সিডনী বুধবার, ১৭ই এপ্রিল ২০২৪, ৩রা বৈশাখ ১৪৩১

মা, মাটি এবং দেশের জন্য ভালোবাসা : মোঃ ইয়াকুব আলী


প্রকাশিত:
১৯ নভেম্বর ২০২০ ২২:০১

আপডেট:
১৯ নভেম্বর ২০২০ ২২:৩২

 

দূর পরবাসের জীবনে দেশের সাথে যোগাযোগের সবচেয়ে সহজ মাধ্যম হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর ক্ষুদে বার্তা প্রেরণ। অবশ্য এটা দিয়ে অডিও বা ভিডিও কলও করা যায় কিন্তু সময় বা পরিস্থিতির কারণে সেটা আর সবসময় করা হয়ে ওঠে না। সেক্ষেত্রে ক্ষুদে বার্তায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। নিজের কাজ করতে করতে দেশের মানুষের খবর নেয়া যায় এবং নিজেদের খবর দেওয়াও যায়। এমনই দুটো ক্ষুদে বার্তালাপ আজকে আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাইছি।

 

এক

প্রথমজন আমাদের কলেজ জীবনের বন্ধু। যার সাথে আমার কখনওই সরাসরি দেখা হয়নি কিন্তু ফোনে কথা হয়েছে কয়েকবার। আর কলেজ পাশ করার পর দুজনে দু প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়াতে আর সাক্ষাতের সুযোগও তৈরি হয়নি। কিন্তু একই প্রজন্মের হওয়াতে বোঝাপড়াটা দারুণ। ওরা স্বামী স্ত্রী দুজনেই বাংলাদেশের একটা সরকারী মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে সেখানেই কর্মরত আছে। আর দুজনের মানসিকতায় মিল থাকার কারণে বার্তালাপটা হয় আরো বেশি অর্থবহ। পাঁচ বছর পর এইবার ডিসেম্বরে দেশে যাওয়ার টিকেট করা ছিলো। কথা শুরু হলো সেটা নিয়েই।

আমিঃ কেমন আছো?

বন্ধুঃ আলহামদুলিল্লাহ। তোমরা ভালো?

আমিঃ আমরাও ভালো আছি। এইবারও দেশে আসা হলো না আমার। টিকেট করা ছিলো আগাম।

বন্ধুঃ দুঃখ করো না। পরেরবার ইনশআল্লাহ।

আমিঃ এইবার আসাটা জরুরী ছিলো। দেশ থেকে আসার পাঁচ বছর হয়ে গেলো।

বন্ধুঃ হ্যাঁ।

আমিঃ কম সময় তো নয় বলো? ইদানীং কুষ্টিয়ার সবকিছু স্বপ্নে দেখি। ঘুম ভেঙে জেগে উঠে কুষ্টিয়া খুঁজি।

এই পর্যায়ে আমাদের আলাপটা একটু সিরিয়াস দিয়ে মোড় নেয়।

বন্ধুঃ একবার যাকে ছেড়ে গেছো তার জন্য আর এতো কষ্ট কেন? ভালো দেশে ভালো আছো। সময় পেলে দেশকে দেখে যেয়ো। আর এখন তো দুঃসময়।

আমিঃ আমি জানি না কেন এমন হয়? মা কে তো কখনও বলিনি তোমাকে ভালোবাসি তবুও অসুস্থ্য হলে সবাই আগেই আমরা মায়ের নাম নিই। ব্যাপারটা সেরকম।

বন্ধুঃ সেই মাকেই তো ছেড়ে আছো এতটা সময়?

