সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

জীবিত জীবনানন্দের চেয়ে মৃত জীবনানন্দ অনেকবেশি শক্তিশালী ও প্রাসঙ্গিক : জালাল উদ্দিন লস্কর শাহীন


প্রকাশিত:
২০ অক্টোবর ২০২০ ২০:৪৮

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:৩৪

ছবিঃ জীবনানন্দ দাশ 

 

বাংলা কবিতায় সিম্বলিজমের (symbolism) স্রষ্টা অগ্রণী বাঙালি কবি ও ঔপন্যাসিক জীবনানন্দ দাশ  ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯  সালে কীর্তনখোলা বিধৌত বরিশালে জন্ম গ্রহন করেন। ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর কলকাতায় ট্রাম দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে কিছুদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে মারা যাওয়ার আগে স্বল্পকালীন এক জীবনে কবি জীবনানন্দ দাস বাংলা সাহিত্য ও কাব্যে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক।তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক, স্বতন্ত্র ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী।মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে যখন তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল, ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবিতে পরিণত হয়েছেন।

রূপসী বাংলার কবি খ্যাত জীবননান্দ দাসের ডাকনাম ছিল মিলু। তার রক্তেই মিশে ছিল কাব্য ও সাহিত্য সৃষ্টির সহজাত ধারা। জীবনানন্দের মাতা কুসুম কুমারী দাসও ছিলেন তৎকালীন সময়ের একজন নামী কবি ও লেখিকা। তাই বলা চলে উত্তরাধিকারসূত্রেই জীবনানন্দ দাস সাহিত্য প্রতিভা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন।

 

প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজীতে অনার্স শেষ করে  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে  উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক গীতিকার, সম্পাদক  ও কলেজের অধ্যাপক হিসাবে তিনি জীবন অতিবাহিত করেন। জীবননান্দের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মঃ

সাতটি তারার তিমির, বনলতা সেন, রূপসী বাংলা, মহাপৃথিবী,বেলা অবেলা কালবেলা ও শ্রেষ্ট কবিতা ইত্যাদি।

গ্রামবাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ ও রূপকথা-পুরাণের জগৎ জীবনানন্দের কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্ররূপময়, আর এ কারনেই তিনি ‘রূপসী বাংলার কবি’ অভিধায় খ্যাত হয়েছেন। বুদ্ধদেব বসু তাঁকে 'নির্জনতম কবি' বলে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে ‘শুদ্ধতম কবি’ অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন। সমালোচকদের অনেকে তাঁকে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি বলে মনে করেন। জীবনানন্দের বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনে পুরস্কৃত (১৯৫৩) হয়। ১৯৫৫ সালে শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থটি ভারত সরকারের সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার লাভ করে।

জীবনানন্দ দাশ প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন তিনি। তবে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্বে তিনি ২১টি উপন্যাস এবং ১২৬টি ছোটগল্প রচনা করেছিলেন যার একটিও তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে তিনি দিনাতিপাত করেছেন। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধকালে অনপনেয়ভাবে বাংলা কবিতায় তাঁর প্রভাব মুদ্রিত হয়েছে।

জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমানে বাংলাদেশ) অন্তর্গত বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষগণ বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার নিবাসী ছিলেন। পিতামহ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৩৮-৮৫) বিক্রমপুর থেকে বরিশালে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সর্বানন্দ দাশগুপ্ত জন্মসূত্রে হিন্দু ছিলেন তবে পরে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন। তিনি বরিশালে ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁর মানবহিতৈষী কাজের জন্যে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হন। জীবনানন্দের পিতা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত সর্বানন্দের দ্বিতীয় পুত্র। সত্যানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৬৩-১৯৪২) ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক এবং ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক।

জীবনানন্দের মাতা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন গৃহিণী, কিন্তু তিনি কবিতা লিখতেন। তাঁর সুপরিচিত কবিতা আদর্শ ছেলে (আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে) আজও শিশুশ্রেণির পাঠ্য এবং সমান জনপ্রিয়। জীবনানন্দ ছিলেন পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান। তাঁর ডাকনাম ছিল মিলু। তাঁর ভাই অশোকানন্দ দাশ ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে এবং বোন সুচরিতা দাশ ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা কম বয়সে স্কুলে ভর্তি হওয়ার বিরোধী ছিলেন বলে, বাড়িতে মায়ের কাছেই জীবনানন্দের বাল্যশিক্ষার সূত্রপাত।

ভোরে ঘুম থেকে উঠেই পিতার কণ্ঠে উপনিষদ আবৃত্তি ও মায়ের গান শুনতেন। লাজুক স্বভাবের হলেও মিলুর খেলাধুলা, বাগান করা, ভ্রমণ ও সাঁতারের অভ্যাস ছিল। ছেলেবেলায় মামার সঙ্গে বহু জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। শৈশবে একবার কঠিন অসুখে পড়েন। স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্যে মাতা ও মাতামহ হাসির গানের কবি চন্দ্রনাথের সাথে লক্ষ্মৌ, আগ্রা, দিল্লী প্রভৃতি স্থান ভ্রমণ করেন। জন্মসূত্রে তাঁর পদবি দাশগুপ্ত হলেও তিরিশের দশকের শুরুতে জীবনানন্দ গুপ্ত বর্জন করে কেবল দাশ লেখা শুরু করেন।

