সিডনী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১

কোটি টাকার প্লট : ব্যারিষ্টার সাইফুর রহমান


প্রকাশিত:
৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:৩৩

আপডেট:
৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:৪৬

ছবিঃ সাইফুর রহমান

 

দরজাটি ভেজানোই ছিল। ঈষৎ ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই রিভলভিং চেয়ারে বসা রফিউল্লাহ বিস্ময়াপ্লুত কণ্ঠে বলে উঠল, আরে হাসনাত যে! আয় আয়, ভেতরে আয়। এত লজ্জা পাচ্ছিস কেন? অথচ রফিউল্লাহর কিন্তু আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কথা নয়। এই তো মাস দেড়-দুয়েক আগেই আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে ওর। আমি একটি কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক। রফিউল্লাহ সেই কলেজেরই বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এসেছিল প্রধান অতিথি হয়ে। ওর সঙ্গে ওখানেই প্রথম দেখা আমার। রফি আমার স্কুলজীবনের বন্ধু হলেও শুধু এতটুকু জানতাম যে ও রাজনীতি-টাজনীতি করে পার্টির সঙ্গেও যুক্ত। কিন্তু আচানক যে সে একেবারে দেশের মন্ত্রী  হবে, এটা আমার কস্মিনকালেও মনে আসেনি। বেল টিপল রফি। পিয়নটাকে আরেক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, শুধু কফির অর্ডার করলাম, আজই তো প্রথম এলি আমার অফিসে। লাঞ্চ না করে কিন্তু যেতে পারবি না। ও হ্যাঁ, যা বলছিলাম। আমি মন্ত্রী হিসেবে এই মন্ত্রণালয়ে যোগদান করার পর কতজন যে এলো দেখা করতে। কতজনের কত রকমের তদবির। কমবেশি প্রায় সবারই ঘুরেফিরে শুধু ওই এক আবদার, ঢাকা শহরের যেকোনো স্থানে একটি প্লট তাদের চাই। বলি কী, সরকার আমাকে মন্ত্রী করেছে, তার মানে কি এই যে শহরের সব প্লটের মালিক আমি। আমি মৃদু হেসে বললাম, তা তো বটেই। সবাইকে প্লট দেওয়া তো আর সম্ভব নয়। মনে মনে ভাবলাম, আজ কতটা বদলে গেছে রফি। মুখ ফসকে বলেও ফেললাম, ‘কতটা বদলে গিয়েছিস তুই। আমি যতই তোকে দেখছি, ততই বিস্মিত হচ্ছি।’

হো হো শব্দে রফিউল্লাহর অট্টহাসি কক্ষটির পুরু দেয়াল ভেদ করতে না পেরে ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হতে লাগল বারবার। রফি তার মুখটি শক্ত ও কঠিন করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আরে স্কুলে তো আমি ছিলাম পেছনের বেঞ্চের ছাত্র। তোদের ভাষায় যাকে বলে লেথুর টাইপের স্টুডেন্ট। কি, ভুল বললাম? আর অন্যদিকে আজহার, ওমর, শামসুল বিশেষ করে তুই, তোরা তো ছিলি ক্লাসের সেরা ছাত্র। আমাকে তো তোরা কখনো পাত্তাই দিতে চাইতি না। অথচ দেখ, শেষমেশ আমি মন্ত্রী হয়েছি। রফিউল্লাহ যে চেয়ারটিতে বসেছে, তার ঠিক পেছনের দেয়ালের ওপরের দিকটায় যে ছবিটি সাধারণত লটকানো থাকে, সেটার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত ও উদাস গলায় বললাম, তা তো বটেই, কার মধ্যে যে কতটা অপার সম্ভাবনা ও মেধা লুকিয়ে থাকে তা কি আর চট করে বোঝা যায়। অনেকের ক্ষেত্রে সেটা কখন যে আচানক কপাল ফেটে বেরিয়ে আসে কে বলতে পারে, বল? তোর ক্ষেত্রে যেমনটি হয়েছে। রফিউল্লাহ আমার কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝল কি না বলতে পারব না। কিন্তু সে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলল, তাহলে মানছিস আমি তোদের চেয়ে সেরা। আমি আমার অবিশ্বাস কোনোমতে আড়াল করে বললাম, আলবত। না মেনে উপায় কী। উপযুক্ত পরিমাণ মেধা না থাকলে তুই কি আর এ পর্যন্ত আসতে পারতি?

