সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্ন যেথায় তলিয়ে গেল : ইশতিয়াক রুপু


প্রকাশিত:
২০ অক্টোবর ২০২০ ২১:১৫

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ২২:৩৯

 

সান মার্টিন। ল্যাটিন আমেরিকার দেশ এল সালভেদরের রাজধানী সান সালভেদরের উপকণ্ঠে গড়ে উঠা এক শহরের নাম। চানচুওয়াও নদীর তীরে গড়ে উঠা শহরে রোজা রামিরেজ নাম এক চল্লিশ বছর বয়সী মা প্রতিদিন অপেক্ষা করতো ছেলে ওস্কার আলবার্টো মার্টিনেজের জন্য। শহরে হাতে গোনা দু তিনটি কারখানার একটিতে ট্রাকের বডি তৈরীর কাজ শুরু করে বছর চারেক আগে। মাসে মাইনে মাত্র ২৪০ ডলার। বাবা জেরেমি মার্টিনেজের ছিলো মাছ ধরার নৌকা। ভোরে নৌকা নিয়ে চলে যেত সাগরে মাছ ধরতে। ফিরতো দিনের শেষে। রোজা ছোট্ট শহরের প্রধান সড়কের একপাশে খোলা গাড়িতে সাজিয়ে রাখতো শাক সবজি। পাশে নানা ফলের ছোট্ট ভান্ডার। বেচা বিক্রি ভালই হতো। বেলা পড়ে যাওয়ার পূর্বে খোলা গাড়ি পথের পাশে গুছিয়ে রেখে দৌড়ে চলে আসতো সাগর পারের ফিস জেটিতে। জেরেমি ফিরতো হাসতে হাসতে নৌকা ভর্তি সামুদ্রিক মাছ নিয়ে। গোল্ডেন মারমেইড নামের ফিস বোটের সামনের ডেকে দাড়ানো লম্বা চুল আর পেটা শরীরের জেরেমির মুখে জ্বলতো হাভানা সিগার আর হৃদয়ে খেলা করতো যুবতী রোজা রামিরেজ কে নিয়ে বুনো ভালোবাসার স্বপ্ন। জেরেমিকে সামলিয়ে দ্রুত ফিরে আসতো সড়কের পাশে। সেই ভালোবাসার মানুষ অন্য কয়টি স্বাভাবিক দিনের মত শান্ত সাগরে গেলো ভোরের আলো ফুটার খানিক আগে। সঙ্গের অন্যান্য সাথী বোট গুলি ফিরলেও, শুধু ফিরলো না জেরেমি ও তার ছোট বেলার বন্ধু মিগেল। একমাত্র ছেলে ওস্কারের বয়স তখন কুড়ি। ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী এক বছর পর সাগর পারে অনুষ্ঠিত হলো হারিয়ে যাওয়া জেরেমির শেষ কৃত্য।

 