১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে আট বছরের জীবনানন্দকে ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়। বিদ্যালয়ে থাকাকালীন তাঁর বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচনার সূচনা হয়। এছাড়া সে সময়ে তাঁর ছবি আঁকার দিকেও ঝোঁক ছিল। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রজমোহন বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন (বর্তমানে মাধ্যমিক বা এসএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। দু'বছর পর ব্রজমোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট বা এফএ (উচ্চ মাধ্যমিক) পরীক্ষায় পূর্বের ফলাফলের পুনরাবৃত্তি ঘটান; অতঃপর উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য কলকাতায় গমণ করেন।

১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স সহ বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ওই বছরেই ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয়। কবিতার নাম ছিল বর্ষ আবাহন। ওতে কবির নাম ছাপা হয়নি, কেবল সম্মানসূচক শ্রী কথাটি লেখা ছিল। তবে পত্রিকার বর্ষশেষের নির্ঘণ্টসূচিতে তাঁর পূর্ণ নাম ছাপা হয়: শ্রীজীবনানন্দ দাস, বিএ।

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেন। তবে পরীক্ষার ঠিক আগেই তিনি রক্ত আমাশয় রোগে আক্রান্ত হন, যা তাঁর প্রস্তুতি বাধাগ্রস্ত করে। সে সময়ে তিনি হ্যারিসন রোডের প্রেসিডেন্সি বোর্ডিংয়ে থাকতেন। এরপর তিনি আইন বিষয়ে পড়া শুরু করেন, কিন্তু অচিরেই তা পরিত্যাগ করেন। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে জীবনানন্দ কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন।

যৌবনের প্রারম্ভেই জীবনানন্দের কবিপ্রতিভা বিকশিত হতে শুরু করে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৫ এর জুনে মৃত্যুবরণ করলে জীবনানন্দ তাঁর স্মরণে 'দেশবন্ধুর প্রয়াণে' নামক একটি ব্রাহ্মবাদী কবিতা রচনা করেন, যা বঙ্গবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কবিতাটি পরবর্তীতে তাঁর প্রথম কাব্য সংকলন ঝরা পালকে স্থান করে নেয়। কবিতাটি পড়ে কবি কালিদাস রায় মন্তব্য করেছিলেন, "এ ব্রাহ্মবাদী কবিতাটি নিশ্চয়ই কোনো প্রতিষ্ঠিত কবির ছদ্মনামে রচনা"। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দেই তাঁর প্রথম প্রবন্ধ স্বর্গীয় কালীমোহন দাশের শ্রাদ্ধবাসরে প্রবন্ধটি ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার পরপর তিনটি সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ঐ বছরেই কল্লোল পত্রিকায় 'নীলিমা' কবিতাটি প্রকাশিত হলে তা অনেক তরুণ কাব্যরসিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ধীরে ধীরে কলকাতা, ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হতে থাকে; যেগুলির মধ্যে ছিল সে সময়কার সুবিখ্যাত পত্রিকা কল্লোল, কালি ও কলম, প্রগতি প্রভৃতি। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালক প্রকাশিত হয়। সে সময় থেকেই তিনি তাঁর পারিবারিক উপাধি 'দাশগুপ্তের' বদলে কেবল 'দাশ' লিখতে শুরু করেন।

 

প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি সিটি কলেজে তাঁর চাকরিটি হারান। ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে কলেজটিতে ছাত্র অসন্তোষ দেখা দেয়, ফলাফলস্বরূপ কলেজটির ছাত্রভর্তির হার আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। জীবনানন্দ ছিলেন কলেজটির শিক্ষকদের মধ্যে কনিষ্ঠতম; আর্থিক সমস্যাগ্রস্ত কলেজ প্রথমে তাঁকেই চাকরিচ্যুত করে। এই চাকরিচ্যুতি দীর্ঘকাল জীবনানন্দের মনোবেদনার কারণ ছিল। কলকাতার সাহিত্যচক্রেও সে সময় তাঁর কবিতা কঠিন সমালোচনার মুখোমুখি হয়। সে সময়কার প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক কবি-সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাস শনিবারের চিঠি পত্রিকায় তাঁর রচনার নির্দয় সমালোচনায় প্রবৃত্ত হন।কলকাতায় করবার মতো কোনো কাজ ছিল না বলে কবি ছোট্ট শহর বাগেরহাটের প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।তবে মাত্র দুই মাস কুড়ি দিন পরেই তিনি কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় তিনি প্রেসিডেন্সি বোর্ডিংয়ে থাকতেন।

চাকরি না থাকায় এ সময় তিনি চরম আর্থিক দুর্দশায় পড়ে গিয়েছিলেন। জীবনধারণের জন্যে তিনি গৃহশিক্ষকরূপে কাজ করতেন, এবং লেখালিখি থেকে সামান্য কিছু রোজগার হতো। সাথে সাথে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনি চাকরির সন্ধান করছিলেন। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে তিনি দিল্লির রামযশ কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। এখানেও তাঁর চাকরির মেয়াদ মাত্র চার মাস।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই মে তারিখে তিনি লাবণ্য দেবীর সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ে হয়েছিলো ঢাকা শহরে, পুরান ঢাকায় সদরঘাট সংলগ্ন ব্রাহ্ম সমাজের রামমোহন লাইব্রেরিতে।লাবণ্য গুপ্ত সে সময় ঢাকার ইডেন কলেজে লেখা-পড়া করছিলেন। জীবনানন্দ দাশের বিয়েতে কবি বুদ্ধদেব বসু, অজিতকুমার দত্ত প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

