সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

নবাব ফয়জুন্নেসা: বঙ্গললনাদের ব্যতিক্রমী বাতিঘর : অনিরুদ্ধ আলি আকতার


প্রকাশিত:
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:৩৮

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:৪৫

ছবিঃ নবাব ফয়জুন্নেসা

 

তখনও সমাজে অন্ধকার গেঁড়ে বসে আছে, তাবিজ-কবচ, ঝাড়-ফুক-তুক-তাক  গ্রাস করেছে মুসলিম জনচেতনাকে। কতিপয় ঘুমভাঙা বাঙালির কলোতানে মুখরিত হচ্ছে সমাজদেহ। তাও আবার পুরুষতন্ত্রের পতাকাতলায় ঘটছে সেই জাগরণের জাদুখেলা, এক কথায় সমাজবিপ্লব। ক্ষিণ আলোকবর্তিকা প্রজ্জ্বলিত হয়ে চলেছে এখানে ওখানে। রামমোহন-বিদ্যাসাগর-সৈদয় আমির আলী-নওয়াব আব্দুল লতিফ প্রমুখ স্বনামধন্য বাঙালির নেতৃত্বে বঙ্গবাসীর মধ্যে যে আত্মসচেতনা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতা, জাতীয়তাবাদী চেতনা ও কুসংস্কার মোচনের বাসনা জাগ্রত হয়েছে, তারই ফলশ্রুতিতে ধর্ম, শিক্ষা-সংস্কৃতি, সাহিত্য ও চলতি সমাজ রীতি-নীতির গড্ডালিকা প্রবাহে নবনব চিন্তার বিপ্লবাত্মক ঢেউ প্রত্যাঘাত হেনেছে। বাঙালির এই নবতম চিন্তার জয় পতাকার রঙ সমগ্র উপমহাদেশের শিষ্ট চিন্তা প্রবাহকে আকর্ষিত করেছে বঙ্গভূমির দিকে। ক্রমে বাংলা হয়ে ওঠে আধুনিক চিন্তাচেতনার সূতিকাগার। পাশ্চাত্য চিন্তার শরিক হয়েও নিজস্ব চিন্তা-দর্শনে বাঙালি আপন স্বাতন্ত্র্যতাকে প্রতিষ্ঠা করে আধুনিক থেকে আধুনিকতম হয়ে ওঠার সাধানায় মগ্ন হয়েছে।

এই সমাজবিপ্লবের ধারায় বাঙালি হিন্দুর তুলনায় বাঙালি মুসলমানের অগ্রগতি কোথাও যেন ধাক্কা খেয়ে সেই চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে বন্দিত্ব বরণ করতে প্রস্তুত হল। হাতে গোণা কয়েকজন ছাড়া বাঙালি মুসলমানের পথ দেখাবার মতো আর কাউকে দেখা গেল না। বিশেষত মুসলিম নারীদের ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয়া হয়ে ওঠার মতো তেমন কেউ এগিয়ে এলেন না। বরং সমকালীন রাজনৈতিক-সামাজিক ঘূর্ণাবর্তে পাক খেয়ে, আধুনিক শিক্ষার আলোক থেকে খানিকটা সরে গিয়ে মধ্যযুগীয় যাপিত জীবনকে বেছে নিতেই তারা সন্তোষ প্রকাশ করল। ঘরের অন্ধকারে বরের হাতের চাবুক আর পরের দেওয়া উপদেশেই হয়ে উঠল তাদের চলার পথের পাথেয়। কথায় আছে—মায়ের শিক্ষা আগে হলে শিশুর শিক্ষা মায়ের কোলে। সেই মায়ের শিক্ষা হল ঠিকই তবে তা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোয় না, বরং তা হল ধর্মীয় গোঁড়ামির অন্ধকারে। শিক্ষা হল, না বোঝা পুথি, না বোঝা  জের জবরের আঁকা-বাঁকা পথে। এদিকে তখন নারী শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে ক্রমান্বয়ে। ১৮১৯-এ বাংলায় মেয়েদের স্কুল চালু হয়েছে মিশনারিদের উদ্যোগে। ’ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি’(১৮১৯ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সম্ভ্রান্ত হিন্দু বালিকাদের জন্য একের পর এক স্কুল প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে কলকাতা, ঢাকার নানা স্থানে। ১৮৮৩ তে কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ও চন্দ্রমুখি বসু বেথুন কলেজ থেকে বি. এ. ডিগ্রি লাভ করছেন।

