সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

যিশু খ্রিস্ট: এক নিঃস্বার্থ প্রেমের ভাস্কর্য :  এডওয়ার্ড রিয়াজ মাহামুদ


প্রকাশিত:
২৫ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:০৬

আপডেট:
২৫ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:৪৬

ছবিঃ এডওয়ার্ড রিয়াজ মাহামুদ

 

শুভ করোনাময় বড়দিন। আমরা বৈশ্বিক যে ক্ষত বহন করছি তাতে এবারের বড়দিনের উৎসব অনেকটা ম্লান। আমরা যারা যিশু খ্রিস্টকে জগতের ত্রাণকর্তা হিসেবে বিশ্বাস করি, তাদের কাছে এদিনের তাৎপর্য অনেক বড়। নতুন নতুন জামাকাপড় পরা, ভালো ভালো খাবারের ভোজসহ অন্যান্য আনন্দ-ফুর্তিতে এ দিনের তাৎপর্য সীমাবদ্ধ নয়, এর তাৎপর্য আধ্যাত্মিক। বিশ্বের ২৮০ কোটি খ্রিস্টান সহ বৈশ্বিক সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রনীতি এক নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বড়দিন পালন করছেন। আমরা এখন এমন এক পৃথিবীতে বাস করি, যেখানে কোটি কোটি মানুষের জীবন বড়ই কঠিন বাস্তবতার আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ, এখন জীবন মানব জাতির কাছে বড় এক বোঝাস্বরূপ। মানুষে মানুষে, দেশে দেশে, গোত্রে গোত্রে, ধর্মে ধর্মে ভয়াবহ বৈরিতা ও হিংসা-বিদ্বেষ যেন বেড়েই চলেছে। মানবসভ্যতা এগিয়ে চলেছে, মানুষের জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বৃদ্ধি হচ্ছে বটে; কিন্তু তার পাশাপাশি চলছে মানুষের মানবাধিকারের লঙ্ঘন।

‘যিশু খ্রিস্ট: এক নিঃসার্থ প্রেমের ভাস্কর্য’। এই লেখার শিরোনামে ‘ভাস্কর্য’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এই শব্দটি বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম আলোচ্য বিষয়। ভাস্কর্য শব্দটি ইতিবাচক কিছুকে ধারণ করে। নেতিবাচক কোন কিছুর ভাস্কর্য পরিলক্ষিত নয়। হ্যাঁ বলছি প্রায় দু’হাজার বছর আগে মরুভূমিতে পাহাড়ে-গালিল সাগরের তীর ঘেষে যে মানুষটি প্রেমের বাণী প্রচার করেছেন তার কথা। ‘প্রতিবেশীকে আপনার মতো প্রেম করো’ এই অমোঘ বাণীর মাধ্যমে বাইবেলের পুরাতন নিয়ম এর যিনি পূর্ণতা দিলেন তিনি খ্রিস্ট। ক্ষমা-দয়া আর প্রেমই মানুষকে দিতে পারে মিলনের আনন্দ। ঈশ্বর প্রেম। তাই তিনি জগৎকে এমন প্রেম করলেন যেন মর্ত্যরে নশ্বর মানুষকে নিজের সাথে মিলনের আনন্দ দান করতে নিজে মানুষ হিসেবে জগতে এলেন। ‘ধন্য যারা মিলন করে দেয়, কারণ তারা ঈশ্বরের পুত্র বলে আখ্যাত হবে।’ এভাবে মিলনের বাণী প্রচার করে মানবপুত্র খ্রিস্ট হয়ে ওঠেন এক অনন্য পরিত্রান কর্তা আর বাইবেল হয়ে ওঠে খ্রিস্টের বাণী সম্বলিত ঐশী পুস্তক। আর মানুষ যে আমরা, সে আমরাও তার কাছে এসে তার সমকক্ষ হয়ে উঠি। মানুষকে এইভাবে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া কেবল প্রেমের পক্ষেই সম্ভব। কেননা ঈশ্বর নিজে প্রেমের আঁধার। আর সকল মহামানবের মতো যিশু খ্রিস্ট পৃথিবীতে এসেছিলেন সহজ কথা বলার জন্য।