আমিঃ দুঃখটা সেখানেই। হয়তোবা মাঝে মধ্যে মায়ের উপর বিরক্তও হই কিন্তু ভালোবাসাটা মনের গহীনে ঠিকই আছে।

বন্ধুঃ শোন, আমার যেটা মনেহয় এখন। মাকে ভালোবাসি বলিনি। মাকে প্রতি পনের দিনে দেখতে যাইনি। ছয় মাস পরে দেখতে গেছি। মুখে মুখে মাকে আমি অনেক ভালোবাসি। এইসব আসলে নকল ভালোবাসা। হাজার হাজার মাইল দূরে থেকে বলা, জানো মা তোমাকে অনেক ভালোবাসি। এটাও নকল। 

আমিঃ হয়তোবা, কিন্তু দিনের একটা সময় ঠিকই কিন্তু মাকে তুমি অনুভব করবে।

বন্ধুঃ ভালোবাসা মনের মধ্যে পুষে রাখলে হয় না। তার চর্চা করতে হয়। তুমি যদি মেয়ে বা ছেলে হিসেবে মায়ের দায়িত্ব পালন না করতে পারো তাহলে কি লাভ এই ভালোবাসার?আমরা সন্তানেরা বড্ড স্বার্থপর। আমরা নিজেদেরটাই বুঝি শুধু। আমাদের ছেলে মেয়েরাও তাই করবে।

এরপর মেজাজ আরও একটু চড়িয়ে বন্ধুটি বলে যায়, ইয়াকুব সাহেব, তুমি কি মনেকরো অস্ট্রেলিয়া বসে তার মায়ের কথা ভাবলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? আমি তো পারিনি আমার মায়ের সেবা করতে, দায়িত্ব পালন করতে। এখন তো আর শত চাইলেও সেটা পারবো না।  .

আমিঃ এই কথাটা সেদিন এক বন্ধুকে বলছিলাম। এতটা শিক্ষিত নাহলেও হয়তোবা পারতাম। গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক হলেই বরং ভালো করতাম। অন্ততঃপক্ষে প্রিয়জনদের পাশে থাকতে পারতাম।

বন্ধুঃ মার সাথে রাত দিন কথা বলা। মায়ের সব চাহিদা পূরণ করা, চিকিৎসা করানো এগুলোর সবই আমি করতাম কিন্তু মায়ের আসল চাহিদা ছিলাম আমি, আমার উপস্থিতি। এটা আমি বুঝিনি। 

আমিঃ খুব সত্যি কথা বলেছো। উনারা স্বচ্ছলতা চান না। চান শুধু প্রিয় মানুষদের একটু ছোঁয়া, একটু পাশে থাকা।

বন্ধুঃ আমার এক সহকর্মী আছেন। প্রতি সপ্তাহে তার মাকে দেখতে যান। সামান্য বেতন পান। প্রাইভেট প্রাকটিস করেন না। এই করোনার সময়েও প্রাইভেট কার ভাড়া করে মাকে দেখতে যান। মাকে একবেলা ইনসুলিন দিয়ে দেন। তার কি যে সন্তুষ্টি।

এরপর কথা আরো এগিয়ে যায়। প্ৰসংগক্রমেই দেশ মাতৃকার কথা চলে আসে।

"মাঝে মাঝে দেশের উপর খুব অভিমান, রাগ হয় যখন প্রাপ্য সম্মান পাই না এবং চারিদিকে শুধু দুই নম্বরি আর দুর্নীতিবাজদের দেখি। শুধু প্রিয়জনদের কাছাকাছি থাকার জন্যই হয়তোবা দেশে পরে আছি।"

এরপর আসে ব্যাক্তিগত কাজের প্রসঙ্গ।

"আমার স্বামীকে দেখি প্রতিদিন অন্যদের দ্বারা অপমানিত হতে তবুও সে তার বাবা মাকে ফেলে কোথাও যাবে না। এমনকি বাসার অন্য তলাতেও যেতে রাজি না।"

