সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

সত্যজিৎ বিশ্বাস এর গল্প

সিনথিয়া তুমি কার (রম্য গল্প) : সত্যজিৎ বিশ্বাস


প্রকাশিত:
২৬ নভেম্বর ২০২০ ২২:৩৮

আপডেট:
২৭ নভেম্বর ২০২০ ০১:১০

 

কড়াই থেকে ধোঁয়া ওঠা সিংগাড়া দেখে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবার মানুষ এ দেশে যে খুব একটা নেই, তা জানি। তবে ঠান্ডা, বাসি সিংগাড়া দেখলেও চোখ দুটো কপালে তুলে দু’পাটি দাঁত মেলে ধরে, এমন মানুষের সংখ্যা ক’জন পাওয়া যাবে! সেই লিস্টে সর্বপ্রথম যে নামটা পাওয়া যাবে, তার নাম মশা। না, না, মশা মাছির মশা না। ওর নাম মশিয়ুর শাহিন ওরফে মশা। ‘মশা’ তার আসল নাম না। পিতৃ প্রদত্ত নাম মশিয়ুর হলেও সে নাম আমাদের মত বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে হারিয়েছে অনেক আগেই। মশা সাধারণত ¯ি¬ম হয়, এই মশা ¯ি¬ম না। আমাদের খাদ্যরসিক মশা আটচলি¬শ সাইজ কোমরের অধিকারী স্বাস্থ্যবান মানুষ। ও যখন হাঁটে, শরীরের আকর্ষণীয় বাঁকগুলো দুলে দুলে ওঠে। শুধু তার সাইজই না, চিন্তাভাবনাও আলাদা। চলার পথে আমরা যখন কোন সুন্দরী মেয়ে দেখলে তার আশেপাশে চক্রাকারে ঘুরঘুর করতে থাকি, তখন মশা ভনভন করে ঘুরতে থাকে খাবারের দোকানের চারপাশ দিয়ে।

কপাল কুঁচকে কী ভাবছেন, এটা কি মশার গল্প নাকি সিনথিয়ার গল্প? সে আপনি ভাবতেই পারেন। গল্পটার নাম যেহেতু ‘সিনথিয়া তুমি কার’, সেহেতু সিনথিয়াকে দিয়েই গল্পটা শুরু করা উচিত ছিল। আসলে হয়েছে কি, সিনথিয়ার কথা বলতে গেলেই মশাকে আমি ভুলতে পারি না। সিনথিয়া আর মশা যেন পাঁচ টাকার কয়েনের এ পিঠ, ও পিঠ। ভাবছেন, এ আবার কেমন কথা? গল্পটা পড়ে আপনিই বিবেচনা করে বলুন তো, ভুল বলেছি কীনা।

আসুন তবে গল্পে ফেরা যাক।
সিনথিয়া যে এ পাড়ার সেরা সুন্দরী, মোটেও তা না। বরং উল্টোটা। উচ্চতায় আমি যেমন ওর দ্বিগুণ তেমনি প্রস্থে ও আমার দ্বিগুণ। ও যখন রাস্তায় নামে মহল্লার পরিবেশটাই যেন বদলে যায়। পাড়ার ছেলেরা ওকে দেখলে উল্টো দিকে হাঁটা দেয়। এমনকি টং দোকানের দোকানীও উঁকি দিয়ে তাকায়। সুন্দরী দেখার আকর্ষণে নয়, আশংকায়। দোকানটা কেঁপে উঠল কেন, তাই দেখতে।

তবে ওর যা আছে তা নেই এলাকার আর কারো। ওর আছে বাবা। বাবা সবারই থাকে। তবে ওর বাবা শুধু ওর না, আমাদের এলাকারও বাবা। সিনথিয়া আমাদের এলাকার সরকারী দলের নেতার মেয়ে। খুব সঙ্গত কারণেই ওর দিকে নজর দেয়ার প্রশ্নই আসে না। তারপরেও দিলাম। শুধু নজরই দিলাম না, বুকের ভেতর থাকা কলিজাও ওর হাতে দেবার জন্য তৈরী হলাম।

বুদ্ধিটা অবশ্য আমার বন্ধু মশারই দেয়া। মোড়ের পুরির দোকানে বসে একদিন ডালপুরি সাঁটাতে সাঁটাতে বুদ্ধি দেয়, ‘দেখ, এ পর্যন্ত তো অনেক চেষ্টাই করলি, জীবনের ক্যারিয়ার তো দূরের কথা, একটা বাই সাইকেলের ক্যারিয়ার ধরারও তো ব্যবস্থা করতে পারলি না। শিক্ষাগত যোগ্যতার যে দূরাবস্থা চাকরি-বাকরি করে কোথাও দাঁড়াতে পারবি বলে মনে হয় না। তারচেয়ে বরং তুই সিনথিয়ার সাথে সম্পর্ক করে দাঁড়িয়ে যা। শ্বশুরের বরাতে পুরো লাইফ ফকফকা হয়ে যাবে।

