সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১

সত্যজিৎ বিশ্বাসের রম্য গল্প

টেলিফোন বিভ্রাট (রম্য গল্প) : সত্যজিৎ বিশ্বাস


প্রকাশিত:
২২ অক্টোবর ২০২০ ২১:৫৯

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ০০:০৭

ছবিঃ সত্যজিৎ বিশ্বাস


আহসান করিম সাহেব অফিসের বড় অফিসার। কিছুদিন বাদেই রিটায়ার্ড করবেন। রিটায়ার্ড জীবনে কি করে একাকীত্ব কাটাবেন ভাবতে ভাবতে শুক্রবার সকালে বের হলেন বাজার করতে। মাছ বাজারে ঢুকতেই অফিস একাউন্টেন্ট ফরিদ সাহেবকে দেখলেন ব্যাগ দুলিয়ে দুলিয়ে মাছওয়ালার সাথে দাম-দর করতে। হঠাৎ মাথায় একটা প্রশ্ন চক্কর দেয়ায় ফরিদ সাহেবকে ডাকতে গিয়েও ডাকলেন না। এতদিন একসাথে চাকরী করছেন, অথচ অফিসের কাজ ছাড়া একবারের জন্যও কি ফোন দিয়ে কারো সাথে কুশল বিনিময় করেছেন? নিজেকে প্রশ্ন করে কোন উত্তর খুঁজে পেলেন না। অপরাধ বোধে বিষণ্ণ মনে বাসার দিকে রওনা দিলেন আহসান সাহেব।

বাসায় ফিরে গোছল সেরে এক কাপ চা আর মোবাইল সেট নিয়ে বসলেন ড্রয়িং রুমের সোফায়। প্রথমেই ফোন দিলেন অফিসে সবচেয়ে বেশি ঝাড়ি মারেন যাকে, সেই মেহেদী সাহেবকে।

‘তুমি একদিন ভাল না বাসিলে, পরাণ আমার রয় না পরাণে’ রিংটোনে গায়ক পুরো লাইনটা গেয়ে শোনালেও মেহেদী সাহেবের গলা শোনা গেল না। ভুরু কুঁচকে আবার ফোন দিলেন আহসান সাহেব। লাইনটা কেটে যাবার ঠিক আগ মুহুর্তে হাঁপাতে হাঁপাতে ফোন ধরলেন মেহেদী সাহেব।
- কী ব্যাপার মেহেদী সাহেব, হাঁপাচ্ছেন কেন?
- স্যার, আপনার ফোনটা দৌড়ে ধরার জন্যই হাঁপাচ্ছিলাম। সরি স্যার।
- আরে না, না, সরি হবার কি আছে? ছুটির দিনে ব্যস্ততা থাকতেই পারে। তা, বাসায় জগিং করছিলেন নাকি?
- জ্বী না স্যার।
- এখনো তো হাঁপাচ্ছেন। মিথ্যে বলছেন কেন? জগিং করা তো খারাপ কিছু না।
- জ্বী স্যার।
- টেক ইট ইজি ম্যান, এমনি গল্প করতে ফোন দিয়েছি।
- জ্বী স্যার।
- আরে বাবা, আজ আমি স্যার হয়ে অফিসের কোন কাজে ফোন দেইনি।
- বুঝেছি স্যার।
- বুঝলে শুধু স্যার স্যার করছেন কেন? ফিল ফ্রী ম্যান।
- জ্বী স্যার। ফ্রি হয়েই বলছি।
- তাহলে বলছেন না কেন, কি করছেন?
- বললাম তো স্যার, তেমন কিছু না।
- আমাকে বলতে এত আপত্তি?
- পি¬জ স্যার, ভুল বুঝবেন না।
- আচ্ছা ঠিক আছে, না বলতে চাইলে নাই। তা, এটা কি আপনার নিজের ফ্ল্যাট নাকি ভাড়া বাসা?
- ভাড়া বাসা, স্যার। কেন স্যার?
- না মানে, যে রুমে বসে কথা বলছেন, রূমটা কিন্তু একেবারে অন্য রকম। কেমন যেন প্রতিধ্বনি হচ্ছে কথাগুলো।
- জ্বী স্যার, যেখানে বসে কথা বলছি, সেখানে বসে কথা বললে ইকো হওয়ারই কথা।
- আপনার সমস্যাটা কি বলবেন? আপনি কি আমার সাথে গল্প করতে চাইছেন না?
- জ্বী না স্যার, মানে জ্বী স্যার। আসলে, মানে ব্যাপারটা তা না।
- আসলে ব্যাপারটা কি?
- আসলে এখন যা করছিলাম, তা বলাটা ঠিক হবে কী না ভাবছি।
- আপনি এমন কি করছিলেন যে, আমাকে বলতে এত দ্বিধা? এতদিন একসাথে কাটালাম, তাও আপন ভেবে বলতে পারছেন না!
- স্যার, বড় কাজ করছিলাম।
- বলেন কি? ছুটির দিনেও কাজ করেন? কোন অফিসে পার্ট টাইম?
- স্যার এই কাজ সেই কাজ না।
- তাহলে কোন কাজ?
- প্রকৃতির ডাক
- অ্যাঁ ?!
- স্যার, কাল রাত থেকেই ডায়রিয়া। রাতে এতবার যাওয়া আসা করেছি, আর পারছিনা। তাই ভোর থেকে আর যাচ্ছি না। এখানেই বসে আছি।
- ও ইয়ে, আগে বলবেন তো সে কথা। ঠিক আছে, তাহলে পরে কথা বলি।
- না স্যার, পি¬জ শুনুন স্যার। আপনার দেয়া প্রথম ফোন কলই রিসিভ করতে পারতাম। কল রিসিভ করার জন্য বাথরুম থেকে বের হয়ে যেই মোবাইলটা হাতে নিয়েছি ওমনি বিছানায় শোয়া তিন বছরের ছেলেটা ঘুম থেকে জেগে উঠে বলে, আব্বু ন্যাংটা, আব্বু ন্যাংটা। এক দৌড়ে মোবাইলটা নিয়ে আবার বাথরুমে ঢুকেছি। স্যার শুনছেন, আমি কিন্তু এখন আপনাকে সব খুলেই বলছি... ...

