সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

জ্যোৎস্না রাতে রক্তস্নান : মালিহা পারভীন


প্রকাশিত:
২৪ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:১৩

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:০৪

ছবিঃ মালিহা পারভীন

 

ইদানিং রাতে ঘন ঘন জলের তেষ্টা পায় সুবিনয়ের।  মাথার কাছে টেবিলে রাখা বোতল থেকে ও জল ঢালতে যেয়ে দেখে বোতল খালি।
বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে এগোয়।
: বিনয়,  দিলে তো আমার ঘুমটা ভেংগে।
অবন্তীর বিরক্ত গলা।   অবন্তী - ওর স্ত্রী।  ওর ঘুম অল্পতে ভেংগে যায় সুবিনয় তা  জানে। তাই সাবধানে দরজা ভিজিয়ে ও ডাইনিং স্পেসে আসে। ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানির বোতল বের করে। আলো জ্বালিয়ে চেয়ার টেনে বসে।

ঘরের  সিলিঙে ঝাড়বাতির ফুল লতার রহস্যময় ছায়া পরেছে। কখনো এভাবে নিজের ঘরটাকেই দেখা হয় নি। তিন বছর হলো সুবিনয় ও অবন্তীর সংসার। চারুকলা থেকে পাশ করা অবন্তী মনের মত ক'রে সংসারটা সাজিয়েছে।  কচু পাতা রঙ দেয়াল। জানালায় সাদা পর্দা । ওদের যুগল ছবি দেয়াল জুড়ে। অবন্তীর একক একটা ছবিও আছে। লাল সাদা শাড়িতে প্রতিমার মতন লাগছে।

ঘরের এক কোণে  রট আয়রনের কালো স্ট্যান্ড। নীচের তাকে সবুজ পাতার টব, ক্যাকটাস রাখা। উপরের তাকে পারিবারিক সুত্রে পাওয়া সবুজ ল্যান্ডফোন। এই অকেজো যন্ত্রটাকে অবন্তী কেন যে এতো যত্ন করে রেখে দিয়েছে কে জানে!

ফোনটা দেখলেই সুবিনয়ের সুমিতার কথা মনে পরে। একদিন রঙ নাম্বার থেকে  সুমিতার ফোন এসেছিল এখানে। তারপর ফোনালাপ এবং  প্রেম। কত রাত এই ফোনে কথা  বলতে বলতে হাত ব্যাথা হয়ে যেতো, ভোর হয়ে যেতো।

সুমিতার কথা মনে হতে সুবিনয়ের কপালে ঘাম জমতে শুরু করে। আরেক গ্লাস জল গলায় ঢেলে ও উঠে দাঁড়ায়। দেয়াল ঘড়িতে তিনটা বাজার দশ মিনিট বাকি। ফেব্রুয়ারি শেষ না হ'তেই এবার ভ্যাপ্সা গরম পরেছে।

সুবিনয় জানালার পর্দা সরিয়ে দাঁড়ায়। ঝিরঝিরে হাওয়া এসে চোখে মুখে লাগে। আকাশে মস্ত চাঁদ। আজ কি ফাল্গুনী পুর্ণিমা! বাড়ির সামনের রাস্তাটা  স্তব্ধ, সুনসান। ওদের বাড়িটা শহরতলীর দিকে। এমনিতেই কোলাহল কম। আর এখন করোনা মহামারিতে কঠিন লক ডাউন চলছে। কেমন ভুতুরে পরিবেশ! 

আর তখনই সুবিনয় দেখে এক তরুণী নীল শাড়ি পরে হেঁটে যাচ্ছে ধীরে। এতো রাতে কে এই মেয়ে ! কৌতুহল নিয়ে তাকায় ও। মেয়েটা ওর দিকে ফিরে তাকায় । একি! এ যে সুমিতা! মুখে ক্রুর হাসি।

সুবিনয়ের মাথা কেমন শুন্য লাগে। কোনোমতন শোবার ঘরে এসে ও শুয়ে পরে। অবন্তী শব্দ পেয়ে বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরে শোয়। সুবিনয় চোখ বন্ধ করতে ভয় পায়। আবার বুঝি সুমিতাকে দেখবে!  ও তমফ্যানের ঘোরা দেখে।

সুমিতা মারা যাবার পর আজ নিয়ে দুদিন হলো দেখলো ওকে। অবন্তীর সাথে বিয়ের পর ওরা কুয়াকাটা বেড়াতে গিয়েছিল। তখন রাস পুর্ণিমার রাত । সমূদ্র পাড়ে ছাতার নীচে একটা চেয়ারে বসেছিল।  তখনই সুবিনয় দেখলো নীল শাড়ি পরা সুমিতা হেঁটে যাচ্ছে ওদের সামনে দিয়ে - আজকের মতনই। তারপর হঠাৎ নাই হয়ে গেল। হোটেলে  ফিরে সেদিন প্রচন্ড জ্বর হলো।

আজও সুবিনয়ের কেমন জ্বর জ্বর লাগছে। মস্তিস্কে হুল ফোঁটাতে শুরু করেছে দুঃসহ সেই স্মৃতি। সুমিতার সাথে গভীর প্রেম চলছে । সেদিন লক্ষী পুজার রাত। ধবল জোছনায় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। সুমিতাদের বাড়ীর ছাদে ওরা চুপিচুপি দেখা করেছিল সেদিন। কত কথা! কথা বলতে বলতে সুবিনয়ের কি জানি কি হলো। ছাদের কার্ণিশে হেলান দেয়া সুমিতাকে ও মজা করেই ধাক্কা দিল। তারপর!বাড়ির সামনের রাস্তায় সুমিতার থেতলে যাওয়া মাথা। হলুদ  মগজ ঠেলে বের হয়ে আসছে। চাঁদের আলোয় তা চিকচিক করছে।