তখনও মুসলিম নারী শিক্ষার বেহাল দশা। মোটামুটি ভাবে উনিশ শতকের শেষদিকে মুসলিম সমাজের একটি অংশ নারীশিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের দিকে মনোনিবেশ করতে শুরু করে। মূলত আশরাফ শ্রেণির মুসলিমরাই এপথে প্রথম পদার্পণ করেন।  আলীগড়ের সৈদয় আহমদ খানকে অনুসরণ করে কতিপয় পয়সাওয়ালা বঙ্গমুসলিম পরিবার এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে শুরু করে। বাংলার সেই সব ধনী মুসলিম পরিবারে নারীদের চরিত্রগঠন ও আদর্শ নারীচরিত্র নির্মাণে উর্দু ভাষায় লিখিত কিছু পুস্তক পাঠ-চর্চার অনুমতি মেলে। এমনই এক দুর্ভেদ্য অন্ধকারের ভিতরে থেকে প্রজ্জ্বলিত আলোকবর্তিকা হাতে এগিয়ে আসেন সম্ভ্রান্ত এক ভূস্বামী কন্যা নবাব ফয়জুন্নেসা[(১৮৩৪-১৯০৩ খ্রি.)যদিও জন্ম সন নিয়ে মতভেদ বর্তমান।]

জনাব আহমেদ আলী চৌধুরী ও মাতা আরাফান্নেসা চৌধুরাণীর তৃতীয় সন্তান ফয়জুন্নেসা। দুই ভাইয়ের পর ঘর আলো করে জন্ম নিলেন ফয়জুন। চঞ্চলমতি, ক্রীড়া-কৌতুকে মেতে থাকা এই ফয়জুন যথা সময়ে কালি-কলম ধরলেন।  বাল্যাবস্থায় বয়স্যাদিগের সাথে ক্রীড়া কৌতুকে নিমগ্ন থেকেও যথাসময়ে শিক্ষক সন্নিধানে অধ্যয়নাদি সম্পন্ন করলেন তিনি। সুকঠোর পর্দা প্রথার বেড়ি ভেঙে পরিবারের উৎসাহে সেসময় পুরুষ শিক্ষক উস্তাদ তাজউদ্দিনের সান্নিধ্যে বিদ্যাশিক্ষা সুযোগ পান তিনি। আরবি ফারসি তো বটেই এমনকি বাংলা ও সংস্কৃত চর্চায় ও তিনি ক্রমে পারদর্শী হয়ে উঠলেন। যুগের বদল হওয়া শিক্ষা-সংস্কৃতির হওয়ায় তিনি  বেড়ে উঠলেন। যথাযোগ্য গুরুর হাতে উপযুক্ত শিষ্যা হয়ে উঠলেন তিনি, তাঁর ভাষায়—

উস্তাদের পদবন্ধি শিরের উপর।
অন্ধচক্ষে জ্যোতি দিয়ে করিল পসর্।।
তাজউদ্দীন মিয়া তাঁর নাম।
প্রভু আগে মাগি তাঁর স্বর্গে হৈতে স্থান।। (শ্রীমতি ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী: রূপজালাল, পৃ-৪)

আলোর ধর্মই ছড়িয়ে পড়া, অন্ধকার দূরীভূত করা, সত্যের সন্ধান দেওয়া। আলোকিত ফয়জুন্নেসা নিজে যেমন নবজাগরণের আলোয় আলোকিত হলেন, তেমনি উনশ শতকের অন্ধকারে বাস করা মুসলিম নারী চেতনার বদ্ধ কারাগারে আলোক সম্পাতের জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে উঠলেন। এদিকে তখন ধর্মের কুসংস্কারে আঘাত হানতে একে একে এগিয়ে এসেছেন উত্তর ভারতের সৈয়দ আহম্মদ বেরিলভী , ইনায়েত আলী, মওলবী আহম্মদ উল্লাহ্,সৈয়দ আমীর আলী,আবদুল লতিফ প্রমুখ। এঁদের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের শরিক হয়েছে বঙ্গের মুসলমান সমাজের একাংশ। ক্রমান্বয়ে জেগে উঠছে সমাজ। রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগতভাবে পিছপা মুসলিম সমাজের এমনই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে এলেন নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী। বিরাট জমিদারির ভার সমালে তিনি একজন বিদূষী রমনীর মতো সমাজসংস্কারে আত্মনিয়োগ করলেন। অন্ধকারের অভিশাপ থেকে মুসলিম নারী সমাজকে মুক্ত করার কঠিন পণ কাঁধে তুলে নিলেন। তিনি উপলব্ধি করেন—শিক্ষা ছাড়া এ জাতির মুক্তি নেই। তাই শুধু নারী শিক্ষাই নয়, নারী-পুরুষ উভয়ের শিক্ষাকেই সমান গুরুত্ব দিলেন তিনি। প্রতিষ্ঠা করলেন—ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ছেলেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মেয়েদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

দশ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ, অবৈতনিক মাদ্রাসা নির্মাণ তাঁর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণের সাক্ষ বহন করে। ছেলেদের জন্য তাঁর জমিদারির বেশ কয়েকটি মৌজায় স্থাপন করলেন প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চবিদ্যালয়।

