সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

বধির নিরবধি (শেষ পর্ব) : আসিফ মেহ্‌দী


প্রকাশিত:
১৯ নভেম্বর ২০২০ ২০:৫৯

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ০৬:৪৮

 

(দেশসেরা দুই ফান ম্যাগাজিন ‘উন্মাদ’ ও ‘রস+আলো’তে লেখার সুবাদে আসিফ মেহ্‌দী রম্যলেখক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন আগেই। ‘বেতাল রম্য’ নামের প্রথম বইয়েই তিনি লাভ করেন তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা। তারপর একে একে প্রকাশিত তাঁর প্রতিটি বইয়ে ব্যঙ্গ আর হাসির সঙ্গে গভীর জীবনবোধের প্রতিফলন ঘটিয়ে তিনি শুধু পাঠকপ্রিয়তাই লাভ করেননি, তাঁর বইগুলো উঠে এসেছে বেস্ট সেলার বইয়ের তালিকায়। সেগুলোর মধ্যে 'বধির নিরবধি', ‘মায়া’, ‘অপ্সরা’, ‘তরু-নৃ’ অন্যতম। এছাড়া এনটিভিতে প্রচারিত তাঁর লেখা নাটক ‘অ্যানালগ ভালোবাসা’-র বিষয়বস্তুর জীবনঘনিষ্ঠতা দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়েছে। ‘ন্যানো কাব্য’ নামে একটি বিশেষ কাব্যধারার প্রবর্তক আসিফ মেহ্‌দী কবিতা প্রেমীদের কাছে ন্যানো কবি হিসেবে পরিচিত। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পঁচিশ।)

 

শেষ পর্বঃ

ইনা ও তাহমিদ পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত থেকে ফেরার পথেই খবর পেয়েছিল, শওকত সাহেব আর নেই। খবরটি ইফরাকে জানানোর পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সেই যে শয্যাশায়ী হলেন, আর কখনো পূর্ণ সুস্থতা ফিরে পাননি। বর্তমানে তাকে দেখভালের জন্য একজন কেয়ারার থাকেন তার সঙ্গে। সময় পেলেই তাহমিদ হালিশহরে এসে ইফরা দাদুমণির সঙ্গে দেখা করে যায়। গল্পের খোঁজে থাকা তাহমিদ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে কোনো এক সময়ে পৃথিবীর বুকজুড়ে থাকা ইফরা ও শওকতের অসাধারণ প্রেমকাহিনি।

বন্ধুমনা সংঘের আড্ডা এখন কেন যেন আর জমে না। শওকত সাহেবের মৃত্যুর পর সদস্যদের বাড়িবাড়ি গিয়ে প্রতিদিনের আড্ডা তেমন একটা আর হয়নি। শওকত সাহেবকে কবর দেওয়ার সময় এই সংঘের সদস্যরা শিশুর মতো হাউমাউ করে কেঁদেছেন। কারণ, বৃষ্টির জন্য কবরে সেদিন হুহু করে পানি ঢুকছিল। ঠেকানো যায়নি সেই জলের ধারা। শেষমেশ প্রিয় বন্ধুটির সাধের শরীর পানির মাঝে রেখেই কবর দিতে হয়েছে।

নিজের জীবন নিয়ে ভাবতে ভাবতে একটা সময় ঠিকই জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে পেরেছে রনি। মনের গোপন কুঠুরিতে থাকা ইচ্ছাটির কথা জানতে পেরেছে। সে আসলে আড্ডাবাজি, বন্ধুতা, ভ্রমণ-এসব অন্তর থেকে ভালোবাসে। নূপুর তাকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো করে ফেলেছিল সত্য কিন্তু তার অন্তরকুঠুরির ইচ্ছামণিটিকে নিতে পারেনি। নিজের ক্যারিয়ারের একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরি করে এগোচ্ছে রনি। স্কলারশিপ নিয়ে আপাতত বিদেশে পড়তে যাওয়ার ইচ্ছা তার। পৃথিবী গ্রহের অবারিত সৌন্দর্য আস্বাদনের জন্য এবং নতুন বন্ধুর খোঁজে তার এই পথচলা। আরও একটি খোঁজ সে চালাচ্ছে মনেমনে। সুন্দর দেখতে মানুষের পরিবর্তে সুন্দর মনের কাউকে খুঁজে চলেছে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে।