সেই সহজ কথা বলেন তিনি প্রেমের ভাষায়। প্রেমের ভাষা কী? প্রেমের ভাষা হলো ক্ষমা-দয়া। বাইবেলে প্রেম সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা রয়েছে। ‘যদি আমি মনুষ্যদের এবং দূতগণেরও ভাষা বলি, কিন্তু আমার প্রেম না থাকে, তবে আমি শব্দকারক পিত্তল ও ঝম্ ঝম্কারী করতাল হইয়া পড়িয়াছি। আর যদি ভাববাণী প্রাপ্ত হই ও সমস্ত নিগূঢ়ত্ত্বের ও সমস্ত জ্ঞানে পারদর্শী হই এবং যদি আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস থাকে যাহাতে আমি পর্বত স্থানান্তর করিতে পারি, কিন্তু আমার প্রেম না থাকে তবে আমি কিছুই নহি। আর যথাসর্বস্ব যদি দরিদ্র দিগকে খাওয়াইয়া দেই, এবং পোড়াইবার জন্য আপন দেহ দান করি, কিন্তু আমার মধ্যে প্রেম না থাকে তবে আমার কিছুই লাভ নেই। প্রেম চির সহিষ্ণু, প্রেম মধুর, ঈর্ষা করে না, প্রেম আত্মশ্লাঘা করে না, গর্ব করে না, অশিষ্টাচরণ করে না, স্বার্থচেষ্টা করে না, রাগিয়া ওঠে না, অপকার গণনা করে না, অধার্মিকতায় আনন্দ করে না, সত্যের সহিত আনন্দ করে, প্রেম কখনো শেষ হয় না।’  (বাইবেল, ১ করিন্থীয়-১৩: ১-৮)।

এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কী বলেন? তিনি বলেন, ‘মিলনের মধ্যে যে সত্য, তাহা কেবল বিজ্ঞান নহে। তাহা আনন্দ, তাহা রস স্বরূপ, তাহা প্রেম। তাহা আংশিক নহে তাহা সমগ্র কারণ তাহা কেবল বুদ্ধি নহে, তাহা হৃদয়কেও পূর্ণ করে। মিলনের যে শক্তি, প্রেমের যে প্রবল সত্যতা, তাহার পরিচয় আমরা পৃথিবীতে পদে পদে পাইয়াছি। পৃথিবীতে ভয়কে যদি কেহ সম্পূর্ণ অতিক্রম করতে পারে, বিপদকে তুচ্ছ করিতে পারে, ক্ষতিকে অগ্রাহ্য করিতে পারে, মৃত্যুকে উপেক্ষা করিতে পারে, তবে তাহা প্রেম। স্বার্থপরতাকে আমরা জগতের একটা সুকঠিন সত্য বলিয়া জানিয়াছি, সেই স্বার্থপরতার সুদৃঢ় জালকে অনায়াসে  ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করিয়া দেয় প্রেম।’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: ধর্ম/উৎসব,৭-৮)। তিনি আরও বলেন, ‘প্রেম তো কিছু না দিয়া বাঁচিতে পারে না।’ বাইবেল বলে, ‘প্রেম প্রত্যাশা করেনা। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘প্রেম যাহা দান করে, সেই দান যতই কঠিন হয় ততই তাহার স্বার্থকতার আনন্দ নিবিড় হয়। (রবীন্দ্রনাাথ: ধর্ম পৃ: ২৩)।

ইফিষীয় পুস্তকে বলা আছে, ‘আমরাও অন্য সকলের মত ঈশ্বরের গজবের অধীন ছিলাম। কিন্তু ঈশ্বর মমতায় পূর্ণ; তিনি আমাদের খুব প্রেম করেন। এইজন্য অবাধ্যতার দরুন যখন আমরা মৃত ছিলাম তখন খ্রিস্টের সঙ্গে তিনি আমাদের জীবিত করলেন। ঈশ্বরের দয়ায় তোমরা পরিত্রাণ পেয়েছ। আমরা খ্রিস্ট যিশুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছি বলে ঈশ্বর আমাদের খ্রিস্টের সঙ্গে জীবিত করে তার সঙ্গেই স্বর্গে বসিয়েছেন। তিনি এই কাজ করেছেন যেন তিনি তাঁর অতুলনীয় অশেষ দয়া আগামী যুগ যুগ ধরে দেখতে পারেন।’ এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ও মিলন আমাদের কাছে এখনও উপলব্ধ হচ্ছে যা আগামী দিনে আরও স্পষ্ট ভাবে সামনাসামনি দেখা যাবে। তাইতো কবি বলেছেন, ‘সীমার মাঝে, অসীম তুমি বাজাও আপন সুর। / আমার মধ্যে তোমায় প্রকাশ তাই এত মধুর।’ (গীতাঞ্জলী)