আমিঃ খুব ভালো করেছেন। এমন ছেলে লাখে একটা।

বন্ধুঃ কিন্তু ঐ যে কাজে সন্তুষ্টি নেই। রাতদিন সে কষ্ট করে আর ফল অন্যরা পায়।

আমিঃ কিছু মানুষের কপালটাই এমন। সারাজীবন কষ্ট করবে আর ফল অন্যরা নিবে।

বন্ধুঃ আর আছে পরচর্চা। অন্যের ভালো কাজে বাধা।

আমিঃ মুশকিল তো সেখানেই। তবুও বাবা মায়ের কাছে আছে সেটাই আসল সন্তুষ্টি।

বন্ধুঃ রাতদিন বিনামূল্যে অপারেশন করে তাই যারা বেশি বেশি প্রাইভেট প্রাকটিস করে তারা পিছনে লেগেই আছে। মাঝেমাঝে ভেঙে পরে আবার মাঝেমাঝে বলে যে যা করে করুক। আমি কি করলাম সেটাই আমার কাছে আসল।

আমিঃ খুব ভালো ভাবনা। ও ওর কাজটা করে যাচ্ছে ঠিকমতো। এটাই ওর সান্ত্বনা। আমি তোমাদের জন্য সবসময় দোয়া করি। এতো প্রতিকূলতার মধ্যেও তোমরা নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে মানুষের সেবা করে যাচ্ছো।

 

দুই

রাসেলের সাথে পরিচয় আমার বন্ধু আমিনুরের মাধ্যমে। কলেজ পাশ করে আমি ঢাকা চলে আসলাম আর আমিনুর ভর্তি হলো কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিভাগে। সেই বিভাগেরই জুনিয়র রাসেল। আমাদের কুষ্টিয়ারই ছেলে তবুও পরিচয় ছিলো না কারণ আমাদের স্কুল আলাদা ছিলো। রাসেলের সাথে পরিচয়ের পর ঘনিষ্ঠতা হতে সময় লাগেনি। আমাদের সময়ে কুষ্টিয়ার সবার সাথেই আমরা কমবেশি পরিচিত ছিলাম। সেদিক দিয়ে রাসেল আবার আমাদের বন্ধু মান্নার ছোট ভাই চঞ্চলের ব্যাচের। এটা অবশ্য জেনেছি বেশ পরে। আমাদের দুজনের চরিত্রেই মারাত্মক রকমের দুরন্তপনা আছে। কিন্তু একইসাথে আমরা দুজন আবার প্রচন্ড রকমের ঘরকুনো। আমরা দ্রুতই কোন কিছুর সাথে নিজেদের যুক্ত করে ফেলি।

শৈশব কৈশোরের বিশাল একটা সময় কুষ্টিয়ায় কাটিয়ে ঢাকায় পড়তে যেয়ে আমি প্রতি মুহুর্তে কুষ্টিয়ার সবকিছুকে খুব বেশি অনুভব করতাম। রাসেলের অবস্থাও অনেকটা তাই। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে জীবন ও জীবিকার টানে তাকে ঢাকা থাকতে হয় কিন্তু মনটা পড়ে থাকে কুষ্টিয়াতে।  তাই অস্ট্রেলিয়া আসার পরও ও যতবারই কুষ্টিয়া গেছে মুঠোফোনে ভিডিও কল দিয়ে আমাকে আমাদের শৈশব কৈশোরের নিত্যসঙ্গী গড়াই নদী দেখিয়েছে। অনেকেই জানেন না হয়তোবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা "আমাদের ছোট নদী" এই গড়াই নদীকে নিয়ে লেখা। আমরা কুষ্টিয়ার মানুষ আসলেই খুবই সৌভাগ্যবান যে আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লালনের মতো মানুষদের চরন ধূলি পেয়েছি। সম্প্রতি রাসেলের সাথে কথা হচ্ছিলো ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে।

আমিঃ কেমন আছো তোমরা?

রাসেলঃ ভাই মনের মধ্যে অশান্তি। কিছুই ভালো লাগে না।

আমিঃ আবার কি নিয়ে অশান্তি?