‘দ্য ইনোভেটর’ ইনো ভাইয়ের দেওয়া কৌশলে রুহানের সমস্যাটির সমাধান হয়েছে। প্রীতি ঘরের মধ্যে স্বামীর কাছে অন্য মেয়ের আসা কোনোভাবেই মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। এটি তার মধ্যে ভীষণ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। ফলে সে নিজ থেকেই নয়নকে আর কখনো ঘরে আনেনি বা পারিবারিক কোনো বিষয়ে জড়ায়নি। প্রীতি ভালোভাবে অনুভব করতে পেরেছে, সংসার পবিত্র জায়গা এবং পবিত্রতা ছাড়া পবিত্র জায়গা টিকে না।

ইনা তার দাদাজানকে যত চিনছে, ততই অবাক হচ্ছে! শওকত সাহেবের মৃত্যুর পর মতি নামের এক বয়স্ক লোক ইনার সঙ্গে দেখা করেন। তিনি নাকি দাদাজানের পরম বন্ধু; অথচ ইনা তাকে আগে কখনো দেখেনি। মতি দাদা থাকেন চট্টগ্রামে। তিনি ঢাকায় ইনার সঙ্গে দেখা করে তার হাতে তুলে দেন শওকত সাহেবের রেখে যাওয়া উপহার! ইনা সহজেই বুঝতে পেরেছে, তার দাদাজান যে অপূর্ব পারিশ্রমিকের কথা বলেছিলেন, এ উপহার সেই পারিশ্রমিক। 

শ্রাবণের এক রাতে ইনা যখন তার রুমে একাকী, তখন খুলল উপহারের প্যাকেট। সবুজ পাথরের অপূর্ব একটি মালা। ইনার মন বলছে, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে স্কটল্যান্ড থেকে এই মালা দাদাজান কিনেছিলেন তার প্রিয় মানুষটিকে দেওয়ার জন্য! মালার পেছনে আসলে কী গল্প লুকিয়ে আছে, তা ইনার জানা নেই; তবে আজ মালাটি ইনার হাতে। হঠাৎ ইনার চোখে পড়ল, মালার সঙ্গে ছোট্ট একটি চিরকুট। চিরকুটের ভাঁজ খুলল সে। তাতে লেখা, ‘দাদু, মনে রাখবি এক জীবনে মনের ওপরে কিছু নেই। অথচ মনের কথাই আমরা শুনি না। বধির থাকি নিরবধি। অনুরোধ থাকবে, মনের কথা শুনবি। তোর মনের মানুষের জন্য শুভকামনা। তোদের জন্য অপরিমেয় দোয়া।’ শোভন নাকি তাহমিদ-এ নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্বে ছিল ইনা। দাদাজানের বার্তাটি পড়ার পর ইনা নিবিষ্ট চিত্তে তার মনের কথা শুনতে চাইল। আশ্চর্য, মন যেন কিছু বলে উঠল! একবুক আনন্দ নিয়ে ইনা হেডফোন কানে নিল। বেজে উঠল তার প্রিয় গান,

“এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে নাতো মন,
কাছে যাব কবে পাব ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।”

পরিশিষ্ট:
(ইফরা-র কাছে লেখা শওকতের চিঠি)

 

প্রিয় ইনা,
পঞ্চাশ বছর আমার জন্য অতিরিক্ত দীর্ঘ ছিল। তারপরও নিজে হাজির হতে পারলাম না বলে অতীব দুঃখিত। তুমি হয়তো দূর থেকে অনুভব করেছ, এই সুদীর্ঘ অপেক্ষার প্রতিটা দিন আমি তোমাকে স্মরণ করেছি। রোজ একটি করে মেঘ পাঠিয়েছি তোমার ঠিকানায়। গ্লেনকো-র পাহাড়ের শিখর পেঁচিয়ে থাকা সেই মেঘ! তাতে ভরে দিয়েছি না-বলা মিষ্টি কথামালা আর আদুরে আবদার। তারপর অপেক্ষা করেছি; শুধুই অপেক্ষা। কোনো মেঘ ফিরে আসেনি তোমার উত্তর নিয়ে। তাই কখনো খররোদে পুড়েছে আমার হৃদয়, কখনো কুয়াশায় ঢেকেছে কষ্টগুলো। থেমেছে জীবনের চঞ্চলতা; তবু থামেনি অপেক্ষা। 

ভেবেছিলাম, কদম ফুল হাতে হাজির হব পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হওয়া শ্রাবণের বৃষ্টিমাখা দিনে। বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে প্যাচপেচে কাদাপায়ে আমাকে দেখে শুরু হবে তোমার ঝালবকুনি। সেই প্রতীক্ষিত ক্ষণের মাত্র কয়েক দিন বাকি; অথচ হঠাৎ করেই অসহনীয় শারীরিক অসুস্থতা অনুভব করছি। এক জীবনে আর একটিবার দেখার অপেক্ষা শেষ হবে কিনা জানি না। সৃষ্টির সবকিছুরই শেষ আছে। অপেক্ষারও শেষ আছে, আমার বিশ্বাস।

