সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

ঝিলম গাছের তলা : সিদ্ধার্থ সিংহ


প্রকাশিত:
২১ জানুয়ারী ২০২১ ১৯:৪৫

আপডেট:
২১ জানুয়ারী ২০২১ ২০:২২

 

তিনাই ঝপ করে বিছানা থেকে নেমে কাউকে কিছু না বলেই সোজা হাঁটা দিল তাদের বসতবাড়ির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে সেই ঝিলম গাছের তলায়। না, আমেরিকা নয়, সে মালয়েশিয়া যাবে।

সুন্দরবনের এই জ্যোতিষপুর অঞ্চলে যাঁরা থাকেন, তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেরই ভিটেমাটি ছাড়াও কম-বেশি একটু-আধটু জমি আছে। সেখানে তাঁরা চাষবাস করেন। আনাজপত্র ফলান। হাঁস-মুরগি পোষেন। পুকুর থাকলে মাছ চাষ করেন। আর তাতেই তাঁদের দু'বেলা কোনও রকমে ঠিক চলে যায়।

কিন্তু তিনাইদের জমিজমা একটু বেশিই। পুকুরই আছে তিন-তিনটে। তাও এত বড় বড় যে, সেগুলোকে আর পুকুর বলা যাবে না। বলতে হবে পুষ্করিণী। তাদের চার পুরুষ আগের, মানে ঠাকুরদার বাবারা বসতবাড়ির খানিক দূরেই যে কারুকার্যখচিত পোড়ামাটির বিশাল মন্দিরটা বানিয়েছিলেন, সেটার অবস্থা এখন একেবারে ভগ্নদশা। তবু প্রতি বছর শিবরাত্রির দিন ঘটা করে পুজো হয়। শুধু তাদের গ্রামেরই নয়, আশপাশের গ্রামের মেয়ে-বউরাও শিবের মাথায় জল ঢালার জন্য রাত থাকতে হাজির হন। এই পুজোকে ঘিরে টানা তিন দিন ধরে মেলা বসে।

সেই মন্দির ছাড়িয়ে আরও খানিকটা গেলে বেশ খানিকটা ফাঁকা জমি। পরিত্যক্তই বলা যায়। না, সেখানে কোনও গাছপালা লাগালেও হয় না। লোকে বলে বন্ধ্যা জমি। অথচ সেই বন্ধ্যা জমিতেই বাপ-ঠাকুরদার যুগ থেকে একটা ঝিলম গাছ বহাল তবিয়তে কী সুন্দর টিকে আছে।

জমিটা কোনও কাজে লাগে না। তাই তাদের বাড়ির কেউ মারা গেলে, যেহেতু ওরা বৈষ্ণবী, তাই কেউ মারা গেলে ওদের তো পোড়ানো হয় না, সমাধি দেওয়া হয়। দু'হাত বাই দু'হাত মাপের ইটের গাঁথুনি দিয়ে প্রথমে তিন দিক ঘিরে ছোট্ট একটি খুপরির মতো বানানো হয়। তার পর মৃতদেহটাকে স্নান করিয়ে নতুন পোশাক পরিয়ে সেই খুপরিতে কোনও রকমে বসানো হয়। তার পর সামনের দিকটা পাঁচিল তুলে মাথার উপরে সিমেন্ট-বালি দিয়ে ঢালাই করে দেওয়া হয়। এ সবের জন্য বৈষ্ণবীরা সাধারণত বাড়ির শেষ সীমানা কিংবা পুকুর পাড়কেই বেছে নেয়। তিনাইরা বহু বছর আগেই বেছে নিয়েছিল ওই জমিটা।

 

খানিক আগে ভোর রাতে তিনাই স্বপ্নে দেখেছে, খেলতে খেলতে কী ভাবে যেন ও সেই ঝিলম গাছের তলায় চলে গেছে। গাছটার গুঁড়ির পাশেই ছিল বহু দিন আগের একটা বেদি। হঠাৎ চোখ পড়তেই দেখে, সেটা ধ্বস নেমে বেশ খানিকটা নীচে নেমে গেছে। কত নীচে নেমে গেছে বোঝা যাচ্ছে না। ভয়ে-ভয়ে সেই গর্তে উঁকি দিতেই ও দেখল, এক-দেড় হাত নীচেই কাঠের পিঁড়ির মতো কী যেন একটা পাতা।

