সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

সিন্ধুর মেয়ে : অমর মিত্র  


প্রকাশিত:
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:৫৫

আপডেট:
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:১৮

ছবিঃ অমর মিত্র  

 

(অমর মিত্র এই সময়ের একজন জনপ্রিয় বাঙালি লেখক। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। তিনি ২০০৬ সালে ‘ধ্রুবপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ভারতে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। অশ্বচরিত’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চ শিক্ষা দপ্তর থেকে। এ ব্যতীত ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার (ভাগলপুর ), ১৯৯৮ সালে সর্ব ভারতীয় কথা পুরস্কার স্বদেশযাত্রা গল্পের জন্য। ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র পুরস্কার পান। ২০১৭ সালে সমস্ত জীবনের সাহিত্য রচনার জন্য যুগশঙ্খ পুরস্কার, ২০১৮ সালে কলকাতার শরৎ সমিতি প্রদত্ত রৌপ্য পদক এবং গতি পত্রিকার সম্মাননা পেয়েছেন। খ্যাত্নামা অভিনেতা ও নাট্যকার মনোজ মিত্র তার অগ্রজ।)

 

সিন্ধুর মেয়ে

ভোরে নেমেছিলাম মধুগঞ্জে। এখান থেকে মাইল দেড় অশ্রুনদী। অশ্রুনদীর ওপারে, উত্তর-পশ্চিমে একটি পাহাড় আছে। ঘুমপাহাড়। পুরাকালে পাহাড় হেঁটে বেড়াত। হাঁটতে হাঁটতে এই অশ্রুনদীর ধারে এসে দাঁড়ায়। গাঙের অশ্রুপাতে সে গাঙ পার হতে পারে না। মস্ত হাতির মতো পাহাড়েরও বুক ফাটল সেই অশ্রুধারায়। সে দাঁড়িয়েই থাকল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমপাহাড় ঘুমের ভিতরই একটু নাকি পিছিয়ে গেছে। ঘুমের ভিতরে হাঁটত নাকি। এসব সুরেনের বলা গল্প ছিল। সুরেনের কথা বলছি। তার আগে অন্য কথা হোক। যা আমি আসতে আসতে শুনেছি   অচিন্ত্যর কাছে।

 

অচিন্ত্যই এই অশ্রুনদী আর ঘুমপাহাড়ের কথা আমাকে বলেছিল, চ, একটা নতুন জায়গায় নিয়ে যাই, একদম নতুন, ট্যুরিস্টরা খোঁজ পায়নি। অচিন্ত্য বলছে অশ্রুনদীর ধারে একটি বাংলো আছে। সেখানে যে চৌকিদার, তার নাম সুরেন। সে আগে কলকাতা কর্পোরেশনে কাজ করত। বিল্ডিং বিভাগ। কলকাতার রাস্তাঘাটের ম্যাপ তার মুখস্ত ছিল। কোথায় ছকু খানসামা লেন, কোথায় খেলাৎবাবু লেন, আর্মেনীয় গির্জা সব সে চিনত। সুরেন   থাকত অচিন্ত্যদের বাড়ি। তাদের রান্না করত সে। রান্নার হাত ভালো।  হ্যাঁ, সেই সুরেনের  হাতের রান্না আমি খেয়েছি। সেই সুরেনের বাড়ি এই মধুগঞ্জে।  মধুগঞ্জের সাতমাইল উত্তর-পশ্চিমে। মধুগঞ্জ ওড়িশায়। অশ্রুনদী কিছুটা গিয়ে মিশেছে বৈতরণী নদীতে। বৈতরণী দক্ষিণ-পুবে গিয়ে সাগরে মিশেছে। সুরেনের বাড়ি  পাহাড়তলীতে। হ্যাঁ, ঘুমপাহাড়ের কোলে তাদের গাঁ, সবুজগাঁ তার নাম। সুরেন  আচমকা ফিরে গেছে তার  দেশে। মেয়ের বিয়ের পর বউ বলেছিল আর কলকাতায় থাকতে হবে না, গাঁয়ে এসে ক্ষেতি কাম করো। সুরেনের এক ছেলে গেছে হরিয়ানায় কী এক কাজ করতে, আর ফেরেনি। তার কোনো খোঁজই নেই। সেই সুরেন এখানে ফিরেও একটা কাজ জুটিয়ে নিয়েছে। অশ্রুনদীর ধারের বাংলোর চৌকিদারি। ভোরে সাইকেলে চেপে আসে, বিকেল বিকেল সাইকেল চেপে ফিরে যায়। কলকাতায় থেকে থেকে ক্ষেতি-কাম সে ভুলে গেছে। তার জমি চাষ করে দেয় গাঁয়ের লোক, বিনিময়ে ফসলের অর্ধেক ভাগ নেয়। আমরা দুজন, আমি ও অচিন্ত্য মধুগঞ্জে নেমেছি ভোরে। কদিন কাটিয়ে ফিরে যাব। অচিন্ত্য বলছিল, এমন সুন্দর জায়গা আর হয় না। নির্জন, নিঝুম। নদীর চ্ছল চ্ছল, বয়েই যাচ্ছে, বয়েই যাচ্ছে। শোনা যায় কোন দুখিনী মেয়ের কান্না থেকেই নদীর জন্ম। কোন চাষীঘরের মেয়েকে লুট করে নিয়ে গিয়েছিল জমিদারের লেঠেল। জমিদার তার দাসী করে রেখে দিয়েছিল শোনা যায়। সেই মেয়ের কান্না থেকেই অশ্রুনদীর জন্ম। মেয়ে ঐ নদীতেই আত্মবিসর্জন দিয়েছিল।