মশার কথা শুনে তখন মাথার চুল থেকে শুরু করে অনেক কিছুই দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। কোনভাবে যদি সিনথিয়ার সাথে ইয়ে করে বিয়ে করে ফেলতে পারি, আর দেখতে হবে না। এলাকায় আমার পদচারনাতেই ক্যারিয়ার দাঁড়িয়ে যাবে।
মশার আচমকা প্রস্তাবে ডালপুরি গলায় আটকে যাবার আগেই তাড়াতাড়ি দুই গ্লাস পানি খেয়ে ভুরু কুঁচকে তাকালাম, মশা ফাজলামী করছে না তো। নাহ, মোটু গভীর মনোযোগ দিয়ে পুরি খাচ্ছে। অনেকটা গরু যেভাবে একমনে ঘাস খেয়ে চলে।

মশার খাওয়া দেখতে দেখতে ফ্লাসব্যাকে চলে যাই। ছোটবেলা থেকেই আমার সাথে ভাগ্য কতই না নির্মম পরিহাস করেছে। বন্ধুরা মেয়ে পটানোর নানা বাহানায় যখন সফল, একই কাজ করে আমি তখন রামধরা। কলেজের র্যাাগ’ডের দিন যখন শুভ, বাবু, আব্বাস পছন্দের মেয়েদের গায়ে রঙ মেখে দিচ্ছিল, মেয়েদের সে কী হাসি। ওদের দেখাদেখি একই কাজ আমিও করতে গেলাম। গোপন পছন্দের এক মেয়ের দিকে এক মুঠো রঙ ছুঁড়ে মারলাম। মেয়েটি মুহূর্তের মধ্যেই গর্জে উঠল, ‘অসভ্য, ইতর কোথাকার, এত বড় সাহস? মেয়েদের গায়ে রঙ ছুঁড়ে মারতে লজ্জা করে না? ডাকব, প্রিন্সিপাল স্যারকে?’ মাথা নিচু করে সেই যে দৌড় লাগিয়েছি, আর পেছনে তাকাইনি।

কত চাকরির পেছনে ছুটেছি, রিটেন পর্যন্ত গিয়েই লটকে গিয়েছি। ভাইভা বোর্ড পর্যন্ত যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। বিপুল উৎসাহ নিয়ে এ যাবত জীবনে যে ব্যবসাই করেছি, ধরা খেয়েছি। শুধু ধরা না, রাম ধরা।
মশার ঠোনা খেয়ে ঘোর ভাঙ্গল। ওর পে¬টের পুরি শেষ, আরো অর্ডার দেবে কীনা, সেই আকুতি চোখে মুখে। তখন অবশ্য ইনভেস্ট না করে আর উপায় নেই। মশার বুদ্ধি পছন্দ হয়েছে।এ বুদ্ধি কাজে লাগাতে পারলে আমাকে আর পায় কে? পুরো জীবন এলইডি লাইটের মত ফকফকা। আরো চারটা পুরির অর্ডার দিয়ে মশাকে বললাম, ‘দোস্ত, শুভস্য শীঘ্রম। কালই তবে একশনে নেমে পড়ি। কী বলিস?’

কিছু বলাবলির মত অবস্থায় নেই মশা। মুখে একটা আস্ত ডালপুরি ঢুকে আছে। মাথা ঝাঁকিয়ে সে তার সম্মতি জানিয়ে দিল।

জীবনের মোড় ঘোরানো প্রকল্প বাস্তবায়নের চিন্তায় নির্ঘুম রাতটা পার করে পরদিন সকালেই হাজির হলাম গলির মোড়ে।
জীবনের মোড়ের থেকে গলির এই মোড়টা তুলনামূলক ফাঁকা। তারপরও কেন জানি মশা উসখুস করে বারবার চলে যেতে চাইছে। আমার অতীত ইতিহাসের কথা বিবেচনা করেই হয়ত। এ দেশে কেন জানি নতুন উদ্যোক্তাদের সাথে কেউ থাকতে চায় না। সেই উদ্যোক্তার যদি এর আগে দু’একটা উদ্যোগ ব্যর্থ হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই। তার সাথে আর কেউ নেই। যুব সমাজ ধ্বসে যাবার এটাও একটা বড় কারণ। কিন্তু কে শোনে এই অধমের কথা?

