সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

বই চোর : সাইফুর রহমান


প্রকাশিত:
২২ অক্টোবর ২০২০ ২২:০৮

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১১:১৩

ছবিঃ সাইফুর রহমান

 

সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ যেখানে শেষ হয়েছে তার থেকে ঈষৎ আগে শ্যাওড়া গাছ সাদৃশ্য একটি পাকুড় বৃক্ষের সন্ধান পাওয়া যায়। বনসাঁই আকৃতির এই গাছটি সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সম্ভবত বেশ কিছু কাল ধরে। পাকুড় গাছের ছায়ার নিচে সস্তা টিন দিয়ে ছাওয়া ঘুপচির মতো যে চায়ের দোকানটি আছে সেখানেই বেলা বারটা নাগাত অপেক্ষা করার কথা ছিল সুনীলের।
দুপুরের দিকে চায়ের দোকানটি অপেক্ষাকৃত নির্জন থাকে। ডিমের কুসুমের মতো সূর্য্যটা পশ্চিমে হেলে পড়লে পাকুড় গাছটির সুশীতল ছায়া পড়ে চায়ের চালাঘরে। তখন সেখানে মানুষের জমায়েত হয়। কোলাহল বাড়ে।
চায়ের এই দোকানটি অবশ্য অত্র অঞ্চলটিতে মোহনমিয়ার চায়ের দোকান নামে পরিচিত। সুনীল বেলা বারটার আগেই সেখানে এসে উপস্থিত হলেও এখন পর্যন্ত দেখা নেই ইন্দ্রনাথের। ইন্দ্রনাথ সুনীলের দীর্ঘদিনের ইয়ার। বই সংগ্রহ বিষয়ক কিছু শলা-পরামর্শের জন্য ইন্দ্রনাথ-ই সুনীলকে বারংবার অনুরোধ করেছে অপেক্ষা করতে এখানে।
সময় পেরিয়ে গেছে বারটা অতিক্রম করে আরো ঘন্টাখানেক। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে ভাদ্রের অকাল বর্ষণ। চারদিক ভেসে যাচ্ছে বৃষ্টির পানিতে।
সকাল থেকে পেটে দানাপানি পরেনি কিছুই। এরই মধ্যে অবশ্য চা খাওয়া হয়ে গেছে বেশ কয়েক প্রস্থ। শূন্য উদরে চা পান করার কারণেই হয়তো টক্ মতো অস্বস্তিকর একটি প্রবাহ পাকস্থলী থেকে খাদ্যনালী বেয়ে উঠে আসছে উপরের দিকে।
বৃষ্টির জন্যই হয়তো কোথাও আটকা পড়েছে ইন্দ্রনাথ, মনে মনে ভাবে সুনীল। দোকানে সাজিয়ে রাখা কাঁচের বোয়াম গুলোর একটি খুলে, ভিতরে হাত ঢুকিয়ে লাঠি বিস্কুট উঠিয়ে নেয় গোটা কয়েক। বিস্কুট গুলো চিবুতে চিবুতে প্রবল বর্ষণ থেকে উদ্ভুদ আবছা কুয়াশা ভেদ করে দৃষ্টি সম্প্রসারিত হতেই দেখা গেল রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে ইন্দ্রনাথ। বাঁ হাতটি উঁচু করে স্বজোরে চেঁচিয়ে উঠলো সুনীল- ইন্দ্রনাথ, এই যে আমি এখানে।
-বাহঃ বেশ! তুইতো দেখছি এখানে বসে আরামে চা-বিস্কুট খাচ্ছিস আর আমি একেবারে কাক ভেজা হয়ে গেলাম। শরীর থেকে পানি ঝাড়তে ঝাড়তে কথা গুলো বলল ইন্দ্রনাথ।
-কি করব বল, তুই আসতে দেরি করছিস। এদিকে বেদম বৃষ্টি। সকাল থেকে পেটে কিছুই পরেনি।
ইন্দ্রনাথ স্ববিষ্ময়ে সুনীলের দিকে তাকিয়ে বলল- তোর হাতে চটের এই থলে দুটো কিসের রে সুনীল। সুনীলের কণ্ঠে ইতস্ততার সুর- এই আর কী, এগুলোর মধ্যে চাউল।
-চাউল? চাউল পেলি কোথায়?