 

ঘুমপাহাড়ের পিছনে সূর্য ঘুমতে যায়। সূর্যাস্তের সময়টি খুব সুন্দর। আকাশে সিঁদুরে রঙ ধরে। সেই ছায়া নদীর জলে পড়ে। নদীর ওপারে সূর্যাস্তের দেশেই যেন সুরেনের গাঁ। নদী পেরিয়ে বিকেলে সে ফেরে। এখানে  সূর্যোদয় হয় বিস্তীর্ণ প্রান্তরের ভিতর দিয়ে। ভারি সুন্দর সেই সূর্যোদয়। নীলগিরি এক্সপ্রেস ট্রেনে এইসব শুনতে শুনতে এসেছি আমি।   

   

মধুগঞ্জে নেমে একটি রিকশা পেলাম। রিকশাওয়ালা বুড়ো জিজ্ঞেস করল, গাঙধার?

হ্যাঁ। চশমার কাচ মুছতে মুছতে অচিন্ত্য জবাব দেয়, তারপর বিড়বিড় করে আমাকে বলে, আগের বার যেমন দেখেছিলাম, তা থেকে জায়গাটা যেন অন্য রকম মনে হচ্ছে, চেনা নয় যেন। সব জায়গা চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে, ধর আমাদের বাগুইয়াটি, মল হয়েছে তিনটে, হাইরাইজ বিল্ডিং…, এয়ারপোর্টের দিকে একটু এগো, চোখে ধা-ধা লেগে যাবে। আমি বললাম।

কথাটি শুনছিল বুড়ো রিকশাওয়ালা, বলল, মধুগঞ্জের বয়স বাড়ি গিইছে বাবু, বুড়া হইছে, মানুষ বুড়া হলি কি আগের মতোন থাকে?

হুঁ। অচিন্ত্য চুপ করে গেল, একটু থেমে বলল, এই যে জায়গাটা, এখানে একটা বট গাছ ছিল না ?

রিকশাওয়ালা বুড়ো চমকে উঠে বলল, না, ছিলনি, আরো দূরে ছিল, ইখানে না।

আছে? অচিন্ত্য জিজ্ঞেস করল।

বুড়ো রিকশাওয়ালা বলল, না, নেই, ঝড়ে পড়ি গিছে।

এখানে একটা পুকুর ছিল।

রিকশাওয়ালা বলল, না, ছিল না, ভুল বলছেন বাবু, পুকুর অনেকটা দূরে, রাজার দিঘি।

আমার স্পষ্ট মনে আছে। অচিন্ত্য বিহ্বল হয়ে বলল।

রিকশাওয়ালা বলল, আপনি অন্য জাগার সঙ্গে মিলাই দিছেন।

এইটা মধুগঞ্জ তো ? জিজ্ঞেস করল বিমূঢ় অচিন্ত্য। আমার মনে হচ্ছিল কোথাও ভুল হচ্ছে অচিন্ত্যর। মনে নেই স্পষ্ট করে।

হাঁ বাবু। রিকশাওয়ালা জবাব দেয়, মধুগঞ্জ তো, ইস্টিশন দেখুন।

অশ্রুনদী ?

বুড়ো বলল, নিয়ে যাচ্ছি তো সেই বাংলোর দিকে।

আছে তো, নদীর ওপারের ঘুমপাহাড় ?

আছে আছে আছে, খানিক পিছাই গিইছে। রিকশা টানতে টানতে বুড়ো জিজ্ঞেস বলে, ঘুমের ভিতর হাঁটে তো।

        

এই কথোপকথন আমাকে বিস্মিত করছিল। পাহাড় পিছিয়ে গেছে, দিঘিটা যেখানে ছিল, নেই। কী বলছে অচিন্ত্য, কী শুনছি আমি। প্যাডেল করতে করতে বুড়ো রিকশাওয়ালার  পিঠ বেঁকে যাচ্ছে, জিজ্ঞেস করল, ক’দিন থাকবেন ?