প্রিয়তম স্বামীর হারিয়ে যাবার দিন সাগর তীরে সারাদিন কাটিয়ে দেয় স্বামীর অকৃথিম ভালোবাসাকে স্মরণ করে। সে বছর ২১ বছর বয়সের ছেলে ওস্কার আলবার্টো মার্টিনেজ রামিরেজের সহপাঠি এবং প্রেমিকা তানিয়া ভেনেসা আভলস কে ঘরে তুলে নিলো ছেলের বৌ করে। শান্ত স্বভাবের মিষ্টি মেয়ে তানিয়া সপ্তাহে দু'দিন স্থানীয় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে কাজ করে সুন্দর করে সামলে নিতো তিন জনের সংসারকে। ছোট্ট সংসার আর ছোট্ট থাকলো না। বিয়ের পর পর পালা করে তানিয়ার সংসার আলো করে পরিবারে যোগ দিলেন দুজন রাজকুমারী। দাদীর ভাষায় প্রথমে আসা এঞ্জী ভ্যালেরিয়া ছিলো অনেক সুখি আর বুদ্ধিমতি। যে কিনা মাত্র ২৩ মাস বয়সেই হারিয়ে গেলো রিও দ্যা গ্রান্ডে নদীর সর্বনাশা জলের তোড়ে। পরের বছর এলেন আরেক রাজকুমারী। সংসার যত বড় হতে লাগলো ওস্কারের কপালে চিন্তার ভাঁজ পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগলো সমানে। তানিয়া আরো দুটো দিন কাজ করতে চাইলে ওস্কার রাজী হলো না। স্ত্রী কে বলতো তুমি আমার মেয়েদের সময় দাও। আমি অন্য কিছু ভাবছি। বলবো তোমাকে একদিন। প্রায়শঃ মালিকের সঙ্গে বেতন নিয়ে দেন দরবার চলতো। মালিক শুনিয়ে দেয় কতো হিসাব আর নানা তত্ত্বকথা। ওস্কার এসবের কি বুঝে? এল সালভেদর নাকি এখন নতুন নিয়মে চলবে। যার একটি পুরানো মুদ্রা কলনসের বদলে যাওয়া। দেশের পুরাতন মুদ্রা কলনস কে আমেরিকান ডলারে রুপান্তর করে দেশের সব মুদ্রা এখন ডলার নামে চলে। এদিকে কম দামী মোবাইল ফোনে সদা উৎকন্ঠিত মা ছেলেকে ফোন দিচ্ছেন বারবার। বেলা থাকতে ঘরে ফেরার কথা মনে করিয়ে দেন।

 

ছেলে বিরক্ত হয়ে ধমকের সুরে বলে, বার বার ফোন করো না তো। ক্রুদ্ধ স্বরে মাকে বলে, কতবার বলেছি কাজের সময় ফোন করো না। ফ্যাক্টরীতে ফোন ব্যবহার নিষেধ। ফোরম্যানের চোখে পড়লে চাকুরী চলে যাবে। ছেলের ধমকে মা থেমে যায় কিন্তু মায়ের মন থেকে দুই মাস আগের ঘটনা মুছে না। কারখানা থেকে ওস্কার বাড়ি ফিরতো যে পথ ধরে। সে পথেই পড়তো কুখ্যাত গ্যাং মারাসের আড্ডা। ওদের সঙ্গে কখনো মিত্র, কখনো শত্রু এমন আরেক দলের নাম, ডেথ স্কোয়াড। যাদের চরম নৃশংসতার গল্প পুরো দেশ জানে। মারাসের নিয়ন্ত্রনে দেশের পুরো পরিবহন ব্যবস্থা। সরকারী বেসরকারি সব ধরনের পরিবহন মারাসের কথা মত চলে। আর দু'দলের যৌথ ব্যবস্থাপনায় চলতো মাদকের রমরমা ব্যবসা। সাথে নিত্য দিনের খুন খারাবি আর প্রতিপক্ষকে গুম করার ঘটনা। সরকার কখনো কঠোর হলে ওরা দল বেঁধে সটকে পড়তো। ফের কয়দিন পর এসে শুরু করতো সব বেআইনী কাজ। ওদের কে শহরে সবাই যমের মত ভয় পেত। এদিক সেদিক হওয়ার জো নেই। কথা না শুনলে শহরে বাস করা কঠিন। যখন ইচ্ছে তখন শহরের উপকন্ঠে গড়ে উঠা কারখানার বাস থামিয়ে কর্মচারীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলতো ইচ্ছে মত।

 

