সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

ধ্রুবপুত্র (পর্ব আঠারো) : অমর মিত্র


প্রকাশিত:
২১ জানুয়ারী ২০২১ ১৭:৪৬

আপডেট:
২১ জানুয়ারী ২০২১ ১৮:২০

ছবিঃ অমর মিত্র

 

সেদিন ছিল মদনোৎসব।
চৈত্র পূর্ণিমা। কামদেবের মন্দিরে যৌবনমেলা, যৌবনোৎসব। সেদিনই অতি প্রত্যূষে, ঊষার আলোয় ঘরে ফিরল ধ্রুবপুত্র। গন্ধবতীর ঘুম ভেঙেছিল আরো আগে চৈত্র পূর্ণিমার ভোরে। বসন্তোৎসবের দিন। সখার টানেই যেন ঘুম ভেঙে উঠে  আবছা আলোর ভিতরে সে বসেছিল আঙিনায় পুবের দিকে চেয়ে। ওই আকাশে তখন শুকতারাটি জ্বলজ্বল করছিল, দক্ষিণ দিগন্তে অগস্ত্য নক্ষত্র ধীরে ধীরে অদৃশ্য  হয়ে যাচ্ছিল। তখন দেখা গেল ধ্রুবপুত্রকে। ঝুঁকে হাঁটছে। বোধহয় মধ্যরাতে উজ্জয়িনী থেকে রওনা দিয়েছিল। চৈত্রের রাত তো শীতলই হয়। ধ্রুবপুত্রের গায়ের উত্তরীয়খানি ময়লা, বুকটি উদলা। দেহটি শীর্ণ, হয়ত অনাচারে অমন হয়েছিল। রক্তবর্ণ চক্ষু দুটি কোটরগত। ক্ষৌরকর্ম না করায় মুখখানি আরো রুগ্ন লাগছিল। শুকতারাটি নিভে গেল, ধ্রুবপুত্র আঙিনায় পা দিল। গন্ধবতী অভিমানে মুখ ফিরিয়ে ছিল।

গন্ধবতীর তখন সবই জানা। ওই উদ্ধবনারায়ণ কত দিন ধরে চেয়ে আছে গন্ধবতীর দিকে। উদ্ধবনারায়ণই একটি খচ্চরের পিঠে চেপে এসে খবর দিয়েছিল তার ঠাকুর্দাকে। প্রধান গণিকার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নগরে ভীষণ ঝড় তুলেছে ধ্রুবপুত্র। ওই গণিকা, দেবদত্তা তো শ্রেষ্ঠী সুভগদত্তের নয়নের মণি, এ কথা কে না জানে। নির্বোধ যুবক শেষ পর্যন্ত কিনা শ্রেষ্ঠীর নিজস্ব সম্পদে হাত দিতে গেল তাঁরই আশ্রয়ে থেকে।

গন্ধবতী বিশ্বাস করেনি। তার ভালোই লাগেনি উদ্ধবের উপস্থিতি। উদ্ধবের চোখের ভাষাও ছিল সন্দেহজনক।  কিন্তু ঠাকুর্দাই তো তারপর ওই খবর জানলেন নগরে গিয়ে। তিনি দেখা পাননি ধ্রুবপুত্রের। শ্রেষ্ঠী ছিলেন ভীষণ ক্ষুব্ধ। সে তখনই উজ্জয়িনী ত্যাগ করেছিল কিনা তা জানা যায় না, তবে ফিরেও তো এল চৈত্র পূর্ণিমার ভোরে। ওই ফেরা চিরকালের ফেরা তা ভেবেছিল গন্ধবতী। না হলে সে মদনোৎসবের  দিনে ফিরবে কেন? হায়, কেন যে অভিমানে অন্যদিকে ফিরে ছিল সে? যদি জানত অবন্তী ত্যাগ করার জন্যই শেষবারের মতো ফিরেছে তার সখা, সে কি তাকে যেতে দিত? সখার দিকে মুখটি ফেরালেই সবার সমস্ত দুঃখ দূর হয়ে যেত। সমস্ত অপমান, লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত হতো সখা। ঘরে ঢুকল ধ্রুবপুত্র। অর্গল রুদ্ধ করল।