কেন ? জিজ্ঞেস করে অচিন্ত্য।

এমনি জিজ্ঞেস করছি বাবু। বলে সে চুপ করে গেল সে।

         

মধুগঞ্জের অশ্রুনদী শীর্ণকায় এক স্রোতস্বিনী। এখন কার্তিক মাস। নদীর মধ্যিখানে জল। তারপর বালি চিকচিক নদীতট। ঘুমপাহাড় ছোট সেই নদীর ওপারে পশ্চিম দিকে। আমাদের বাংলোটি ছোট। দুটি ঘর, ডাইনিং রুম, কিচেন। আরো একটি ঘর আছে, তালা দেওয়া। ঐ ঘরটি চৌকিদারের। চৌকিদার সুরেন তো থাকে না রাত্রে। কিন্তু ভোর সকালে এসে আমাদের জন্য সে  অপেক্ষা করছিল। এই সুরেনকে অনেকদিন আগে অচিন্ত্যর বাড়িতে দেখেছিলাম। বয়স আমাদের মতোই। বছর পঞ্চাশ হবে। বেশ চমৎকার সুগঠিত শরীর ছিল ওর। এখন তাকে চেনাই যাচ্ছে না।  অতি শীর্ণকায় এক ব্যক্তি, বয়স মনে হচ্ছে, সত্তরের উপরে। আচমকা যেন বুড়ো হয়ে গেছে সুরেন। গায়ে ময়লা র‍্যাপার, ময়লা প্যান্ট শার্ট, ধবধবে শার্ট আর প্যান্ট পরিহিত সেই সুরেন আর এই সুরেন যেন এক নয়। বলল, সারাদিন থাকবে, সব কাজ করে দেবে, কিন্তু রাতে বাড়ি ফিরে যাবে। তার বউ একা থাকতে পারে না।

   

মধুগঞ্জে এই কার্তিক মাসেই ভালো শীত পড়ে গেছে। সুরেনের সঙ্গে কথা বলছিলাম আমরা। সে খোঁজ নিতে লাগল কলকাতার। কলকাতার রাস্তার, প্রায় ভেঙে পড়া টালা ব্রিজ, আর ভেঙেই পড়া মাঝেরহাট ব্রিজের কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করল। উত্তর থেকে দক্ষিণ কলকাতার সব তার চেনা। জিজ্ঞেস করতে লাগল  অচিন্ত্যর বাড়ির কথা। ঐ বাড়িতে সে অনেকদিন ছিল। মায়া পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু উপায় ছিল না, তাই চলে এসেছে। তার বউ একা থাকতে পারে না। তার একটা মোবাইল ফোন আছে, কিন্তু খুব কম সময়ে তা চালু থাকে। টাওয়ার আসে যায়। এই বাংলোয় বিদ্যুৎ নেই, কিন্তু ডায়নামোর ব্যবস্থা আছে। সুরেন বলল, সে চালিয়ে দিয়ে যাবে। রাতে বন্ধ করে দিতে হবে সুইচ দিয়ে। সে বুঝিয়ে দিল আমাদের। আমরা সব জেনেই এসেছি এই পূর্ণিমার সময়। প্রাণভরে জ্যোৎস্না দেখব অশ্রুনদীর কুলে বসে। অনেকদিন ভালো করে চাঁদের আলো দেখিনি। আমি গল্প লিখি। নতুন গল্প এনেছি অচিন্ত্যকে শোনাব বলে। শাদা ওয়াইন পানাদি হবে। একটু আরাম করব দুদিন।

   

সুরেন বাজার করে আনল। চাল, ডাল, ঘি, সব্জি, মাছ, কচি পাঁঠার মাংস। বাজার বেশ দূরে। সাইকেল নিয়ে যেতে আসতে ঘন্টাখানেক। আমরা লম্বা বারান্দায় বসে শীতের রোদ পোহাচ্ছিলাম। কলকাতায় শীতের কোনো চিহ্ন নেই, অথচ এই জায়গা কী সুন্দর! এর ভিতরে শীতের রোদ এসে গেছে। আমি আর অচিন্ত্য বহুদিনের বন্ধু। দুজনে বহু জায়গায় গিয়েছি। মধুগঞ্জে আমি এই প্রথম। অচিন্ত্য সপরিবারে আগে এসেছে। তাও বছর তিন হবে। 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি সত্যি চিনতে পারনি মধুগঞ্জ ?

অচিন্ত্য বলল, হ্যাঁ, বুঝতে পারছি না, সেই নদী, নদীর ওপারে পাহাড়, কিন্তু বদল হয়ে গেছে যেন কিছু কিছু, ষ্টেশন এলাকাও তাই।

কী রকম ?

অচিন্ত্য বলল, ধরো নদী ছিল বাংলোর যেদিকে, মানে পশ্চিমে, তাইই আছে, কিন্তু পিছিয়ে গেছে বেশ  অনেক দূর মনে হচ্ছে, আর ঘুরেও গেছে, সোজাসুজি নেই, উত্তর-পশ্চিম হয়ে গেছে যেন, এমন কি এত তাড়াতাড়ি হতে পারে ?

