সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে (রম্য গল্প) : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
২৪ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৩৬

আপডেট:
২৪ ডিসেম্বর ২০২০ ২৩:১০

 

মহান কবি একদা বলেছিলেন, 'প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে--' আর সেই ফাঁদে কে যে কখন হারিয়ে যাবে বা আটকে পড়বে তার ঠিক ঠিকানা নেই। কথাটা অনেকখানি প্রবাদপ্রতিম বাক্য বলে আমি মনে করি। কবির কথায় বড় ভরসা করে একেবারে কাঁচা বয়সে মনে মনে দারুন ভাবে উল্লসিত হয়েছিলাম। কিন্তু সেই সময়ে  বাড়ির অভিভাবকদের কাছে প্রেম ছিল ভীষণ ভাবে নিষিদ্ধ ঘটনা বা  বস্তু। এমনকি, প্রকাশ্যে 'প্রেম'  শব্দ উচ্চারণ করাও ছিল এক ধরনের গর্হিত সামাজিক অপরাধ। এর  শাস্তি ছিল বেশ বড় -সড়। এই নিয়ে আলোচনা করাও ছিল ভীষণ রকমের ভয়ের ব্যাপার। অথচ হৃদয়ভূমিতে প্রেম জাগতেই পারে যে কোন মুহুর্তে। এই বাস্তব ভিত্তিক ভাবনাকে অভিভাবরা তখন  মানতে ও বুঝতেই চাইতেন না।

আসলে হৃদয়ের তটভূমিতে জেগে ওঠা রঙিন -রোমাঞ্চকর প্রেমে তাঁদের ভীষণ আ্যলার্জি। তাঁদের অভিমত, প্রেমে পড়া মানেই সবুজ-সতেজ  ছেলেমেয়েদের চরিত্র নষ্ট, গোল্লায় যাওয়া উচ্ছন্নে যাওয়া, চরম অধঃপতন ইত্যাদি - ইত্যাদি ---। হঠাৎ আবেগ তাড়িত হয়ে কেউ যদি কাঁচা প্রেমে পড়ত এবং সে কথা প্রকাশ হলে তাদের কাঁচা প্রেমে লেবুর মতো চটকাবার জন্য প্রেমিকা মেয়েটির মা তার চুলের মুঠি ধরে কিল-চড় কষে লাগাতেন এবং বেশ কিছু দিন ঘরে আটকেও রাখতেন।উপরি পাওনা বকা ও মারধর জুটতো।  অন্যদিকে প্রেমিক প্রবরের রাগী পিতৃদেব ছেলের পিঠে খড়ম,বা জুতো পেটা করে তাদের প্রেমরোগ ভাগিয়ে ছাড়তেন।

 

প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, প্রেমের এই মারাত্মক, শোচনীয় পরিণতি দেখে আমাদের কিশোর মনে প্রেম সম্পর্কে এক দারুণ ভয়ের সঞ্চার হয়েছিল। অথচ ডালপালা নিয়ে কাঁচা প্রেম জাগতে চায়, এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। কিশোর -কিশোরির বয়স সন্ধির নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই অভিভাবকদের। যেটা এযুগে দেখা যায়।

তাছাড়া সেই সময়ে কড়া ও গোড়া রক্ষণশীল পরিবারের কঠোর নজরদারি ও অনুশাসনে আমরা মানুষ  হয়েছিলাম। তাদের নজরদারি এড়িয়ে প্রেম করা ভীষণ শক্ত কাজ ছিল। কথায় কথায় বংশমর্যাদার দোহাই দিয়ে আটকে দিত। শৃঙ্খলিত কচি প্রেম ফুটতে পারতো না। সে এক ভয়ানক বয়স সন্ধির যন্ত্রনা। নিরাময়ের কোন ফর্মূলা ছিল না। সেকালের ঠাকুরদা, ঠাকুরমারা  রাধা- কৃষ্ণের প্রেমলীলার পালাগান শুনে ভক্তিভাবে বিভোর ও বিগলিত হতেন অথচ বাস্তবে নিজের ছেলেমেয়েদের অমল প্রেমকে তাঁরা মর্যাদা দূরে থাক, বরদাস্ত করতে পারতেন না।

