সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১

ত্রিকোণ পতাকা : মাহবুবুল আলম মাসুদ


প্রকাশিত:
২৮ অক্টোবর ২০২০ ২০:৩৯

আপডেট:
২৮ অক্টোবর ২০২০ ২১:০৬

ছবিঃ মাহবুবুল আলম

 

শ্রাবণ মাসের চার তারিখ। আকাশ ভেঙে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামার কথা নামছে গনগনে রোদ। গনগনে এই রোদ মাথায় নিয়ে এনামুল হাঁটছে। পথ পিচঢালা। হাতে একটা মোটা কাপড়ের ব্যাগ। ব্যাগে কিছু যন্ত্রপাতি। বহুল ব্যবহারে ব্যাগটা মলিন হয়ে গেছে তবে মজবুতি কমেনি। একটা রিকশা নিতে পারলে একটু আরাম হতো। কিন্তু চোখে-দেখা-দূরত্বে রিকশায় উঠে দশটা টাকা খরচ করে ফেলার কোনো মানে হয় না। এই কিছুদিন আগেও রিকশায় উঠে পাঁচ টাকা দেয়া যেত। এখন ছ্যাৎ করে ওঠে। সেদিন তো এক রিকশাওয়ালা বলেই ফেলল, রিকশায় পাছা ছুয়াইলেই দশ টেহা, চাক্কা ঘুরুন লাগে না। এনামুলও বলে দিয়েছে, থাক তুই তর তিন চাক্কা লইয়া; আমি আমার দুই চাক্কা দিয়াই চলতে পারি।
অবশ্য গরম নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয় এনামুল। নিশ্চয়ই গরমেরও দরকার আছে। দরকার আছে বলেই আল্লাহ দিছে। গরমে তো তার লাভই হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ ডাকছে। গতকাল অফিস ছুটির পর গিয়েছিল এক ডাক্তারের বাসায়। রান্নাঘরে এক্সহস্ট ফ্যান লাগিয়ে দিয়ে এসেছে। ডাক্তার তাকেই কিনে নিয়ে যেতে বলেছিলেন ফ্যানটা। ফ্যান কিনে দোকান থেকে কমিশন পাওয়া গেছে এক শ’ টাকা। ডাক্তার সাহেব লাগানো বাবদ পাঁচ শ টাকা দিয়েছেন সঙ্গে সঙ্গে। গায়ের ঘাম শুকানোর আগে।
কিছু কিছু লোক আবার খুব ঝামেলা করে। শুক্রবারে গিয়েছিল জিলা স্কুলের এক টিচারের বাসায়। ফ্যান নষ্টের কল। ফ্যান খুলে এনামুল দেখল বিয়ারিং নষ্ট হয়ে গেছে, এটা এখানে ঠিক করা সম্ভব নয়, বাসায় নিয়ে যেতে হবে। শুনে শিক্ষক গণি সাহেব কিছু বলার আগেই তাঁর স্ত্রী বলে উঠলেন, না, না, বাসায় নেওয়া যাবে না; এখানেই ঠিক করে দেন।
: এখানে তো আপা সম্ভব না। খুলে ঝালা দিয়ে আবার লাগাতে হবে।
: দেখেন না একটু চেষ্টা করে।
: দেখার কিছু নাই। এটা ঠিক করতে সময় লাগবে।
: আমার মেয়ের যে পরীক্ষা।
: দুই একটা দিন একটু কষ্ট করেন।
: কী কন, দুই দিন! মেয়ে তো ফ্রাই হয়ে যাবে।
: আচ্ছা ঠিক আছে। আমার বাসা থেকে পুরনো একটা লাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। আমাকে তিনটা দিন সময় দিন, তিন দিন পর আপনারটা লাগিয়ে দেব।
: ঠিক আছে নিয়ে যান ফ্যানে যেন দাগ না পড়ে।
কাজ যা তাতে খুব সাবধানে করলেও একটু-আধটু দাগ পড়বেই। এনামুল ভিতরের রাগটা বহু কষ্টে গিলে ফেলে চার শ’ টাকার চুক্তিতে ফ্যানটা নিয়ে এল। মাসের আজ বিশ তারিখ। বেতনের টাকা শেষ। এখন টাকার খুব দরকার।
পরের দিনই মহিলার ফোন এল, ভাই, ফ্যানটা।
: বলেছি তো তিন দিন লাগবে।
: একটু তাড়াতাড়ি করেন ভাই।
: কেন, ফ্যান তো একটা দিয়ে এসেছি।
: আপনার ফ্যান শব্দ করে; মেয়ে ঘুমাতে পারে না।
: আচ্ছা চেষ্টা করব।
সারা দিন অফিস করে এসব কাজ রাতেই করতে হয় তাকে। ওই রাতেই ফ্যান ঠিক হল। সকালে ম্যাচিং করে রঙ কিনে দাগ মোছারও চেষ্টা হল। কিন্তু জেদ করে এনামুল ফ্যান নিয়ে গেল তিন দিন পরেই।
ফ্যান দেখে মহিলা আৎকে উঠলেন, একি করেছেন ফ্যানের! ফ্যানের তো সর্বনাশ হয়ে গেছে!