তা হয় নাকি, সব তোমার মনের ভুল।

 

ভুল হলে ভালো, তাইই হওয়ার কথা, কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে যে বাংলোর এই বারান্দায় বসে নদী ভালো দেখা যেত, নদীর ওপারও।

তাহলে সত্যিই নদী গতিমুখ বদলেছে, এমন তো হয়।

হতে পারে সুজন, কিন্তু পাহাড়ি নদী এতটা  সরে না, জল থাকে তো শুধু বর্ষার সময়, তাও পাহাড়ে বৃষ্টি হয়ে সেই জল নেমে এলে। অচিন্ত্য বলল। 

আর কি তফাৎ দেখছ ? জিজ্ঞেস করলাম।

বললাম না বাংলোর মুখোমুখি ছিল নদী, নদীর ওপারে পশ্চিমে  ঘুমপাহাড়, সব কত স্পষ্ট ছিল, এখন দেখছি বাংলোর মুখও একটু সরে গেছে।

অবাক হলাম। অচিন্ত্য যা বলছে তা কি হতে পারে ? বললাম, তুমি সুরেনকে জিজ্ঞেস করো।

সুরেন বলল সব ঠিক আছে, আমারই ভুল হচ্ছে। অচিন্ত্য একটু উদ্বিগ্ন গলায় বলে, এত ভুল হয়! মধুগঞ্জে নামার পর থেকে মনে হচ্ছে এই মধুগঞ্জ যেন সেই মধুগঞ্জ নয়।       

 

সুরেন দ্রুত রান্না সারছিল। এখানে গ্যাস আছে। গ্যাসে রান্না হচ্ছে। আমরা স্নান করলাম কুয়োতলায় বসে। কুয়োর জল এখনো ইষদুষ্ণ। রোদে  বসে কুয়োর  জলে স্নানে যে কী সুখ। আমার  বেশ লাগছিল জায়গাটা। নদী পার হয়ে লোক আসছে। তারা নদীর তট থেকে উঠে এসে রাস্তা দিয়ে স্টেশনের দিকে চলে যাচ্ছে। লোক চলাচল আছে এদিকে। না, চুরি-চামারির ভয় নেই। ডাকাতির ভয়ও নেই। বাংলোর দিকে কেউ আসে না। এদিকের লোক শান্তিপ্রিয়। সুরেন অভয় দিয়েছে। অচিন্ত্যও তাই বলেছিল। সে সাতদিন ছিল বছর দুই আগে ফাল্গুন মাসে। এসেছিল সুরেনের মেয়ের বিয়েতে। বিয়ের পর ক’দিন থেকে গিয়েছিল।  তখন তার কোনো অসুবিধে হয়নি। সুরেনের ছেলে চৈতন রান্না করে চলে যেত। তারপর বিকেলে আসত। রাতের খাবার নিয়েই আসত বাড়ি থেকে।  থাকত রাত্তিরটা কোনো কোনোদিন। সন্ধের পর ডায়নামো চালু করত না। পেট্রম্যাক্সের আলো বেশ ভালো লাগত। আমরাও সেই পেট্রম্যাক্স কিংবা হেরিকেন জ্বালাতে পারি। কিন্তু সুরেন বলল, না, সে মেসিন চালিয়ে দিয়ে যাবে, বন্ধ করে দিলেই হবে। আনখা জায়গা। তার ছেলে হরিয়ানায় গেল, ফিরল না। ছেলেকে পাঠানোই ভুল হয়েছিল। ছেলে থাকলে রাত্তিরে থাকতে পারত।

 

দুপুরে পেট ভর্তি করে সুস্বাদু খাদ্য খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙতে বেলা তিনটে। এখনো বেলা আছে। সুরেন আমি আর অচিন্ত্য বারান্দায় বসে গল্প করছিলাম। সুরেন সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি। অচিন্ত্য সব জানে। মেয়ের বিয়ের পর সুরেন গাঁয়ে  ফিরে আসে। মেয়ে কোথায় থাকে সুরেন ?

 

সুরেন চুপ করে আছে।

কী হলো, কত দূরে ? অচিন্ত্য জিজ্ঞেস করে।

সুরেন চুপ করে থাকে। অচিন্ত্য থেমে যায়।

তখন সুরেন বলল, হরিয়ানায় ছেলেকে না পাঠালে ছেলে এখানেই মরে যেত, সে পাঠিয়েছিল মেয়ের খোঁজ করতে, কিন্তু ছেলে ফেরেনি।

হরিয়ানায় বিয়ে দিয়েছিলে, ঠিকানা রাখনি? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

সুরেন চুপ করে থাকে। আসলে মেয়ের বিয়ের পর সেই যে গেল আর সঙ্গে দেখা হয়নি। মেয়ে আর আসেনি। জামাইয়ের খোঁজ পায়নি সুরেন। যে গ্রামের ঠিকানা ছিল তার কাছে, সেই গ্রামের কোনো অস্তিত্ব ছিল না।  মেয়েকে নিয়ে কোথায় চলে গিয়েছিল জামাই তা আজও জানতে পারেনি সুরেন। জামাইয়ের নাম ছিল গজেন্দ্র। তাকে পছন্দ করেছিল মেয়ে নিজেই। বলতে বলতে  সুরেনের চোখে জল। সে আর তার বউ অনেক ঘুরেও পায়নি মেয়েকে। বউ তাই তাকে ছাড়তে চায় না। একা একা কাঁদবে সারা রাত!

