সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

শরতের রংছটা : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
১১ আগস্ট ২০২০ ২২:৫৮

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:০৭

 

বর্ষার পরবর্তী ঋতুই হোল শরত ! বর্ষার অতি বর্ষণ ও মেঘবালিকার অবিরাম গুরু গুরু গর্জন থেমে গিয়ে প্রকৃতিতে নিয়ে আসে এক অপরুপ দৃশ্য !

ঝকঝকে নীল আকাশের বুকে নিয়ে ধবে সাদা মেঘের ভেলা পাগল করে যে কারো প্রকৃতিপ্রেমিক মন !

ভাদ্র আশ্বিন দুইমাস মিলে শরত ঋতু! শরতকে ঋতুরানী বলা হয়!

শরত মানেই নদীতীরে কাশফুল, গাছে গাছে শিউলি,বেলি,জুই, শেফালি, মালতি,টগর ,হাস্নহেনা, নানাবিধ ফুলের শোভা আর শস্যের শ্যামলতা ! আকাশে যত রঙের ছটা যেন শরতেই ধরা পড়ে ! 

বিলে ঝিলে শাপলা ফুলের সমারোহ আর রাস্তার ধারে গ্রামীণ জনপথে ইয়া বড় লম্বা লম্বা তালগাছে পাকা তালের মিষ্টি ঘ্রাণ ! গাছের মাথায় ঝুলন্ত বাবুই পাখির অপরুপ দৃশ্য মন ভরিয়ে দেয় ! তালের পিঠা, পায়েশ, কার না প্রিয় !

আর ক্ষেতে ক্ষেতে বেড়ে ওঠা আমন ধানের চারা !বাতাসে ঢেউ খেলে যায় অপরুপ !

শরতের সকালে বয়ে যায় ঝিরিঝিরি হাওয়া চলে ছোট্ট পাখিদের বেপরোয়া দাপাদাপি আর মিষ্টি কলতান !

ফুটন্ত শিউলির পরান জুড়ানো ঘ্রান! সকালে হালকা শিশির ভেজা শিউলিতলায় দূর্বাঘাসের উপর বিছিয়ে থাকে রাশি রাশি শিউলিফুল ! আমনের মাঠে মাঠে শিশিরসিক্ত সবিজের স্বচ্ছ অপরুপ শামিয়ানা ! মিষ্টি দমকা বাতাসের দাপটে অবিরাম ঢেউ খেলে যায়!  আমনের সারা ক্ষেতজুড়ে !

নদীতীরে যেন শ্বেতশুভ্র পালকের মত নরম কাশফুলের মিষ্টি খিলখিল হাসিতে যেন তার সবটুকু সৌন্দর্য উপচে পড়ার উপক্রম ! শরতের পরিচ্ছন্ন আকাশে পেঁজাতুলোর মত এমন অপরুপ মোহময়ি মেঘ আর কোন ঋতুতেই দেখা যায় না !

শরতের আকাশ ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় লাস্যময়ী হয়ে ওঠে ! শুভ্র মেঘবালিকা দুধেল রঙ মেখে যেন নৃত্য করে! রুপালি আলোতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পৃথিবী! দোলা দেয় মনে ! যুগ যুগ ধরে হাজার ও কবি মহাকবি, শিল্পী, সাহিত্যিক শরত নিয়ে রচনা করেছেন হাজার ও পদাবলি !

চিত্তে বাজে অন্যরকম ছন্দ, গন্ধ ও রঙ !

শরতকে নববধুর ন্যায় তুলনা করে মহাকবি কালিদাস বলেছেন ----

'প্রিয়তমা আমার, ঐ চেয়ে দেখ,
নববধুর ন্যায় শরৎকাল সমাগত'

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর কাব্যিক কল্পনা মুলত এই ঋতুটির দ্বারা অনুপ্রানিত হয়েছে !

সম্ভবত এ কারনেই তিনি গীতবিতানের প্রকৃতি বিভাগে চকচকে প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং পূর্ণিমা সম্পর্কে অনেক কথাই বলেছ কখনও কখনো সামগ্রিকভাবে বাংলার ভাবমূর্তির সাথে কবি ঋতু সমৃদ্ধিকে যুক্ত করেছেন ! তাঁর অনেক কবিতায় ঋতুর প্রশংসা তাঁর দেশের প্রশংসার সাথে মিশে গেছে!

আবার অন্যদিকে,পল্লীকবি জসিম উদ্দিন শরতকে দেখেছেন বিরহি নারীরুপে! তিনি বলেন------

গনিতে গনিতে শ্রাবণ কাটিল আসিল ভাদ্র মাস,
বিরহী নারীর নয়নের জলে ভিজিল বুকের বাস,
আজকে আসিবে, কালকে আসিবে হায় নিদারুন আসা,
ভোরের পাখির মতন শুধুই ভোরে ছেয়ে যায় বাসা '

বাংলা সাহিত্যের আদি মধ্যযুগের কবি চণ্ডীদাসের কবিতায় শরতকে তুলে ধরেছেন এভাবে ----

'ভাদর মাসে অহর্নিশি অন্ধকারে/শিখি ভেক ডাহুক করে কোলাহলে
তাওনা দেখিব ঘরে কাঞ্চির মুখ /চিন্তিতে চিন্তিতে মোর ফাটি যায় বুক' !

শীত শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত নবান্ন উৎসব (বার্ষিক ফসল কাটা উদযাপন) উদযাপনের সাথে একইরকমভাবে শারদীয় উৎসবও অব্যাহত থাকে ! শরত মানেই কাশফুল,স্বচ্ছ নীল  আকাশ আর দিগন্তজোড়া সবুজের সমারোহ ! আকাশে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘের ভেলা আর কাশফুলের শুভ্র আভাই জানিয়ে দেয় তার আগমনী বার্তা ! গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ আর শ্রাবণের অঝোর ধারার পর প্রকৃতিতে শরতের আগমন এনে দেয় এক অনন্য সৌন্দর্য ! শরত যেন নতুন সাজে সেজে প্রকৃতিকে নানা রঙের ছটায় নতুনরূপে সাজিয়ে তোলে !

চট্টগ্রামের কবি আলাওল তাঁর পদ্মাবতী কাব্যের ষড় ঋতু বর্ণন খণ্ডে আমরা দেখতে পাই, শরতনিশি
যাপনের এক মিলন মধুর দৃশ্য -----'আইল শরত ঋতু নির্মল আকাশ/ দোলায় কাশ কুসুম বিকাশ !'

 

শাহান আরা জাকির পারুল 
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top