রেশনশপ থেকে তুললাম। সেড় পাঁচেক পেয়েছি। এর মধ্য থেকে সেড় খানেক সরিয়ে আলাদা করে রাখলাম ছোট এই থলের ভেতর। এগুলো বিক্রি করে বই কিনব। আমিতো আর তোর মতো ধনীর দুলাল নই যে হাজার টাকা খরচ করে বই কিনতে পারি। প্রতি সপ্তাহে সেড় খানেক করে চাউল এভাবে সরিয়ে রাখি। তারপর পাঁচ-দশ সেড় জমিয়ে সেগুলো বিক্রি করে বই কিনি। ইন্দ্র বিস্ফারিত নেত্রে তাকায় সুনীলের দিকে।
বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না আজ। সুনীল ইন্দ্রনাথকে বলল- আপাতত এখানে বসেই চা-বিস্কুট কিছু খেয়ে নে ইন্দ্র। বৃষ্টিটা একটু ধরে আসুক আগে তারপর না হয় যাওয়া যাবে অন্য কোথাও।
ইন্দ্র একভাড় চায়ের ফরমায়েশ করে প্যান্টের পকেট থেকে বের করল গোল্ডফ্লাগ সিগারেটের সুদৃশ্য একটি টিনের কৌটো। সেখান থেকে সিগারেট বের করে তাতে আগুন ধরিয়ে মুখ থেকে কুন্ডলির মতো ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল- আচ্ছা সুনীল তোর এই কবিতা লিখা কিংবা ধর এই যে বই সংগ্রহের মতো বাতিক গুলো কীভাবে পেলি।
-সে অনেককাল আগের কথা ইন্দ্র। আমরা তখন থাকতাম বাংলাদেশের মাদারীপুরে। আমাদের গ্রামের পাঠশালায় আমার সঙ্গে ইয়াকুব নামে একটি ছেলে পড়ত। ও রোজ এমন মজার মজার অদ্ভুদ সব গল্প আমাদের শোনাতো যে আমি অবাক বিস্ময়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম সেসব। যদিও আমি বেশ ভালো করেই জানতাম যে এ সবই হলো ইয়াকুবের কল্পনা শক্তির চমৎকার প্রসব। আজ আমার বলতে দ্বিধা নেই ইয়াকুবই ছিল আমার জীবনে প্রথম ব্যক্তি যে আমার কল্পনা শক্তিকে উস্কে দিয়েছিল। আমার লেখক স্বত্তাকে জাগিয়ে তুলেছিল।
আমাদের পরিবারে আমার মায়ের ছিল বই পড়ার মারাত্মক নেশা। মায়ের সেই নেশা মেটাতে আমাকে রোজ দুটো করে বই তুলতে হতো উত্তর কোলকাতার বয়েজ ওন্ লাইব্রেরি থেকে। দেখা যাচ্ছে মা হয়তো বসেছে একটি বই নিয়ে। লুকিয়ে চুকিয়ে অন্যটি পড়তাম আমি। আর এভাবেই ধীরে ধীরে একজন পাক্কা পড়ুয়া হয়ে উঠলাম।
যদিও বর্তমানে একটু আধটু কবিতা টবিতা লিখে বন্ধুমহলে নাম করেছি বটে কিন্তু কেউ হয়তো কোনদিন জানতেও পারবে না যে লেখকস্বত্তার চেয়ে আমার পাঠকস্বত্তা এখনও আমার কাছে বেশি প্রিয়।
তুই শুনে অবাক হবি ইন্দ্র আমি আমার সমসাময়িক সমস্ত বন্ধু সুহৃদদের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি একমাত্র মানবেন্দ্র ছাড়া আমার চেয়ে বেশি বই আর কেউ পড়েনি। সে হোক শক্তি, সন্দিপন কিংবা শীর্ষেন্দু। ইন্দ্রনাথ বলল- তাই না কি। বেশ ভালো বলেছিস তো। সবইতো বুঝলাম তা তুই বই সংগ্রহের এই ঘোড়া রোগটি কিভাবে পেলি। সুনীল স্মিত হেসে বলল- তুই একটা আস্ত মুর্খ্য। যে ছেলেটি বই পড়তে ভালবাসে সে যে বই সংগ্রহ করতেও ভালবাসবে সেটাই স্বাভাবিক নয়কি।