 

অচিন্ত্য সুরেনের বউয়ের জন্য একটা শাড়ি এনেছিল। দিল। বলল, তোমার বউদি দিয়েছে, হ্যাঁ সুরেন, তোমার  বউকে একদিন নিয়ে এস।

সুরেন চুপ করে থাকে। তখন অচিন্ত্য জিজ্ঞেস করে, বউয়ের নাম কী ?

সুরেন বলল, সিন্ধু।

সিন্ধুর জন্য মিষ্টি নিয়ে যেও সুরেন। অচিন্ত্য একশো টাকা দিতে গেল। সুরেন মাথা নাড়ে। নেবে না। অচিন্ত্য তখন কথাটা আবার বলল, সুরেন জায়গাটা আমার অন্য রকম লাগছে কেন, সেবার সাতদিন ছিলাম, তোমার সাইকেল নিয়ে কত ঘুরেছিলাম আমি, চেনা জায়গা বদলে গেছে মনে হচ্ছে কেন ?

কী বলব বাবু!

অচিন্ত্য বলল, বারান্দার মুখ নদীর দিক করা ছিল, তা এখন নেই।

আপনার তাই মনে হচ্ছে ?

হ্যাঁ, আমার কি ভুল হচ্ছে ?

কী জানি বাবু, আমি খেয়াল করিনি, সব ঠিকই আছে মনে হয়।

আমারও তাই মনে হয়। অচিন্ত্যর ভুল। এমন কি হতে পারে ? এ কি শিশুদের সাজানো খেলনার ঘরবাড়ি যে  এদিক থেকে ওদিকে সে নিয়ে যাবে ? ভাবতেই আমি চমকে গেলাম। তাই! চা এল। চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমি ভাবতে লাগলাম কেমন ছিল এই মধুগঞ্জ আর অশ্রুনদী ? কেমন দেখেছিল অচিন্ত্য আগের বারে। আর একটুবাদে বেলা পড়ে গেল। সুরেন সাইকেল নিয়ে নদীর দিকে চলে গেল। আমরা বাইরে এলাম। বাংলো অনেকটা জমি দিয়ে ঘেরা। পেছন দিকটায় ফুলের বাগান। এ যে বড় সুন্দর বাগান। সারাদিন তো দেখিনি। দেখিনি কেন না আমরা বাংলোর পিছনে আসিনি।  গোলাপ, সূর্যমুখী, চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, কেয়া বনও রয়েছে সীমানাজুড়ে। একটা বড় নিমগাছে কয়েকটা পাখির বাসা।পাখিরা কিচিরমিচির করছে। অচিন্ত্য আচমকা বলল, ঐ চন্দ্রমল্লিকা দেখছ, কত বড়!

 

হ্যাঁ। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, সত্যি কত বড়। সারাদিন গেল, কই সুরেন তো আমাদের বাগান দেখায়নি, বাগানের কথা বলেনি।  

আমি দেখছিলাম চন্দ্রমল্লিকা যেন তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। ফুলের চোখ দেখতে পাচ্ছি যেন আমি। বললাম, এত বড় ফুল!

একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন। চাপা গলায় বলল অচিন্ত্য, ভেবে দ্যাখো।

আমার গাঁয়ে রোঁয়া কাটল। বললাম, এত সুন্দর, ফুল সব জীবন্ত মনে হচ্ছে।

অচিন্ত্য চাপা গলায় বলল, আগেরবারে এখানে  বাগান ছিল না, বাগান দেখায়নি কেন সুরেন, কবে করল বাগান ?

ও ভেবেছে আমরা দেখে নেব।        

এমন সুন্দর ফুলের বাগান, ভুলে গেল, একটি কথাও বলল না, সুরেনও বদলে গেছে।

আমি বললাম, চলো, আমার কেমন যেন লাগছে।

আসলে চন্দ্রমল্লিকার দিকে আমি তাকাতে পারছিলাম না। অতি বৃহৎ ফুলটি চেয়ে আছে আমার দিকে।  চোখে চোখ পড়ে যাচ্ছে। রঙিন ফুলের চোখের ভিতরে যেন রয়েছে  কয়েক ফোঁটা অশ্রুবিন্দু। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।  সেই অশ্রুবিন্দুই আমাকে দাঁড়াতে দিল না। আমরা ফিরে আসছিলাম, ফিরতে ফিরতে মনে হচ্ছিল কেউ সজল চোখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে অশ্রুনদীর দিকে গেলাম। নদী নিঝুম হয়ে পড়ে আছে। আমি অচিন্ত্যকে বললাম, কেন এমন হচ্ছে বলো দেখি ?