আমি ফিকে হয়ে আসা আমার শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতির বাক্স-তরঙ্গগুলো হাতড়ে দেখার চেষ্টা করতেই উপলব্ধি করলাম, গভীরতম অর্থে বলতে গেলে বলতে হয়, রফি আমার আদৌ তেমন ঘনিষ্ঠ বন্ধু কিংবা সহচর ছিল না। প্রতিবছর পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করতে করতে রফি একসময় ভিড়েছিল বখাটেদের দলে। ব্যক্তিগতভাবে একজন  নিঃসঙ্গ, নির্লিপ্ত ও বন্ধুবান্ধবহীন গোছের মানুষ ছিলাম আমি। আমার বেশির ভাগ সময় জায়গা করে নিত বই ও লেখালেখি। বই পড়তে ও কবিতা লিখতে দারুণ ভালোবাসতাম আমি। কাকে কতটুকু পাত্তা সে সময় দিয়েছিলাম, নাকি আদৌ দিইনি, সে বিষয়ে ছিলাম একেবারেই ভাবলেশহীন। অথচ রফি আজ দম্ভ করে বলছে, আমি নাকি ওকে কখনো পাত্তা দিইনি। যা-ই হোক, মনে মনে ভাবলাম আজ হয়তো এখানে আমার আসাই হতো না, শুধু রফি আমাকে একটি ভালো প্লট দেবে বলে লোভ দেখাল, সে উদ্দেশ্যেই এখানে আসা।

রফি আমার দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে বলল, কী রে, কী অত ভাবছিস। দুপুরে তোকে আমি কী খাওয়াব এই তো। আমি ঠিক ধরেছি কি না বল। শোন, একজন মন্ত্রীর সঙ্গে বসে একবেলা খাচ্ছিস, এটাই বা কম কী। হোক সে ডাল-ভাত, মাছ-চচ্চড়ি। আরে মুখ কালো করলি যে। আমি তো তোর সঙ্গে মশকরা করছিলাম।

আমি মনে মনে ভাবলাম, রফি কি পাগল-টাগল হয়ে গেল নাকি। আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম—স্কুলের আর কোনো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ আছে নাকি তোর। অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ হয়। আমি তো আর আজকাল কোথাও যেতে পারি না। কিন্তু স্কুল-কলেজের অনেকেই আসে। তবে আমাকে দেখতে আসে না। আসে তদবির নিয়ে। চাকরি দাও। প্লট দাও। ছেলেমেয়েকে একটি ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দাও। এসব আর কি। তদবিরের যন্ত্রণায় জীবন আমার অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।