শোন তোকে তাহলে বলি- ছোটবেলায় আমি একটির বেশি দু’টি জামা পর্যন্ত কিনতাম না। বরং বাবাকে বলতাম জামা-জুতোর পরিবর্তে বই কিনে দাও আমাকে। কথা গুলো রূপকথার মতো মনে হলেও এটাই সত্যি ইন্দ্র। আমাদের বাড়িতে বইয়ের কোন সংগ্রহ ছিল না। আমার বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। নুন আনতে পান্তা ফুড়োয় অবস্থা। বইয়ের সংগ্রহ গড়ে ওঠে কয়েক পুরুষে। আমরা তখন কোলকাতায় বাংলাদেশ থেকে আসা রিফিউজি। কিন্তু মাদারীপুরে আমার মামাদের বাড়িতে বইয়ের সংগ্রহ ছিল বেশ ভালো। সেই সংগ্রহ থেকে প্রচুর বই আমি চুরি করে এনেছিলাম অকৃপন হস্তে। জানিসতো ইন্দ্র একটি প্রবাদ আছে- “ধনবানে কেনে বই বুদ্ধিমানে পড়ে”। তবে তোকে আজ একটি সত্যি কথা বলি, আমি জীবনে সবচেয়ে বেশি বই চুরি করেছি আমার এক মাড়োয়ারী বন্ধুর সংগ্রহশালা থেকে।
ইন্দ্র এবার সুনীলের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল- তুই আবার আমার লাইব্রেরি থেকে বই এদিক সেদিক করিসনিতো। তোর বাড়ি গিয়ে ভালো করে সার্চ-টার্চ করে দেখতে হবে একবার।
ঝংকার দিয়ে উঠলো সুনীল- আরে থাম থাম, চোরের মায়ের বড় গলা। তুইতো শালা একটা বড় চোর। ধনী আর বিখ্যাত সব লোকদের সংগ্রহশালায় হানা দিয়ে বেড়াস। আর আমিতো এখন হয়েছি চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা। বই চুরির অভ্যেসটা আমি তোর সঙ্গে দেখা হওয়ার অনেকদিন আগেই ছেড়ে দিয়েছি। ইনফ্যাক্ট আমার কবিতা ও গল্পটল্প গুলো যখন থেকে কাগজে ছাপা হতে শুরু হয়েছে তখনি ছেড়ে দিয়েছি। আমাকে বারবার না থামিয়ে গল্পটা আগে শোন না ইন্দ্র।
ইন্দ্রনাথ বলল- আমার কাছেও দুর্দান্ত একটি খবর আছে যা শুনলে তুইও অভিভূত হয়ে যাবি। আগে তোর গল্প শেষ হোক তারপর আমারটা বলছি।
সুনীল বলতে শুরু করলো- সেই যে আমার মাড়োয়ারী সহপাঠির কথা বলছিলাম আমি আর আমার সেই বন্ধু আমরা একসঙ্গে একই স্কুলে পড়তাম। ওর নাম কমল ভান্ডারিয়া। আমার সেই বন্ধুর বাবা ছিলেন চামড়া ব্যবসায়ী। প্রচুর কাঁচা পয়সার মালিক। কমল বাংলা বলত ভাঙ্গা ভাঙ্গা কিন্তু প্রায়ই ও নতুন নতুন সব বই নিয়ে আসত স্কুলে।
তুইতো জানিস লাইব্রেরি গুলোতে যেসব বই পাওয়া যায় সেগুলোর বেশির ভাগই পুরোনো। যেমন ধর- নীহারঞ্জন গুপ্ত, শশধর দত্তের মোহন সিরিজ, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, মনীন্দ্রলাল বসু, পাঁচকড়ি দে এগুলো আর কী। কিন্তু কমল ক্লাসে নিয়ে আসতো সদ্য প্রকাশিত আনকোরা সব বই। যেমন একদিন নিয়ে এলো শিবশঙ্কর মিত্রের “সুন্দরবনের আর্জান সর্দার”। নামের মধ্যেই আমি যেন খুঁজে পেলাম বইটি পড়ার দুর্দমনীয় এক আকর্ষণ। কমলকে কত করে বললাম- বইটি আমাকে কয়েকদিনের জন্য একটু ধার দে না ভাই, পড়া শেষ হলেই ফিরিয়ে দেব। মা কালির দিব্যি কেটে বলছি। কমল ভান্ডারিয়া ছিল হাঁড়কিপটে গোছের। ও বইটি আমাকে কিছুতেই দিলো না পড়তে।