বিয়ের পর আর তিনি দিল্লিতে ফিরে যাননি। এরপর প্রায় বছর পাঁচেক সময় জীবনানন্দ কর্মহীন অবস্থায় ছিলেন। মাঝে কিছু দিন একটি বীমা কোম্পানির এজেন্ট হিসাবে কাজ করেছেন; ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে অর্থ ধার করে ব্যবসা করেছেন; কিন্তু উড়নচণ্ডী স্বভাবের কারনে কোনোটাই স্থায়ী হয়নি। এ সময় তাঁর পিতা জীবিত এবং জীবনান্দের স্ত্রী বরিশালেই ছিলেন বলে জীবনানন্দের বেকারত্ব পারিবারিক দুরবস্থার কারণ হয়নি।

১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে কবির প্রথম সন্তান মঞ্জুশ্রীর জন্ম হয়।প্রায় সে সময়েই তাঁর 'ক্যাম্পে' কবিতাটি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং সাথে সাথে তা কলকাতার সাহিত্যসমাজে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়। কবিতাটির আপাত বিষয়বস্তু ছিল জোছনা রাতে হরিণ শিকার। অনেকেই এই কবিতাটি পাঠ করে তা অশ্লীল হিসেবে চিহ্নিত করেন।তিনি তার বেকারত্ব, সংগ্রাম ও হতাশার এই সময়কালে বেশ কিছু ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছিলেন;- তবে তাঁর জীবদ্দশায় সেগুলো প্রকাশ করেননি। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একগুচ্ছ গীতিকবিতা রচনা করেন যা পরবর্তী কালে তাঁর রূপসী বাংলা কাব্যের প্রধান অংশ নির্মাণ করে। এ কবিতাগুলিও জীবনানন্দ প্রকাশ করেননি। ১৯৫৪-তে তাঁর মৃত্যুর পর কবিতাগুলো একত্র করে ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেন তাঁর বোন সুচরিতা দাশ।

১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে জীবনানন্দ তাঁর পুরনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে ফিরে যান, যা তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল।তিনি সেখানকার ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। সে সময়ে কলকাতায় বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং সমর সেন একটি আনকোরা নতুন কবিতাপত্রিকা বের করার তোড়জোড় করছিলেন, যার নাম দেয়া হয় কবিতা। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যাতেই জীবনানন্দের একটি কবিতা স্থান করে নেয়, যার নাম ছিল 'মৃত্যুর আগে'। কবিতাটি পাঠ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুদ্ধদেবকে লেখা একটি চিঠিতে কবিতাটিকে 'চিত্ররূপময়' বলে মন্তব্য করেন। কবিতা পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যাতে (পৌষ ১৩৪২ সংখ্যা; ডিসেম্বর ১৯৩৪/জানু ১৯৩৫) তাঁর কিংবদন্তিসম 'বনলতা সেন' কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এই ১৮ লাইনের কবিতাটি বর্তমানে বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতার অন্যতম হিসেবে বিবেচিত। পরের বছর জীবনানন্দের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ধূসর পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হয়। জীবনানন্দ এর মধ্যেই বরিশালে সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছিলেন।

১৯৩৬-এর নভেম্বরে তাঁর পুত্র সমরানন্দের জন্ম হয়। ১৯৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথ একটি কবিতা সংকলন সম্পাদনা করেন, যার নাম ছিল বাংলা কাব্য পরিচয় এবং এতে জীবনানন্দের 'মৃত্যুর আগে' কবিতাটি স্থান পায়।১৯৩৯ সালে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয় আবু সয়ীদ আইয়ুব ও হিরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়; এতে জীবনানন্দের চারটি কবিতা - পাখিরা, শকুন, বনলতা সেন এবং নগ্ন নির্জন হাত অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৪২ সালে কবির পিতৃবিয়োগ হয় এবং ঐ বছরেই তাঁর তৃতীয় কবিতাগ্রন্থ বনলতা সেন প্রকাশিত হয়। বইটি বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ভবন হতে 'এক পয়সায় একটি' সিরিজের অংশ হিসেবে প্রকাশিত হয় এবং এর পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ষোল। বুদ্ধদেব বসু ছিলেন জীবনানন্দের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক এবং তাঁর সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় জীবনানন্দের বহু কবিতা ছাপা হয়। ১৯৪৪ সালে তাঁর চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ মহাপৃথিবী প্রকাশিত হয়। এর আগের তিনটি কাব্যগ্রন্থ তাঁকে নিজের পয়সায় প্রকাশ করতে হয়েছিল, তবে মহাপৃথিবীর জন্যে তিনি প্রকাশক পান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে প্রকাশিত এই কবিতাগুচ্ছে যুদ্ধের ছাপ স্পষ্ট পরিলক্ষিত।

চাকরির প্রয়োজনে বরিশালে প্রত্যাবর্তন করলেও কলকাতা জীবনানন্দকে খুব টানতো। কলকাতার সুবিস্তৃত পরিসর তিনি উপভোগ করতেন। তিনি সর্বদাই কলকাতায় অভিবাসনের কথা ভাবতেন। সুযোগ পেলেই স্টিমারে বরিশাল থেকে খুলনা তারপর ট্রেনে বেনাপোল হয়ে কলকাতায় পাড়ি জমাতেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন প্রবল হয়ে ওঠে।কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলমানদের জন্যে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানান। এর ফলে বাংলা দ্বিখণ্ডিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে, কারণ এর পূর্ব অংশ ছিল মুসলমান সংখ্যাপ্রধান আর পশ্চিমাংশে হিন্দুরা ছিল সংখ্যাগুরু। ১৯৪৭ এর দেশভাগ পূর্ববর্তী ঐ সময়টিতে বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিভৎসরূপে দেখা দেয়।জীবনানন্দ সব সময়ই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সপক্ষে সোচ্চার ছিলেন। কলকাতায় যখন ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে আবার হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে কবি তখন লেখেন ১৯৪৬-৪৭ কবিতাটি।দেশবিভাগের কিছু আগে তিনি বি.এম. কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন।