দু'মাস আগের ঘটনা। বেতন পেয়ে খুশি মনে বাড়ি ফিরতে কারখানার গাড়িতে উঠলো ওস্কার। বাড়ির সামনে নেমে যাবার আগেই বাস থামালো ডেথ স্কোয়াড গ্যাং এর লোকজন। একজনের হাতে ছোট্ট হ্যান্ড মাইক। তার সঙ্গে উঠলো আরে চারজন অস্ত্রধারী যুবক। যুবক চারজনের মুখ লাল কাপড় দিয়ে বাঁধা। মাইক হাতে লোকটি বাসের ড্রাইবারের পাশে দাড়ালো। তার মুখ পুরোটাই খোলা। ‘বুয়েনস তারদেছ’ মানে শুভ অপরাহ্ন বলে শুরু করে করলো সে, বাসে বসা সকল কে ১০০ কলনস মানে ২৫ ইউ এস ডলার চাঁদা দিতে হবে ওদের এক নিহত সঙ্গীর শেষকৃত্যের জন্য। ঘোষনা শুনে সবার মুখ ভয়ে আর অপমানে শুকিয়ে গেলো। সারা মাস অমানুষিক পরিশ্রম করে পাওয়া বেতনের দশ ভাগের এক ভাগ ওদের দিয়ে দিতে হবে। মগের মুল্লুক নাকি? এদিকে ওস্কারের মা অপেক্ষা করছে বেতনের ডলার দিয়ে গ্রোসারির শপিং করবে।ভেজিটেবল,পাস্তা, মসলা সহ আরো কত কিছু কেনার বাকি। সারা মাস তো ওদের এই ডলার খরছ করেই চলতে হবে। গত রাতে মা বলেছে বেতন পেলে পুষ্ট ষাঁড়ের হাড়ের মাংস কিনে ওস্কারের জন্য সুস্বাদ্য স্টু বানাবে। কত দিন মায়ের হাতের বানানো স্টু খায় না। অথচ জল্লাদরা এসেছে কার না কার শেষ কৃত্য করবে, তাই ওস্কারকেও চাঁদা দিতে হবে।

 

না, সে দিবে না। বলতে না বলতে দুজন মুখ ঢাকা লোক তার পাশে এসে দাড়ালো। দুজনের হাতে ধরা লাল রঙের স্কার্ফ। একজন ইশারা করছে স্কার্ফে ডলার ফেলতে। ওস্কার স্পেনিশ ভাষায় জিজ্ঞেস করলো ‘পরকে’ মানে কেনো? তা শুনে মাইক হাতে লোকটি বিশ্রী একটি গাল দিয়ে বলছে, তুই শুনিস নি এতক্ষন? আমি কি বলেছি! বলেই বাসের নিচে দাঁড়ানো দুজনকে ডেকে বলছে, বেজন্মার বাচ্চাকে নিচে নামা। তার প্রশ্নের উত্তর একটু সময় নিয়ে এমন ভাবে দেবো। যেনো আর কখনো প্রশ্ন করতে সাহস না পায়। ডেথ স্কোয়াডের লোকজনের রুদ্র মুর্তি দেখে বাকিরা ভয়ে গুটিয়ে গেলো। কেউ কেউ আবার ওস্কার কে ধমকাচ্ছে অনেক। দল নেতা আবার ওস্কার কে জিজ্ঞেস করলো

‘কিয়েরেস প্রবলেমাস’ মানে তুমি কি ঝামেলা করতে চাও? ওস্কার হ্যাঁ না বলার পূর্বেই তার উপর ঝাপিয়ে পড়লো হায়েনার দল। বেদম মারপিট করে জোর করে নিচে নামিয়ে নিয়ে যেতে চায় ওরা। ঠিক সেই সময় বাদবাকি শ্রমিকরা এক যোগে চিৎকার শুরু করলে হঠাৎ কি মনে করে দলবেধে নেমে ওরা নিমিষে হাওয়া হয়ে যায়। যেতে যেতে বলতে থাকে 'নস ভেঙ্গারেমস’ মানে আমরা এর বদলা নেবই নেবো।

 

খানিক পর মারাত্মক আহত ওস্কার কে নিয়ে কয়জন শ্রমিক হাজির হলো ছেলের জন্য প্রতিদিন উৎকন্ঠায়