তো হয়েছে কি- একদিন বিকেলে স্কুল শেষে কমলই আমাকে এক প্রকার জোর করে নিয়ে গেল ওর বাড়িতে। ফেরার সময় কৌশলে অপহরণ করলাম সুন্দরবনের আর্জান সর্দারকে।
আরেক দিনের কথা, পরীক্ষা শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগে হবে বোধহয় কমল ক্লাসে নিয়ে এল হেমেন্দ্র কুমার রায়ের ‘যখের ধন’। কমল সেই বইটাকেও সত্যি সত্যি যখের ধনের মতো আগলে রইল। হাজার অনুনয় বিনয় করেও কোন লাভ হলো না। কেন জানিনা সেই বইটি পড়ার জন্য মনটা আমার ছটফট করতে লাগল তৃষ্ণার্ত কোন প্রাণীর মতো। ভিতরে ভিতরে মুখিয়ে রইলাম কিভাবে পড়া যায় বইটি।
পরীক্ষা শেষ করেই গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে গেছি মামাবাড়ি। সেখানে মামাদের সংগ্রহশালায় পেয়ে গেলাম সেই যখের ধন বইটি। আজ অকপটে স্বীকার করছি, আমি সাত রাজার ধন ভান্ডারের সন্ধান পেলেও বোধহয় এতটা খুশি হতাম না যতটা খুশি হয়েছিলাম সেই যখের ধন বইটি আবিস্কার করে। মামাদের যখের ধন সন্তর্পনে চলে এল আমার ঘরে।
একটি দু’টি বইতে কি আর আমার মতো গ্রন্থভুখের খিদে মেটে। অথচ নিয়মিত বই কেনার সাধ্য ছিলনা আমার। তাই ছলে-বলে-কৌশলে এমনকি চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন করেও বই জোগাড় করতাম আমি। পকেটে পয়সা নেই অথচ জীবনানন্দ দাসের নতুন কবিতার বই বেরিয়েছে সে যে কি দুঃখের দিন সেটা তোকে আমি বোধহয় কিছুতেই বোঝাতো পারবোনা ইন্দ্র। মনের মধ্যে পর্বততুল্য কষ্ট নিয়ে ফেউ ফেউ করে ঘুরে বেরিয়েছি কলেজ স্ট্রিটের বই পাড়ায়। অনেক সময় হুটহাট ঢুকে পড়েছি কোন বইয়ের দোকানে। সদ্য প্রকাশিত বইখানি একটু নেড়েচেড়ে নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকে মনের আশ মিটিয়েছি।
এ পর্যন্ত বলে থামল সুনীল। ইন্দ্রের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল- একটা সিগারেট দে। অনেকক্ষণ হলো সিগারেট ফুঁকা হয়নি। নিকোটিনের প্রচন্ড অভাব অনুভূত হচ্ছে শরীরে।
সিগারেটের কৌটোটি এগিয়ে দিতে দিতে ইন্দ্রনাথ সুনীলকে উদ্দেশ্য করে বলল- বেশ জম্পেস ধরনের একটি বই সংগ্রহশালার সন্ধান পেয়েছি জানিস।
সুনীল সিগারেট জ্বালানো বন্ধ রেখে কৌতুহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, বলিস কি, কোথায়?