মাঝে মাঝে মনে জাগত, কেন ? এত আ্যলার্জি।যুক্তি-তর্ক দিয়ে ভাববার একটা চেষ্টা করতাম, কিন্তু প্রকাশ করা যেতো না। ছেলেমেয়েদের প্রেম আটকাতে গোয়েন্দা লাগিয়ে দিত। কাকা--পিসি, মামা-মাসি ছিল গোয়েন্দা। আমাদের শৈশব কেটেছে গ্রামে, জন্মেছি পাড়াগাঁয়ে। সবুজ প্রকৃতি আর বনেবাদাড়ে ঘুরে মানুষ। সেই সময়ে পাড়ার ছেলেমেয়েরা একসাথে খেলেছি,বর-কনে সেজেছি। এইভাবেই বড় হয়েছি। কিন্তু সেই খেলাঘরের সঙ্গী মেয়েটি যেই একটুখানি বড় হয়ে উঠল, তার অঙ্গে বসন উঠতেই আমাদের চরিত্রশুদ্ধির কারণেই মেলামেশা কথাবার্তা বন্ধ। এমনকি কিছু, ক্ষেত্রেও বাড়িতে কোনো সমবয়সী  মেয়ে এলে পাছে  আমাদের চিত্তচাঞ্চল্য জাগে, সেই জন্যই তৎক্ষণাৎ নতমস্তকে স্হানত্যাগ করাই ছিল প্রধান কর্তব্য। এগুলোকে যারা অগ্রাহ্য করে প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে বিচরণ করতে চেষ্টা করত, তাদের জন্য জুটত নানান ঝক্কি ঝামেলা, পোহাত হতো অভিভাবকদের। প্রতিবেশী মেয়ের বাবাকে ছেলের বাবা হুঙ্কার দিতেন, 'তোর মেয়ের জন্য আমার ছেলে নষ্ট হচ্ছে,' সেই হুক্কারের উত্তরে মেয়ের বাবাকে বলতে শোনা যেত, তোমার এঁড়ে গরুকে গোয়ালে বেঁধে রাখ,' ফলে সম্পর্কের ফাটল দেখা দিত। অনেক ক্ষেত্রে ছেলে ও মেয়েকে তাদের মামার বাড়িতে পাঠিয়ে দিত'।

ভালোবাসা নিয়ে এই ভাবে লুকোচুরি খেলতে খেলতেই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে জেলা শহরের কলেজে এসে ভর্তি হলাম। ব্যাস, এ-যেন এক স্বর্গরাজ্য,নিজেই নিজের অভিভাবক। বেশ আনন্দের ব্যাপার। অভিভাবকদের রক্তচক্ষু এড়িয়ে হস্টেল অথবা মেসের বাধাবন্ধনহীন মুক্ত জীবন। ভাবে সাবালোক, একটু কেউকেটা ভাব। তখন সবে ঠোঁটের উপর গোঁফের সীমান্ত রেখার ছোঁয়া, ভিতরে ভিতরে সাহসী পৌরুষ টগবগ করে জাগ্রত। হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্ট আর চুল সুন্দর করে ছেটে, পরিপাটি ফুলশার্ট পরে কলেজে যাচ্ছি। নিজেকে দেবদাস মনে করছি মনে মনে। কো-এডুকেশন কলেজ। রঙবেরঙের শাড়ি আর সুগন্ধি প্রসাধনে সুসজ্জিত নন্দিনীরা সপ্তরঙের প্রজাপতির মতো  দেহ দুলিয়ে, আঁচল  উড়িয়ে কলেজে আসছে। তাদের দেখে আমাদের তরুণ মনে ফাগুনের পলাশ- শিমুলের রঙ মাতাল!