ছুটি বাড়িয়ে কলকাতায় দীর্ঘ কয়েক মাস অবস্থান করেছেন। এর পর পূর্ববঙ্গে এসেছেন কিন্তু তা ছিল সাময়িক। ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের কিছু পূর্বে সপরিবারে বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেন এবং কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

কলকাতায় তিনি ''দৈনিক স্বরাজ'' পত্রিকার রোববারের সাহিত্য বিভাগের সম্পাদনা করেন। কিন্তু এই চাকুরির স্থায়ীত্ব ছিল ছিল মাত্র সাত মাস। কাজী নজরুল ইসলাম বিষয়ক একটি গদ্য রচনা মালিক পক্ষের মনঃপুত না-হওয়ায় তার এই চাকুরিচ্যূতি। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আরো দু'টি উপন্যাস লিখেছিলেন - ''মাল্যবান'' ও ''সুতীর্থ'', তবে আগেরগুলোর মতো এ দুটিও অপ্রকাশিত রেখেছেন।এ বছরের ডিসেম্বরে তার পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ সাতটি তারার তিমির প্রকাশিত হয়।একই মাসে কলকাতায় তার মাতা কুসুমকুমারী দাশের জীবনাবসান ঘটে।

ইতোমধ্যেই জীবনানন্দ কলকাতার সাহিত্যিক সমাজে নিজস্ব একটি অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন। তিনি 'সমকালীন সাহিত্যকেন্দ্র' নামে একটি সংস্থার সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন এবং এই সংস্থার মুখপত্র দ্বন্দ্ব পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক নিযুক্ত হন। মাঝে তিনি কিছুকাল খড়গপুর কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে তার জনপ্রিয় কবিতার বই বনলতা সেন সিগনেট প্রেস কর্তৃক বর্ধিত কলেবরে প্রকাশিত হয়। বইটি পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে এবং নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন-কর্তৃক ঘোষিত "রবীন্দ্র-স্মৃতি পুরস্কার" জয় করে। মৃত্যুর কিছু পূর্বে হাওড়া গার্লস কলেজ-এ অধ্যাপনার চাকুরি জুটে গেলে তার কলকাতা জীবনের অপরিসীম দৈন্যদশার একটা সুরাহা হয়।১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ শ্রেষ্ঠ কবিতা। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারত সরকারের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন তিনি।

অধ্যাপনার কাজে তার কর্মজীবনের সূচনা ও সমাপ্তি। এমএ পাসের পর কলকাতায় কলেজের বোর্ডিংয়ে থাকার প্রয়োজন হলে তিনি আইন পড়া শুরু করেন। এ সময় তিনি ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার ব্রাহ্মসমাজ পরিচালিত সিটি কলেজে টিউটর হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯২৮-এ সরস্বতী পূজা নিয়ে গোলযোগ শুরু হলে অন্যান্য কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে তাকেও ছাঁটাই করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। জীবনের শেষভাগে কিছুদিনের জন্য কলকাতার একটি দৈনিক পত্রিকা স্বরাজ-এর সাহিত্য বিভাগের সম্পাদনায় নিযুক্ত ছিলেন।

অধ্যাপনা করেছেন বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, যার মধ্যে আছে সিটি কলেজ, কলকাতা (১৯২২-১৯২৮), বাগেরহাট কলেজ, খুলনা (১৯২৯); রামযশ কলেজ, দিল্লী (১৯৩০-১৯৩১), ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল (১৯৩৫-১৯৪৮), খড়গপুর কলেজ (১৯৫১-১৯৫২), বড়িশা কলেজ (অধুনা 'বিবেকানন্দ কলেজ', কলকাতা) (১৯৫৩) এবং হাওড়া গার্লস কলেজ, কলকাতা (১৯৫৩-১৯৫৪) তার কর্মজীবন আদৌ মসৃণ ছিল না। চাকুরী তথা সুস্থির জীবিকার অভাব তাকে আমৃত্যু কষ্ট দিয়েছে।

একটি চাকুরির জন্য হন্যে হয়ে তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। স্ত্রী লাবণ্য দাশ স্কুলে শিক্ষকতা করে জীবিকার অভাব কিছুটা পুষিয়েছেন। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে অকাল মৃত্যুর সময় তিনি হাওড়া গার্লস কলেজ কর্মরত ছিলেন। দুই দফা দীর্ঘ বেকার জীবনে তিনি ইন্সুরেন্স কোম্পানীর এজেন্ট হিসাবে কাজ করেছেন এবং প্রধানত গৃহশিক্ষকতা করে সংসার চালিয়েছেন। এছাড়া ব্যবসায়ের চেষ্টাও করেছিলেন বছরখানেক। দারিদ্র্য এবং অনটন ছিল তার কর্মজীবনের ছায়াসঙ্গী।

জীবনানন্দ দাশ ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই মে (বঙ্গাব্দ ১৩৩৭, ২৬শে বৈশাখ) ঢাকার ব্রাক্ষ্মসমাজ মন্দিরে রোহিণীকুমার গুপ্তের কন্যা লাবণ্য গুপ্তকে বিয়ে করেন। তার কন্যা মঞ্জুশ্রী দাশ এবং পুত্র সমরানন্দ দাশ।

