সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

বাউল - এক অসাম্প্রদায়িক সম্প্রদায়ের নাম : রোজীনা পারভীন বনানী 


প্রকাশিত:
১৫ অক্টোবর ২০২০ ২০:৩৩

আপডেট:
১৫ অক্টোবর ২০২০ ২০:৫৮

ছবিঃ লালন শাহ

 

অষ্টাদশ- ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই উপমহাদেশে বিশুদ্ধ ঈশ্বরপ্রেমিক, স্বাধীনচিত্ত, জাতিসম্প্রদায়ের তকমাবিহীন একদল রহস্যময়ী সাধক 'বাউল' নামে পরিচিতি লাভ করে এবং এই নামেই সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সম্প্রদায় গোড়ে তোলে। বাউল একটি পার্শি শব্দ---'বা' অর্থ সহিত, আর 'উল' অর্থ সন্ধান । এই সন্ধান আত্মিক বা আধ্যাত্মিক । গান হচ্ছে বাউল সম্প্রদায়ের শাস্ত্র।অন্য কোন শাস্ত্র এরা মানেনা। গানের মাধ্যমেই এরা যুগে যুগে মানুষকে শিক্ষা দিয়েছে এবং এখন ও দিচ্ছে।সে শিক্ষায় কোন সংকীর্ণতা নেই। বাউল গানগুলোতে সুগভীর ঈশ্বরোপলব্ধি, মনের সহজ অনুভূতি ও সহজ সত্যের কথাই কবিত্বময় ভাষায় প্রকাশ পায়। বাউল গানের সুর এমনই হয় যে, এর কথা ও সুর মিলে মানুষের মনকে একটা আধ্যাত্মরাজ্যের দিকে নিয়ে যায়।

 বাউলরা মনে করে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই এক 'অধর চাঁদ' বা 'মনের মানুষ' বাস করে। তাঁকে উপলব্ধি করে দেহের ভিতর আবিষ্কার করতে পারলেই সাধকের মুক্তি লাভ হয় এবং 'আলেখ্য নূর' বা পরম জ্যোতির সন্ধান পাওয়া যায়। তখন  মানুষের পার্থিব সত্তা ধ্বংস হয়ে চেয়ে সাধক-ঈশ্বর সাযুজ্য তৈরী হয়। অর্থাৎ সীমাবদ্ধ জড়সত্ত্বাকে বিনাশ করে দেহ ও মনে মুমুক্ষ হয়ে ওঠাই বাউল সাধনার মূল কথা। তাই স্বাভাবিক ধর্মীয় আচার- অনুষ্ঠান, পূজার্চনা, রোজা- নামাজ, মন্দির- মসজিদ, কাবা-কাশি সবকিছু সমন্ধেই এরা উদাসীন---কোন ধর্মীয় ভেদাভেদ এরা মানে না। হিন্দু বাউল তাই স্বচ্ছন্দে সূফী সাধনার পরিভাষা ব্যবহার করে, আবার সূফী বাউল ও নিদ্বির্ধায় যোগতন্ত্রের শব্দ অনুশীলন করে। কোন বাউল তাই মন্দির- মসজিদকে

তুচ্ছ করে গেয়ে ওঠে----

তোমার পথ ঢেকেছে মন্দিরে মসজিদে/ তোমার ডাক শুনে সাঁই চলতে না পাই
রুইখা দাঁড়ায় গুরুতে মুরশেদে....

কিংবা, 

দেখি রে তোর পৈতে গলে/ তাজ মাথায় তছবি হাতে
বলো তুমি কোন জাতির ছেলে/ তুমি কিবা হিন্দু কি মুসলমান
কোন পথে বলো .....

সত্যধর্মের কাছে আত্মনিবেদন মানুষের অন্তরে বইয়ে দিতে পারে এক আনন্দের ফল্গুধারা।কিন্তু মানুষ মাঝে মাঝেই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই ধর্মকে নিজের মনমতো করে গড়ে নেয়। বাউলের ভাষায় 'সাঁই এবং হরি' এই দুটি শব্দ মানুষেরই তৈরি। তাই তো তারা দুঃখ প্রকাশ করে গেয়েছে----

একই ঘাটে আসা যাওয়া/ একই পাটনী দিচ্ছে খেওয়া
কেউ খায় না কারও ছোঁয়া/ ভিন্ন জল কে কোথায় পান?
বেদ পুরাণে করেছে জারি/ যবনের সাঁই হিন্দুর হরি
আমি বুঝতে পারি/ এইরূপ সৃষ্টি করলেন কি তার প্রমাণ?