 

সময়টা উত্তম -সুচিত্রার  রোমান্টিক যুগ। তখন ছায়াছবির রূপালী পর্দায় ওদের রোমান্টিক জুটির রমরমা। আর আমাদের  দেহ ও মনেও একটা হিরো হিরো ভাব। কিন্তু নায়িকা না জুটলে তো হিরো জিরো হয়ে যায়। তখন এই বাস্তব সত্য বোঝার  বয়স হয়েছিল। এদিকে কলেজে তখন ভীষণ কড়াকড়ি। ছাত্র-ছাত্রীদের অবাধ মেলামেশা এমনকি সামান্য কথাবার্তাও একেবারে নিষিদ্ধ ও বন্ধ। কলেজের অধ্যাপকদের স্টাফ রুমের পাশেই মেয়েদের কমনরুম। ঘন্টা পড়লে স্যারেরা  আ্যটেনডেন্স রেজিস্ট্রার হাতে বেরলে মেয়েরা তাঁদের পিছনে পিছনে গুটিগুটি এসে ক্লাসের একপাশে বরাদ্দ বেঞ্চে বসতে হতো। একদিকে ছেলে, মধ্যিখানে  ফাঁক, অন্যদিকে মেয়েরা। অনেকটাই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া। এটা অতিক্রম করতে যাওয়া জীবনে ঝুঁকি। এই সময়ে এধরনের কোন সীমারেখা নেই।অবাধ বিচরণ করছে নতুন প্রজন্মের তরুন-তরুণীরা। অনেক সাহস আর অবাধ মেলামেশা করার সুযোগ।সেযুগে ভাবাই যেত না। ক্লাসে ছাত্রদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা বেশকম ছিল। তাই তাদের হৃদয় জয় করা এবং নজর কাড়ার জন্যে ছেলেদের মধ্যে ছিল তীব্র রেষারেষি, সেই সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতা। ক্লাসের স্যারদের লেকচার তখন বিশেষ গুরুত্ব পেত না, পড়াশোনা কানে  ঢুকতো না, পিছনের বেঞ্চে বসে আড়চোখে সুন্দরী মেয়েদের দেখতাম। এ ব্যাপারে কোন বাছবিচার ছিলনা। দুচোখে তখন মায়ার কাজল, তাই  খেঁদি, বুঁচি, পেঁচিকেই তিলোত্তমা ঊর্বশী মনে হতে। বিশেষভাবে  বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাসে প্রেমের কবিতা পড়ে আমাদের প্রেমিক হিয়াও 'পিয়া পিয়া কোয়েলিয়া' ডাক ছাড়ে।

 

অনেককেই দেখেছি, ক্লাসে প্রেমের থিয়োরিতে মন ভরে না, এর প্রাকটিক্যাল  অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। এমন মনোভাবের কিছু বন্ধু ছিল। কিছুটা বেপরোয়া। তাঁরাই আমাদের  গুরু হয়ে গেল। কলেজের গেটের বাইরে প্রেম ভিখারী নব কেষ্টরা  বুকে 'হৃদয়ভাড়া দেওয়া হইবে,'--এই ধরনের অলিখিত পোস্টার সেঁটে অন্যদের সঙ্গে ঘুরঘুর করতাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কলেজ জীবনে  কপালে কোন হৃদয়হরিণী তরুণী ভাড়াটের সাক্ষৎ মেলেনি। আসলে, পিতৃদেবের ভয়, লোক জানাজানির  ভয়, সেটাই ছিল অনুচ্চারিত প্রেমের যুগ। 'এক পলকে একটু দেখা'--অথবা 'একটুকু ছোঁয়া' লাগতেই মনে মনে রঙীন বর্ণীল অধরা স্বপ্নপূরণের জালবোনা-রোমান্সের সে স্বর্ণযুগ আজ আর দেখতে পাওয়া যায় না। আর সুগন্ধি মাখা  হালকা আকাশ নীল কাগজে ' একূল-ওকূল-- দু-কূল ভেসে' যাওয়া প্রেমিক-প্রেমিকার উদ্বেল হৃদয়ের উচ্ছ্বাসভরা প্রেমপত্র তো  এই যুগে দূর অস্ত।