: আপা, হাতুড়ির বাড়ি পড়েছে, ঝালাই করতে হয়েছে, দাগ তো একটু পড়বেই। আমি ম্যাচিং করে রঙ লাগিয়ে দিয়েছি।
: এর নাম ম্যাচিং! কী সুন্দর ক্রীম কালারের ফ্যান আমার আর আপনি এটা কী রঙ লাগিয়েছেন  সবই তো বোঝা যাচ্ছে।
এ সময় গণি সাহেব বললেন, আচ্ছা বাদ দাও। ঘুরলে কিছু বোঝা যাবে না।
মহিলা এবার স্বামীর উপর ছ্যাৎ করে উঠলেন, তুমি চুপ কর! ফ্যান কি সব সময় ঘুরবে?
ভদ্রলোক চুপ করে গেলেন কিন্তু এনামুলের মুখ খুলে গেল, আপা শুনেন, ধরেন আপনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হলেন। আপনার একটা অপারেশন হল। অসুখটাও সারল। কিন্তু দাগটা কি কোনোদিন সারবে?
ভদ্রলোকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ঠিক বলেছেন ভাই। তারপর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার বুঝেছ?
স্ত্রী বুঝলেন কি বুঝলেন না বোঝা গেল না। ভিতরের ঘরে চলে গেলেন।
টাকা নিয়ে এনামুলও চলে এল।
মাঝে মাঝে তাই এই মিস্ত্রির কাজটা ছেড়ে দিতে মন চায়। কিন্তু মাসের শেষের দিকে যখন জোর টানাটানি পড়ে যায় তখন আবার মনে হয় ভাগ্যিস এই বিদ্যাটা জানা ছিল তা না হলে দিন চলত কী করে? বিমা কোম্পানির কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে যা পাওয়া যায় তাতে তো খুব টেনেটুনে বিশ দিনের বেশি যায় না। কখনো কখনো গ্রামে ফিরে যাওয়ার চিন্তাও করে। ছেলে-মেয়ে দুটোর পড়ালেখার চিন্তায় সে চিন্তাও বেশি দূর যেতে পারে না। গ্রাম একবার যাকে উগরে দেয় তাকে আর সহজে গ্রহণ করতে চায় না।
এনামুল যাচ্ছে সাইফুল ভাইয়ের বাড়ি। সাইফুল ভাই অন্যরকম মানুষ। দিলখোলা। টাকা-পয়সায়, মুখেও। একেবারে তার খাস কামরায় নিয়ে বসান। সমস্যাটা কী তা ফোনে বলেননি। এনামুল যখন জানতে চেয়েছে, বলেন না সমস্যাটা কী? ওপাশ থেকে সাইফুল ভাই বলেছেন, আরে আসেন না। সমস্যা ছাড়াও তো ডাকতে পারি।
এনামুল আর কিছু জানতে চায়নি। কাজের চাপের কারণেই আজ ছুটি নিয়েছে সে। ভরদুপুরের গনগনে রোদেই তাই রওনা দিয়েছে। বিকেলে যদি আবার অন্য কোনো দিকে যেতে হয়। সাইফুল ভাই না বললেও এনামুল অনুমান করছে আইপিএস-এ কোনো সমস্যা হয়েছে। সাইফুল ভাইকে দুইটা আইপিএস দিয়েছে সে। কোনটার কোন সমস্যা হলো কে জানে।