-মুর্শিদাবাদের আজিমগঞ্জে। পরিত্যাক্ত বনেদি জমিদারের এক প্রাসাদে। বাড়িটি নিয়ে অবশ্য তার ওয়ারিশদের মধ্যে মামলা মোকদ্দমা চলছে দীর্ঘকাল ধরে। কিন্তু সেই বাড়ির পাহাড়াদারের সঙ্গে আলাপ হয়েছে আমার। দারোয়ানটির নাম লজপত সিং। জাতিতে রাজপুত। ওর পূর্ব পুরুষ বহুকাল পূর্বে চলে এসেছে বাংলায়। আমি কয়েকদিন আগে সেখানে গিয়ে নিজ চোখে দেখে এসেছি বইয়ের সেই সংগ্রহ। দেখলাম দুর্লভ সব বইয়ের সমাহার সেখানে। খাস ফার্সি ভাষায় লিখা এক সেট শাহানামা দেখলাম। মরোক্ক চামড়ায় বাঁধানো।
হাফিজ, আর্যভট্ট, ইবনে খালেদুন, কৌটিল্য- চমৎকার সব কালেকশানস। কিন্তু সমস্যা হলো সমস্ত বই-ই কাঁচের আলমারীতে সাজানো। চাবি অবশ্য লজপত সিং এর কাছে থাকে না। সেই চাবি থাকে প্রাসাদের আরক্ষক, দুর্গাধিপতি ইরফান আলীর কাছে। ইরফান আলী জমিদারদের বহু পুরোনো খিদমতগার। আমি অবশ্য বেশ টাকা-পয়সার লোভ দেখিয়ে এসেছি সিং ব্যাটাকে। বলেছি সিং মিয়া তোমার ওই ইরফান আলীকে যে করেই হোক রাজি করাও। হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ করতে প্রস্তুত আমি এই ইন্দ্রনাথ কিন্তু মনে রেখ আলমারীর চাবি আমার চাই।
এতসব দুর্লভ বইয়ের লোভ সামলানো সত্যিই বেশ কঠিন। ইন্দ্রনাথের এমন লোভনীয় প্রস্তাবে সুনীল রাজি হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। ওরা দু’জন যখন মুর্শিদাবাদের আজিমগঞ্জে গিয়ে পৌঁছাল তখন বেলা দ্বিপ্রহর। বিশাল প্রাসাদটির এখন প্রায় ভগ্নদশা। একসময়ের সাদা ধবধবে সৌধটি এখন পাউরুটি রঙ ধারণ করেছে। বাড়িটির কতক স্থানে শ্বেত রোগির মতো ছোপছোপ দাগ। নির্বাক গাছ গুলোও যেন কিভাবে টের পেয়ে গেছে এই আবাসটি দীর্ঘদিন আবাসশূন্য। সে কারণেই বোধহয় দেয়ালের কিছু কিছুু স্থানে জায়গা করে নিয়েছে ছোট ছোট বৃক্ষ ও গুল্মলতা। প্রাসাদটির সামনে বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে সবুজ ঘাসের গালিচা পাতা। সেখানেই কোন একটি কাজে ব্যস্ত ছিলো লজপত সিং। ইন্দ্রনাথ সিংহদ্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে হাক দিলো- এই যে, লটপট সিং আসো একটু এদিকে। লজপত সিং লোহার মোটা মোটা গরাদ যুক্ত তোরণটি খুলতে খুলতে বলল- সাহেব হামার নামতো লটপট সিং নাহি, লজপত সিং।
ইন্দ্রনাথ নির্বিকার কণ্ঠে বলল- আরে ঐ হলো... একই কথা। লটপট সিং ও যা লজপত সিং ও তা।
সিং লোকটা বিশাল দেহী। সামনের বপুটি অনেকখানি ফুলে উঠেছে উপরে। সেলোয়ার ও কুর্তা গুলো বেশ ঢোলা ধরনের। মাথায় অবশ্য পাগড়ি নেই কিন্তু নাঁসিকার নিচে পাকানো ও পুরু গুম্ফটি কর্ণ পর্যন্ত বিস্তৃত। পায়ে ফিকে হতে আসা খসখসে কালো রঙের পাম্পসু। বিপুল দেহের জন্যই হয়তো হাঁটার সময় লজপত সিং হাঁটে হেলেদুলে।