এখন অভিভাবকদের মধ্যে অনেকেই ছেলে' মেয়েদের বন্ধু, কাছের মানুষ। সময়ের দাবিকে মান্যতা দিচ্ছেন অনেকেই। শিক্ষা প্রসারে  মানসিকতার বদল ঘটেছে অনেক খানি। লুকোচুরির প্রেমের যুগ শেষ, শুরু হয়েছে ডিজিটাল প্রেমের যুগ। সেই সময়ে শালীনতার সীমা অতিক্রম করা অনেক ক্ষেত্রে দেখা যেত, পরিমানে অতি সামান্য। এই সময়ে  শ্রীল-অশ্রীল ও শালীনতার সীমান্তরেখা অনেক খানিই উঠে গেছে। এর পিছনে বেশ কিছু কারণ আছে, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তি, পরিবেশগত, জীবন দর্শনগত এবং  পাশ্চাত্যের দেশগুলোর প্রভাব, সেই সঙ্গে বিশ্বায়নের প্রভাব গভীর ভাবে ক্রিয়াশীল বলে আমার নিজস্ব বিশ্বাস। একথা সত্য যে, যুগের ও সময়ের দাবিকে আমরা অস্বীকার করতে পারিনা। বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে মানুষ সর্বদা কেজো জীবনে শৃঙ্খলিত। কারোর থামার উপায় নেই। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। মানবিক, সামাজিক দায়বদ্ধতা অনেক খানি ফিকে হয়ে গেছে। নিজের কেরিয়ার নিয়ে সবাই ব্যস্ত। এছাড়াও বিশ্বায়নের ঝোড়ো জোয়ারে এখন তরুণ -তরণী ভাসমান। সব পেয়েছির জগতে বিচরণ করতে ভালোবাসে। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের প্রেম-ভালোবাসা অপলক নয়নে দেখি। আমি আমার কর্মজীবনে একাদশ-দ্বাদশ  শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের প্রেম দেখতে  বেশ ভালো লাগে। শুধু শালীনতা বজায় থাকুক। এটাই চাওয়া, এর বেশি কিছু নয়।  কিন্তু কষ্ট ও দুঃখের বিষয় এদের অনেকের প্রেমের সলিল সমাধি দেখে খারাপ লাগে। বেদনা দায়ক পরিসমাপ্তি কষ্ট দেয় মনে। বন্ধন ও ভালোবাসা খুব পোক্ত নয় বলে মনে হয়। চাওয়া-পাওয়ার সীমারেখা  সম্পর্কে  অভিজ্ঞ নয় বলে মনে হয়। আসলে সেই সময় একটা শ্লোগান শুনতাম অভিভাবকদের কাছ থেকে 'মানিয়ে নাও, মানিয়ে চল,' এটাই ছিল প্রেম ভালোবাসার প্রাথমিক ভিত্তি ও মন্ত্র। এই মন্ত্র অনেক খানি আজ উধাও।

 

খোলামেলা জীবন যাপন, এক্ষেত্রে ভালোর চেয়ে বেশি খারাপ করছে বলে মনে হয় । একটা গভীর জীবনবোধের বড় অভাব এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে। 

জীবনের প্রান্তবেলায় গুটিগুটি পায়ে হেঁটে চলেছি, আমাদের এখন অবস্থা'দু নৌকায় পা, 'না ঘরকা না ঘাটকা--'।  বয়স ক্রমশ বাড়ছে, অনেক কিছুই দেখলাম এই ভুবনে, জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে এই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে শুধুই 'হেড়ো' গলায় অমধুর স্বরে কাকের মতো 'কা কা' ডাকছি। এটাই বুঝি জেনারেশন গ্যাপ! ব্যাকডেটেড? চোখের সামনেই মনোমুগ্ধকর পৃথিবীটার রঙ পালটে ও বদলে যাচ্ছে খুব দ্রুত। হিসাব মিলছে না। একুশ শতকের বদলে যাওয়া দুনিয়ায় আমাদের মূল্যবোধ, জীবনদর্শন, শিক্ষা -দীক্ষা,