এসব আমি জানি! চাপা গলায় বলল রেবা, সে এখন কোথায়?
তাম্রধ্বজ বলল, সমস্তটা আপনার জানার কথা নয়, সমস্তটা কেউ জানে না, না গন্ধবতীও নয়, নয় সেই ধ্রুবপুত্রও।
তাহলে কে জানে?
তাম্রধ্বজ বলল, আমি জানি মা।
তোমার গণনায় জেনেছো?
হাসে তাম্রধ্বজ, সে তো নিশ্চয়ই। আপনি আকাশের দিকে তাকান, আপনার মনের ভিতরেও জেগে উঠবে অজানা সত্যগুলি।
আমি যে গ্রহ তারা চিনি না, কয়েকটি মাত্র চিনতে পারি।

তাম্রধ্বজ বলে, লক্ষ কোটি তারা, কে চেনে সব? আকাশগঙ্গায় কত সহস্র  তারকা, নীহারিকাপুঞ্জ, কে চেনে তাদের? কিন্তু আকাশে তাকালে, অযুত আলোর বিন্দুর দিকে রাত্রিকালে তাকালে বুক ভরে ওঠে না! আপনি ওই আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবুন সেই দিনটির কথা। পরমান্ন রাধলেন ধ্রুবপুত্রের জন্য। সেই পরমান্ন গ্রহণ করল না সে। দুয়ার খোলে না। জানালাও বন্ধ। গন্ধবতী কতবার ডাকল, সখা সাড়া দিল না।

সব আমার জানা।
কী আর জানা, যেটুকু চোখে দেখেছেন, সেইটুকুই তো। চোখের আড়ালে যা ঘটে গেছে তার খবর তো রাখেন না মা। আমি এলাম গম্ভীরা হয়ে, নদীটি জলহীন হয়ে পড়ে আছে। বালুরাশি সরিয়ে নদীর অন্তঃস্থল থেকে জল সংগ্রহ করছে গ্রামবধূ, গ্রাম বালিকারা। এই তো সেই নদী, যে নদীর স্বচ্ছ জলে বর্ষার মেঘের ছায়াময় শরীর প্রবেশ করত। সেই জল, সেই মেঘ অবন্তীর আকাশে নেই। মনে পড়ে কি মা, বর্ষায় এই ধরণী কেমন উল্লসিত হয়ে উঠত, কেমন মধুর গন্ধ ব্যাপ্ত হয়ে যেত চারিদিকে, সেই গন্ধ উঠত মাটি থেকে, সজীব বৃক্ষাদি লতাগুল্ম থেকে, বাতাসে মিশে যেত নদীর স্রোতধ্বনি,  নদীতীরের ডুমুর বনে ডুমুর পেকে উঠছে ধীরে ধীরে......।
আশ্চর্য! অস্ফূটধ্বনি বেরিয়ে এল রেবার কণ্ঠ থেকে, এসব তুমি দেখেছ?
উহু, আমি তো বেত্রবতীতীরের মানুষ, বেত্রবতী  দশার্ণ দেশের দক্ষিণ-পুবে।
তবে তুমি গম্ভীরার বর্ষার রূপ জানলে কী করে?
জানি মা।
গণনায় জেনেছ?
তাম্ৰধ্বজ বলে, বেত্রবতী নদীও শুকিয়ে গেছে, জল নেই, দশার্ণ  দেশেও বৃষ্টি হয়নি।  দাবানল লেগেছিল দূর আম্রকূট পর্বতের সানুদেশের অরণ্যে । সেই দাবানল এখনো নেভেনি মা। ধিকিধিকি জ্বলছে আগুন। গ্রাস করে নিচ্ছে সমস্ত সবুজ। অরণ্যচারী নিষাদরা পালাচ্ছে। অরণ্যের প্রাণীরা লোকালয়ে এসে পড়ে নিহত হচ্ছে।
কী করে জানলে?
শুনেছি মা, আম্রকূটের দিক থেকে আসা একদল বণিক উজ্জয়িনী পার হয়ে কনখলের দিকে চলে গেল।
আশ্চর্য! রেবার দুটি চোখ বিস্ময়ে স্ফীত হয়ে উঠেছে অন্ধকারে।
তাম্ৰধ্বজ বলে, ওই আম্রকূটেই রেবা নদীর জন্ম। সেই নদী শুষ্ক, বিশীর্ণা।
তারপর! রেবার চোখদুটি ছলছল করে আকাশের দিকে চেয়ে।