বাউলদের মতে, স্রষ্টা এক এবং অদ্বিতীয়। তাঁর দ্বিতীয় কোন রূপ নেই।তিনি সকলের স্রষ্টা। সকলকেই তিনি সমানভাবে দেখেন, সকলের জন্যই তাঁর সমান করুণা। কিন্তু আজ আমরা মানুষে মানুষে নিজেদের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর খাড়া করেছি। তাই বাউল বলে-----

কেউ মালা কেউ তছবি গলায়/ তাইতে কি জাত ভিন্ন বলায়
যাওয়া কিংবা আসার বেলায়/ জেতের চিহ্ন রয় কাররে।।
গর্তে গেলে কূপজল হয়,/ গঙ্গায় গেলে গঙ্গা জল হয়,
মূলে এক জল, সে যে ভিন্ন নয়,/ ভিন্ন জানায় পাত্র অনুসারে ।।
জগত বেড়ে জেতের কথা/ লোকে গর্ব করে যথা-তথা,
লালন সে জেতের ফাতা/ বিকিয়েছে সাত বাজারে----

'মান আরাফা নাফ্সাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু' অর্থাৎ ' know thyself and you will know God'-- এই তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে বাউলরা  নির্জনে বসে শুধু নিজের ভিতরই স্রষ্টা বা 'মনের মানুষ' কেই সন্ধান করে----

আছে হেথায় মনের মানুষ মনে সে কি যেন মালা/ অতি নির্জন বসে বসে দেখছে খেলা
কাছে রয় ডাকে তারে উচ্চস্বরে কোন পাগেলা
 

বাউল সাহিত্য তাই হিন্দু-মুসলমান উভয়ের। বাউল কবিদের মধ্যে উভয় সম্প্রদায়ের লোকই আছে, কিন্তু নিজেদেরকে তারা সবসময় একটা সম্প্রদায়ভুক্ত মনে করে--সে সম্প্রদায় হচ্ছে মানব সম্প্রদায়। আমাদের এই উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলমান বহুকাল ধরে পরস্পরের সাথে যে প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল বাউল গান হয়তোবা সেই সত্যেরও প্রমাণ----

ভক্তির জোরে বাঁধা আছে সাঁই/ হিন্দু কি যবনি বলে জাতির বিচার নাই
শুধু ভক্তি মাতোয়ারা ভক্ত কবির দেখনা তাই/ ধরেছে সে ব্রজের কালা শুনি সর্বদাই ।
এক চাঁদে হয় জগৎ আলো/ একবীজে সব পয়দা হলো----

উপরের গানগুলো থেকে এটা স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, শাস্ত্র- পুরাণ, কোরান-হাদিস, পাঁজি পুঁথি মিলিয়ে গোঁড়া হিন্দু-মুসলমান যে ঈশ্বরের আরাধনা করে, সেই ঈশ্বরের কথাতো এভাবে জানা যায় না। ঈশ্বরের উপর পরম নির্ভরতা, পরমেশ্বরের সাথে নিত্য-মিলনের বোধ বাউলদের মনে এক অপার বিশ্বাসের সৃষ্টি করে। বাউল কবিরা তাই অনুভব করে--মানুষের জীবনযাত্রার আদিতে, অন্তে তার সঙ্গে তাঁর 'মনের মানুষ' সর্বদাই আছেন এবং সেই 'মনের মানুষে'র রূপ  খুঁজতে গিয়ে নিরন্তর গেয়ে চলে---

না জানি কেমন রূপ সে/ ওগো সৃষ্টি করলেন কোথায় বসে
না জানি কেমন রূপ সে/ আকারে নি সাকার ভাবি
নিরাকারে বত্রিশ রূপ সে/ কোথায় রূপের ঘরবাড়ি
আমি খুঁজে আলাম দ্যাশ-বিদাশে-----

অথবা,
যারে আকাশ- পাতাল খুঁজে মরিস/ এই দেহে সে রয়
আছে আদি মক্কা এই মানব দেহে/ দেখনা  রে মন চেয়ে

দেশ-দেশান্তর দাড়িয়ে এবার/ মরিস কেন হাঁপিয়ে------

   
সহায়ক গ্রন্থাবলি :

(১) বাউল কবি লালন শাহ---অধ্যাপক আনোয়ারুল করিম
(২) বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস----শ্রীকণক বন্দ্যোপাধ্যায়
(৩) বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত ----ডঃ.অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

রোজীনা পারভীন বনানী 
ঝিনাইদহ, বাংলাদেশ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top