আর কিছু খোলাখুলির আগেই আহসান সাহেব ফোন কাটলেন। সব কথা শোনা ঠিক না।

কাকে ফোন দেয়া যায়, কাকে দেয়া যায় ভাবতেই হঠাৎ মনে হলো সকালে বাজারে দেখা ফরিদ সাহেবের কথা। ফরিদ সাহেব কি রঙের টি-শার্ট, প্যান্ট পড়ে বাজারে এসেছেন, বাজারের ব্যাগে কি কি ছিল, সব বলে চমকে দিলে কেমন হয়? যেই ভাবা, সেই কাজ। চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে ফোন দিলেন ফরিদ সাহেবকে।
- হ্যালো ফরিদ সাহেব? কেমন আছেন?
- স্যার, আর বইলেন না। শুক্রবার দিনটা যে কোন কুক্ষণে আসে কে জানে?
- কেন, কি হয়েছে?
- কি হয়নি, তাই বলেন স্যার। সেই সাত সকালে বউ, বাচ্চা ঘুম থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছে চিড়িয়াখানায়। আপনিই বলেন, চিড়িয়াখানা কি একটা দেখার জিনিষ?
- ও আচ্ছা, আপনি সকাল থেকে চিড়িয়াখানায়?
- জ্বী স্যার। সেই সকাল থেকেই।
- তা, আপনি চিড়িয়াখানায়, কোনো পশুপাখির শব্দ শুনি না যে?
- হে,হে,হে... স্যার কী যে বলেন?
- কেন, ভুল বললাম কিছু?
- তা না স্যার। বলছিলাম, পশুপাখিদেরও তো ছুটির দিন বলে একটা কথা আছে। মুখ বন্ধ রেখে ওরাও তো সপ্তাহের একটা দিনে বিশ্রাম নেয়।
- তার মানে? আপনি কি আমাকে কিছু মিন করলেন?
- আপনাকে মিন করব কেন? স্যার, কি মাইন্ড করলেন? ৃজরুরী কোন কাজ ছিল? ৃআমি কি অফিসে আসব, না আপনার বাসায়? বলেন স্যার, কোন অসুবিধা নাই। পুরা দুনিয়াটাই হলো চিড়িয়াখানা। আসব, স্যার?
- না, না, আপনি চিড়িয়াখানায় সময় দেন।
আহসান সাহেব লাইনটা কেটে দিয়ে সোফায় ছুঁড়ে মারলেন মোবাইল সেট। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। তাঁকে এড়িয়ে যাবার জন্য এত মিথ্যে কথা বলতে হয়? তাঁর সম্পর্কে অফিসের স্টাফদের এই ধারণা? কাজ ছাড়া কি আহসান সাহেব কুশল বিনিময়ের জন্য ফোন দিতে পারে না? অফিসের কেউই কী তাঁকে পছন্দ করেনা!