রাসেলঃ আর চাকরি করতে ভালো লাগে না ভাই। বাড়ি যেতে মন চাই।

আমিঃ আহারে পাঁচ বছর কুষ্টিয়া যাই না।

রাসেলঃ মনেহয় নদীর ধারে যেয়ে বসে থাকি। মাছ মারি। কলেজের পুকুর ঘাটে আড্ডা দিই। ঈদগাহে ক্রিকেট খেলি। সাইকেল নিয়ে রেনউইক বাঁধে যাই। মতি মিঞার রেইলগেটটা কতদিন দেখি না। বদু দত্তের হোটেলটা আছে কি না জানি না ভাই।

আমিঃ ছোট বেলায় আমরা মতি মিঞার রেইলগেটে ঝুলে থাকতাম।

রাসেলঃ দধী ভান্ডারের দই চিড়া। পুরোনো মানুষগুলোকে অনেক অনুভব করি ভাই। তাদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ভুলি কেমন করে?

আমিঃ ঠিক তাই। একে একে সব হারিয়ে যাচ্ছে।

রাসেলঃ ভালো লাগছে না। এদিকে অফিস থেকেও ছুটি পাচ্ছি না। মনেহয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যাই। এভাবে বাঁচা যায় না। এভাবে বেঁচে থাকা মানে জীবনের সাথে ছলনা করা। কতদিন খেজুরের রস খাই না। দুঃখিত ভাই, অনেক আবেগের কথা বলে ফেললাম।

আমিঃ আমরা সবাই সুখে থাকার অভিনয় করে যাচ্ছি।

রাসেলঃ আসলে এখন নিজের আবেগটাও মানুষ বুঝে প্রকাশ করতে হয়। আপনি কেমন আছেন?

আমিঃ ঠিক তাই। তুমি এই কথাগুলো অন্য কাউকে বললে ভাববে তুমি ভাব নিচ্ছো। সুখে থাকে তাই এইসব বিলাসী ভাবনা ভাবে। কিন্তু আমি জানি তুমি ঠিক কেমন অনুভব করছো।

এরপর রাসেল রাস্তার মাঝে নির্মীয়মাণ একটা কংক্রিটের একটা থামের ছবি দিয়ে লিখলো, এই আমার প্রতিদিনের সকাল।

আমিঃ পুরো ঢাকাটা কংক্রিটের জঙ্গল হয়ে যাচ্ছে।

রাসেলঃ আপনার সাথে ভিডিও কল করতে পারছি না। আমি নিশ্চিত আমি কেঁদে ফেলবো।

আমিঃ এখন আমি ডেস্কে। সপ্তাহান্তে কথা হবে ইনশাআল্লাহ।

রাসেলঃ কবে বাংলাদেশে আসবেন?

আমিঃ ডিসেম্বরের টিকেট কাটা ছিলো কিন্তু করোনা সব উলট পালট করে দিলো।

রাসেলঃ বাংলাদেশে করোনা নাই, চলে আসেন। হা হা হা।

আমিঃ তাও ঠিক।

রাসেলঃ আপনি আসলে জানাবেন। কুষ্টিয়াতে সাতদিন দুই ভাই মিলে ঘুরবো। সকালে বের হবো সন্ধ্যায় বাসায় ফিরবো। আমার জন্য সাতদিন বরাদ্দ রাখতে হবে কিন্তু ভাই এবং সেটা অবশ্যই প্রথম দিকে।

আমিঃ অবশ্যই।

রাসেলঃ দোয়া রাখবেন।

আমিঃ ফি আমানিল্লাহ।

 

উপসংহার

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ক্ষুদে বার্তাগুলো প্রবাস জীবনে এভাবেই দেশের মায়া বয়ে নিয়ে আসে। আর আমরা কল্পনায় চলে যায় আমাদের গ্রামের বাড়ির আঙিনায়। গ্রামের মাটির বাড়ির বাইরে রাস্তার ধারে গাছের ছায়ায় বাঁশের চাঙে শুয়ে অলস দুপুর পার করা। যেখানে নেই কোন তাড়াহুড়ো। জীবন চলেছে দুপুরের অলস বাতাসের গতিতে এলোমেলোভাবে।

 

মোঃ ইয়াকুব আলী
মিন্টো, সিডনী, অস্ট্রেলিয়া

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top