তুমি তো আসনি, তুমি তো বুঝতে পারছ না আসলে কী দেখেছিলাম আমি। অচিন্ত্য বলল, সুরেনও বদলে গেছে মনে হয়।

 

আমরা ফিরে এলাম অন্ধকার নামতে নামতে। সুরেন ডায়নামোর কথা বলেছিল সকালে কিন্তু তার ব্যবস্থা করে দিয়ে যায়নি। আমরা টর্চ জ্বেলে ঘরে ঢুকতে দেখলাম হেরিকেন এবং পেট্রোম্যাক্স রয়েছে। পেট্রোম্যাক্স কী হবে ? দুটি হেরিকেন জ্বালিয়ে নিলাম। রাত বাড়তে এই পাহাড়ি গঞ্জে শীতও বাড়ে। আমরা শাদা ওয়াইন নিয়ে বসলাম। এ ব্যতীত সন্ধ্যা কাটে কী করে ? সুরেন সব গুছিয়ে রেখে গেছে। বোনলেস চিকেন, শসা, আপেল কুচি। অচিন্ত্য কেমন গম্ভীর হয়ে গেছে। কয়েক সিপ নিয়ে অচিন্ত্য বলল, দেখ, সুজন, আমার আশ্চর্য লাগছে, আমার কাছে সেই ছবি আছে, কিন্তু বাড়িতে, আমার কম্পিউটারে, দেখলে কিছুটা আন্দাজ করতে পারবে, সব অন্য রকম হয়ে গেছে, বাগান ছিল, সামনে, সেই ছবিও আছে, আমি ঢুকতে ঢুকতে অবাকই হয়েছিলাম, অত সুন্দর বাগানটার কোনো চিহ্ন নেই ?

 

বলনি তো। আমি মন্তব্য করলাম।

 

বাগান থাকা না থাকা কিছু না, হতেই পারে, কিন্তু সেই একই বাগান পিছনে নিয়ে গিয়ে কেউ যেন বসিয়ে দিয়েছে, চন্দ্রমল্লিকা ফুলটি তখন ছিল না, বাকি সব এক, তখন চন্দ্রমল্লিকার সিজিন চলে গেছিল মনে হয়, ফুল ঝরে গিয়েছিল। মৃদুস্বরে অচিন্ত্য বলল।

বাগানে যাবে ? আমার মাথায় ঘোর এসেছে ওয়াইনের।

এস। আচমকা কেউ যেন ডাক দিল। তাই কি ? আমার মনে হলো তাই। চন্দ্রমল্লিকা ডাকল যেন। ডাকলে সে-ই ডাকতে পারে। অচিন্ত্য বলল, চ কমল, বাগানটা সামনে নিয়ে আসি।

থাক, তোর নেশা হয়ে গেছে অচিন্ত্য।

না, সব উলটে পালটে দিয়েছে কেউ, তা আগের মতো করে দিতে হবে। বলল অচিন্ত্য।

এস। কেউ যেন বলে উঠল।কার কন্ঠস্বর ? চন্দ্রমল্লিকা ফুল! অশ্রুভরা চোখ। কানে এল স্পষ্ট।

অচিন্ত্য বলল, মনে হচ্ছে বাগান তুলে সামনে বসিয়ে দি, চ কমল।

এস। আবার শুনলাম। সেই কন্ঠস্বর।   

 

আমরা কথা বলতে লাগলাম। কিন্তু উঠলাম না। আমরা বসেই থাকলাম আর কথা বলতে লাগলাম। আমি কয়েকবার বাগানে যাওয়ার কথা বলতে, ‘এস’ ডাক শুনেছি। কেউ ডাকছে বাগানে থেকে। আমি সত্যই শুনছি, না মনে মনে মনে ভেবে নিচ্ছি। গল্প তৈরি করছি। এই সেই গল্প। গল্পের গল্প বলছি আমি।

        

কখন খেয়েছি তা মনে নেই। কিন্তু খেয়েছি। আমাদের নেশা হয়ে গিয়েছিল খুব। শাদা ওয়াইনে অত নেশা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু হয়েছিল। আমাদের উপায় ছিল না যে নিজেদের রাতের খাবার খাই। বেড়ে খেতে হবে। কিন্তু আমরা বেড়েই খেয়েছিলাম। প্লেট ডাইনিং টেবিলে  রেখে, দুজনে দুটি খাটে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমার আবছা মনে আছে, কেউ একজন সব গুছিয়ে দিয়েছিল ডাইনিং টেবিলে। আমাদের ডেকেছিল, এস। আমরা গেলাম। তা কি সত্য হতে পারে ? নেশার ঘোরে ছিলাম, কী হয়েছিল, কী হয়নি তা মনে নেই।

 

পরের দিন সুরেন এসেছিল খুব ভোরবেলায়। তখনো আলো ফোটেনি। শেষ রাতে আমার ঘুম ভেঙেছিল। কী মনে হতে বাইরে এসে দেখি লোকটা চাদর দিয়ে মাথামুড়ে বসে আছে। বলল, ঘুম কম, চলেই এল। আমি ভিতরে গিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেই  ঘুম ভাঙতে আটটা। বাইরের মরা রোদ দেখে কুয়াশা হয়েছিল যে তা বুঝলাম। তখনো তা কাটেনি। নদীর দিকটা আবছা হয়ে আছে। সুরেন জিজ্ঞেস করল, কোনো অসুবিধে হয়নি তো দাদা ?