স্কটল্যান্ডের সেই প্রথম সাক্ষাতের দিনটি অমোচনীয় কালির মতো লেপটে আছে আমার হৃৎপ্রকোষ্ঠে। কী কাকতালীয়ভাবেই না সেদিন ট্রাভেল এজেন্সির বাসে পাশাপাশি আমাদের আসন হয়েছিল! তুমি লজ্জায় রাঙা হচ্ছিলে আর সদ্য যৌবনে পা রাখা আমি ঐন্দ্রজালিক সৌন্দর্যের প্রথম ধাক্কা সামলানোতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে ঠিকই কথা হলো দুজনাতে। আলাপচারিতা ছাড়াও ছুটে চলা বাসে সহস্রবার আড়চোখে তোমার দিকে তাকালাম। মন সঙ্গোপনে জানিয়ে দিল, আমি হৃদয়ে গোপনে লালন করা স্বপ্নের রাজকন্যার পাশে বসে আছি। সেই আড়চোখে তাকানোর মুহূর্ত আমার মস্তিষ্কে প্রোথিত হলো আজীবনের জন্য। তখন জানতাম না যে মুহূর্তটি হবে আমার চিরসঙ্গী। আমার নাসারন্ধ্র যেমন শুষে নেয় আশপাশের বাতাস; তেমনি হৃদয় শুষে নেয় মস্তিষ্কের পরতে সযত্নে রাখা এই একটি ক্ষণ।

বাসের যাত্রা শেষ হলো; আমাদের যাত্রা নয়। পরিচয় থেকে হলো প্রণয়। স্বপ্নীল সেই ক্ষণে মনে হতো, আমাদের দুজনের হৃদয়ধারা একই উৎস থেকে প্রবাহিত। কখনো ভাবিনি সেই হৃদয়প্রবাহে আসবে টর্নেডোর তাণ্ডব। ভয়ংকর ঝড় যে প্রতিটি জীবনেই আসে, তখনও তা জানা ছিল না। বাবা-মায়ের পছন্দ করা পাত্রের হাত ধরে চলে গেলে চিরজীবনের জন্য।

যাওয়ার আগে হলো আমাদের শেষ দেখা। সেই অন্যভুবনে; সেই গ্লেনকো-তে। কী পাষাণ তুমি, কত সহজেই ইতি টেনে দিলে স্বপ্নের। হঠাৎ খেয়ালে বললে, ঠিক পঁচিশ বছর পর শেষ দেখার সেই দিনটিতে যদি আমি আবার হাজির হই তোমার সামনে, তাহলে তুমি মনে করবে আমি সত্যিই তোমায় ভালোবেসেছি। আমি বললাম, এই একটি জীবন আমি শুধু তোমাকেই ভালোবেসে কাটাব। বেঁচে থাকলে পঞ্চাশ বছর পর দেখা করে জানিয়ে যাব, জীবনসায়াহ্ণ পর্যন্ত তোমাকে ভুলিনি। এক সাগর অভিমান নিয়ে জীবনের অন্যপ্রহরে সেদিন ডুব দিলাম আমি।

শেষ দেখার পর শুরু হলো মহা অপেক্ষার। তুমি হয়তো পেলে প্রতীক্ষিত জীবন কিন্তু আমি পেলাম অপেক্ষার জীবন। কলেজবন্ধু মতির মাধ্যমে আমি তোমার খোঁজ পেয়েছি কখনোবা; কিন্তু নিজে সামনে হাজির হইনি অভিমানে, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ভয়ে। মাঝেমাঝে খুব ভয় হয় জানো? মনে হয়, এই ভীষণ অপেক্ষার পর ভীষণ প্রিয় মানুষটির দেখা ইহকালে কি আমি আর পাব? এক বুক আশা নিয়ে বেঁচে আছি।

ইতি,
তোমার মায়ার ছায়াসঙ্গী।

সমাপ্ত

আসিফ মেহ্‌দী
কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী

 

বধির নিরবধি (পর্ব এক)
বধির নিরবধি (পর্ব দুই)
বধির নিরবধি (পর্ব তিন)
বধির নিরবধি (পর্ব চার)
বধির নিরবধি (পর্ব পাঁচ)
বধির নিরবধি (পর্ব ছয়)
বধির নিরবধি (পর্ব সাত)
বধির নিরবধি (পর্ব আট)
বধির নিরবধি (পর্ব নয়)
বধির নিরবধি (পর্ব দশ)
বধির নিরবধি (পর্ব এগার)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top