সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

বৃদ্ধাশ্রমে মায়ের চোখের জল : মনজুরুল ইসলাম


প্রকাশিত:
২৩ নভেম্বর ২০২০ ২২:০২

আপডেট:
২৩ নভেম্বর ২০২০ ২২:১৪

 

আজ শুক্রবার। জুন মাসের ১১ তারিখ। ২০২০ সাল। বৃদ্ধাশ্রমে সকালের নাস্তা বিতরণ চলছে। ২০ জন ষাটোর্ধ্ব বয়েসি মহিলা বসবাস করে মায়ের দোয়া বৃদ্ধাশ্রমে। বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা মা প্রিয় ছেলে শোভন মাহারা হন বিশ বছর বয়সে। মায়ের প্রতি ভালোবাসা আজীবন বাঁচিয়ে রাখতে তাঁর এমন মহান উদ্দ্যোগ।

 

একমাত্র ছেলে শোভন। বাবা বাবরকে হারিয়েছেন জন্মের তিন মাস আগে। মা সোহানা পরের বাড়িতে কাজ করে ছেলেকে ২০০০ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করান। মা ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ায় শোভন সাহেবের আর লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি। মা নিজের তিন ভরি স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করে ছেলের হাতে ব্যবসা করার জন্য কিছু টাকা তুলে দিয়েছিলো। দু'বছর পরে মা মারা যান এবং মায়ের দোয়ায় ফুটপাতে কাপড়ের ব্যবসা দিয়ে শুরু করে বর্তমানে বিভিন্ন দোকান ও কারখানার মালিক শোভন। বর্তমানে তিনি কোটিপতি।

 

শোভন সাহেব প্রতি শুক্রবারের মতো আজও বৃদ্ধাশ্রমে এলেন বিশজন মায়ের সাথে সকালের নাস্তা করে ভালোবাসা ভাগাভাগি করবেন বলে। তিনি খাবার টেবিলে সকল মায়ের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখতে পান, বৃদ্ধ মা জাহানারা কী যেন দেখছেন এবং শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছছেন। তিনি কান্নার কারণ জানতে চান।

 

জাহানারা হাতের ছবি দেখিয়ে বলেন এটা আমার একমাত্র ছেলে। আজ ছেলের জন্মদিন।আজকের দিনে বিভিন্ন ধরনের রান্না করে ছেলেকে নিজের হাতে খাওয়ায় দিতাম। ছেলের জন্মদিনটা স্মরণীয় হয়ে থাকতো। কপালের এমন নিয়তি আমার বুকের ধনকে আজ আদর করতে পারি না। উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে সে আজ সরকারি বড় কর্মকর্তা।

 

শোভন সাহেব নিজের চোখের জল মুছে জাহানারার পাশের চেয়ারে এসে বসে বললো, মা, তুমি আজ তোমার আদরমাখা হাত দিয়ে আমার মুখে সকালের নাস্তা তুলে দাও। মা ডাক শুনে তৃপ্তি পেলো জাহানারা। শোভন সাহেব মায়ের হাতের খাবার পরম শান্তিতে খেলেন। বৃদ্ধাশ্রমের সকল মায়ের চোখে আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

 

শোভন সাহেব বৃদ্ধাশ্রম থেকে বের হলো। এক কিলোমিটার দূরে  তার প্রতিষ্ঠিত বাবর ও সোহানা পোশাক কারখানা। পোশাক শ্রমিকদের আগামীকাল বেতন দিতে হবে। তাই কারখানার মাসিক হিসেব-নিকেশ করতে যাবে আজ। প্রাইভেট কার নিয়ে  ঢাকার ধানমন্ডি নিজের বাসা থেকে গাজীপুরের টঙ্গি এসেছে। গাড়ীর ইঞ্জিনে একটু সমস্যা দেখা যাওয়ায় ড্রাইভার গাড়ি ঠিক করতে গেছে।

 