তাম্ৰধ্বজ বলে, আম্রকূট থেকে উত্তরের পথে সেই নদী পার হয়েছিল বণিকেরা। বালু ধু-ধু, বৃষ্টি নেই, রেবা নদী প্রমত্ত হবে কী করে? এবার কদম্ব কি ফুটেছিল? জানিনা। ভূঁইচাঁপা কি ফুটেছিল ভিজে মাটিতে? দেখিনি। মনে পড়ে মা সেই বর্ষার কথা, মেঘের তলা দিয়ে চিতল হরিণযুথ ছুটে যাচ্ছে। নদীতীর ধরে, আকাশের মেঘের দিকে চেয়ে ময়ূরের কেকাধ্বনি। আমার দশার্ণ দেশ এক সুন্দর বাসভূমি, কেতকীর সার দিয়ে ঘেরা। দশার্ণ দেশটি জম্বুবনে শ্যামল, জম্বুবৃক্ষে পরিপক্ক ফল, ওই বৃক্ষেই আবার পাখিরা বাসা নির্মাণ করছে খড়কুটোয়, কেতকী বনে কুড়ি এসেছে বর্ষার আগমনে, বেত্রবতী ছিল জলপূর্ণ, কী লীলায়িত ভঙ্গী সেই নদীর--এখন জলহীন!

রেবা স্তব্ধ হয়ে আছে। সে জানেও না অদূরে অন্ধকারে এসে দাড়িয়েছে গন্ধবতী। তাম্ৰধ্বজ দেখতে পাচ্ছিল গন্ধবতীর অবয়ব। চোখ দুটি অন্ধকারে যুগল দুই নক্ষত্রের মতো জুলছিল আলোর বিন্দু হয়ে। তাম্ৰধ্বজ বলছিল নীচৈঃ পাহাড়ের কথা। দশার্ণ দেশের রাজধানী বিদিশা নগরীর কথা। বেত্রবতী নদীর তীরেই বিদিশা নগরী। তার উপকণ্ঠে নীচৈঃ পাহাড়। এখন সেই পাহাড়ের চারপাশের গভীর নৈঃশব্দ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। পাহাড়ের নির্জনতা তো প্রণয় বিলাসী-বিলাসিনীদের পরম প্রিয় ছিল। নির্জন গিরিগুহায় যুবক-যুবতীরা মিলিত হতো, প্রণয় সম্ভাষণে মুখর করে তুলত দশদিক। সেইসব বিলাসী, বিলাসিনী নারী-পুরুষের দেহের সুগন্ধে ভরে থাকত নীচৈঃ পাহাড়ের গুহা। এখন দ্বিপ্রহরে শুধু শৃগালেরা ঘুরে বেড়ায় ওই পাহাড়ের কোলে। গুহাগুলি হিংস্ৰপ্ৰাণীর বাসভূমি হয়েছে। মনে পড়ে বেত্রবতীর নদীর দুই কূলে নববর্ষায় যুথিকার বন গভীর হয়ে যেত। সেই বনে রমণীরা পুষ্পচয়ন করতে আসত। এখন নদীতীর খাঁ খাঁ, শুধু বালি ওড়ে।