আমি মুখে ঈষৎ হাসি ফুটিয়ে বললাম—রাজনীতি করতে নেমেছিস, জনসেবা করতে বসেছিস—এত বিরক্ত হলে চলে। মানুষ তো নানা সমস্যা নিয়ে আসবেই। সেগুলো মুখ বুজে সহ্য করে হাসিমুখে তাদের কথা শুনতে হবে। তাদের সমস্যাগুলো নিরসন করার চেষ্টা তো নিদেনপক্ষে করতে হবে, কি, ঠিক বলিনি। চল এবার মধ্যাহ্ন ভোজটি সেরে ফেলা যাক। কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার এলো টেবিলে। এমন কোনো আহামরি ব্যঞ্জন নয়। সাদা ভাত, বাঁশপাতা মাছের ঝোল, সঙ্গে ধুঁদুল ভাজি ও ডাল। খাবারদাবার নিয়ে কোনোকালেই আমার তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। এমন অনেক দিনই আসে, যখন এর চেয়েও খারাপ খাবার জোটে আমার কপালে। আমি শুধু তক্কে তক্কে রইলাম। কখন আমি আমার প্লটের প্রসঙ্গটি তুলব সেই প্রত্যাশায়। যাহোক এরই মধ্যে মন্ত্রী কক্ষে হুড়মুড় করে প্রবেশ করল একপাল উঠতি বয়সী ছেলেপুলে নিয়ে। বয়স দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এরা সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র। সবাই মন্ত্রীকে সালাম ঠুকছে। সেই সঙ্গে যন্ত্রের মতো নিজের নাম, পরিচয় ও ছাত্র সংগঠনের কে কোন পদে সমাসীন, সে বিষয়টি বিদিত করে মন্ত্রীর সঙ্গে করমর্দন করছে। মন্ত্রী চোখ দিয়ে ইশারা করে আগত ছাত্রদের অফিস কক্ষের বা প্রান্তে, যেখানে বেশ কয়েকটি সোফা পাতা রয়েছে, সেখানে গিয়ে বসতে ইঙ্গিত করলেন।

রফি আমার দিকে তাকিয়ে অস্ফুট কণ্ঠে বলল—দেখেছিস হাসনাত, সাধারণ ব্যঞ্জন দিয়ে দুপুরের ভোজটি সেরে ফেলার কী মাজেজা। দেখিস এখন এই ছেলেরাই তাদের ক্যাম্পাসে গিয়ে গল্প করবে—‘আরে নিজ চোখে দেখে এলাম, আমাদের মন্ত্রী মহোদয় প্রতিদিন কী সাধারণ অন্ন গ্রহণ করেন।’ আর এ জন্যই বেশির ভাগ সময় আমি দুপুরে সাধারণত দু-তিনটি পদ দিয়েই আহার পর্বটি সেরে ফেলি।

—আমি সবিস্ময়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম রফির দিকে। শেষ পর্যন্ত নিজের আহার্য বিষয়গুলো নিয়েও রাজনীতি! হায় খোদা! কোথায় যাই।

খাওয়া পর্ব শেষ করে রফি দলপতি গোছের যে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল—এবার বলো কী করতে পারি তোমাদের জন্য। কোন কাজ নিয়ে এসেছ? নাকি সৌজন্য সাক্ষাৎ? দলনেতার মুখে কথা ফুটল এবার। ছেলেটি বলল—রফি ভাই, আমাদের দলের একটি ছেলের জন্য চাকরির তদবির করতে হবে আপনাকে। পদ খুবই ছোট, সাবইন্সপেক্টর। আপনি শুধু একটু হোম সেক্রেটারি অথবা আইজি সাহেবকে ফোন করে বলে দিলেই হবে। তাহলে চাকরিটা একেবারে কনফার্ম। এই বলেই ছেলেটি নাম-ঠিকানা ও অন্যান্য তথ্যসংবলিত একটি চিরকুট ধরিয়ে দিল মন্ত্রী মহোদয়ের হাতে।

রফি এবার স্মিত হেসে ছেলেগুলোকে উদ্দেশ করে বলল— আচ্ছা, রেখে যাও। আমি পরে সময় করে বলে দেব।

—কী বলছেন রফি ভাই? রেখে যাব? এত ব্যস্ততার মধ্যে আপনার মনে থাকবে নাকি। প্লিজ! এখনই একটু ফোন করে বলে দিন না। ছেলেটি বড়ই অসহায়। একটা চাকরি হলে ছেলেটি বেঁচে যায়। দলপতি গোছের ছাত্রনেতাটি জোঁকের মতো রফির পেছনে লেগে রইল যে রফিউল্লাহ প্রথমে নিমরাজি হলেও খানিক পরে ফোন তাকে করতেই হলো।