কারখানার উদ্দেশ্যে বৃদ্ধাশ্রম থেকে হেঁটেই রওয়ানা দিলো শোভন সাহেব। জাহানারার কথা ভাবছেন আর চোখের জল ফেলছেন। কেননা, জাহানারার জীবনে কত বড় ক্ষতি হয়ে গেলো সেটা শোভন সাহেবই জানেন। জাহানারাকেও জানতে দেননি তার জীবনে কী দুর্ঘটনা ঘটে গেলো। জাহানারার জীবনের করুণ ইতিহাস শোভন সাহেবের মনে উঁকি দিতে লাগলো। জাহানারার বৃদ্ধাশ্রমে আসার কারণ জাহানারার মুখেই শুনেছেন এবং জাহানারা বৃদ্ধাশ্রমে আসার পরে তার সন্তানের খোঁজ-খবর নিয়ে যে পরিণতির কথা জেনেছেন তা জাহানারাকে বলার সাহস করেননি শোভন সাহেব।

 

শোভন সাহেবের এক ঘনিষ্ট পরিচিত লোক ছিলো। বিধান দত্ত তার নাম। ট্রেনের স্টেশন মাস্টার পদে চাকরী করেন। ঢাকা থেকে ব্যবসায়িক কাজে ট্রেনে করে বিভিন্ন সময় চট্টগ্রামে ভ্রমণের সময় শোভন সাহেবের মানবিকতা সম্পর্কে জানতে পারেন বিধান। অতঃপর দুজনের মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠে। সততার পথে চলে নিজের রোজগারের অর্থ মানবতার কল্যানে  বিলিয়ে যারা নিরলস কাজ করে যায় তাদের সাথে সহজেই সবার সাথে শর্তহীনভাবে ভালোবাসার বন্ধন তৈরী হয়।

 

দু'বছর আগে বিধানের একটি ফোন আসে শোভন সাহেবের মোবাইলে। রেল স্টেশনে একজন অসহায় বৃদ্ধ মহিলার খোঁজ পেয়েছেন তিনি। ঘর-বাড়ি নেই উল্লেখ করে চিৎকার করে কান্না করছিলো জাহানারা। জাহানারাকে মায়ের দোয়া বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় দেওয়ার আহ্বান জানান বিধান। শোভন সাহেব মহৎ কাজে না করার লোক নন। তিনি লোক পাঠিয়ে কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে জাহানারাকে নিয়ে যান।

 

জাহানারার একটি মাত্র ছেলে। কিরণ তার নাম। কিরণের আর কোনো ভাই-বোন ছিলো না। মা-ছেলের মধ্যে মধুর সম্পর্ক ছিলো। কিরণের বাবা মোবারক আলী প্রবাসী ছিলো। ইরাকে থাকতো। বাড়ী চট্টগ্রামে। মোবারক ৩০ বছর বয়সে ২৫ বছরের জাহানারাকে বিয়ে করে। দু'বছর পরে ১৯৮৫ সালে তিনি ফ্রি ভিসা নিয়ে ইরাক গমন করেন। মাঝে মাঝে এসে কয়েক মাস দেশে থেকে যেতো। শেষবার ২০০২ সালে ছুটিতে এসে হালিশহরে তিনতলা বাড়ী করে আবার ইরাক চলে যায়। ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের পরে মোবারকের সাথে পরিবারের আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। মোবারক বেঁচে আছে না মারা গেছে সে খবরও পরিবারের কাছে আসেনি।

 

১৯৮৪ সালে কিরণের জন্ম। কিরণের বাবার খোঁজ না থাকলেও জাহানারা দু'টি বাসা ভাড়া দিয়ে প্রাপ্ত বিশ-চব্বিশ হাজার টাকা দিয়ে সন্তানের পড়া-লেখার খরচসহ সংসার চালিয়ে নিতো। মা-ছেলে পরস্পরকে প্রাণের চেয়ে বেশী ভালোবাসতো। ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিরণ সিভিল ইঞ্জিয়ারিং এ স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করে। ২০০৯ সালে বিসিএস ক্যাডার হিসেবে গণপূর্ত বিভাগে সহকারী প্রকৌশলী পদে যোগদান করে। ২০১০ সালে একজন শিল্পপতি ও সংসদ সদস্যের মেয়েকে বউমা হিসেবে ঘরে তোলে জাহানারা। বউমার নাম বিউটি। কিরণ ও বিউটি দম্পতির সংসারে ২০১১ সালে দু'টি জমজ সন্তান হয়। একটি ছেলে সন্তান, একটি মেয়ে সন্তান। দুজনের নাম রাখা হয় সৌরভ ও সুরভী।