থাকা মায়ের কাছে। একমাত্র ছেলের রক্তাক্ত চেহেরা দেখে মা রোজা রামিরেজের বুক ফাটা কান্না আর আর্তনাদ শুনে জড়ো হওয়া প্রতিবেশিদের চোখ অশ্রু সজল করে দেয়। সঙ্গে ছিলো প্রিয়তমা স্ত্রী তানিয়ার আহাজারি। মা রোজা আর স্ত্রী তানিয়া পুলিশের কাছে গেল অভিযোগ করতে। থানায় যেয়ে জানলো, অভিযোগ করতে হলে স্থানীয় মেয়রের অনুমতি নিতে হবে। সান মার্টিন মিউনিসিপালিটির মেয়র ভিক্টর ম্যানুয়েল রিভেরা অনেক দুঃখ প্রকাশ করে ওস্কারের জন্য ঔষধ পত্র সহ খাদ্য সামগ্রী তানিয়ার হাতে তুলে দিয়ে এই ঘটনার তদন্তের আশ্বাস দিলো বার বার। তার মানে এ অন্যায়ের কোন বিচার হবে না। মেয়রও মনে মনে গ্যাংদের ভয় পায়। তিনি তাদের ঘাটাতে সাহস করছেন না। এ যেন বিচারের বাণী নিরবে কাঁদে সান মার্টিনের খোলা রাজপথে। সব শুনে ওস্কার ভীষন মুষড়ে পড়লো। কাজ থেকে তাগিদ এলো আবার কাজ শুরুর।

 

মা জিজ্ঞেস করলো বার কয়েক। কারো কথায় উত্তর না দিয়ে সারাক্ষন কি যেন ভাবতে থাকে ওস্কার। তানিয়া ফ্যাক্টরির কাজ ছাড়াও স্থানীয় মলে চাইনিজ ফাস্ট ফুডের দোকানে শুরু করল। শহরে কতই না কথা উড়ে বেড়ায়। ওস্কার যেমন শুনে তেমনি তানিয়াও। প্রতিদিন কেউ না কেউ ছোট্ট শহর সান মার্টিন ছেড়ে আমেরিকা চলে যাচ্ছে। সবাই হতাশ হয়ে বলে, কি করবো এখানে? ভাল কাজ নেই, প্রতিনিয়ত দারিদ্রতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। সন্তানদের ভবিষৎ নেই। এ ভাবে আর কত? উনষাট বছরের হামবার্তো আনড্রে টরেস নামের প্রতিবেশীও বলছে এই শহরে থেকে কেউ আমেরিকান স্বপ্নের ধারে কাছেও যেতে পারবে না। তাকে আমেরিকা যেতেই হবে। এরপর সত্যি এক রবিরার ওস্কারের মাথায় চেপে বসলো দূরে দূরে অনেক দূরে ১৬৫৮ মাইল উত্তরের দেশ আমেরিকা চলে যাবার সিদ্ধান্ত। মা রোজা রামিরেজ তখনো ঈশ্বরের কাছে বার বার প্রার্থনা করছে একমাত্র পুত্র ওস্কার যেনো তার সিদ্ধান্ত বদল করে। ছেলের পছন্দের বিফ স্টু তৈরী করে রবিবারের মধ্যাহ্নের আহারে। ভ্যালেরিয়া ও তার ছোট বোন সহ সবাইকে নিয়ে ওটাই ছিলো পরিবারের শেষ আহার।

 