সম্ভবত মা কুসুমকুমারী দাশের প্রভাবেই ছেলেবেলায় পদ্য লিখতে শুরু করেন তিনি। ১৯১৯ সালে তার লেখা একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। এটিই তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা। কবিতাটির নাম বর্ষা আবাহন। এটি ব্রহ্মবাদী পত্রিকার ১৩২৬ সনের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। তখন তিনি শ্রী জীবনানন্দ দাশগুপ্ত নামে লিখতেন। ১৯২৭ সাল থেকে তিনি জীবনানন্দ দাশ নামে লিখতে শুরু করেন। ১৬ জুন ১৯২৫ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এর লোকান্তর হলে তিনি 'দেশবন্ধুর প্রয়াণে' শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলেন যা বংগবাণী পত্রিকার ১৩৩২ সনের শ্রাবণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।

তবে দীনেশরঞ্জন দাস সম্পাদিত কল্লোল পত্রিকায় ১৩৩২ (১৯২৬ খ্রি.) ফাল্গুন সংখ্যায় তার নীলিমা শীর্ষক কবিতাটি প্রকাশিত হলে আধুনিক বাংলা কবিতার ভুবনে তার অন্নপ্রাশন হয়। জীবদ্দশায় তার ৭টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। প্রথম প্রকাশিত ঝরাপালক শীর্ষক কাব্যগ্রন্থে তার প্রকৃত কবিত্বশক্তি ফুটে ওঠেনি, বরং এতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মোহিতলাল মজুমদার ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রকট প্রভাব প্রত্যক্ষ হয়। তবে দ্রুত তিনি স্বকীয়তা অর্জন করেছিলেন। দীর্ঘ ব্যবধানে প্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্য সংকলন ধূসর পাণ্ডুলিপি-তে তার স্বকীয় কাব্য কৌশল পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।বাংলা সাহিত্যের ভূবনে তার বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। শেষের দিককার কবিতায় অর্থনির্মলতার অভাব ছিল। সাতটি তারার তিমির প্রকাশিত হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দুবোর্ধ্যতার অভিযোগ ওঠে। নিজ কবিতার অবমূল্যায়ন নিয়ে জীবনানন্দ খুব ভাবিত ছিলেন।

তিনি নিজেই স্বীয় রচনার অর্থায়ন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন যদিও শেষাবধি তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে কবি নিজেই নিজ রচনার কড়া সমালোচক ছিলেন। তাই সাড়ে আট শত কবিতার বেশি কবিতা লিখলেও তিনি জীবদ্দশায় মাত্র ২৬২টি কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও কাব্যসংকলনে প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন। এমনকি রূপসী বাংলার সম্পূর্ণ প্রস্তুত পাণ্ডুলিপি ট্রাঙ্কে মজুদ থাকলেও তা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি জীবনানন্দ দাশ। তবে তিনি এ কাব্যগ্রন্থটির নাম দিয়েছিলেন বাংলার ত্রস্ত নীলিমা যা তার মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত এবং রূপসী বাংলা প্রচ্ছদনামে প্রকাশিত হয়। আরেকটি পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয় মৃত্যু পরবর্তীকালে যা বেলা অবেলা কালবেলা নামে প্রকাশিত হয়।

জীবদ্দশায় তার একমাত্র পরিচয় ছিল কবি। অর্থের প্রয়োজনে তিনি কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন ও প্রকাশ করেছিলেন। তবে নিভৃতে গল্প এবং উপন্যাস লিখেছিলেন প্রচুর যার একটিও প্রকাশের ব্যবস্থা নেননি। এছাড়া ষাট-পয়ষটিট্টিরও বেশি খাতায় "লিটেরেরী নোটস" লিখেছিলেন যার অধিকাংশ এখনও  প্রকাশিত হয়নি।

জীবদ্দশায় কথাসাহিত্যিক হিসাবে জীবনানন্দের কোনোও পরিচিতি ছিল না। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ অবধি প্রকশিত তার রচিত উপন্যাসের সংখ্যা ২১ এবং ছোটগল্পের সংখ্যা শতাধিক।তিনি সম্পূর্ণ নিভৃতে উপন্যাস-ছোটগল্প লিখেছিলেন এবং জীবদ্দশায় একটিও প্রকাশ করে যাননি।তার মৃত্যুর পর উপন্যাস-গল্পের পাণ্ডুলিপির খাতাগুলো আবিষ্কৃত হয়।কবিতায় যেমনি, কথাসাহিত্যেও তিনি তার পূর্বসূরীদের থেকে আলাদা, তার সমসাময়িকদের থেকেও তিনি সম্পূর্ণ আলাদা। তার গল্প-উপন্যাসে আত্মজৈবনিক উপাদানের ভিত লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তাই বলে এই রচনাগুলো আত্মজৈবনিক নয়। তার সর্বাধিক পরিচিত উপন্যাস মাল্যবান, তবে "মাল্যবান" তার বিরচিত প্রথম উপন্যাস নয়।

