত করে চার্লস বললেন, দুঃখিত, আমাদের এখানে যে চা-পানীয়টির কোনো চলন নেই, তার চেয়ে এক গ্লাস উৎকৃষ্ট বিয়ার হলে আপনার ক্লান্তি দূর করার পক্ষে মনে হয় মন্দ হত না।

ইংল্যাণ্ডে চায়ের  চলন রাণী ক্যাথেরিনের উদ্যোগে ও জমানায় হয়েছিল কিনা তা নিয়ে তর্ক চলতেই পারে। আর এই তর্কটা আরও বাধিয়ে দিলেন জাপানের কাকুজো ওকাকুরা চা-নিয়ে তাঁর বিখ্যাত বই 'The Book Of Tea-তে। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে ইউরোপে চায়ের সূত্রপাত---- ১৬৩৬ সালে ফ্রান্সে, দু বছর পরে রাশিয়ায় এবং ১৬৫০ সালে ইংল্যাণ্ডে। ওকাকুরা বললেন 'সাহেবরা আমাদের আদর্শ আর ধর্মটাকে নিয়ে টিটকিরি মারলেও 'বাদামী রঙের' পানীয়টাকে মুখে তুলতে কোনো কুণ্ঠাবোধ নেই। পশ্চিমের সমাজে বিকেলের চা-চক্রটাই এখন প্রধান।'  তিনি আরও বলেন, 'চা একটা শিল্প আর এর উৎকর্ষতা আনতে দক্ষ হাতের প্রয়োজন হয়।'

ওকাকুরা তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধুদের মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যাঁদের প্রভাবিত করেছিলেন তাঁদের  মধ্যে যেমন বিবেকানন্দ আছেন তেমনি রবীন্দ্রনাথও রয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ জাপান ভ্রমণকালে এক ধনী ব্যক্তির বাড়িতে চা-পানের অনুষ্ঠানে গিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন ওঁনারা এটিকে ধর্মানুষ্ঠানের মত মনে করেন। চা-শিল্পকলা ওঁনাদের জাতীয় সাধনা। চা তৈরির প্রতিটি অঙ্গই যেন কবিতার ছন্দের মত। ধোয়া, মোছা, আগুন জ্বালা, চায়ের পাত্রের ঢাকনা খোলা, গরম জলের পাত্র নামানো, চা ঢালা, অতিথিকে এগিয়ে দেওয়া---ইত্যাদি প্রতিটি পর্বেই যেন সৌন্দর্যের ছোঁয়া লেগে থাকে। চায়ের ঘরে প্রবেশের পূর্বে অতিথিদের একটি বারান্দাতে বসানো হয়। চায়ের ঘর আকর্ষণীয় না হলেও শৈল্পিক স্পর্শে সমৃদ্ধ। একটি সাধারণ মানের অট্টালিকার চেয়েও চা-ঘর বানানো খরচাবহুল। পরিচ্ছন্নতাই সর্বাগ্রে বিবেচ্য। প্রকৃত চা-মাস্টার হতে গেলে ঘরের কোণেও এক চিলতে নোংরা বা ধুলো থাকবে না।

চীনের চা-পান সম্বন্ধেও রবীন্দ্রনাথের উচ্চ ধারণা হয়েছিল। তাই চীন থেকে ফিরে শান্তিনিকেতনে একটি চা-চক্র গড়েছিলেন। সু-সুমো নামে বিশ্বভারতীর এক চীনে বন্ধু এ বিষয়ে সাহায্য করেছিলেন বলেই ওই চক্রের নাম দিয়েছিলেন সুসীম চা-চক্র। দীনেন্দ্রনাথ ওই চক্রের চক্রবর্তী পদে আর বিভিন্ন অধ্যাপকেরা সেখানে মিলিত হতেন। 'চক্রেশ্বর' হয়ে রবীন্দ্রনাথ 'চাতক' কবিতাটি একদিন পাঠ করেন। আবার বিশ্ববিখ্যাত লিপটন কোম্পানির চায়ের বিজ্ঞাপনের জন্য রবীন্দ্রনাথ পদ্যও লিখেছিলেন 'চাস্পৃহ চঞ্চল / চাতকদল চল / কাতলি-জল তল / কলকল হে। (এখানে  কাতলি অর্থে কেটলি)

রবীন্দ্রনাথের নির্দেশেই কালিপদ দলুই ওরফে কালো ১৯১৮ সালে আশ্রমের মধ্যে একটি চায়ের দোকান খোলেন। এই কালোর দোকানে অবনীন্দ্রনাথ, রামকিঙ্কর বেজ, নন্দলাল বসুরা ছিলেন নিয়মিত চায়ের সদস্য। সস্ত্রীক মহাত্মা গান্ধী যখন শান্তিনিকেতনে আসেন তখন কালোর দোকানের চা খাইয়ে রবীন্দ্রনাথ আতিথেয়তা রক্ষা করেছিলেন। দেবব্রত বিশ্বাসও ওই কালোর দোকানে আড্ডা দিতেন। কালো একমুখ হাসি নিয়ে চা এগিয়ে দিতেন। ওদিকে রবীন্দ্রনাথের নাতনি নন্দিতা দেবব্রতকে দেখেই জর্জ এসেছে, জর্জ এসেছে বলে হাঁক দিতে শুরু করলে লোকেরা ভীড় করত আর তারপর বাঁশি বাজিয়ে, টেবিল পিটিয়ে শুরু হয়ে যেত গান-বাজনা।  