গন্ধবতী এগিয়ে এল, এসব আপনাকে কে বলেছে?
কেউ না, আমি তো দশার্ণের মানুষ।
কিন্তু আম্রকূট পাহাড়, রেবা নদী?
বণিকেরা।
বণিকেরা এত মধুর করে দেখতে জানে?
হাসে তাম্ৰধ্বজ, কী জানি!
আপনাকে কে বলল, বলুন।
তাম্ৰধ্বজ আকাশে তাকায়, আকাশের নক্ষত্রদের দিকে হাত তুলে তর্জনী নিক্ষেপ করে। মগ্নস্বরে বলল, আকাশের তারারা। আকাশে তাকিয়ে এই সবই যেন দেখতে পাই আমি। দেখতে পাই সেই বর্ষায় গম্ভীরা কেমন ছিল, গম্ভীরার কুলে কারা দাঁড়িয়েছিল।

আপনি বলুন আমার পিতা কার্তিককুমার কোথায় আছেন।
রেবা আচমকা চাপাস্বরে কেঁদে ওঠে, না, থাক, আমি জানতে চাই না।
গন্ধবতী এগিয়ে মাকে স্পর্শ করে। সে কাঁপছিল থিরথির। তার মনে হচ্ছিল মা রেবা বোধহয় জানে উদ্ধবনারায়ণের সেই কথা। রটনাটি শুনেছে মা। কিন্তু তাই বা কী করে হয়? তাহলে কি মা তার কাছে, প্রকাশ করত না রটনাটি?
রেবা নিজেকে সম্বরণ করে নিয়েছে। বলল, তুমি যা বলছিলে বলো, আমাকে জানাও কোথায় কীভাবে আছে ধ্রুবপুত্র।
গন্ধবতী মাকে ভর করে বসে পড়ল আঙিনায়। মা-মেয়ে বসে আছে পাশাপাশি। তাম্ৰধ্বজ বলল, যে কল্পনাহীন তার কথার কোনো মূল্য নেই!
চমকে ওঠে গন্ধবতী, এ কার কথা! এই কথাই যেন সখা বলত উদ্ধবনারায়ণ সম্পর্কে। হায়, বসে আছে সামনে?
তাম্ৰধ্বজ বলল, এই যে অবন্তীদেশ, উজ্জয়িনী নগর, এই নগরের আকাশে, মহাকাল মন্দিরের শীর্ষে, হর্ম্যশ্রেণীর মাথায় যখন হিমালয়ে যাত্রা করা মেঘ এসে দাঁড়াত, মনে পড়ে মা?
রেবা নয়, গন্ধবতীর দু’চোখ দিয়ে জল পড়ছে। এই মানুষটি কি ইন্দ্রজাল জানে? এই কথা তো ধ্রুবপুত্রের। অবিকল ধ্রুবপুত্রের।
রেবা বলল, এইসব কথার সঙ্গে ধ্রুবপুত্রের কী সম্পর্ক? সে কোথায় আছে তাই তো শুনতে বসে আছি।
তাম্ৰধ্বজ বলল, সেই কথার ভিতরে প্রবেশ করতে এত কথা, শোনো মা, সেই ধ্রুবপুত্র নেই, অবন্তী, দশার্ণ দেশ পুড়ছে রৌদ্রে, মেঘ নেই, তুমি মা মেঘের কথা জানো?

রেবা চুপ করে আছে। রেবা ঠিক ধরতে পারছে না কী বলতে চায় তাম্ৰধ্বজ। কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে যাচ্ছে সে। গন্ধবতী ভাবছিল সে কি ঠিক শুনছে! নাকি সবটাই তার শ্রবণের বিভ্রম। যে কথা শুনত সে গম্ভীরা তীরে বসে, এই গ্রামের ধূলিতে ধূসরিত হতে হতে, বকুল ফুলের মালা গাঁথতে গাঁথতে, সেই কথাই যেন শুনছে এই অন্ধকারে বসে। ওই যে বলছে তাম্ৰধ্বজ, মেঘ তিনরকমের। উৎপত্তি ভেদে মেঘ আগ্নেয়, ব্রহ্মজ ও পক্ষজ। এই কথাটি ধ্রুবপুত্র বলেছিল? বলেনি বোধহয়, কিন্তু মনে হয়। যা বলছে ওই দশার্ণদেশীয় জ্যোতির্বিদ, তার সবটাই সে যেন তার সখার কাছে শুনেছে। সখাই তো এমন কথা জানে। আর কেউ জানে না। কিন্তু বলে যাচ্ছে তো তাম্ৰধ্বজ আকাশের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে।