জীবনানন্দ দাশের প্রাবন্ধিক পরিচয় অদ্যাবধি বিশেষ কোন মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয় নি। তবে তিনি বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ-আলোচনা লিখেছিলেন যার প্রতিটি অত্যন্ত মৌলিক চিন্তা-ভাবনার স্বাক্ষর বহন করে। তার প্রবন্ধের সংকলন কবিতার কথা বেরিয়েছিল তার মৃত্যুর পর - ১৩৬২ তে । এতে তার জীবদ্দশায় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় মুদ্রিত পনেরটি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছিল।এই প্রবন্ধগুলি বহুল পঠিত । এই বিখ্যাত পনেরটি প্রবন্ধের বাইরেও জীবনানন্দের আরো কিছু প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সমালোচনা রয়েছে। এই রচনাসমষ্টির সংখ্যা খুব বেশি নয়। হিসেব করলে দেখা যায় তার সাহিত্য-সমাজ-শিক্ষা বিষয়ক রচনার সংখ্যা ৩০, গ্রন্থ'ভূমিকা ও গ্রন্থালোচনা জাতীয় রচনার সংখ্যা ৯, স্মৃতিতর্পণমূলক রচনার সংখ্যা ৩ এবং বিবিধ প্রবন্ধ-নিবন্ধের সংখ্যা ৭।তদুপরি আরো ৭টি খসড়া প্রবন্ধের হদিশ করা গেছে। বুদ্ধদেব বসু কবিতা পত্রিকার একটি প্রবন্ধ সংখ্যার (১৩৪৫, বৈশাখ) পরিকল্পনা করেছিলেন মূলত কবিদের গদ্য প্রকাশের উদ্দেশ্য নিয়ে। এরই সূত্রে জীবনানন্দ তার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন যার নাম ‘কবিতার কথা’।

প্রবন্ধটি শুরু করেন তিনি এভাবেঃ

“ সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি—কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা রয়েছে, এবং তাদের পশ্চাতে বিগত শতাব্দীর অভিজ্ঞতা এবং  সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্যবিকীরণ তাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না,যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয়। নানারকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়। ”

তার গদ্য ভাষারীতিও বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। প্রারম্ভিক বাক্যটি হ্রস্ব হলেও অব্যবহিত পরেই তিনি দীর্ঘ বাক্যের ঘন বুনোট গড়ে তুলেছেন। ‘এবং, ‘ও’ ইত্যাদি অন্বয়মূলক পদ এবং ’কমা’, ‘সেমিকোলন‘, ‘ড্যাশ‘ প্রভৃতি যতিচিহ্নের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এমন একটি গদ্যভাষা যার সঙ্গে সমকালীন বাঙালি লেখক-পাঠকের আদৌ পরিচয় ছিল না। বস্তুত তার প্রবন্ধগুলোর বাক্য গঠনরীতি সমসাময়িককালে সুপরিচিত ছিল না। এমনকী মনোযোগী পাঠকের কাছেও তা জটিল প্রতীয়মান হতে পারে। জীবনানন্দের অধিকাংশ গদ্য রচনাই ফরমায়েশী। সাহিত্য, শিক্ষা, সমাজ, এই তিনটি পরিক্ষেত্রে জীবনানন্দ প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলো লিখেছেন।

তার বিশিষ্ট প্রবন্ধগুলোর শিরোনাম এরকম - ‘কবিতার কথা’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা কবিতা’, ‘মাত্রাচেতনা’, ‘উত্তররৈবিক বাংলা কাব্য’, ‘কবিতার আত্মা ও শরীর’, ‘কি হিসাবে কবিতা শ্বাশত’, ‘কবিতাপাঠ’, ‘দেশকাল ও কবিতা’, ‘সত্যবিশ্বাস ও কবিতা’, ‘রুচি, বিচার ও অন্যান্য কথা’, ‘কবিতার আলোচনা’, ‘আধুনিক কবিতা’, ‘বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ’, ‘কেন লিখি’, ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘শরৎচন্দ্র’, ‘কঙ্কাবতী ও অন্যান্য কবিতা’, ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’, ‘পৃথিবী ও সময়’, ‘যুক্তি, জিজ্ঞাসা ও বাঙালি’, 'অর্থনৈতিক দিক’, ‘শিক্ষা ও ইংরেজি’, ‘শিক্ষা-দীক্ষা-শিক্ষকতা’, ‘শিক্ষার কথা’, ‘শিক্ষা সাহিত্যে ইংরেজি’ এবং ‘শিক্ষা-দীক্ষা’। বলা যায় যে সাহিত্য, বিশেষ ক’রে কবিতা নিয়ে জীবনানন্দ বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ উপহার দিয়েছেন। প্রতিটি রচনাই বহুমাত্রিক মৌলিক চিন্তাসূত্রের স্বাক্ষর বহন করে।

জীবদ্দশায় অসাধারণ কবি হিসেবে পরিচিতি থাকলেও তিনি খ্যাতি অর্জন করে উঠতে পারেননি। এর জন্য তার প্রচারবিমুখতাও দায়ী; তিনি ছিলেন বিবরবাসী মানুষ। তবে মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই তিনি বাংলা ভাষায় আধুনিক কবিতার পথিকৃতদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। জীবনানন্দ দাশের জীবন এবং কবিতার উপর প্রচুর গ্রন্থ লেখা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, বাংলা ভাষায়।

এর বাইরে ইংরেজিতে তার ওপর লিখেছেন ক্লিনটন বি সিলি, আ পোয়েট আপার্ট নামের একটি গ্রন্থে।ইংরেজি ছাড়াও ফরাসিসহ কয়েকটি ইউরোপীয় ভাষায় তার কবিতা অনূদিত হয়েছে। তিনি যদিও কবি হিসেবেই সমধিক পরিচিত কিন্তু মৃত্যুর পর থেকে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দ অবধি তার যে বিপুল পাণ্ডুলিপিরাশি উদ্ঘাটিত হয়েছে তার মধ্যে উপন্যাসের সংখ্যা ১৪ এবং গল্পের সংখ্যা শতাধিক।

১৪ই অক্টোবর, ১৯৫৪ তারিখে কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় তিনি আহত হন। ট্রামের ক্যাচারে আটকে তার শরীর দলিত হয়ে গিয়েছিল। ভেঙ্গে গিয়েছিল কণ্ঠা, ঊরু এবং পাঁজরের হাড়।