ভ্যাপসা গরমে ঘেমে, ভিজে সাইফুল ভাইয়ের বাড়ির খোলা গেইট দিয়ে ঢুকে গেল এনামুল। শরীর ঠান্ডা না হলেও মন ঠান্ডা হয়ে গেল গাছের ছায়ায়। গেইট থেকেই শুরু। বাড়ির বড় পুকুরটার চারদিক ঘিরে শুধু গাছ আর গাছ। কত জাতের যে গাছ অনেকগুলোর নামও জানে না এনামুল। একটা গাছে ফুটবলের মতো দেখতে সেরকমই বড় হালকা সবুজ রঙের এক ধরণের ফল ঝুলে আছে। এটা নাকি খাওয়া যায় না কিন্তু দেখলেই খেতে ইচ্ছে হয় এনামুলের। গাছটার নাম সাইফুল ভাইও বলতে পারেননি। এত বড় পুকুরওয়ালা বাড়ি এই শহরে এখন আর দ্বিতীয়টি বোধহয় নেই। সেই ফুটবলাকৃতির ফলের গাছের নিচে দিয়ে হেঁটে গিয়ে সাইফুল ভাইয়ের খাসকামরার সামনে দাঁড়াল এনামুল। দরজা খোলাই ছিল। এনামুলকে দেখেই ভিতর থেকে ডাকলেন তিনি, আসেন এনামুল ভাই, আসেন।
ঢুকেই প্রাণটা শীতল হয়ে গেল। বিশাল ঘরটার এসিটাও বিশাল। তিন টনি। সাইফুল ভাই ডাকলেন, মনির কোথায়, মনির!
তোরো-চৌদ্দ বছরের মনির এসে বিনীত ভঙ্গিতে সামনে দাঁড়াল। সাইফুল ভাই বললেন, এনামুল ভাইকে নাশতা-পানি দাও।
আদেশ পেয়েই মনির ভিতরে চলে গেল। সাইফুল ভাই বসেছিলেন, উঠে দাঁড়ালেন, নাশতা-পানি খেয়ে ঠান্ডা হোন। পরে কথা বলি। আমি একটু আসছি। বলে, তিনিও ভিতরে চলে গেলেন।
পানীয় এল দুই রকম। ফ্রিজের ঠান্ডা পানি, লেবুর শরবত। সঙ্গে ফল; আপেল, খেঁজুর, পেয়ারা। আরেকটা পিরিচে সাদা ধবধবে দুটো মিষ্টি। এ আপ্যায়ন অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। সাইফুল ভাইয়ের বাড়ি এসে আপ্যায়িত না-হয়ে যাওয়াটাই অপ্রত্যাশিত। যতবার এসেছে ততবার এরকমই আপ্যায়িত হয়েছে এনামুল।
এনামুল দুই নিঃশ্বাসে পানীয়ের গ্লাস দুটো খালি করে ফেলল। তারপর তিন টুকরো আপেল আর দুই টুকরো পেয়ারা খেয়ে যখন একটা খেঁজুর হাতে নিল তখনই সুন্দরী এক মহিলা ঢুকলেন ঘরে; সঙ্গে পনেরো-ষোলো বছরের একটি মেয়ে তাঁরই মতো রূপের ঝলক তারও। মহিলা ঢুকেই জানতে চাইলেন, সাইফুল ভাই আছে?
এনামুল ‘আছে’ বলার সঙ্গে সঙ্গে মহিলা এনামুলের উল্টো পাশের সোফাটায় বসে পড়লেন; পাশ ঘেষে মেয়েটিও।
এনামুল দুটো খেঁজুর খেয়ে মিষ্টির পিরিচটা হাতে নিয়ে সামনে বসা নারী দু জন নিয়ে ভাবতে লাগল। মা-মেয়েই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু এত বড় মেয়ে জন্ম দিয়ে মা এত ঝলমলে আছে কী করে? এখানে আসার কারণই বা কী? আত্মীয় হলে তো ভিতরেই চলে যেত।
এনামুল মিষ্টি দুটো খেয়ে পিরিচটা টেবিলে রাখতে রাখতে আরেকবার তাকাল তাদের দিকে। দু জনের গায়েই লাল ওড়না। এই ওড়নাই কি তাদেরকে আরো রঙিন করে তুলেছে? এত রঙ নিয়ে এরা এখানে এসেছে কেন? এরা ঘুরাঘুরি করবে রাজধানী শহরে টিভি চ্যানেলের চত্বরে।
এনামুলের ভাবনা ভেসে গেল সাইফুল ভাইয়ের আগমনে, ও আপনারা, কখন এসেছেন?