মুসলিম পুরুষ যখন শিক্ষাক্ষেত্রে ক্রমাগ্রসরমান, তখন ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী নারী শিক্ষা প্রসারে জীবন উৎসর্গ করলেন। উনিশ শতকে যেখানে এদেশীয় মুসলিম নারীশিক্ষার হার ছিল প্রায় শূণ্যের কোঠায়, সেখানো দাঁড়িয়ে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে নারী শিক্ষার অগ্রগতিতে ঝাপিয়ে পড়লেন তিনি। অধুনা বাংলাদেশের কুমিল্লা শহরে মেয়েদের জন্য তিনি পৃথকভাবে দুটি প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করলেন। সালটা ১৮৭৩। নানুয়া দিঘির পশ্চিমপাড়ে আর কান্দিরপাড়ে দুটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। ‘ফয়জুন্নেছা উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়’(ফয়জুন্নেছা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়/নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়) বিদ্যোৎসাহিনী ফয়জুন্নেসার সেই শুভতম নারী শিক্ষা প্রসারের স্বাক্ষ বহন করে চলেছে। গোড়া আলেম সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে আধুনিক শিক্ষা প্রসার, নারী শিক্ষা প্রসারের মতো  নির্ভিক কর্মকাণ্ড সমকালতো বটেই, উত্তরকালের মুসলিম নারীদের সারণীতে তাঁকে ব্যতিক্রমী প্রতিস্পর্ধী বীরাঙ্গণা হিসেবে সম্মানীত করে।

তিনি রানি ভিক্টোরিয়ার কাছ থেকে পেলেন সম্মানীয় ’নবাব’ খেতাব। এই খেতাব শুধু তাঁর রাজআনুকূল্যজাত খেতাব নয়, এ খেতাব তাঁর সেবাব্রতের, এ খেতাব তাঁর শিক্ষাব্রতের স্বার্থক পুরস্কার। রাস্তাঘাট, গোরস্থান নির্মাণ এমনকি চিকিৎসা বঞ্চিত তৎকালীন নারী সমাজের চিকিৎসার জন্য ‘ফয়জুন্নেছা জেনানা হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠলেন দয়াময়ী নবাব ফয়জুন্নেসা। জমিদারির বেশির ভাগ অংশ মানুষের কল্যাণে দান করে তিনি হয়ে উঠলেন কল্যানীয়া জননীর প্রকৃত প্রতিভূ। তাছাড়া বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম সাহিত্যিক হিসেবে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে রইলেন বাঙালির হৃদয়ে। সেই অর্থে অবরোধবাসিনী হয়েও ফয়জুন্নেসা ‘রূপকজালাল’, ’সঙ্গীত লহরী’ ও ’সঙ্গীত সার’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করে উত্তরসূরী মহিলাদের সাহিত্য সেবার পথ খনন করে যথার্থ বাতিঘর নির্মাণ করেলেন। তাঁর নির্মিত পথেই বলা চলে বেগম রোকেয়ার মতো বিদূষীর আবির্ভাব স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।  

সরলাদেবী চৌধুরানী, সরোজ নলিনী দত্ত, স্বর্ণকুমারী দেবী বা কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর মতো নারীদের পাশাপাশি বঙ্গীয় মুসলিম নারীদের বাতিঘর হিসেবে নবাব ফয়জুন্নেসাও যে জ্ঞানে-গরিমায় বাঙালির প্রকৃত একটি বাতিঘর তা বলাই বাহুল্য।

একবিংশ শককের  এই উন্নত বিশ্বের অলিতে-গলিতে যেভাবে নারী নির্যাতন, কন্যাভ্রূণ হত্যা, ধর্ষণ বেড়ে চলেছে বিশেষত, বঙ্গীয় মুসলিম সমাজে এখনো যেভাবে বাল্যবিবাহ, কন্যাভ্রূণ হত্যার মতো নারকীয় খেলা চলেছে নির্বিবাদে,  সেখানে দাঁড়িয়ে নবাব ফয়জুন্নেছার মতো বিদূষী নারীর আবাহন জরুরি হয়ে পড়ে। জরুরি হয়ে পড়ে তাঁর মতো দানশীলা-মানবদরদী-নারী জাগরণের প্রতিভূদের জীবন-ইতিহাসকে ফিরে দেখা।

১৩১০ সালের ১০ আশ্বিন এই মহীয়ষী বিদূষী নারীর জীবনাবসান ঘটে। তাঁর প্রয়াণ মাসে তাঁকে এভাবে ফিরে দেখা আসলে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন। এই বঙ্গবীরাঙ্গণার প্রতি রইল শতকোটি প্রণাম।

 

তথ্য: নবাব ফয়জুন্নেছা ও পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজ ও আন্তর্জাল ।

অনিরুদ্ধ আলি আকতার, শিক্ষক, চন্দ্রকেতুগড় শহীদুল্লাহ্ স্মৃতি মহাবিদ্যালয় (বাংলা বিভাগ)
উত্তর ২৪ পরগণা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top