শাশ্বত আদর্শ, আকড়ে ধরা পুরানো ধ্যানধারণা সব সময়ের প্রেক্ষিতে উধাও। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আমাদের  কাছে অনেক খানি অচেনা, দূরে মানুষ। এদের  অনেকের জীবন ভাবনা, যাপিত জীবন, শিক্ষা, রুচি, সংস্কৃতি, ভাষা, চলনবলন, পোশাক এবং আচার -ব্যবহার দেখে মনে হয় ভিন্ন গ্রহের জীব। অবসারভোগী প্রবীণরা এমনকি নিজেদের বৃদ্ধ বাবা ও মা সমাজে বাতিলের দলে। এমনটি আমরা কেউই কোন দিন আশা করেনি। আমরা কয়েকজন বয়স্ক শিক্ষক, কিছুদিনের মধ্যেই  কর্মজীবন থেকে বিদায় নেবো। সবাই কাছের মানুষ। কাছাকাছি বসবাস করি। সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নিই।ভাবের বিনিময় করি।  শ্যামল দত্ত, নির্মল দাস, তপনপাল, পাঁচুগোপাল সরকার ও আমি  সুবীর নন্দী। সকাল-বিকেল আমরা চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিই, কোন সময়ে  একসঙ্গে হাঁটি, গল্পগুজব করি, সময় পেলে ফেলে আসা অতীতের স্মৃতির জাবর কাটি। মাঝে মাঝে হা-হুতাশ করি । আমাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ পাঁচুদা বহুদর্শী, রসিক মানুষ এবং গান পাগল মানুষ, জীবনে কোন দিন টেনশন করতে দেখলাম না, সব কিছু হেসে উড়িয়ে দেন‌। আমার খুব ভালো লাগে ওনার সাহচর্য।  তপনপাল শৌখিন মানুষ, কিন্তু সাদা মনের। এক সময়ে ভালো আবৃত্তি করতেন। খুঁত - খুতে মানুষ, তবে ভিতরটা কাঁচের মত স্বচ্ছ। বেশ নীতি আদর্শ নিয়ে নিজের মতো করে থাকেন। ভালো পড়াশোনা আছে,  বিভিন্ন ধরনের বিষয়ে।বেশ ভালোলাগা মানুষ। একদিন আড্ডায় আলোচনার বিষয় ছিল আজকালকার ছেলেমেয়েদের প্রেম, হঠাৎ প্রেমের প্রসঙ্গ উঠতেই পাঁচুদা একটু রসিকতা করে বললেন, ছ্যা, ছ্যা আর বলবেন না, একালের ছেলেমেয়েদের ব্যস্ত জীবনে রয়েসয়ে প্রেম করার সময় কই? এখন বিশ্বায়নের যুগে ওদের প্রেম ডিজিটাল ও হাইটেক প্রেম। আমরা হেসে লুটোপুটি। সোস্যাল মিডিয়ার যুগে আমাদের সময়ের মতো লুকিয়ে চুরিয়ে প্রেম করতে হয় না।

প্রেমের সঙ্গী জোটাতে এযুগের ছোকরা-ছুকরিকে বাউল বাবাজির মতো 'মনের মানুষ' খুঁজে বেড়াতে হয় না। এখন ইন্টারনেটের দৌলতে মাউস ক্লিক করলেই  বিশ্বপ্রেমের বিগবাজার। দেশি-বিদেশি সুন্দরী ললনাদের খোলা আকাশের নীচে বিরাট হাট। কেনাবেচায় কোন কাজেই অসুবিধা নেই। ব্যাস ওখান থেকেই ওরা মনের মানুষ খুঁজে নেয় । তারপর শুরু হয় চ্যাটিং -ফাটিং। মন দেওনা -- নেওয়ার পালা শুরু, অতঃপর মিটিং- ডেটিং এবং-- -।