যে মেঘ নেই অবন্তীর আকাশে, সেই মেঘ আগ্নেয়, ব্রহ্মজ, পক্ষজ। আগ্নেয় মেঘ জলজাত। এই মেঘ মহিষ, শূকর ও মত্ত হস্তীর আকারে আকাশে ভেসে ওঠে, পৃথিবীতে নামে। এরাই জীমূত। এদের দিয়ে প্রাণবান হয় পৃথিবী। এই মেঘ নিজেকে নিঃশেষিত করে পৃথিবীকে সিক্ত করতে করতে। এই মেঘ নিঃশব্দে ধারাবর্ষণ নামায়। আর যে মেঘ বিদ্যুৎগুণসম্পন্ন, গর্জন করে যায় আকাশমণ্ডলে, যে মেঘের ডাকে বলাকারা গর্ভবতী হয়, যে মেঘ ব্রহ্ম নিঃশ্বাসে উৎপন্ন, সেই মেঘই ব্রহ্মজ মেঘ। এই ব্রহ্মজ মেঘই  পাহাড় চূড়ায়, হর্ম্যশ্রেণীর মাথায় ডেকে ডেকে ফেরে আষাঢ়, শ্রাবণ, প্রোষ্টপদে। ধরণী এই মেঘের ডাকে। শস্যশালিনী হয়, সুন্দর হয়ে ওঠে। এই মেঘের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অতি মধুর। মা সেই মেঘের কথা কি মনে পড়ে?

গন্ধবতী অস্ফুট শব্দে শিহরিত হয়, সবই যেন শোনা আমার!

তাম্ৰধ্বজ তখন বলে যাচ্ছিল পুষ্করাবর্ত মেঘের কথা। পক্ষজ মেঘেরই সেই নাম। মহাতেজস্বী পর্বতগণ আগে পক্ষধর ছিল। তারা উড়ে উড়ে বেড়াত পৃথিবীময়। তাদের অত্যাচারে প্রাণীকুল দেবরাজ ইন্দ্রের শরণাপন্ন হয়। দেবরাজ তখন পর্বতের পক্ষ ছিন্ন করেন। সেই ছিন্ন পক্ষই হয়ে যায় জলেভরা মেঘ। সেই মেঘের নামই পুষ্করাবর্ত। তাদের নানারূপ। কথিত আছে এই মেঘ কল্পের শেষে বর্ষণ করে, কল্প হলো ব্রহ্মার এক অহোরাত্র। ব্রহ্মার অহোরাত্রর কথা কল্পনায় আসে না। কোটি কোটি বর্ষ তা। জ্ঞানীরা বলেন চারিশত বত্রিশ বর্ষ অন্তে এক কল্প শেষ হয়। এই মেঘে বৃষ্টি হবে যুগান্তকালে। এই রকম কত যুগান্তই না পার হয়ে গেছে আমাদের অজ্ঞাতে। কত সহস্রবার বৃষ্টিপাতে পৃথিবী প্লাবিত করেছে পুষ্করাবর্ত  মেঘ।