দু জনই দাঁড়িয়ে গেল। মা বললেন, এই তো এখনই। মেয়ের জেএসসি পরীক্ষা। খালি দুশ্চিন্তা করে, তাই নিয়ে এলাম।
মেয়ে এগিয়ে এসে সালাম করল সাইফুল ভাইকে। সাইফুল ভাই নিজে বসে তাদেরকেও বসতে বললেন। তারা বসল। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, লিজা, চিন্তা করো কেন?
: করতে তো চাই না মামা, এসে যায়।
: চিন্তা কইরো না। পরীক্ষা ভালো হবে।
: আপনি বলছেন মামা!
: হ্যাঁ, ভালো হবে। চিন্তার কিছু নাই। আচ্ছা দাঁড়াও, একটু দেইখা দেই।
কপালে পড়ে যাওয়া মাথার টুপিটা পিছনে একটু ঠেলে দিয়ে সাইফুল ভাই উঠে দাঁড়ালেন। ঘরটার পুব পাশের দেয়ালের কাছে গেলেন। ওখানে তাকের উপর সাজানো ছোট-বড় অনেক কিতাব। একটা বড় কিতাব টেনে নিয়ে ওখানে দাঁড়িয়েই পাতা উল্টাতে উল্টাতে এক জায়গায় গিয়ে থামলেন। কিছুক্ষণ কিছু দেখলেন কিংবা পড়লেন। তারপর কিতাবটা রেখে আগের জায়গায় এসে বসে বললেন, একটু সমস্যা আছে, ওইটা থাকব না। তুমি নিশ্চিন্তে যাও, পরীক্ষা দেও।
: দোয়া করবেন মামা।
: অবশ্যই।
মা-মেয়ে উঠে দাঁড়াল।
সাইফুল ভাই বললেন, উঠছেন কেন, বসেন। কিছু খেয়ে যান।
: না সাইফুল ভাই, আজ যাই। লিজার একটা বই কিনতে হবে।
: কিনবেন, সমস্যা কী। মনির, মনির!
মনির চলে এল মুহূর্তেই। সাইফুল ভাই বললেন, উনাদের মিষ্টি দাও।
মা-মেয়ে আবার বসতে প্রায় বাধ্য হল। বসার আগে মা তার পায়ের কাছে রাখা নেটের ব্যাগে জড়ানো কাগজের ঠোঙার একটা প্যাকেট মনিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এটা নিয়ে যাও।
সাইফুল ভাই দেখে বললেন, এসব আবার আনতে গেছেন কেন; ফ্রিজে তো জাগাই নাই।
: লিজা বলল, মামার কাছে খালি হাতে যাব!
মা হাসলেন মেয়ের দিকে তাকিয়ে; মেয়ে মায়ের দিকে। হাসলেন সাইফুল ভাইও। একটু দূরে বসা এনামুলও মিটিমিটি হাসল কী বুঝে কে জানে।
মিষ্টি, ফ্রিজের ঠান্ডা পানি খেয়ে আবার যখন মা-মেয়ে উঠে দাঁড়াল সাইফুল ভাই তখন তাঁর থুতনির গণনাযোগ্য দাড়ি কয়টাতে বাম হাত বুলাচ্ছিলেন। মা এগিয়ে গিয়ে সাইফুল ভাইয়ের ডান হাতে একটা সাদা খাম গুঁজে দিলেন। নিঃশব্দে খামটা তিনি তাঁর পাঞ্জাবির ডান পকেটে পুরে ফেললেন।
মা-মেয়ে বেরিয়ে যেতেই সাইফুল ভাই গিয়ে বসলেন এনামুলের পাশে। বললেন, এনামুল ভাই, আমার তো আরেকটা আইপিএস লাগব।
এনামুল খুশি আর গোপন করল না। হেসে বলল, লাগব, দিব।
: তা তো দিবেন কিন্তু টাকা? টাকা তো নাই।
এনামুল হেঁয়ালি বুঝল। বলল, টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
: আসলে আপনাকে যখন ফোন করি তখনও টাকার যোগাড় ছিল না। একটু আগে ব্যবস্থা হল। জুবলীঘাটে স্যানেটারির ব্যবসা করে নজরুল ভাইয়ের কথা মনে আছে আপনার?