এখানে পিঁড়ি এল কোথা থেকে! লোকে তো পিঁড়ি পেতে দেয় বসার জন্য। তা হলে কি কেউ তাকে এখানে বসতে বলছে! নিশ্চয়ই বলছে, না হলে এখানে খামোকা কেউ পিঁড়ি পাততে যাবে কেন! ও তাই কোনও রকমে পা টিপে টিপে খুব সাবধানে সেটায় গিয়ে বসল।

গুড়ির মতো এই ঝিলম গাছটার একটা মোটা শেকড় এ দিক থেকে ও দিকে চলে গেছে।

বসেই টের পেল, এটা কোনও পিঁড়ি নয়, এই ঝিলম গাছটার একটা মোটা শেকড়। এ দিক থেকে ও দিকে চলে গেছে। জায়গাটা অন্ধকার অন্ধকার মতো। তার ওপরে এটা এতটাই মোটা যে, উপর থেকে দেখেছে বলে তখন তার পিঁড়ি বলে মনে হয়েছিল।

ও বসামাত্রই, ডান দিক বাঁ দিক থেকে ঝপ ঝপ করে কতগুলো লতাগুল্ম ওকে একেবারে জাপটে ধরল। তার পরই সেটা শাঁ শাঁ করে নীচের দিকে নামতে লাগল। কোথায় যাচ্ছে এটা! এটা কি মাটি ফুঁড়ে পৃথিবীর ও প্রান্তে গিয়ে বেরোবে! ও জানে, পৃথিবীটা গোল। ভারতের ঠিক উল্টো দিকে রয়েছে আমেরিকা। তার মানে ও কি আমেরিকায় গিয়ে পড়বে!

কয়েক মুহূর্ত মাত্র। ও দেখল, ও যা ভেবেছিল ঠিক তা-ই। ও একেবারে আমেরিকায় এসে হাজির হয়েছে। আমেরিকা মানে নিউজার্সির একটা পরিত্যক্ত কবরখানায়। উঠেই দেখে, সামনেই একটা মস্ত বড় ঝিলম গাছ। অবিকল তাদের সেই ঝিলম গাছটার মতোই। গাছটার পাশেই শ্বেতপাথরে বাঁধানো একটা প্রশস্ত বেদি। সেই বেদির ওপরে বেশ কয়েক জন গোল করে বসে দাবা খেলছে। ওকে দেখেই একজন বলল, ও... তুমিও পিঁড়িতে বসে বুঝি আমেরিকার কথা ভেবেছিলে!

তিনাই বলল, হ্যাঁ। কিন্তু তোমরা জানলে কী করে!

ওদের মধ্যে থেকে অন্য একজন বলে উঠল, আমরাও তো মনে মনে আমেরিকার কথাই ভেবেছিলাম। তাই এখানে চলে এসেছি। পরে শুনলাম, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নাকি এই রকম আরও অনেক ঝিলম গাছ আছে। সেই গাছের কাছাকাছি কোনও গহ্বরের ওই রকম কোনও পিঁড়িতে বসে যে যেখানে যাওয়ার কথা ভাবে, ওই পিঁড়ি নাকি তাকে সেখানেই পৌঁছে দেয়। তুমি যদি আমেরিকা না ভেবে লন্ডন ভাবতে, তা হলে এখানে নয়, তুমি সোজা লন্ডনে চলে যেতে। ভিয়েতনাম ভাবলে ভিয়েতনামে।

--- সে কী! এ রকম আবার হয় নাকি! তা হলে লোকে এত টাকা দিয়ে টিকিট কেটে প্লেনে করে ওই সব জায়গায় যেতে যাবে কেন? এ ভাবেই তো যেকে পারে! ধ্যাৎ, এ রকম আবার হয় নাকি?

--- নিশ্চয়ই হয়। না হলে আমরা আমেরিকা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকায় চলে এলাম কী করে!

--- এটা কি সত্যিই আমেরিকা?

--- বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি, না? যাও, ওই যে মরচে ধরা বিশাল লোহার ফটকটা দেখতে পাচ্ছ, ওটার বাইরে গিয়ে একবার চারিদিকে তাকিয়ে দ্যাখো। এদিক ওদিককার দোকানের নামের নীচে যে ঠিকানাগুলো লেখা আছে, সেগুলো পড়ো। তা হলেই বুঝতে পারবে, তুমি নিউজার্সির কোন অঞ্চলে কত নম্বর রাস্তায় কত নম্বর বাড়ির উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে আছ, বুঝেছ?

--- তাই?