আমি বলতে গিয়েও বললাম না। অচিন্ত্য বলল, আজ রান্না তাড়াতাড়ি সারো।

কেন দাদা ?

অচিন্ত্য কি চলে যাওয়ার কথা ভাবছে? অচিন্ত্য চুপ করে থাকে। তারপর জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা সুরেন, বাগান সামনে ছিল তো?

সামনে ?

হ্যাঁ, খুব সুন্দর বাগান ছিল, দুপাশে বাগান, ফুলে ভরা, মাঝখান দিয়ে নুড়ি ফেলা  রাস্তা।

সুরেন বলল, পিছনে নেই ?

সামনে থেকে পিছনে গেল কেন ?

পিছনেই ছিল দাদা, তাই আছে।

বলছ ? অচিন্ত্য জিজ্ঞেস করল।

বলছি দাদা।

তোমার ভুল হচ্ছে না সুরেন ?

সুরেন বলল, এই রকমই ছিল মনে হয়।

আমি বছর আড়াই আগে এসেছিলাম তোমার মেয়ের বিয়ের সময়।

সুরেন বলল, বিয়ের সময় না, বিয়ের পরে, সব এমনিই ছিল দাদা, আপনার ভুল হচ্ছে।

অচিন্ত্য বলল, হতে পারে, আমরা আজ একটু পাহাড়ের দিকে যাব সুরেন, খেয়ে বেরব।

ঘুমপাহাড় ?

তোমার বাড়ি আগেরবার যাইনি, এবার যাব।

সুরেন চুপ করে থাকে। দুপুরে ডাল, বেগুন ভাজা, পালং শাকের তরকারি, রুই মাছের কালিয়া, টম্যাটোর চাটনি...। সুরেনের রান্নার হাত এখনো খুব  ভালো। খেয়ে বাংলোর গেটে তালা দিয়ে আমরা রওনা হলাম। সুরেন সাইকেল নিয়ে এগিয়ে সামনে সামনে চলল, আমরা নদী পার হলাম প্যান্ট গুটিয়ে। জল খুব ঠান্ডা।  নদীর স্বচ্ছ  জলের নিচে বালি দেখা যায়। ছোট ছোট মাছের ঝাঁক স্রোতের বিপক্ষে চলেছে। মাথার উপরে পাক দিচ্ছে মাছরাঙা।  জল কিছুটা, তারপর আবার বালুচর। ওপারে পৌঁছে হাঁটতে লাগলাম দুজনে। সুরেন সাইকেল হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ওকে অনুসরণ করছি আমরা। ওপার থেকে যেমন মনে হয়েছিল পাহাড় নদীর পারে, আসলে তা নয়। অনেকটা দূর। ঘুমের ভিতর  পাহাড় সরে গেছে ? কোনো কিছুই ঠিক নেই। নদী সরে গেলে, পাহাড়ও সরে যাবে।

       

না, অচিন্ত্য আগে আসেনি নদীর এপারে। তাই জানে না পাহাড় ঠিক কতটা দূরে ছিল।  আমরা একটা ছোট বাজারের পাশ দিয়ে এগিয়ে সুরেনের বাড়ি এলাম। পায়ে হেঁটে  মিনিট চল্লিশ লাগল। নিঝুম একটি  বাড়ি, খাপরার চাল, ইটের গাথনি। দুটি ঘর। আমরা উঠনে বসলাম একটি খাটিয়ার উপর। আমি খুঁটিয়ে দেখছিলাম বাড়িটিকে। অযত্নের ছাপ সর্বত্র। মানুষ যেন থাকে না।  কতদিন ঝাট পড়েনি উঠনে। শুকনো ঝরা পাতায় চারদিক ভরে আছে।  সুরেনের দুঃখী জীবন। সংসার সাজিয়েছিল। কিন্তু তা ভেঙেচুরে একাকার। ছেলে ফেরেনি, মেয়ে হারিয়ে গেছে। যা মনে হয়, পাচারকারী কারো হাতে পড়েছিল মেয়েটা। অচিন্ত্য বলল, সুরেন, তোমার বউ সিন্ধুকে ডাকো, শাড়ি পছন্দ হয়েছে ?