গন্ধবতী বলে, এবার কি পুষ্করাবর্ত মেঘে বৃষ্টি হবে, প্লাবিত হবে পৃথিবী, যুগান্ত হয়ে যাবে,  না হলে আকাশ এমন অন্ধ, ঘুমিয়ে আছে কেন?
তাম্ৰধ্বজ বলে, যেন মনে হয় তাই! না হলে এমন হবে কেন, ধ্রুবপুত্র কি কিছু বলে গিয়েছিল?
গন্ধবতী বলে, এসব বলেছিল কিনা মনে নেই, তবে এখন যেন মনে হচ্ছে এইসব কথাও যেন বলতে চেয়েছিল সে, ঠিক এই কথা, এমন কথা বলার কথা ছিল তার সেই চৈত্র পূর্ণিমার সন্ধ্যায় ।
সত্যি বলছ? 
হ্যাঁ, সেও তো বলত পুষ্করাবর্ত মেঘের কথা, সেই মেঘ সব আগুন নিভিয়ে দেয়, পরাবহ নামে এক বাতাসের আশ্রয়ে তারা থাকে......।
বলো, বলে যাও। তাম্ৰধ্বজ বলে।
আমার সব মনে নেই, তবে মেঘের কথা সে খুব বলত, সমস্ত মেঘের ধূমের কথা বলত, সেইসব ধূমের ভিতরে চার দিগগজ-- গজ, পর্বত, মেঘ, সর্প এবং পর্জন্যই হলো শ্রেষ্ঠ।
তাম্ৰধ্বজ বলে, হ্যাঁ, গজ, পর্বত, মেঘ এবং সর্প, এই চার দিগগজ একই কুল থেকে এসেছে। একই জল থেকে এদের জন্ম হয়েছে। পর্জন্য ও দিগগজেরা হেমন্তকালে শস্যবৃদ্ধির জন্য তুষারপাত ঘটায়, হিমপতন হয় তাদেরই জন্য।
গন্ধবতী বলে, এখন কি মেঘেরই কথা বলা হবে?
হ্যাঁ তাই।
এসব কথা তো আমার শোনা মনে হয়, ওই যে যুগান্তের কথা বললেন সবই তো আগে শুনেছি যেন, গম্ভীরা তীরে শুনেছি, শুনেছি এই আঙিনায় চন্দ্রালোকের ভিতরে বসে, নাহলে পরাবহ বাতাসের কথা বললাম কীভাবে, পুষ্করাবর্ত মেঘের আশ্রয় যে বাতাসে।
শোনো গন্ধবতী তোমাকে এই শীতঋতুর বৃষ্টির কথা বলি, তোমার কি মনে পড়ে হিমালয়ের উত্তরে, সুমেরু পর্বতের দক্ষিণে হেমকূট নামে এক পর্বত আছে।
মাথা নাড়ে গন্ধবতী। ফিসফিস করে, এই কথা হয়ত সেই চৈত্র পূর্ণিমার রাতে বলত ধ্রুবপুত্র, সে এখন কোথায়?
তাম্ৰধ্বজ যেন শোনেই না কথাটা, বলে, হেমকূট পর্বতের সানুদেশে এক নগর আছে, পুণ্ড্র তার  নাম।
শুনেছি যেন!
আগে কি বলেছি?
বোধহয়। অনুচ্চ কণ্ঠে বলে গন্ধবতী।
শোনো হেমকূট পর্বতে তুষার বর্ষণ হলে বাতাস সেই জল ধারণ করে হেমকূট থেকে হিমালয় পর্যন্ত বর্ষণে ভাসায়। সেই বর্ষার প্রভাবে অন্যদেশেও ঈষৎ বর্ষণ হয়ে থাকে, সামান্য বর্ষণ। সমতলে নেমে আসে সেই মেঘ, সমতলে সেই মেঘের প্রভাবে ফসল জন্মায়, মাঘের বৃষ্টি তো সুসময় আনে, মাটি  নরম হয়, হল কর্ষণের উপযোগী হয়ে ওঠে।
মাঘ তো শেষ হয়ে গেল, আসবে সেই মেঘ?

তাম্ৰধ্বজ আকাশের অযুত নক্ষত্রের দিকে তাকায়, মগ্নস্বরে বলে, হেমকূট থেকে হিমালয়, হিমালয় থেকে সেই বাতাস আসে এইসময়, মদ্রদেশ, পাঞ্চালদেশ, সিন্ধু নদ, পঞ্চনদ পার হয়ে সেই মেঘ যমুনার কুলে কুলে বৃষ্টি নামায়, চর্মণ্বতী নদীর দুই অনার্দ্র তীর আর্দ্র করে এইসময়। ক্ষণবর্ষণ হলেও তা মানুষের অতিপ্রিয়। সেই মেঘ হিমালয় থেকে সমুদ্রের দিকে যায়, অপরা সমুদ্রে গিয়ে নিঃশেষ হয়। 