ছবিঃ কলকাতার প্রসিদ্ধ ফেভারিট কেবিন

 

ওই ১৯১৮তেই চট্টগ্রাম থেকে আসা বৌদ্ধ বড়ুয়া ভাইয়েরা কলকাতার মির্জাপুর স্ট্রিটে (বর্তমানে ৬৯ বি সূর্য সেন স্ট্রিট) ' ফেভারিট কেবিন' নামে একটি চায়ের দোকান খুলে বসলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি, কফি হাউস থেকে প্রায় ঢিল ছোড়া দূরত্বে অবস্থিত এই চায়ের ঠেকে তখন কল্লোল গ্র্রুপের দৈনন্দিন আড্ডা। সাহিত্যিক অচিন্ত্য কুমার, শিবরাম, প্রেমেন মিত্তির,নজরুলের মতো দিকপালেরা তখন নূতনচন্দ্র বড়ুয়াদের এই তিন পার্টের কেবিন জমিয়ে রাখতেন। সামনের অংশের চার নম্বর টেবিলটি নজরুলের জন্য বাঁধা ছিল। প্রেসিডেন্সির ছাত্র সুভাষচন্দ্র সেসময় প্রায়ই আড্ডায় যোগ দিতেন নজরুলের কবিতা আর গান শোনার জন্য। মাস্টারদা সূর্য সেনেরও নিত্য যাতায়াত ছিল। অন্দরমহলের অংশে স্বাধীনতা সংগ্রামের ছকগুলো কষা হত। বিপ্লবীদের সন্ধানে পুলিশ এলে ডিশে চামচ বাজিয়ে বড়ুয়ারা সতর্ক করে দিতেন। পুলিশ ঢোকার আগেই পিছনের রান্নাঘরের ছোট্ট দরজা দিয়ে পাখিকুল তখন ডানা মেলে দিয়েছে।

শতবর্ষ অতিক্রম করে এই ফেভারিট কেবিন তার অতীতের স্মৃতি পাথেয় করে আজও  চলমান---অধিকাংশ মার্বেলের টেবিল আর কাঠের চেয়ার তার চেহারার শ্রী খুইয়েছে, পান কেক, বাদামি টোস্ট আর চায়ের স্বাদে-গন্ধের চটক স্তিমিতপ্রায়, তবু, ঘণ্টার পর ঘণ্টা, পেয়ালায় তুফান তুলতে নবীন-প্রবীণের দল আজও হাজির--- ছোট্ট ক্যাশ কাউন্টার আর কিচেন সামলে বাবা কাকাদের মত এখনও অতিথিদের অক্লেশে দেখভাল করছেন পৌত্র সৈকত। 

প্যারিসের ক্যাফে-আড্ডাগুলো দেখে বাঙালিদের চায়ের আড্ডা থেকে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলেন অন্নদাশংকর রায়। আবার চা শ্রমিকদের নিয়ে মুলকরাজ আনন্দ 'দুটি পাতা একটি কুঁড়ি' নামে উপন্যাসও লিখে ফেলেন। '1984' উপন্যাসের স্রষ্টা জর্জ অরওয়েল তো চা-সংস্কৃতিকে দেশের সভ্যতার অন্যতম স্থায়ী সম্পদ বলেছেন। আলেক্সজান্ডার পুশকিন এক গ্লাস চা আর মুখের মধ্যে চিনির ডেলাতে উন্মাদনা খুঁজেছেন। অন্যদিকে আচার্য প্রফুলচন্দ্র চা-পানের সরাসরি বিরোধিতা করে বলেছেন আমাদের গ্রীষ্মপ্রধান দেশে এর কোনোই সার্থকতা নেই। স্বল্প বেতনভুকদের ঘন ঘন চা পানের বদাভ্যাসে খিদে কমে যায়, পুষ্টিকর খাবারেরও কোনো প্রয়োজন হয় না।

বলাই বাহুল্য আচার্যের এই পুষ্টিকর কথাবার্তায় বাঙালিদের চিঁড়ে যে ভেজেনি তা চায়ের ঠেকগুলোয় ভিড় দেখলেই বোঝা যায়। প্রায় তিন দশক আগে একটি পাক্ষিকে চা নিয়ে একটি মজাদার খবর বের হয়। শ্রীরামপুরের জনৈক খোকাবাবুর চায়ের দোকান--আর তার বিচিত্র সাইনবোর্ড--- চোখ পড়লেই চমকে উঠতে হত। বিভিন্ন ভাষায় লেখা সেই সাইনবোর্ডটি হল এরকম :

খোকার দোকান (বাংলা)
খোকাস্য দোকাস্য (সংস্কৃত)
খোকাং দোকাং (চীনা)
খোকাত্রে দোকাত্রে (গ্রীক)
খোকানভ দোকানভ (রাশিয়ান)
খোকায়ঁ দোকায়ঁ (ফরাসি)

এহেন খোকার দোকানে চায়ের স্বাদ নিতে দেশ দেশান্তরের লোকেরা আসতেন কিনা জানা নেই তবে শ্রীরামপুর থিওলজি বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মতত্ত্বের পাঠ নিতে ভিন দেশীরা যে সেই শহরে পা রাখতেন একথা সত্য। বাঙালির টিকে থাকা গর্বের বস্তুর মধ্যে দার্জিলিঙের চা আজও প্রধান---- আর বিশ্বের চা-পিয়াসীদের কাছে এখানেই ভেতো বাঙালির শির পর্বতসমান উচ্চতা পেয়ে গেছে।     

 

শান্তনু কুমার
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top