: আছে। গতবার ব্যাটারির টাকার জন্য তো উনার কাছেইপাঠাইছিলেন।
: উনার কাছে গিয়ে আমার কথা বলবেন, আপনাকে বিশ হাজার টাকা দিব। কাজ শুরু করেন, বাকিটা পরে হবে।
: আচ্ছা, আমি আজই যাব। আইপিএস লাগব কবে?
: যত তাড়াতাড়ি পারেন।
: একটা সপ্তাহ সময় দেন। অফিসে কাজের চাপটা একটু বেশি।
: আচ্ছা ঠিক আছে, আপনার যেভাবে সুবিধা।
: আগের দুইটা ঠিকমতো চলছে তো?
: হ্যাঁ, ঠিক আছে।
: সমস্যা হইলেই কল দিবেন।
: তা তো দিবই।
: আজ তা হলে যাই?
: যাবেনই তো। বসেন না। এই গরমে বাইরে গিয়া করবেন কী?
: একটা ফ্যান খুলে রাখছি। কয়েল প্যাচাতে হবে।
: আপনার ছেলের খবর কী?
: ছেলে তো এইবার এসএসসি দিব।
: মেয়েটা?
: ক্লাস থ্রিতে পড়ে।
: কোন স্কুলে?
: বাসার কাছেই একটা কিন্ডারগার্টেনে।
: ছেলে পড়ালেখায় কেমন?
: ভালো। এইবার তো থার্ড হইছে।
: পরীক্ষার আগে আগে একবার নিয়া আইসেন। আরো ভালো করব।
: আচ্ছা। আপনার ছেলের খবর কী? জিলা স্কুলে না ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল।
: দিছে তো। এইবারও তো হইল না। আর কী করব কন! মাসে পাঁচ হাজার টাকায় জিলা স্কুলের মাস্টারই বাসায় আইসা পড়াইল। তাও তো হইল না।
: কয়বার দিল পরীক্ষা?
: এইবার নিয়া তিনবার।
: কী করবেন, কপালে নাই।
: হ ভাই, সবার কপালে সব জোটে না।
: আচ্ছা, আজ যাই তাইলে।
: যান।
এনামুল উঠে দাঁড়াল। সাইফুল ভাই বিমর্ষমুখে বসেই রইলেন।

সাইফুল ভাইয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে পুকুরপাড় ধরে গেইটের দিকে হাঁটছিল এনামুল। পুকুরের পুব-দক্ষিণ কোণে বড় রাস্তার পাশ ঘেষে আরেকটি ঘর। ঘরটি দোতলা। এই ঘরের পাশ দিয়েই গেইটে যেতে হয়। ঘরটার কাছে এসে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল সে। ফুলের গন্ধ নাকে লাগল মনে হল। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে গন্ধটা আবার বোঝার চেষ্টা করল। হ্যাঁ, ফুলের গন্ধই। গন্ধটাও চেনা। বেলী ফুলের গন্ধ। কিন্তু আশেপাশে তো রঙ্গন ছাড়া আর কোনো ফুলের গাছ দেখা যাচ্ছে না। যখন এসেছে তখনও গন্ধ পায়নি। এখন হঠাৎ গন্ধ আসছে কোত্থেকে? এনামুল গেইটের দিকে না গিয়ে ঘরটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। খোলা দরজা দিয়ে ঘরের ভিতর দুটো মাথা দেখা গেল। দুটো মাথাই লাল ওড়নায় ঢাকা। তাদের মুখ দেখা যাচ্ছে না। তার দিকে পেছন ফেরা। কিন্তু মাথার লাল ওড়না দেখেই এনামুল তাদের চিনে ফেলল। এরা সেই মা ও মেয়ে।
এনামুল যতবার এ বাড়ি এসেছে কমপক্ষে তার দ্বিগুণবার এ ঘরটার দিকে তাকিয়েছে। একবার ঢোকার সময় বাম দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে, আরেকবার যাওয়ার সময় ডানদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে। কিন্তু কোনো দিন ঘরের ভিতরে ঢুকেনি। আজ হঠাৎ করে আরো তিন কদম এগিয়ে পায়ের চটি দুটো খুলে ফেলল এনামুল।