গুরুতরভাবে আহত জীবনানন্দের চিৎকার শুনে ছুটে এসে নিকটস্থ চায়ের দোকানের মালিক চূণীলাল এবং অন্যান্যরা তাকে উদ্ধার করে। তাকে ভর্তি করা হয় শম্ভূনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। এ সময় ডাঃ ভূমেন্দ্র গুহ-সহ অনেক তরুণ কবি জীবনানন্দের সুচিকিৎসার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। কবি-সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাস এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার অনুরোধেই পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় কবিকে দেখতে এসেছিলেন এবং আহত কবির সুচিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছিলেন যদিও এতে চিকিৎসার তেমন উন্নতি কিছু হয়নি।

তবে জীবনানন্দের অবস্থা ক্রমশ জটিল হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন কবি। চিকিৎসক ও সেবিকাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ২২শে অক্টোবর, ১৯৫৪ তারিখে রাত্রি ১১টা ৩৫ মিনিটে কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। গবেষক ও কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ-সহ কেউ কেউ ধারণা করেছেন হয় আত্মহত্যা স্পৃহা ছিল দুর্ঘটনার মূল। জীবনানন্দ গবেষক ডাঃ ভূমেন্দ্র গুহ মনে করেন জাগতিক নিঃসহায়তা কবিকে মানসিকভাবে কাবু করেছিল এবং তার জীবনস্পৃহা শূন্য করে দিয়েছিল। মৃত্যুচিন্তা কবির মাথায় দানা বেঁধেছিল। তিনি প্রায়ই ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা ভাবতেন। গত এক শত বৎসরে ট্রাম দুর্ঘটনায় কোলকাতায় মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র একটি। তিনি আর কেউ নন, কবি জীবনানন্দ দাশ। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীর মতে এ সময় দুই হাতে দুই থোকা ডাব নিয়ে ট্রাম লাইন পার হচ্ছিলেন কবি। আত্মহননের সিদ্ধান্ত নিয়ে দুই হাতে দুই থোকা ডাব নিয়ে গৃহে ফেরার সড়কে ওঠার জন্য ট্রাম লাইন পাড়ি দেওয়া খুব গ্রহণযোগ্য যুক্তি নয়!

জীবনানন্দের কাব্যগ্রন্থসমূহের প্রকাশকাল সম্পর্কে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের একাধিক পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল।নিচে কেবল প্রথম প্রকাশনার বৎসর উল্লিখিত। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালক প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে। এর দীর্ঘ কাল পর ১৯৩৬-এ প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ধূসর পাণ্ডুলিপি। ইত্যবসরে কবির মনোজগতে যেমন পরিবর্তন হয়েছে তেমনি রচনাকৌশলও অর্জন করেছে সংহতি এবং পরিপক্বতা।তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ বনলতা সেন প্রকাশিত হয় ১৯৪২-এ। এটি "কবিতাভবন সংস্করণ" নামে অভিহিত। সিগনেট প্রেস বনলতা সেন প্রকাশ করে ১৯৫২-তে।বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের কবিতাসমূহ সহ পরবর্তী কবিতাগ্রন্থ মহাপৃথিবী ১৯৪৪-এ প্রকাশিত।জীবনানন্দর জীবদ্দশায় সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮)। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর কিছু আগে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা।

কবির মৃত্যু-পরবর্তী প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ হলো ১৯৫৭-তে প্রকাশিত রূপসী বাংলা এবং ১৯৬১-তে প্রকাশিত বেলা অবেলা কালবেলা। জীবনানন্দ দাশ রূপসী বাংলা'র পাণ্ডুলিপি তৈরি করে থাকলেও জীবদ্দশায় এর প্রকাশের উদ্যোগ নেন নি। তিনি গ্রন্থটির প্রচ্ছদ নাম নির্ধারণ করেছিলেন বাংলার ত্রস্ত নীলিমা। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশকালে এর নামকরণ করা হয় "রূপসী বাংলা।" তার অগ্রন্থিত কবিতাবলি নিয়ে প্রকাশিত কবিতা সংকলনগুলো হলো: সুদর্শনা (১৯৭৩), আলো পৃথিবী (১৯৮১), মনোবিহঙ্গম, হে প্রেম, তোমারে ভেবে ভেবে (১৯৯৮), অপ্রকাশিত একান্ন (১৯৯৯) এবং আবছায়া (২০০৪)।

কবির প্রকাশিত-অপ্রকাশিত গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত সকল কবিতার আঁকড় দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত জীবনানন্দ দাশের কাব্যসংগ্রহ সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে। অব্যবহিত পরে গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত সকল কবিতার পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে আবদুল মান্নান সৈয়দের উদ্যোগে। পরবর্তী কালে আবিষ্কৃত আরো কবিতা অন্তর্ভুক্ত করে ক্ষেত্র গুপ্ত ২০০১-এ প্রকাশ করেন জীবনানন্দ দাশের কাব্য সমগ্র। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে ভূমেন্দ্র গুহ প্রতিক্ষণ প্রকাশনী থেকে প্রকাশ করেন জীবনানন্দ দাশের প্রকাশিত-অপ্রকাশিত-গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত সকল কবিতার আঁকড় গ্রন্থ পাণ্ডুলিপির কবিতা (১৪ খন্ড)।

জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত হয় অজস্র গল্প ও উপন্যাস। এগুলোর প্রথম সংকলন জীবনানন্দ দাশের গল্প (১৯৭২, সম্পাদনা : সুকুমার ঘোষ ও সুবিনয় মুস্তাফী। বেশ কিছুকাল পর প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ গল্প ১৯৮৯, সম্পাদনা : আবদুল মান্নান সৈয়দ।