রফি ঈষৎ ভারিক্কি কণ্ঠে বলল—হ্যালো, কে, আইজি সাহেব বলছেন। হ্যাঁ, আমি রফিউল্লাহ বলছি। সব ঠিকঠাক চলছে তো। আমি? আছি একরকম। হ্যাঁ, হ্যাঁ, একটা বিশেষ প্রয়োজনেই ফোন দিতে হলো আপনাকে। আমাদের ছাত্র সংগঠনের একটি ছেলে আপনার ডিপার্টমেন্টে অ্যাপ্লাই করেছে। কোন পদে? সাবইন্সপেক্টর। প্লিজ, কাইন্ডলি ছেলেটির নাম-ঠিকানা একটু লিখে রাখুন। দেখবেন, ছেলেটির চাকরিটা যেন হয়। আরে হ্যাঁ... হ্যাঁ..., আমি সবই জানি। আপনি যেভাবে দেশের জন্য সার্ভিস দিচ্ছেন। আমি অবশ্যই পিএমকে আপনার ব্যাপারে বলব। এক্সটেনশন আপনার অবশ্যই হবে।

ছেলেগুলো এবার রফির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উত্ফুল্লচিত্তে অফিসরুম থেকে বেরিয়ে গেল। আমি মনে মনে ভাবলাম—যাক, এতক্ষণে রফিকে একটু ফাঁকা পাওয়া গেল মনে হয়। এই সুযোগে আমার প্লটের প্রসঙ্গটি তোলা দরকার। আমি ঈষৎ নরম গলায় বললাম—রফি, আমি তোর কাছে এসেছিলাম একটু বিশেষ প্রয়োজনে। ওই দিন আমাদের কলেজ ফাংশনে তুই যে আমাকে একটা প্লটের কথা বললি। তোর কাছে আজ আমার আসার উদ্দেশ্যই হচ্ছে, প্লটটি সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে চাই আমি। তুই যদি আমাকে একটু সময় দিতে পারিস, তবে আজই আমি আমার নোট বইয়ে সব টুকে নিতে পারি।

রফিউল্লাহ কিছুটা অপ্রতিভ কণ্ঠে বলল—শোন হাসনাত, আষাঢ় মাসের গীত কি আর শীতকালে চলে। তুই তো অনেক দেরি করে ফেলেছিস। দুই মাস আগে তোকে আমি যে প্লটের কথা বলেছিলাম সেগুলো তো সব শেষ। সব প্লটই ডিস্ট্রিবিউশন হয়ে গেছে এরই মধ্যে। তুই এত পরে এলি।

আমার দুই চোখে বিস্ময়—কী বলছে রফি এসব। আমি একটু উত্তেজিত কণ্ঠে বললাম, আরে ধুত্তরি। আমি কি তোর ওই সব জমিজমার প্লটের কথা বলছি নাকি। আমার প্লট কেনার মতো আর্থিক সংগতি কোথায়। আমি নিতান্তই একজন ছাপোষা শিক্ষক। সারা জীবন অর্থ সঞ্চয় করেও একটি ফ্ল্যাট কেনার সামর্থ্য যেখানে নেই আমার, সেখানে তুই কিনা আমাকে বলছিস আস্ত একটি প্লট কেনার কথা। তুইও পারিস বটে। আমার যত দূর মনে পড়ে, তুই সেদিন কলেজের অনুষ্ঠানে আমাকে বলেছিলি, আমি যেহেতু কবিতা ও গল্প-উপন্যাস লিখি। তোর কাছে একটি ভালো প্লট আছে। আমি চাইলে তুই সেটি আমাকে দিতে পারিস।