পরদিন রোজা রামিরেজ যেদিন রাতের শিফটে কাজে গেলো সে রাতে ছেলে ওস্কার বাড়ি ছেড়ে রওয়ানা হলো স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় সোনার হরিন ধরবে বলে। ভোরে বাড়ি ফিরে রোজা দেখলো পুরো বাড়ি শুন্য। কোথাও কেউ নেই। বারান্দায় মন খারাপ করে শুয়ে আছে পোষা কুকুর জেসি। ওস্কার চলে গেছে। সাথে নিয়ে গেছে স্ত্রী তানিয়া আর দুটো ফুটফুটে কণ্যাদের। যাদের একজনের বয়স ২২ মাস অন্যজনের মাত্র ৯ মাস। মা রোজা রামিজের মনে পড়ছে, সে জিজ্ঞেস করতো ছেলেকে সেও কি ভাবছে উত্তরের সর্বনাশা ডাকের সাড়া দিবে বলে। ছেলে কোন উত্তর না দিয়ে চুপ থাকতো। কখনো হতাশ হয়ে বলতো কি হবে মা এই নরকে থেকে। এর চেয়ে অনেক ভাল হবে যদি আমেরিকা চলে যাই। শুধু এই পর্যন্ত। আর কিছুই বলেনি ছেলেটি। ভোরের আলো ফুটে উঠার আগেই পাশের দেশ গুয়েতামালার সীমান্ত শহরমুখী লরি তে চেপে বসলো। শৈশব আর কৈশোরের দুরন্ত সময় কাটানো শহর সান মার্টিনের সন্তান ওস্কার আলবার্টো মার্টিনেজ রামিরেজ। অনেক দূরের পথ। কষ্টের পথ।কখনো রেলে নয়তো লরিতে চড়ে চেপে ওস্কার চলছে বহুদিন ধরে দেখা সুখের জীবন রুপী সোনার হরিনের কাছাকাছি পৌঁছতে। বেশির ভাগ সময় মাইলের পর মাইল হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়েছে বড় নগর, শহর আর মাইলের পর মাইল গ্রামীন জনপদ। পদে পদে কতই না বাঁধা বিপত্তি। চোখের সামনে দুধের সন্তানের দুঃখ আর কষ্ট দেখে কখনো মনে হয়েছে ফিরে যাবে আবার মায়ের কোলে। সাগর পাড়ের শান্ত শহর সান মার্টিনে।

 

কিন্তু তা যে আর হয় না। কষ্টের জীবন অনিশ্চিত ভবিষৎ তার উপর গ্যাং সদস্যের অমানুষিক মানসিক আর শারিরিক অত্যাচার সইতে হবে আবার। না আর ফিরে যাবে না সেই ফেলে আসা অভিশপ্ত জীবনে। এক এক করে নিজ শহর ও দেশ ছেড়ে গুয়েতামালা হয়ে মেস্কিকো সিটি। শহরের এক প্রান্তে বড় একটি স্টেডিয়ামে আশ্রয় নিয়ে মানবতের অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে বিশাল একটি অভিবাসীর দল। মেস্কিকো গুয়েতামালার সীমান্ত শহর ভারাক্রুজ রাজ্যের গুয়াডুলোপে শহর থেকে ছেড়ে যাওয়া মালবাহী রেলের উপর চড়ে বসে হাজার হাজার অভিবাসী আমেরিকা যাবে বলে। যাদের মধ্যে আছে এল সালভেদরের ওস্কার ও তানিয়া সঙ্গে দুটো দুধের সন্তান। কতই না নির্মম। মেস্কিকো সরকার মানবিক কারনে প্রবেশে অনুমতি দেয়। শত শত মানবিক সংস্থাসহ অসংখ্য চার্চের ব্যবস্থাপনায় দারিদ্রতার যাতাকলে পিষ্ট হওয়া হাজার হাজার দেশ ছেড়ে আসা অভিবাসীদের জন্য করা হয় ন্যূনতম খাবার ও পানীয় এর আয়োজন। শরীর আর মানছে না। হতাশা আর স্বপ্ন পূরনের আশা এই দুয়ের মাঝে সব বিবর্ন হয়ে উঠে কোন বেলা। মা রোজার মুখটি মনে পড়ে। কখনো সে যেনো শুনতে পায় মা বলছে আমার একটি মাত্র সন্তান তুই। মা জানতে চাইতো কেমনে আছে ওস্কার। কন্ঠে হতাশ নিয়ে সে বলতো, আমি ভালো আছি, আমি ভাল আছি। অথচ সে ছিলো শংকিত, বিষন্ন আর সন্তানের ভবিষৎ নিয়ে সদা চিন্তিত। যার ফলশ্রুতিতে সে আজ হাজারো অভিবাসীর দলে যোগ দিয়েছে, যাদের লক্ষ্য মেস্কিকোর উত্তর পশ্চিমাঞ্চল রাজ্য টামালুইপাসের সীমান্ত শহর মেটামরস। আমেরিকার কলোরাডোর পাহাড় আর পর্বত মালায় জন্ম নেয়া যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ নদী রিও দা গ্রান্ডের দক্ষিন পারের এই শহরটি টেক্সাসের ব্রাউন্সভিল শহরের ঠিক বিপরীতে।