জানো ভায়া বিশ্বায়নের, ফলে প্রেম এখন পণ্য এবং সুলভ। তপন পাল বলে উঠলেন, ইস! এই যুগে যদি একবার জন্মাতাম তা হলেই দেখে নিতাম,টাইটেল, ভাইরাল প্রেম কাকে বলে! মুক্তমনা ও খোলা হাওয়ার যুগ এখন। তাই  দেশকালের সীমান্ত রেখার গণ্ডী পেরিয়ে শুল্ক ছাড় অবাধ প্রেমের আমদানি-রপ্তানি। নির্মল বলল, পাঁচু দা, আপনি বড় সেকেলে একটু আধুনিকমনষ্ক হন।' জগৎ পরিবর্তনশীল। আমাদের আমলের ম্যাড়মেড়ে রাধাকেষ্টের প্রেম এযুগে বেমানান ও অচল। এখন মেধাবী কেরিয়ার সর্বস্ব ছেলেমেয়েদের হাতে বড্ড সময় কম, হঠাৎ যাকে মনে ধরলো তার সঙ্গে কিছুদিন প্রেম -প্রেম হাডুডু- কানামাছি গেম খেলে তারপর তাকে বাতিল করে অন্যকে ধরে।' শ্যামল বলল, 'তার মানে এটা ইউজ আ্যন্ড থ্রোর ডিজিটাল যুগ,' এই কথা শোনা মাত্রই পাঁচুদা অনেক টা লাফিয়ে উঠে বললেন, ঠিক বলেছ, আরে বাবা এখন স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের হাতে কাঁচা টাকা আর মুঠি দামি- দামি ফোন। টিচারের কোচিং সেন্টার থেকেই তাদের প্রেমের কুড়ি থেকে ফুল ফোটে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কালজয়ী একটি কবিতা হঠাৎ মনে পড়ল "ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত,' এতক্ষণ সবার কথা শুনছিলাম, মানে শ্রোতা। হঠাৎ বললাম, প্রাইভেট টিউটরের কোচিং সেন্টার হলো কিশোর প্রেমের আঁতুর ঘর। শুনে সবাই হো হো করে, হাসতে হাসতেই বললো ঠিক কথা। আগে ছেলেমেয়েরা লুকিয়ে গোপনে প্রেম করত কিন্তু এখন তারা দিব্যি প্রকাশ্যেই করছে,এব্যাপারে অভিভাবকদের মধ্যে  হেলদোল নেই। আমি বেশ কিছু দিন স্কুলের প্রশাসনিক কাজে যুক্ত ছিলাম, সেই সময়ে প্রায় উঁচু ক্লাসের ছেলেমেয়েরা এসে গোপনে বলতো, স্যার দরজা বন্ধ করে একটি ছাত্র আর একটি মেয়ে গল্প করছে। আমি মজাকরে বলতাম ওদের বিরক্ত করো না। ওরা জায়গা পায়না ভালোবাসার। পরে মুচকে মুচকে হাসতাম। আমার দৃষ্টি ভঙ্গি ছিল আলাদা, প্রেম করুক কিন্তু কেরিয়ার বজায় রেখে শোভন সুন্দর ভাবে করুক। শালীনতার সীমা অতিক্রম না করলে হল। ফলে ছেলেমেয়েদের  কাছে আমি খুব পছন্দের মানুষ ছিলাম।

বর্তমানে চারিদিকে ও কর্মজীবনে নানা ঘটনা দেখে মনে হয়, প্রেমের এখন মুক্তবাজার। বিগত বিশ বছরের বেশি এর শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে বলেই মনে হয়। আমাদের নিজেদের ছেলেমেয়েদের দেখছি পড়ার টেবিলে,  শোবার ঘরে রাতের ঘুম বাদ দিয়ে কানে ফোনগুঁজে দিব্যি তাদের প্রেমালাপ পর্ব চালিয়ে যাচ্ছে। বলতে গেলে বলে, বাবা একটু আধুনিক, একটু আপডেট হও অন্তত। ভীষন মন খারাপ হওয়া কথা। কাকে ফোন করেছিলে বললে, উত্তর আসে বন্ধুকে, পড়াশোনা নিয়ে ফোন করছিলাম। এখানেও সীমাহীন মিথ্যাচার।

প্রেমের ব্যাপারে  আমি ছিলাম একদম  আনাড়ি। নতুন চাকরি পাওয়ার পর দু-একজনকে খুশির ঊচ্ছ্বাসে যে প্রেম নিবেদন করিনি তা নয়, ল্যাংমারামারির মধ্যে জড়াতে মন চাইতো না। তাছাড়া পেশা শিক্ষকতা, তাই ও পথের পথিক হবার ইচ্ছা থাকলেও হয়ে ওঠেনি। হয়তো অযোগ্য ছিলাম, একটু সেকেলে। আড্ডার শেষে আমি বললাম, 'একালে একনিষ্ঠ প্রেম বড়ই দুর্লভ। রোমিও জুলিয়েট, লায়লা মজনু বা আমাদের শরৎচন্দ্রের দেবদাসের মতো আর কেউ কোন প্রেমদাস কি পার্বতী মানে পারুকে হারিয়ে গ্যালন গ্যালন দারু খেয়ে দিওয়ানা হয়ে মরেছে ?' নির্মল বিজ্ঞের মতো বলল, 'ঠিক বলেছেন, সুবোধ ঘোষের 'ভারত প্রেমকথা' তো