আমার কথা শেষ না হতেই রফি হো হো শব্দে বিকট অট্টহাসির ফোয়ারা ছড়িয়ে দিল চারপাশে। মিনিটখানেক হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার পর রফি বলল—হাসনাত, তুই কি পাগল? নাকি আস্ত একটা উন্মাদ। সমাজে তোর মতো পাগল সত্যি বিরল। আরে সেদিন আমি তোকে বলেছিলাম যেহেতু তুই কবিতা ও গল্পটল্প লিখিস, সেহেতু আমি ভেবেছিলাম বুড়িগঙ্গা নদীর পাশে ‘ঝিলিমিলি রিভার সাইট’ নামে আমাদের যে প্রকল্পটি আছে, সেখান থেকে একটি প্লট তোকে দেওয়া যায় কি না, যাতে করে তোর লেখালেখিতে সুবিধা হয়। তা ছাড়া লেখক-সাহিত্যিকরা তো সব সময় নদী ও প্রকৃতির নৈসর্গিক দৃশ্যের পাশে বসে লিখতে পছন্দ করে।

আমি কিছুটা অপ্রসন্ন কণ্ঠে বললাম—গল্পের প্লট চাইতে এসে আজ আমি হাসির পাত্র হলাম তোর কাছে। অথচ তুই কী করে বুঝবি একটি লেখকের কাছে একটি ভালো প্লট কতটা জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো একটি ভালো প্লট একজন লেখক যশোপ্রার্থীকে রাতারাতি সত্যিকারের লেখক করে তুলতে পারে। ইয়ান মর্টেলের নাম শুনেছিস?

রফির কণ্ঠে বিরক্তি—না, শুনিনি। আমি বললাম—ওই যে ‘লাইফ অব পি’ উপন্যাসের লেখক। রফি এবার চেঁচিয়ে উঠল। ও লাইফ অব পি! আমি কিন্তু মুভিটা দেখেছি। চমৎকার। অনবদ্য। আমি বললাম—তুই কি জানিস ওই একটি বিশেষ প্লটের জন্য ইয়েন মর্টেলকে সেই সুদূর কানাডা থেকে ভারতে আসতে হয়েছিল তিন তিনবার। এবার বোঝ কত টাকাপয়সা খরচ করতে হয়েছিল বেচারা ইয়েন মর্টেলকে। আমি আবার রফিকে প্রশ্ন করলাম, তুই কি বিখ্যাত ক্লাসিক উপন্যাস ‘মবিডিকের’ লেখক হার্মান ম্যানভিলের নাম শুনেছিস। এবারও রফির উত্তর—না। আমি বললাম, মবিডিক উপন্যাসের প্লটটি জনৈক নাবিকের কাছ থেকে কেনার জন্য হার্মান ম্যানভিলকে গুনতে হয়েছিল মোটা অঙ্কের টাকা। আরো আছে, শোন, রাশিয়ান লেখক আন্তন চেকভ হরহামেশাই তাঁর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবার কাছ থেকে প্লট কিনতেন। ছোটগল্প হলে দশ রুবল, উপন্যাসের প্লট হলে দিতেন বিশ রুবল। তোর কাছে একটি প্লটের মূল্য ধর যদি হয় কোটি টাকা, তবে একজন প্রকৃত লেখকের কাছেও একটি ভালো প্লট তার চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। আমি রফির সঙ্গে যখন এসব বিষয় নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্কে নিমজ্জিত, ঠিক তখনই অফিস কক্ষে প্রবেশ করলেন একজন মহিলা। মহিলাটি বেশ দামি বেশভূষণে সজ্জিত। নানা আভরণে ও প্রসাধনে পরিবৃত। মহিলাটি কক্ষে ঢুকেই রফির দিকে তাকিয়ে চিৎকার জুড়ে দিলেন—তুমি কি এখনো হাতের কাজ শেষ করোনি। অনুষ্ঠান কিন্তু শুরু হবে ঠিক ৫টায়। আমাদের কিন্তু এখনই বেরোতে হবে। আরে আগে এদিকে এসো। তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই—এ হলো আমার স্কুলজীবনের বন্ধু, হাসনাত। আর দোস্ত, এই হলো আমার স্ত্রী—রেহানা বানু। আমরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে সালাম বিনিময় করলাম। রেহানা বানু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—আপনি যেহেতু ওর স্কুলজীবনের বন্ধু, সে জন্যই বলছি, রফিকে একটু ভালো করে বোঝান তো, খাবারদাবারে ও যেন আরো পরিমিত হয়। রক্তে ওর সুগার ধরা পড়েছে। তা ছাড়া ব্লাডপ্রেশারসহ নানা অসুখ বাধিয়ে ফেলেছে এরই মধ্যে। কিন্তু খাবারদাবারে কোনো লাগাম নেই।