 

মায়ের ভালোবাসা ও সেবার পাশাপাশী দাদীর আদর-যত্নে বড় হতে থাকে সৌরভ ও সুরভী। জমজ হলেও তাদের নিয়ে মাকে বেশী কষ্ট পোহাতে হয়নি। তাদের গোছল করানো, ময়লা কাপড় ধোয়ার কাজ, কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি, আদর দিয়ে কান্না থামানো, খেলনা নিয়ে খেলা করা, গান গেয়ে ঘুম পাড়ানো ইত্যাদি কাজে নাতি-নাতনিকে সাধ্যানুযায়ী সময় দিতো জাহানারা।

 

জাহানারা তার স্বামীকে হারিয়ে ছেলে, বউমা, নাতি-নাতনি নিয়ে বেশ হাসি-খুশির সাথে দিন কাটাচ্ছিলো। সৌরভ ও সুরভীর বয়স ৬ বছর হলে তাদেরকে একটি সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করানো হয়। জাহানারা দুজনকে নিয়ে স্কুলে যেতো, স্কুল ছুটি না হওয়া পর্যন্ত বসে থেকে স্কুল ছুটি হলে তাদের নিয়ে বাসায় ফিরে আসতো। এভাবে, সৌরভ ও সুরভী সাফল্যের সাথে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠে। সুরভী বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করে এবং মাত্র পাঁচ নাম্বারের ব্যবধানে সৌরভ দ্বিতীয় স্থান লাভ করে।

 

জাহানারার কপালে সুখ বেশী দিন সইল না। নাতি-নাতনিকে এক রাতে ভূতের গল্প শোনাতে শোনাতে ঘুমিয়ে পড়ে জাহানারা। ঘুমের মাঝে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক ও ব্রেইন স্ট্রোক একত্রে হয়।ভাগ্য কিছুটা হলেও ভালো যে সেদিন কিরণ ছুটিতে বাড়িতেই ছিলো। রাতের ৩:০০ ঘটিকায় অনলাইনে অ্যাম্বুলেন্সকে খবর দিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করায় এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে দুদিন পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় হার্টের বিশেষায়িত হাসপাতালে নিয়ে যায়।  হৃৎপিন্ডের ধমনী রক্ত নালিকার দুটি স্থানে ব্লক ধরা পড়ে। ব্লকগুলোতে রিং বসালে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়। ব্রেইন স্ট্রোকের কারণে বাম পা পক্ষাঘাত তথা অবশ হয়ে যায়।

 

জাহানারাকে চিকিৎসা শেষে বাসায় নিয়ে আসে কিরণ। ঘরের ভেতর হুইল চেয়ারে করে এবং বাহিরে গেলে চলাফেরা করতে হবে ক্র্যাচ নিয়ে। মনের আকাশ যেন মেঘে ঢেকে গেছে জাহানারার। এখন থেকে সংসারের কাজে তেমন সহযোগিতা করতে পারবে না। বরং অনেকটা বোঝা হয়েই থাকতে হবে। এক সপ্তাহ হাসপাতালে চিকিৎসা খরচ হলো প্রায় ৫ লক্ষ টাকা। মায়ের চিকিৎসার জন্য এতো টাকা খরচ হলেও কিরণের বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। কিন্তু, বিউটির মন যেন মানতেই চাচ্ছে না। এতগুলো টাকা চলে গেলো তাই তার মনে যন্ত্রণার শেষ নেই।

 

সংসারে শুরু হয়ে যায় বউ-শাশুড়ি যুদ্ধ। প্রায় এক বছর কেটে গেলো জাহানারা চলাচলে প্রায় অকেজো। কিরণ ঘরে থাকুক বা কর্মস্থলে থাকুক বিউটি মুখোমুখি বা মোবাইলে জাহানারার সেবা করতে অনীহা প্রকাশ করে। কিরণ কখনোই প্রশ্রয় দেয়নি বিউটিকে। বুঝানোর চেষ্টা করেছে নিজের মা হলে তো অবহেলা করা যেতো না। শাশুড়ির স্থানে নিজের মাকেই কল্পনা করো। কিন্তু, বিউটি কোনো উপদেশ বাণী শুনতে নারাজ। এমনকি বিউটি কথায় কথায় জাহানারাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর কথা বলতো। বউমার মুখে বারবার বৃদ্ধাশ্রমের কথা শুনে জাহানারার মন খারাপ হয়ে যায়।