যিশু বলেন, ‘ধন্য যারা দয়াশীল কারণ তারা দয়া পাবে।’  কেবল উপদেশ বাণী সংবলিতই নয়, ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে যে প্রার্থনা, সেখানেও তিনি আরোপ করেছেন প্রেম ও ক্ষমার শর্ত। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘তোমরা যদি লোকের অপরাধ ক্ষমা করো, তবে তোমাদের স্বর্গীয় পিতা তোমাদিগকেও ক্ষমা করিবেন। কিন্তু তোমরা যদি লোকের অপরাধ ক্ষমা না করো, তবে তোমাদের পিতা তোমাদেরও অপরাধ ক্ষমা করিবেন না। তাই প্রার্থনায় বসবার আগে কারও বিরুদ্ধে কথা থাকলে তা মিটিয়ে ফেলা উচিত, না হলে সে প্রার্থনা হয় অর্থহীন। প্রার্থনার নিজের কোনো স্থান নেই। সমগ্র পৃথিবীতে যেন ঈশ্বরের রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়, শান্তি আর প্রেমের রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়, এই হলো প্রার্থনার বিষয়। এ জন্য খ্রিস্টীয় প্রার্থনায় আমরা বলি:

হে পিতা, তোমার রাজ্য প্রতিষ্ঠা হোক
তোমার ইচ্ছা যেমন স্বর্গে তেমনি
মর্ত্যে পূর্ণ হোক, আর 
আমরাও যেমন আপন আপন
অপরাধীদিগকে ক্ষমা করিয়াছি
তেমনি তুমিও আমাদের অপরাধ
সকল ক্ষমা কর।..

সহজ কথায় ঈশ্বরের রাজ্য যিনি প্রতিষ্ঠা করেন তিনিই তো রাজা। তাই তিনি অভিষিক্ত হলেন স্বর্ণ-কুন্দুরু ও গন্ধরসে। প্রত্যাখ্যান করলেন শয়তানের প্রদত্ত রাজ্যের প্রলোভন। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘সে প্রলোভনকে নিরস্ত করিয়া তিনি জয়ী হইয়াছিলেন। এই প্রলাভনের কাহিনীকে কাল্পনিক বলিয়া উড়াইয়া দিবার হেতু নাই। রোমের জয় পতাকা তখন রাজ গৌরবের আকাশে আন্দোলতি হইতেছিল এবং সমস্ত ইহুদি জাতি রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার সুখ স্বপ্নে নিবিষ্ট হইয়াছিল। এই সর্বব্যাপী মায়াজালকে ছেদন করিয়া তিনি ঈশ্বরের সত্যরাজ্যকে সুস্পষ্ট প্রত্যক্ষ করিলেন।’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:খিস্ট/যিশু চরিত)। কেবল তাই নয় মহাত্মা গান্ধী যে আদর্শের পতাকা তুলে ধরেছিলেন, তার পেছনেও রয়েছে খ্রিস্ট ধর্মের প্রভাব। তাঁর আগমন আনন্দ ও পূর্ণতা দিতে। তাঁর জন্ম আজ আমাদের আহŸান করছেন যেন হতাশা থেকে আশা, অসত্য থেকে সত্যে, অন্ধকার থেকে আলোতে আর পাপের জরাজীর্ণতা থেকে ক্ষমা, মিলন ও ও প্রেমের রাজ্যে পদার্পণ করতে পারি। পর¯পরের কাছে ও ঈশ্বরের কাছে আমরা যেন উপহার হয়ে উঠতে পারি। তবেই এই করোনা কালীন খ্রিস্টের জন্মোৎসব বড়দিন হবে সার্থক, সুন্দর, পবিত্র ও মিলন, সুখ ও আনন্দের।

 

এডওয়ার্ড রিয়াজ মাহামুদ
লেখক: শিক্ষক, কলামিস্ট ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top