ঘরটার তিনটা অংশ। প্রথম অংশটা অর্ধচন্দ্রাকৃতির বারান্দা। দ্বিতীয় অংশটা বেশ বড় কমপক্ষে ত্রিশ ফুট বাই বিশ ফুটের একটা কামরা। তৃতীয় অংশটা আকারে অনেক ছোট কিন্তু প্রকারে বিশাল।
এনামুল চটি দুটো বারান্দার নিচে রেখে ব্যাগটা হাতে নিয়ে বারান্দায় উঠে গেল। বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে ব্যাগটা রেখে ভিতরে ঢুকে গেল সে এবং সঙ্গে সঙ্গে ফুলের গন্ধের পর্দা খুলে গেল।
লাল ওড়নায় ঢাকা মাথা দুটোর মুখ দেখা যাচ্ছে এখন। মা-মেয়েই। কিন্তু মাথা আরেকটা আছে তাকে বাইরে থেকে দেখা যায়নি। একটু দূরে সে চাবি হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
বেলী ফুলের সৌরভ ছড়িয়েছে এই মা-মেয়ে আগরবাতি জ্বালিয়ে। আগরবাতির পাশে কয়েকটা মোমবাতিও জ্বলছে। দুই জনই তাদের হাত দুটো উপরে তুলে গভীর আবেশে চোখ বন্ধ করে অনবরত ঠোঁট নাড়িয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত এনামুলের উপস্থিতিও টের পায়নি।
পরের ঘরটার প্রবেশাধিকারে সম্ভবত বিধিনিষেধ আছে। বাম পাশের ছ্ট্টো দরজার বিশাল তালাটা তা খানিকটা জানান দিচ্ছে। এই ঘরে বসে ওই ঘরের ভিতরটা দেখার জন্য লোহার মোটা রড দিয়ে ডিম্বাকৃতির বিশাল একটা জানালা রাখা হয়েছে। এরকম মজবুত আরেকটা ছ্ট্টো জানালা আছে এই ঘরের বাইরে থেকে দেখার জন্য সেটা বড় রাস্তার পাশ দিয়ে।
এনামুল ডিম্বাকৃতির বিশাল সেই জানালা দিয়ে ছ্ট্টো করে তাকাল। পুরোটা দেখা যায় না। তবে মেঝে থেকে কয়েক হাত উঁচু করে আরবি লেখা সবুজ কাপড়ে যাকে ঢেকে রাখা হয়েছে তাকে পুরোপুরিই দেখা যায়। দেয়ালে টানানো ইনভেলাপ সাইজের মলিন ছবিটাও বোধহয় তারই। এনামুল আজই একটু ভালো করে দেখল আগের দেখা উঁকিঝুকি পর্যন্তই। না দেখলেও সাইফুল ভাইয়ের মুখেই শুনেছে এখানে যিনি রাজকীয় ভঙ্গিতে শুয়ে আছেন তিনি সাইফুল ভাইয়ের দাদার বাবা।
মা-মেয়ের চোখ খোলার আগেই যেমন নিঃশব্দে এনামুল ঢুকেছিল তেমন নিঃশব্দেই আবার বের হয়ে এল। বারান্দা থেকে ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে নিচে নেমে চটি পায়ে দিতে দিতে বারান্দার উপর লাগানো সাইনবোর্ডটা বিড়বিড় করে পড়ল সে ‘পীর হজরত কালাশাহ বিক্রমপুরী (র.) চিশতী-উছ-ছাবেরীসাহেবের মাজার শরীফ’।
গেইটে এসে আবার ঘরটার দিকে তাকাল এনামুল। দোতলার ছাদের উপর চকচকে সবুজ গম্বুজটা দেখা যাচ্ছে। গম্বুজের পাশেই আরো কয়েক হাত উপরে একটা পতাকা পতপত করে বাতাসে উড়ছে। চাঁদ-তারা আঁকা ত্রিকোণ সবুজ পতাকাটা বাতাসে তার লেজ নেড়ে নেড়ে যেন ডাকছে, আয়, আয়, আয়।
এনামুল মনে মনে বলল, কী করে যাই বল? সাইফুল ভাইয়ের ছেলের পরীক্ষাটা যেদিন ভালো হবে সেদিন ভেবে দেখব।

 

মাহবুবুল আলম মাসুদ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top