লজপত সিং কাছে এসে চুক চুক করতে লাগল- নেহি সাহেব আপনাদের জন্য কুচ করতে পারলাম না। ইরফান আলীকে কত করে বুঝালাম- তোমার বয়স হয়েছে খানা পিনার পয়সা নাই। শরীরে নানা অসুখ বেঁধেছে। টাকা নিয়ে আলমারীর চাবিগুলো হামাকে দাও। বইগুলো পড়ে মানুষ জ্ঞানী হবে। কিন্তু ইরফান আলীর সাফ কথা ‘নিমকহারামী কিছুতেই করতে পারব না আমি।’
সাহেব তোমাদের জন্য আমি কিছু মূল্যবান জিনিস রেখেছি দেখ তোমাদের নজরে লাগে কি না। একথা বলেই লজপত সিং ভিতরে চলে গেল। ফিরে এলো কিছুক্ষণ পরে, হাতে সুদৃশ্য সব তৈজসপত্র। হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি কিছু জিনিস। পুরোনো একটি কাঠের দেয়াল ঘড়ি, ব্রঞ্জের লণ্ঠন এসব। সুনীল ও ইন্দ্রনাথের বোঝার বাকি রইলো না যে লজপত সিং আসলে বড় তস্কর দলের সদস্য। ওর কাজই হচ্ছে জমিদারদের পরিত্যাক্ত প্রাসাদ গুলো থেকে মূল্যবান সব সামগ্রি চুরি করে বিক্রি করা।
ইন্দ্রনাথ অগ্নিমুর্তি ধারণ করে বলল- আমরা কি এতো কায়ক্লেশ সহ্য করে এখানে এসেছি এসব ফালতু জিনিস কিনতে। লজপত তুমি কেন বুঝতে চাইছো না যে আমরা চাই বই। আলমারীর চাবি। লজপত সিং কাচুমাচু হয়ে বলল- কিন্তু হাম কি করব বলুন সাহেব। ইরফান আলী বলেছে কিছুতেই সে চাবি দিবে নাহি।
ইন্দ্র বলল- ঠিক আছে কোন অসুবিধা নেই আমাদের নিয়ে চলো ইরফান আলীর কাছে। আমরাই বোঝাবো তাকে। বই গুলো অন্য কাউকে পড়ার সুযোগ করে দিলে তার এমন কোন নিমকহারামী হবে না।
লজপত সিং বলল- ঠিক আছে সাহেব চলুন। আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি ইরফান আলীর মাকানে। চেষ্টা তদবির করে দেখুন তাকে মানাতে পারেন কিনা।
ইরফান আলীর বাড়িটি জমিদারের প্রাসাদ থেকে খুব বেশি দূরে নয়। ইরফান আলীর ঘরটিতে মাটির দেয়াল। উপরে অবশ্য টালীর ছাউনী। মনিবের রাজপ্রাসাদটির মতো ইরফান আলীর ঘরটিও হেলে পড়েছে এক পাশে। ঘরের দেউরিতে দাঁড়িয়ে লজপত সিং বেশ কয়েকবার হাঁক দিলো- ইরফান আলী বলে। ভিতরে কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। দোড়টি উন্মুক্ত বলে লজপত সিং ভিতরে ঢুকেই নাকে রুমাল চেপে বিদ্যুৎ গতিতে বেরিয়ে এলো বাইরে। ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে সুনীল ও ইন্দ্রনাথ দু’জনেই ভিতরে ঢুকে দেখলো- বমি করে চারদিক ভাসিয়ে দিয়েছে ইরফান আলী। দূর্গন্ধে সেখানে টেকাই মুশকিল।