সবাই পড়েনি তাহলে বুঝত একনিষ্ঠ প্রেম কাকে বলে‌। ইতিহাসের হলুদ পাতার দিকে দৃষ্টিপাত করলাম, এক'সময় পড়েছি, মহাভারতে দ্রৌপদী ভালোবেসেছিলেন একজনকে কিন্তু বিধির বিধানে তাকে বিয়ে করতে হয়েছিল পাঁচ জনকে।আর এই কলিযুগের দ্রৌপদীরি ভালোবাসে পাঁচ জনকে অথচ বিয়ে করে একজনকে '। পাঁচুদা গায়ক মানুষ। উনি বললেন, 'যে প্রেমে বিরহের জ্বালা যন্ত্রণা  নেই, সে প্রেম মূল্যহীন। তাই তো রবীন্দ্রনাথের গানে আছে 'সখি, ভালোবাসা কারে কয়, সে যে কেবলই যাতনাময়।' 

স্বর্ণযুগের শিল্পীদের মন উদাস করা কালজয়ী গান। তাঁদের সব বিরহের গান। জগন্নাথ মিত্রর, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, শচীন কর্তা, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, গীতা দত্তের সেই সব মনমাতানো গান, তার মাদকতা ছড়িয়ে পড়ত দেহ -মনে। রবি ঠাকুরের লাজুক প্রেমিকার কি মরমী আর্তি,' প্রাণ চায় চক্ষু না চায়,মরি এ  কি লজ্জা'---! অথবা 'তুমি রবে নীরবে,হৃদয়ে মম--' আহা, গানের কী ভাষা! আর এযুগের প্রেমের বিপ্লব ঘটেছে। এখন বঙ্গ তনয়া সোচ্চারে নিজের প্রেম নিজেই ঘোষণা করে, 'প্রেম করেছি, বেশ করেছি, করবই তো'। আর ছেলেদের হ্যাংলামিও কম নয়। আজকাল হিন্দি সিনেমার নায়কদের মত মেয়েদের পিছনে লড়াকু ভঙ্গিমায় প্রেম নিবেদন করে, 'দে দে প্যায়ার দে, প্যায়ার দে রে--।' আমার কাঁচা  পিরিত পাড়ার লোকে  পাকাত  দিলে না,' অথবা  একটু সাহসী হয়ে বলে ওঠে 'চুমা-চুমা দে রে--' বলে জোরকরে প্রেম আদায় করে।' পাঁচু ব্যানার্জী একটু হাসলেন 'ভায়া এটা হাইটেকের যুগ। এখন রসিয়ে রসিয়ে প্রেম করার সময় কি? হাতে  অফুরান সময় নেই। এই জন্য এখানকার ছেলেমেয়েরা ১৪ই ফ্রেব্রুয়ারি ভ্যালেনটাইন ডে পালন করে মহা উৎসাহে। এই দিনটি ছিল বিশ্বপ্রেম দিবস মানে, প্রেমের মোচ্ছব। এদিন প্রেমিক -প্রেমিকার হাতে লাল গোলাপ দিয়ে বিদেশি কায়দায় নতজানু- হয়ে প্রেম নিবেদন করে---'আই লাভ ইউ অথবা অতি সংক্ষেপে' ইলু ইলু' । আর প্রেমিকা প্রেমিকের হাতে চাবির রিং উপহার দিয়ে  সোহাগী গলায় বলে ওঠে --' ইউ আনলক মাই হার্ট'---হে প্রিয়, এই ভালোবাসার চাবিতে তুমি আমার বন্ধ হৃদয় খুলে দাও--' নির্মল গলায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল, "যত্ত সব আদিখ্যেতা--"। পাঁচুদা বললেন, চটছ কেন ভাইয়া, এ হল এই যুগের   হাইটেক প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবন।

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
লোকগবেষক, প্রাবন্ধিক, অনুগল্প-ছোটগল্প, চিত্রনাট্য, রম্যরচনা ও ভ্রমণকাহিনীর লেখক
বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top