মশা পেছন থেকে সরে পড়ার আরেকটা চান্স নেবার চেষ্টা করতেই খপ করে হাতটা চেপে ধরলাম। ‘কীরে শালা আমাকে সিল দেয়ার সময়েই শুধু থাকবি, মিল দেয়ার সময় থাকবি না?’ আমার ঝাড়িতে মুখ ভোতা করে মোটু খাবারের দোকানগুলোর দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। দেখে মায়াই লাগল। পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম, এইতো আর একটু পরেই সিনথিয়া এলেই একশন। যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছি, ঠিক তাই-তাই করবি। তারপর তোকে নিয়ে বার্গার খেতে যাব।

গালে হাত দিয়ে মোটু ভাবে বার্গার মুখে পোরার দৃশ্য আর আমি ভাবি আমার প্রতি সিনথিয়ার ফিল্মি স্টাইলে প্রেমে পড়ার দৃশ্য। লাইফ স্টাইল পাল্টে দেয়া একখানা প্রেম হতে যাচ্ছে! চোখে চোখ রেখে একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়া... ...আহ, এই ফিলিংসটা বোঝানো যায় না। কেমন জানি গা গুলানো-গুলানো ভাব। বুকের ধুকপুক ধুকপুক শব্দ নিজেই টের পাচ্ছিলাম। প¬্যান সফল হলে আর দেখতে হবে না, রাজকন্যা আর রাজত্ব সব আমার।

ও-এম-জি, আর বেশিদূর ভাবার আগেই দেখি রিক্সায় আসছে আমার ড্রিমগার্ল সিনথিয়া। প¬্যান অনুযায়ী মশাকে ধাক্কা মারতেই মোটু পড়িমড়ি করে রিক্সাওয়ালার সামনে লুটিয়ে পড়ল। একেবারে খাঁটি বাংলা ফিল্মের নিখুঁত দৃশ্য। এত বিশাল একটা জিনিষ গড়াতে দেখে ভড়কে গিয়ে রিক্সাওয়ালা সামনের চাকা উঠিয়ে দিয়েছে মোটুর উপর। আমি সাথে সাথে নায়কের বেশে রিক্সার সামনে লাফিয়ে পড়লাম। কপালের চুল ঝটকা মেরে পেছনে সরিয়ে দিয়ে রিক্সাওয়ালাকে বললাম, ‘এটা কী হলো? আমার বন্ধুকে চাপা দিলে কেন? এটা কি মগের মুল¬ুক?’
চিকন, মোটা কোনও ব্যাপার না, মেয়েরা মায়াবতী হয়েই জন্মায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী এ অবস্থা দেখে সিনথিয়ার এখন রিক্সা থেকে নেমে এসে সরি বলার কথা।

ইয়েস, ওই তো সিনথিয়া রিক্সা থেকে নামছে। এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমি দেখেও না দেখার ভান করে মোটুকে ওঠানোর জন্য হাঁটু গেড়ে বসলাম। সিনথিয়া পেছন থেকে এসে এক হাত দিয়ে আমার কাঁধ ছুঁলো। ওর গরম নিঃশ্বাস টের পেলাম আমার কাঁধে। পুরোনো দিনের নায়কের মতো ¯ে¬া মোশনে ঘুরতেই দেখি সিনথিয়ার অন্য হাতটা এগিয়ে আসছে আমারই দিকে।

বিদ্যুৎবেগে সদ্য ক্লিন শেভ করে আসা চাঁদ বদনে একটার পর একটা ঘুষি বসিয়ে দিতে শুরু করলো প্রমীলা বক্সার সিনথিয়া। হতবাক হয়ে তাকাতেই হাতের সাথে তার মুখও ছুটল এবার, ‘মগ তো তুই। মগের বাচ্চা মগ, ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলি কোন সাহসে? আমি দেখিনি মনে করেছিস? মোটা মানুষ কি মানুষ না? নিজেকে তুই কি মনে করিস? দাঁড়া, একদম নড়বি না। বাবাকে ফোন দিচ্ছি, দেখ, আজ তোকে কেমন প্যাঁদানি খাওয়াই’।

প্রমীলা বক্সারের হাতের কারিশমা দেখার পর আমার আর কোন কিছু দেখার শখ নেই। তবু নাক বরাবর ছুটতে ছুটতে ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম,সিনিথিয়া পরম মমতায় রাস্তায় হাঁটু গেড়ে বসে মোটুর মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিচ্ছে।


---
সত্যজিৎ বিশ্বাস
রম্য লেখক ও শিশু সাহিত্যিক
* রম্য বিভাগীয় সম্পাদক- কিশোর বাংলা
* নির্বাহী সম্পাদক- কিশোরকাল
---

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top