সেই মেঘের কোনো চিহ্ন আছে আকাশে?
মাথা নাড়ে তাম্ৰধ্বজ, নেই!
তবে! গন্ধবতীর বুক থেকে যেন চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। কোথাও কোনো আশ্রয় নেই। উদ্ধবনারায়ণ এসে দাঁড়াচ্ছে পিঠের কাছে। শরীরে ছায়া ফেলছে সেই দুর্বৃত্ত। রাজার জলভাণ্ড শুকিয়ে গেছে। গম্ভীরার বুকে বালি উড়ছে। হায়! এ কোনদিন এল? কেন এল? এর থেকে পরিত্রাণের কী উপায়? যে বলতে পারত সে এখন কোথায়, কোন সুদূরে?

তাম্ৰধ্বজ বলে, সেই নিষ্ক্রমণের মুহূর্তগুলি জানতে এসেছি, যতটা জানো আমাকে বলো তুমি, চৈত্র পূর্ণিমার ভোরবেলায় সে ফিরে এল উজ্জয়িনী থেকে, তারপর? 

গন্ধবতী আকাশে তাকায়। অযুত নক্ষত্রের ভিতরে ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে লাগল সেই  চৈত্রের পূর্ণিমা। সেদিন ছিল মদনোৎসব। কামদেবের মন্দিরে যাওয়ার দিন। মনে আশা ছিল সখার হাত ধরে যাবে মদনোৎসবে।

সে এল ভোরে। গন্ধবতী অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল অভিমানে। ঢুকল ধ্রুবপুত্র নিজ ঘরে। ওই যে সেই ঘর। দুয়ার টেনে বন্ধ করা আছে। ওই ঘরে আর ঢোকে না গন্ধবতী। কিন্তু আচমকা এমন কি মনে হয় না যে ঘরে হয়ত ফিরে এসেছে ধ্রুবপুত্র। কোনো কোনোদিন লাফ দিয়ে ওই কুটিরের দাওয়ায় উঠে দরজা ঠেলে দেয়। ভিতরে স্তব্ধ শূন্যতা। বাতাসে গুমোট গন্ধ। ধ্রুবপুত্র যদি না ফেরে ধীরে ধীরে ওই কুটির পড়ে যাবে মাটিতে। কে ওর সংস্কার করবে? কেন করবে? ঠাকুর্দা বলেছিল একবার। কিন্তু তারপর তিনিও তো নিশ্চুপ।

গন্ধবতী জিজ্ঞেস করে, আপনি কোনোদিন কামদেবের মন্দিরে গেছেন?
কোথায়?
এখান থেকে দক্ষিণ-পুবে।
তা আমি জানি।
তবে যে জিজ্ঞেস করলেন?
আমার দশার্ণ দেশে, বিদিশা নগরেও আছে কামদেবের মন্দির।
দেখেছেন কামদেবকে?
তাম্ৰধ্বজ অস্ফুটস্বরে বলল, দেখেছি।
কবে দেখেছেন, বাল্যকালে?
না। সেই দশার্ণ থেকে এলাম অবন্তীতে, পথেই কৌতূহল হলো, দেখি কামদেবকে, কী সুন্দর দেবতা তিনি!
হুঁ। গন্ধবতী আকাশে চোখ মেলে দেয়।
যৌবন অমন সুন্দর হয়, জীবনের সেই পরম লগনে এসে পৌঁছেছিল ধ্রুবপুত্র, তুমিও গন্ধবতী সেই লগনই স্পর্শ করেছ।
আকাশ ঝলমল করে উঠল গ্রামবালিকার চোখের সামনে।

চলবে

 

ধ্রুবপুত্র (পর্ব এক)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দুই)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তিন)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পাঁচ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ছয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সাত)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব আট)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব নয়)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব দশ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব এগার)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব বারো)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব তের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব চৌদ্দ)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব পনের)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব ষোল)
ধ্রুবপুত্র (পর্ব সতের)

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top