প্রকাশিত ১৪টি উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য  হলো উপন্যাস : মাল্যবান (১৯৭৩), সুতীর্থ (১৯৭৭), চারজন (২০০৪ : সম্পাদক : ভূমেন্দ্র গুহ ও ফয়সাল শাহরিয়ার।)

মূলত কবি হলেও সাহিত্যের অধ্যাপক কবি জীবনানন্দ দাশ জীবৎকালে কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছিলেন। এগুলো প্রকাশিত হয় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।এর একটি অংশ নিয়ে কবিতার কথা প্রবন্ধগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে। বাকি প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলো দীর্ঘকাল অপ্রকাশিত থেকে যায়। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম জীবনানন্দের প্রকাশিত-অপ্রকাশিত-গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত সকল প্রবন্ধ এক মলাটে আবদ্ধ করে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধ সমগ্র। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে জীবনানন্দ দাশের জন্ম শতবর্ষে আরো কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ আবিষ্কৃত হলে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের অগ্রন্থিত প্রবন্ধ সমগ্র।

দীপেনকুমার রায়-এর উদ্যোগে ও সম্পাদনায় জীবনানন্দ দাশের পত্রাবলী প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩৮৫ সনে। পরবর্তী কালে আবদুল মান্নান সৈয়দ জীবনানন্দ দাশের পত্রাবলী প্রকাশ করেন ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে। ১০১টি চিঠির সংকলন জীবনানন্দ দাশের চিঠিপত্র প্রকাশিত হয়।

১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বাঁধানো এক্সারসাইজ খাতায় ধারাবাহিকভাবে কিছু টুকরো-টাকরা কথা, টীকা-টিপ্পনী লিখতে শুরু করেছিলেন যা তিনি লিট্যারেরি নোটস নামে চিহ্নিত করেছিলেন।৫৬টি বাঁধানো এক্সারসাইজ খাতায় লেখা, তারিখ ধরে লেখা। উদ্ধারকৃত পাণ্ডুলিপি সমগ্র কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত থাকলেও দিনলিপির খাতাগুলো জীবনানন্দ-গবেষক ভূমেন্দ্র গুহের কাছে সংরক্ষিত ছিল ভূমেন্দ্রের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। লিট্যারেরি নোটস-এর খাতাগুলোর পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪,২৭২ এবং শব্দ সংখ্যা প্রায় ৬,৬২,১৬০।

দিনলিপি প্রায় ধাঁধার মতো, পাঠোদ্ধারের প্রধান সমস্যা হল প্রায়শ ক্ষুদ্রায়তন অনুচ্ছেদে অসম্পূর্ণ বাক্যে লেখা, কখনও ব্যবহার করেছেন সংকেত।

নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে পরিবর্ধিত সিগনেট সংস্করণ বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থটি বাংলা ১৩৫৯-এর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ বিবেচনায় পুরস্কৃত করা হয়। কবির মৃত্যুর পর ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৪) সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার লাভ করে।

 

তথ্যসূত্রঃ

ইসলাম, সিরাজুল, সম্পাদক (২০১২)। "দাশ, জীবনানন্দ"। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (দ্বিতীয় সংস্করণ)। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি।

সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত। (ফেব্রুয়ারি ২০১৮)। জীবনানন্দ দাশ। জীবনী গ্রন্থমালা। ঢাকা: কথাপ্রকাশ। পৃষ্ঠা ৭। আমৃত্যু নির্জন মৃত্যুর পরে অল্প সময়ের মধ্যে সমকালীন বাংলা কবিতার অন্যতম জনপ্রিয় কবিতে পরিণত হন জীবনানন্দ দাশ।

প্রবন্ধ "বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি"

সৈয়দ, আবদুল মান্নান (২ বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামের পর শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ।নতুন প্রজন্ম জীবনানন্দ দাশকে ভুলতে বসেছে।জীবনানন্দের প্রকৃতি প্রেম ও দর্শন নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। বাড়াতে হবে জীবনানন্দচর্চা।এমন অভিমত পোষণ রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য পবিত্র

কোন পরিস্থিতিতে বা কোন্‌ কারণে বাধ্য হয়ে জীবনানন্দ পিতৃভূমি ত্যাগ করে দেশান্তরী হয়েছিলেন তার ইঙ্গিত তাঁর কোন জীবনী গ্রন্থে নেই।জীবনানন্দের কোন রচনায় এ প্রসঙ্গের উল্লেখও নেই।তবে অচ্যিন্তকুমার সেনকে লেখা একটি চিঠি থেকে দেখা যায় তিনি ১৯৪৭-এর জুলাই মাসে বরিশালেই অবস্থান করছিলেন।

প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কবিতাসমগ্র (জীবনানন্দ দাশ), পরিশেষ ১, ৩: সংসারজীবন, সম্পাদনা: আবদুল মান্নান সৈয়দ, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪, অবসর প্রকাশনা সংস্থা।

ক্লিনটন বি সিলি লিখিত আ পোয়েট আপার্ট

স্মরণ করা যেতে পারে যে শনিবারের চিঠি-র সম্পাদক সজনীকান্ত দাশ দীর্ঘকাল বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে জীবনানন্দের সমালোচনায় মেতেছিলেন।

 

জালাল উদ্দিন লস্কর শাহীন
শিক্ষক, উপজেলা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়
মাধবপুর, হবিগঞ্জ, বাংলাদেশ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top