 

জাহানারা অসুস্থ হয়ে অচল হওয়াটাই যে বিউটির মনোবেদনা তা কিন্তু নয়। বিউটি শাশুড়িকে সহ্য করতে না পারার লম্বা ইতিহাস আছে। বিউটিকে বিয়ে করলেও সংসার চালানোতে কিরণ মায়ের উপরই আস্থা রেখেছিলো। বিয়ের পর থেকে সংসারের খরচ মায়ের হাতেই দিতো কিরণ। এতে ধনীর দুলালী বিউটি মনের ইচ্ছে মতো উল্টাপাল্টা খরচ করে বিলাসী জীবন উপভোগ করতে পারতো না। জাহানারার কিছু গুণ থাকলেও তা বিউটির মনে জায়গা করে নিতে পারেনি। প্রতিমাসে ছেলে সংসার খরচ বাবদ যা দিতো তা থেকে মাস শেষে অবশিষ্ট থাকলে জাহানারা ছেলের ব্যাংক হিসাবে জমা করে দিতো। কিরণ সংসার খরচের জন্য টাকা দেওয়া শুরু করলে বাসা ভাড়া থেকে যা পেতো জাহানারা ছেলে ও বউমার নামে মাসিক পাঁচ হাজার টাকা করে, সৌরভ ও সুরভীর নামে দুই হাজার টাকা করে ব্যাংকে দশ বছর মেয়াদী ডিপিএস চালু করেছিলো। তাছাড়া হাত খরচ বাবদ বিউটিকে প্রতি মাসে আরো তিন হাজার টাকা দিতো। অবশিষ্ট বাড়ি ভাড়া নিজের জরুরী প্রয়োজনে ও পরার্থে খরচ করতো। আত্মীয়-স্বজন, গরীব-দুখী কেউ সাহায্যের জন্য এলে কখনো কাউকে খালি হাতে ফেরত দেয়নি। তথাপি বিউটি মনে মনে শাশুড়িকে সহ্য করতে পারতো না। বিউটির চাহিদার শেষ ছিলো না। বাবার কাছে থাকতে বন্ধু-বান্ধবের সাথে হৈ-হুল্লোড় করে যে অর্থ খরচ করতো বিয়ের পরে সে অভ্যাস ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। জাহানারা ছেলের বউকে অপ্রয়োজনীয় কোথাও বের হতে দিতো না। ছেলে কর্মস্থলে থাকাকালীন বউমার বাহিরে যাবার প্রয়োজন হলে নাতিনাতনিসহ নিজেও সাথে যেতো।

 

কিরণ ২০১৮ সালের জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সরকারী সফরে সাত দিনের জন্য সিঙ্গাপুর যায়। এদিকে এক গরীব স্বজন জাহানারাকে ফোন করে তিন হাজার টাকা সাহায্য চায়। জাহানারা বউমাকে ডেকে বাড়ি ভাড়া থেকে তিন হাজার টাকা বিকাশ করে পাঠাতে অনুরোধ করে। বিউটি শাশুড়ির সাথে খারাপ আচরণ করে। কথায় কথায় বিউটি বলে ফেলে  "বসে বসে খেয়ে ঘরের টাকা নষ্ট করেন কেনো? এতো মহান সাজার কী দরকার? সারাদিন এতো কষ্ট দিয়েও সাধ মেটে না? কোনো কাজেও সাহায্য করতে পারেন না। উল্টো আপনার কাজও আমাকে করে দিতে হয়। আপনার দুচোখ যেদিকে যায় চলে যেতে পারেন না?"