রেহানা বানুর কথায় শুধু অল্প এক চিলতে হাসি ফুটল আমার মুখে। কেন যেন কিছুই বলতে পারলাম না আমি। রেহানা বানু এবার রফিউল্লাহর দিকে তাকিয়ে কৌতূহল ভরা দৃষ্টি নিয়ে বলল—আচ্ছা, দুপুরের দিকে আমাকে ফোন করে তখন কী সব আবোলতাবোল বলছিলে বলো তো। আইজি সাহেব.... সাবইন্সপেক্টর... এক্সটেনশন... চাকরিটা যেন হয়... ইত্যাদি। আমি তো এসবের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আজকাল কাকে ফোন করতে গিয়ে কাকে যে ফোন করছ! এমন ভুল তুমি মাসখানেক আগেও দু-তিনবার করেছ। বিষয়টি কী, একটু বুঝিয়ে বলো তো? তোমাকে কী সাইকিয়াট্রিস্ট-টাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে হবে নাকি। তোমাকে নিয়ে কিন্তু আমার বেশ ভয় হচ্ছে রফি। রফি বলল—আরে কী সব বলছ, রাখো তো এসব। পরে তোমাকে বুঝিয়ে বলব সব কিছু। আমি যেন আমার নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। রফির স্ত্রী রেহানা বানু কী বলছে এসব। মানুষ এতটা শঠ, এতটা প্রতারক, এতটা ভণ্ড হয় কী করে। আমাদের মতো কিছু মানুষের অগোচরে সমাজটা কী সত্যি পচে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে মানুষের মূল্যবোধ, বিবেকসত্তা। আমি মনে মনে ভাবলাম, এমন একটা নিকৃষ্ট মানুষের সঙ্গে কাটালাম এতটা সময়। বরং এর অর্ধেক সময় একটি বৃক্ষের সান্নিধ্যে কাটালেও জীবন ধন্য ও সার্থক হতো। আমি বললাম—রফি, আজ উঠি তাহলে। দোস্ত শব্দটি ব্যবহার করতেও ঘৃণা হচ্ছিল আমার। রফি বলল—আরে, আরেক কাপ কফি খেয়ে যা না। আমার একটু তাড়া আছে, বলেই আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। রফি বলল—কেন, প্লট নিবি না। আমি বললাম—প্লট আমি পেয়ে গেছি রফি। আপাতত এই প্লটেই কাজ চলে যাবে। কথাগুলো বলেই ঊর্ধ্বশ্বাসে দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলাম বাইরে। সূর্যটা কমলারঙের আভা ছড়িয়ে হেলে পড়েছে পশ্চিমে। সচিবালয়ের বারান্দার পাশ ঘেঁষে একটি জারুলগাছ থেকে একটি কোকিল কুহু কুহু কুহু করে ডেকে উঠল। এক ঝটকা দমকা বাতাস এসে লাগল আমার শরীরে। আর তাতেই হৃদয়টি যেন এক ঘোর প্রসন্নতায় ভরে উঠল আমার।

 

সাইফুর রহমান
গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top