 

দেশ ভাগ করা খরস্রোতা নদী রিও দা গ্রান্ডে নদী পেরিয়ে সুখ প্রত্যাশী লক্ষ লক্ষ হাজারো ল্যাটিন আমেরিকান স্পর্শ করতে চায় আমেরিকার মাটি। ওস্কারের নিজের ছিলো অন্য পরিকল্পনা। পাশের মেস্কিকোর এল পাসো শহরকে সংযুক্ত করেছে দু দেশের সীমান্ত সেতু। তা বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী অভিবাসন কর্তৃপক্ষ। স্বপ্ন পূরনের শেষ ধাপে ব্যর্থতা মেনে নিতে চায়নি ওস্কার। স্ত্রীকে সাথে নিয়ে এসে দাঁড়ায় রিও নদীর উত্তর তীরে। নদী পেরুলেই আমেরিকা। নিজের সুখ আর নিরাপত্তার সঙ্গে দুটো অবুঝ সন্তানের উজ্জল ভবিষৎ। কান পাতলে শুনা যায় সুখপাখির সুললিত কন্ঠে গাওয়া ঐতিহাসিক সে গানটি, আমেরিকার জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী বিয়ন্সে কন্ঠে গাওয়া-

“Freedom! Freedom! I can’t move / Freedom, cut me loose! / Freedom! Freedom! Where are you? ‘Cause I need freedom, too!” যার বাংলা অর্থ- "স্বাধীনতা! স্বাধীনতা আমি নড়তে চাই না আমি হারাতে চাই না, স্বাধীনতা স্বাধীনতা, তুমি কোথায় আছো? আমি স্বাধীনতা চাই।"

 

রবিবার দিনে শেষে স্ত্রী তানিয়া ভেনেসা আভলসকে বিদায় জানিয়ে শুরু করা যাত্রায় সব হারিয়ে চিরদিনের জন্য নির্বাক হয়ে যাওয়া মিঃ ওস্কার মার্টিনেজ আর ২৩ মাস বয়সের সন্তান এঞ্জী ভ্যালেরিয়া কে শুধু একজনই দেখলো কিভাবে স্বপ্নের চোরাবালিতে আটকে গিয়ে শব্দহীন সমাধি পেয়ে গেলো নিমেষে। তানিয়া বার বার বলছে নিজ চোখে দেখা সব হারানোর কাহিনী। মিঃ মার্টিনেজ প্রথমে নিজ সন্তান দুটোকে কোলে নিয়ে এগিয়ে গেলো নদী পার হতে। বড় সন্তান প্রিন্সেস ভ্যালারিয়াকে পিঠে নিলো টি শার্টের ভিতর শক্ত করে বেঁধে। ছোট সন্তান কে তানিয়ার নিকট ফেরত দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো রিও নদীর অপর পারে পৌছবে বলে। স্ত্রী তানিয়া তখনো নদীতে বোটে বসা। ওস্কারকে শেষ বারের মত দেখলো প্রবল স্রোতের বাঁধা পেয়ে মেয়ে ভ্যালেরিয়া কে নিয়ে ফেরত আসতে চাইছে আবার মেস্কিকো সীমান্তে। মেয়ে ও বাবা দুজন আমেরিকা সীমান্তের খুবই কাছাকাছি তখন। এরপর যা দেখলো তানিয়া তা আর স্মরন করতে চায় না বাকি জীবন। কতই না মর্মান্তিক আর কষ্টের ধারাবাহিকতা। রিও নদীর স্রোতে ভেসে গেলো একজন পিতা, যে বহন করছিলো ২৩ মাসের সন্তান প্রিন্সেস এঞ্জী ভ্যালেরিয়াকে আর মুক্ত আমেরিকায় স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকবার এক আজন্ম লালিত স্বপ্ন।

 

ইশতিয়াক রুপু
গল্পকার ও গীতিকার
কুইন্স, নিউইয়র্ক, আমেরিকা।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top