 

জাহানারার মনে চরম আঘাত লাগে। রাতে একটি চিঠি লিখে তা বালিশের নিচে রেখে পরের দিন ভোরে বিউটি, সৌরভ, সুরভী ঘুম থেকে উঠার আগেই প্রয়োজনীয় কিছু কাপড়-চোপড় নিয়ে ক্র্যাচে ভর দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায় জাহানারা।

চিঠিতে লেখা ছিলো, "কিরণ, বউমা, সৌরভ, সুরভী তোমাদের সবাইকে আমি মনেপ্রাণে ভালোবাসি। তোমাদের কারো উপর আমার কোনো ক্ষোভ নেই। তোমাদের বোঝা হয়ে থাকতে আমার অনেক কষ্ট লাগে। আজীবন সুখে থেকো তোমরা। ভেবে নিও, কিরণের বাবার মতো আমিও নিরুদ্দেশ হয়ে গেছি।"

 

নানা কথা ভাবতে ভাবতে জাহানারা সকাল ৭:০০ টার ট্রেনে চড়ে চট্টগ্রাম রেল স্টেশন থেকে ঢাকা কমলাপুর রেল স্টেশনর চলে যায়। জাহানারা এক প্রতিবেশীর কাছে শুনেছিলো ঢাকায় অনেক ভালো ভালো বৃদ্ধাশ্রম আছে। বয়স্ক অসহায় মানুষের সেবা-যত্ন করায় বৃদ্ধাশ্রমগুলোর তুলনা হয় না। জাহানারার ভাগ্য ভালো যে তিনি রেল স্টেশনে বিধান দত্তের মতো মানুষ পেয়েছিলো যার মাধ্যমে মায়ের দোয়া বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় পায়।

 

জাহানারা ঘর ছেড়ে এসে ছেলে, বউমা, নাতি-নাতনিদের কথা মনে করে কষ্ট পেলেও বৃদ্ধাশ্রমে সমবয়েসীদের সাথে গল্পে মেতে সেবা-যত্ন পেয়ে অনেক সুখে আছে। জাহানারা শোভন সাহেবকে নিজের ছেলের মতন ভালোবাসে। শোভন সাহেব বৃদ্ধাশ্রম থেকে পোশাক কারখানায় যাবার পথে হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে থাকে মা জাহানারার জন্য যত কিছুই করি না কেনো তার ছেলে কিরণকে তো আর তার বুকে ফিরিয়ে দিতে পারবো না। জাহানারা জানে ছেলে সরকারী বড় কর্মকর্তা হিসেবে এখনো চাকরী করে যাচ্ছে। অথচ, কিরণ পৃথিবীতে আর বেঁচে নেই।

জাহানারা ২০১৮ সালে জুন মাসে বৃদ্ধাশ্রমে আসার সপ্তাহখানেক পরে শোভন সাহেব গিয়েছিলো চট্টগ্রামে। জাহানারার বাসায় গিয়ে বিউটির সাথে দেখা হয়। শোভন সাহেব জাহানারার খবরাখবর জানায় এবং কিরণ কোথায় আছে জিজ্ঞেস করলে বিউটি চুপ থাকে। সৌরভ-সুরভী ভেতরের কক্ষ থেকে দৌড়ে এসে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে জানায়, আমাদের বাবা আর নাই, আমরা দাদীর কাছে যেতে চাই। তাদের সাথে কথা বলে শোভন সাহেব কিরণের মৃত্যুর কারণ জানতে পারে। কিরণ বিদেশ থেকে ফিরে এসে সন্তানদের কাছ থেকে জানতে পারে তাদের মা খারাপ ব্যবহার করায় দাদী একটি চিঠি লিখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। কথাটা শুনেই কিরণের বুকে ভীষণ ব্যথা শুরু হলে হার্ট-অ্যাটাক করে এবং হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। অন্যদিকে, কিরণের মৃত্যুর জন্য বিউটি শাশুড়ি জাহানারাকেই দায়ী করে শোভন সাহেবকে বিদায় করে দেয়। বিউটি বলে, "শাশুড়ি এভাবে চলে না গেলে আমার স্বামী মারা যেতো না। যার কারণে আমার স্বামী মারা গেছে সে জাহানারাকে আমি আর বাসায় ঢুকতে দিবো না।" শোভন সাহেব মনে দুঃখ নিয়ে ঢাকায় ফিরে যান। কিন্তু, কিরণের মৃত্যুর খবর তার মা জাহানারাকে দিতে আজও সাহস করেননি। শোভন সাহেব চিন্তা করে, "সন্তান মায়ের কাছে আজীবন জীবিতই থাক।"

ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে

সমাপ্ত

 

মনজুরুল ইসলাম
কবি ও সাহিত্যিক, ডেপুটি জেলার, বাংলাদেশ জেল।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top