সুনীল বলল- ইন্দ্র চল ভাগি এখান থেকে তাড়াতাড়ি। বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা! কিন্তু ইন্দ্রনাথ সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়। ইরফান আলীকে সে ডেকে তুলল। ইরফান আলী চোখ খুলে সুনীল ও ইন্দ্রকে দেখে উঠে বসার চেষ্টা করল একবার। কিন্তু সুনীলই বাঁধা দিলো তাকে, না না থাক উঠতে হবে না আপনাকে। শুয়েই কথা বলুন আমাদের সঙ্গে। অসুবিধা নেই।
অর্ধনিমীলিত নেত্রে ইরফান আলী বলল- আমি জানি আপনারা কেন এসেছেন। কিন্তু আপনারা যা চান সেটা আমি দিতে পারব না। ক্ষমা করবেন আমাকে।
সুনীল বলল- কেন পারবেন না আলী সাহেব। ইরফান আলী সুনীলের দিকে তাকিয়ে বলল- আপনার নাম কী জনাব। সুনীল অস্ফুট গলায় বলল- আমার নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর ও আমার বন্ধু ইন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে ইরফান আলী বলল- আমি আপনাকে চিনি। আপনার অনেক লিখা আমি পড়েছি দেশ পত্রিকায়। আপনার লিখার হাত খুব ভালো।
ইরফান আলী পুনরায় শ্বাস টানতে টানতে বললেন, শুনুন ভায়া- আজীবন আমার মনিবের নুন খেয়েছি। এই শেষ বয়সে এসে বেঈমানী করতে পারব না আমি। জীবনে নিমকহারামী করিনি কখনো। আমি ভীষণ অসুস্থ। দু’কূলে কেউ নেই আমার। স্ত্রী মারা গেছে বছয় দু’য়েক আগে। পুত্র-কন্যারা সব দূরে। যে মেয়েটি এখানে কাজ করে বেতন ঠিক মতো দিতে পারিনা বলে কখনো সে আসে। কখনো আসেনা। এই মুহুর্তে আমার টাকার ভীষণ প্রয়োজন। এরকম পরিস্থিতিতে ঈমানে সাধারণত ফাটল ধরে। আমার যদি সেরকম ভীমরতি হয় সেই ভয়ে গতকালই লোক দিয়ে আলমারীর চাবি আমি পাঠিয়ে দিয়েছি আমার মনিবের কাছে।
এই সম্পত্তি মামলা মোকদ্দমা শেষে যে পায় পাবে। কিন্তু আমি আমার যে মালিককে চিনি তিনিই আমার প্রকৃত মনিব। এসব বলতে বলতে ইরফান আলী পূনরায় বমি করতে শুরু করলো। ইরফান আলী সম্ভবত আক্রান্ত হয়েছে কলেরায়।
ইন্দ্রনাথ বলল- সুনীল শোন, বইয়ের মধ্যে আমরা কি পড়ি? বিখ্যাত সব লোকদের কথা কিংবা তাদের কীর্তিময় জীবনী তাইতো, না কী। সুনীল চাবি দেয়া পুতুলের মতো মাথা নেড়ে বলল- হ্যাঁ, তা তো বটেই। ইরফান আলীর মতো কীর্তিমান ঈমানদার কি আর দু’একটা দেখা যায় সহসা। যায় না, তাইনা। আপাতত বইয়ের পেছনে হাজার টাকা খরচ না করে এই টাকা আমি খরচ করব ইরফান আলীর চিকিৎসায়। এই সাচ্চা মানুষটিকে কিছুতেই মরতে দেয়া যাবে না এই মুহুর্তে। চল ওকে ধরে উপরে তুলি। এক্ষুণি এঁকে নিয়ে যেতে হবে হাসপাতালে। সুনীল অপলক চেয়ে রইল সদ্য আবিস্কৃত তার মহানুভব এই বন্ধুটির দিকে।

 

সাইফুর রহমান
গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top