ঘাড় কাত করল সুরেন, জিজ্ঞেস করল, চা খাবেন দাদা ?

সিন্ধুকে ডাক, এখন চা করতে হবে না।

সুরেন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে হলো, ও ওর বউকে আসতে দিতে চায় না প্রকাশ্যে।

অচিন্ত্য ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিল, বলল, তাহলে ফিরে যাই, শাড়ি ওর পছন্দ হয়েছে কি না শুনতে এসেছিলাম।

সুরেন মাটিতে উবু হয়ে বসল, ভারী আর ভেজা গলায় ডাকল, দাদা!

কিছু বলবে ? আমি জিজ্ঞেস করলাম।  

সিন্ধু শুধু কাঁদে, সারাদিন সারারাত, অশ্রুনদী ওর চোখের জল।

কেঁদে কিছু হবে, বুক বাঁধতে হবে, মেয়ে তোমার ফিরে আসবে একদিন। অচিন্ত্য বলে।

সুরেন চুপ। তারপর স্তিমিত গলায় বলে, সিন্ধুর কান্না থামে না।

আহ, তুমি ওকে এখান থেকে বের করে কলকাতা নিয়ে চলো সুরেন, ভালো থাকবে।

সুরেন বলল, হ্যাঁ, স্পষ্ট গলায় বলল, মা আর মেয়ে কেউ যাবে না, কাঁদে আর সব কিছু ভেঙেচুরে দেয়, আমাকে শান্ত করতে হয় দাদা।

কী বলছ তুমি সুরেন ? অচিন্ত্যর দুচোখ বিস্ফারিত হয়ে গেছে, মেয়ে ফিরে এসেছে ? 

খেলনা সাজিয়ে উলটে পালটে দেয় মেয়েটা, কী রাগ তার! সুরেন মাথা নামিয়ে বিড়বিড় করছে, খেলনাগুলো ছিল সব বাড়িতে, সেই ছোটবেলার, বাড়ি, গাড়ি, নদী, বাগান, মাঠ…...।  

মেয়ে ফিরে এসেছে ? আমি জিজ্ঞেস করলাম।  

 

সুরেনের দুই চোখ দিয়ে অশ্রুনদী বইছে, বলল, মরেছিল সাতটা লোকের পরপর অত্যাচারে, সেই হরিয়ানায়, মরেছিল দাদা, তারপর ফিরেও এসেছে দাদা, ফিরেও এসেছিল, কত রাস্তা হেঁটে, তখন তার মা সিন্ধু কাঁদতে কাঁদতে মরল, তোরে কারা এমন করে মারলরে, সিন্ধুও  ফিরে এল দাদা, তাদের এত রাগ, সব নিজেরাই অদল-বদল করে দেয়, আমাকে বাড়ি ফিরতে হয়, না হলে বাড়ি শেষ করে দেবে, ধ্বংস করে দেবে সব,  কত কঠিন করে মেয়েটারে  মেরেছিল সাতটা লোক, মেরে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিল দাদা, স্বপ্নের ভিতরে মেয়ের  পোড়া মুখ দেখে সিন্ধু নিজেই গায়ে আগুন দিয়ে মরল দাদা……, এখেনে একদিন ভূমিকম্প হবে দাদা, বনে আগুন লাগবে, বজ্রপাত হয়েই যাবে, আমি ওদের শান্ত করি, শান্ত করি, মা মেয়ের এত রাগ, আমিও মরব কোনদিন, আর পারিনে, ওদের রাগে এই হচ্ছে দাদা।         

    

আমরা ফিরে এসেছিলাম, না সুরেনকে নিয়ে আসতে পারিনি। খুব বলেছিলাম, চলো সুরেন, ক’দিন ঘুরে আসবে। সুরেন আসেনি। তাকে শান্ত করতে হবে মা মেয়েকে। না হলে কোনদিন হয়ত মাটির নিচে গিয়ে মাটি কাঁপিয়ে দেবে। বজ্রপাত হয়েই যাবে। বাংলো ভ্যানিশ করে দেবে। পাহাড় ভেঙে পড়বে।  পরদিন ফিরেছিলাম আমরা। ফেরার আগে বাগানে গিয়েছিলাম। সেই চন্দ্রমল্লিকা ঝরে গেছে। পাপড়ি খসে বিশ্রিভাবে গাছটি প্রায় লুটিয়ে ছিল মাটিতে। মধুগঞ্জ থেকে ট্রেন ছেড়ে গেলে,  আমার মনে হচ্ছিল, কেউ সাজিয়ে দিচ্ছে সব, পাহাড়, নদী, বাংলো, ফুলের বাগান, কেউ ভয়ানক ক্রোধে সব তছনছ করে দিতে চাইছে, ধর্ষণের পর হত্যা, হত্যাকারীরা উল্লাসে বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে।         

 

অমর মিত্র
লেখক, সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, বঙ্কিম পুরস্কার এবং যুগশঙ্খ পুরস্কার প্রাপ্ত, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top