কিভাবে যে সেদিন এক ছয় তলার ছাদ থেকে সিঁড়ি ভেংগে নীচে নেমে এসেছিল তা মনে নেই। পরদিন খবরের কাগজে সুমিতার আত্মহত্যার খবর ছাপা হয়েছিল। সি সি ক্যামেরার যুগ ছিল বলে সে যাত্রা  বেঁচে গিয়েছিল। সুবিনয় এটাকে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে ধীরে ধীরে মেনে নিতে থাকে।

বাকি রাত  আজ আর ঘুম হবে না। যদিও সকালে উঠার তাগাদা নেই। লক ডাউনে অফিস বন্ধ। কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলছে। চারিদিকে হাহাকার। অসুস্থতার, বেকারত্বের, অনিশ্চয়তার। ওর অবশ্য তেমন সমস্যা হচ্ছে না। সরকারি চাকরি। অবন্তী নতুন নতুন রান্না করছে। সুবিনয় খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে। তবে আজকাল অবন্তীর সাথে একটুতেই খিটিমিটি লেগে যাচ্ছে।  সুবিনয় ছাদ বাগানের কাজ,  টিভি, ফেসবুকিং নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেস্টা করে।ব

ইদানিং মাঝে মাঝেই সুবিনয়ের পুরানো সেই অস্বাভাবিকতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। যেমন ইচ্ছে করে অবিন্তীকে ছাদ থেকে ফেলে দেয়। কখনো ইচ্ছে করে গ্যাসের চুলায় ঠেসে ধরতে। ছোটবেলাতেও সুবিনয় একবার ছোট ভাইয়কে রাস্তা পার হবার সময় রিক্সার নিচে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। অফিসেও কখনো এমন হয়। ইচ্ছে করে টেবিলে রাখা পেপার ওয়েট তাক করে কারো মাথায় ছুঁড়ে দেয়। 

এ নিয়ে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে কথা বলা উচিত।  কিন্তু সুবিনয়ের মধ্যে একটা ভয় কাজ করে। গেলেই যদি সুমিতাকে ছাদ থেকে ধাক্কা দেয়ার ব্যাপারটা বের হয়ে আসে!

সুবিনয় ঘামছে। ছোট্র লাল বাতিটা  জানান দিচ্ছে ঘরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রন যন্ত্র চলছে। হঠাৎ ডায়নিং স্পেসে ল্যান্ড ফোন বেজে ওঠে। একবার, দুবার, কয়েকবার। সুবিনয় অবাক হয় । ফোনটাতো অকেজো। অবন্তী কি তাহলে বকেয়া বিল মিটিয়ে  এটা চালু করেছে!

কিন্তু এ সময়ে  কে ফোন করলো!  সুবিনয় উঠে ফোনের দিকে এগোয়।  সুবিনয় বার কয়েক 'হ্যালো হ্যালো' করে রিসিভার রেখে দেয়।  নাহ, কোনো সাড়া শব্দ নেই।

:  এই অকেজো ফোনে এই সময় তুমি কাকে ফোন করছো ? তোমার মোবাইলে কি চার্জ নেই? অবন্তীর ঘুম ভাংগা বিরক্ত গলা। ও কখন এসে সুবিনয়ের পাশে  দাঁড়িয়েছে তা টেরই পায়নি।
: না, মনে হলো ফোন বাজছে। তাই এলাম ধরতে। আসলে কেন যেন ঘুম আসছিল না। সুবিনয়ের ক্লান্ত গলা।
অবন্তী স্বামীর কপালে হাত দেয়। নাহ, কপালতো ঠান্ডা। তারপর বলে -
: একটু ছাদে ঘুরে আসবে?  চল। 


সুবিনয় কোনো কথা না বলে বাধ্য ছেলের মতন অবন্তীর পিছু নেয়। সিঁড়ি ভেংগে ওরা ছাদে আসে। ছোট ছাদ কিন্তু গোছানো। একধারে সবজি লাগানোর জায়গা, অন্য পাশে অর্কিড। বাকি জায়গা জুড়ে নানান ফুলের গাছ। ছাদে আসতেই হালকা ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা এসে লাগে। প্রান ভরে শ্বাস নেয় সুবিনয়।

বাতাসে কামিনী ফুলের গন্ধ। আকাশে শেষ রাতের ক্লান্ত চাঁদ। সুবিনয় অনেকদিন পর অবন্তীর হাত দুটো মুঠোয় তুলে নেয়। ফিসিফিস ক'রে বলে -
: আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ অবু ।  তুমি আমার এলোমেলো  জীবনটাকে পুর্ণ করেছো।

অবন্তী অবাক হয়  'তোমার হলো কি আজ! ভালও লাগে।  সুবিনয়ের উত্তরের অপেক্ষা না করে রেলিংগে হেলান দিয়ে আনমনে গুনগুন করে গায় -' চাঁদের হাসি বাঁধ ভেংগেছে --,'

সেই সুর নিস্তব্ধতার অণুতে  মিশে এই মধ্যরাতে অদ্ভুদ মাদকতা আবেশে এনে দেয়। সুবিনয় মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু অবন্তীকে কেন এ মুহুর্তে সুমিতার মতন লাগছে ! ওর অস্বস্তি হতে থাকে। মাথার কোথাও তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। জেগে উঠছে ভয়ংকর সেই ইচ্ছে। চাঁদে থেকে রক্ত ঝরছে সমস্ত পৃথিবী প্লাবিত করে।

কিছুক্ষন পরই অবন্তীর তীব্র চিৎকার শোনা যায়। 

 

ডা: মালিহা পারভীন
কবি ও কথা সাহিত্যিক

সেগুনবাগিচা, ঢাকা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top