চায়ে চুমুক দিয়ে দেখলেন, ঠান্ডা শরবত হয়ে আছে। অন্যমনস্ক হয়ে ডাক দিলেন অফিসের পিওন নজরুলকে। সাথে সাথেই মনে হলো, আজ শুক্রবার। তিনি তো এখন বাসাতেই। আচ্ছা নজরুলকে ফোন দিলে কেমন হয়? স্যারের ফোন পেয়ে খুশিতে নিশ্চয়ই চমকে যাবে।
- হ্যালো নজরুল?
- নাটকির পো, তুই কেডা?
- আমি কে মানে? আমাকে চিনতে পারছো না!
- ওই হালার পো হালা, শুদ্ধ না মারাইয়া তোর নাম কইতে পারস না?
- ইয়ে মানে আপনি কে? এটা নজরুলের মোবাইল সেট না? নজরুল কই?
- তার আগে ক, তুই কই?
- আমি কই মানে? আমি বাসায়। আপনি আমাকে তুই তুই করে বলেছেন কেন? আপনি আমাকে চেনেন?
- আব্বে হালায় কয় কি? তুই আমারে চিনস?
- জ্বী না।
- না চিননই ভালা। তোর লগে কি নজরুল?
- আমার সাথে নজরুল থাকবে কেন? নজরুল থাকবে তার ফোনের সাথে। ওর কী হয়েছে?
- কী হইছে মানে? ছয়মাস ধইরা টাকা লইয়া ঘুরায়। আইজ চান্দুরে পাইয়া যেই খপ কইরা কলারে ধরছি, কয় এই যে মোবাইল জমা থাকল। এক ঘন্টার মধ্যে টাকা লইয়া আইতাছি। হালা বেঈমান, দুই ঘন্টা পার হইয়া গেল। কুনো খবর নাই। অখন তোর ফোন দিয়া মোবাইলের খবর লয়।
- ভাই, আপনে ভুল বুঝছেন, নজরুল আমার সাথে নেই। নজরুলের খবর নেয়ার জন্যই আমি ফোন দিয়েছিলাম।
- আমারে বুঝাস তুই? আমারে বেকুব মনে অয়? নজরুলের খবরের লগে আইজ তোরও খবর আছে। কই আছোস ঠিকানা ডা খালি একবার ক।
- না, না নজরুলের কোন খবরের আর দরকার নেই।
আহসান সাহেব তড়িঘড়ি করে লাইনটা কেটে দিয়ে হাফ ছাড়লেন। নিজেকে সামলে নিয়ে ভুরু কুঁচকে মোবাইল সেটটার দিকে তাঁকালেন।
কোনটা কুফা? মোবাইল সেট নাকি শুক্রবারটা?
... ... নাকি তার পরিকল্পনা?
শেষ কথাটা যখন ভাবছিলেন, কোত্থেকে যেন একটা বদ টিকটিকি টিক, টিক, টিক করে উঠল।



সত্যজিৎ বিশ্বাস
রম্য লেখক ও শিশু সাহিত্যিক
* রম্য বিভাগীয় সম্পাদক- কিশোর বাংলা
* নির্বাহী সম্পাদক- কিশোরকাল
* কন্ট্রিবিউটার – মাসিক স্যাটায়ার কার্টুন ম্যাগাজিন ‘উন্মাদ’, জাতীয় দৈনিক যুগান্তর ‘বিচ্ছু’, দৈনিক ইত্তেফাক ‘ঠাট্টা’।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top