লোকটা বলল, একদমই তাই।

--- আর আমি যদি তখন আমেরিকা না ভেবে মালয়েশিয়া ভাবতাম?

--- তা হলে মালয়েশিয়া চলে যেতে।

লোকটার কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ তীব্র এক আলোর ছটায় তিনাইয়ের চোখ একেবারে ঝলসে যাওয়ার জোগাড়। তাকিয়ে দেখে, তার ডান পাশের একটা প্রকাণ্ড বড় ওক গাছের ঝাঁকড়া মাথা থেকে একটা বিশাল ডানাওয়ালা পাখি আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে। তার গা থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে সূর্যের রশ্মির মতো তীব্র এক আলোর ছটা। সে চোখ বন্ধ করে ফেলল।

না, বন্ধ নয়। আসলে সে চোখ খুলে তাকাল। দেখল, কোথায় সেই পাখি! কোথায় সেই ঝিলম গাছ! কোথায় সেই পরিত্যক্ত কবরখানা! আর কোথায়ই বা সেই আমেরিকা! সে তো তার ঘরের খাটেই শুয়ে আছে! আর আলো? সে তো রোজই তার জানালা দিয়ে সূর্যের আলো যেমন আসে, সে ভাবেই এসে পড়েছে তার মুখে।

তাই ঝটপট বিছানায় উঠে বসল সে। কিন্তু স্বপ্নটা!

সে বাবা-কাকাদের মুখে শুনেছিল, আগেকার দিনে নাকি কেউ মারা গেলে তাঁর মৃতদেহ সমাধিস্থ করার আগেই, যাঁদের যেমন অবস্থা, তাঁরা তাঁদের সাধ্যমত ওই সমাধির নীচে মাটির তলায় সোনাদানা, হিরে-জহরত, তাঁর প্রিয় খাবারদাবার, পোশাক-আশাক, এমনকী তাঁর ব্যবহৃত খাগের কলমটা পর্যন্ত দিয়ে দিতেন।

আর সমাধিস্থ করে আসার পর দিন সকালেই দেখা যেত সেই সমাধিক্ষেত্র লন্ডভন্ড। শুধু ভাঙাই নয়, অনেকখানি গভীর করে খোঁড়া। কে বা কারা যেন রাতের অন্ধকারে মাটি খুঁড়ে সেই সব সোনাদানা-হিরে জহরত নিয়ে পালিয়েছে। কী করা যায়! রাতের পর রাত তো আর সমাধিক্ষেত্র পাহারা দেওয়া যায় না। তাই তাঁরা ঠিক করলেন, যত প্রিয় জনই মারা যাবে না কেন, সমাধিক্ষেত্রের নীচে তাঁরা আর কোনও মূল্যবান জিনিস দেবেন না। সেই যে বন্ধ হল, তো হলই। আর সেটা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ হয়ে গেল রাতের অন্ধকারে সমাধিক্ষেত্র তোলপাড় হওয়া। তার নীচের মাটি খোঁড়া।

এখন তো আর কোনও সমাধিক্ষেত্রের মাটি কেউ খোঁড়ে না! তা হলে এ রকম একটা স্বপ্ন ও দেখল কেন! নিশ্চয়ই কোনও একটা কারণ আছে! তাই ঘুম থেকে উঠেই তিনাই হাঁটা দিয়েছিল সেই ঝিলম তলার দিকে।

ওখানে যদি সত্যিই ওই রকম কোনও কিছু সে দেখতে পায়, তা হলে আর আমেরিকা নয়, স্বপ্নে তো সে আমেরিকা দেখেই নিয়েছে, শুধু শুধু আবার আমেরিকায় গিয়ে কী লাভ? এ বার সে মালয়েশিয়া যাবে। সোজা মালয়েশিয়া।

সে যখন ঝিলম গাছটার কাছে গিয়ে পৌঁছল, দেখল আগেকার বেদিগুলো প্রাকৃতিক কারণেই ভেঙেচুরে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কিন্তু এই কিছু দিন আগেই, ওর দিদুন মারা যাওয়ার পরে যে সমাধিটা বানানো হয়েছিল, সেটার অবস্থা এ রকম কেন!

এ দিক ও দিক একদম শুনশান। শোঁ শোঁ করে বাতাস বইছে। আর সেই বাতাসে একবার এ দিকে আর একবার ও দিকে কাৎ হয়ে হেলে পড়ছে সেই ঝিলম গাছটা। হঠাৎ ওর মনে হল, এই বুঝি কেউ তার পাশে এসে দাঁড়াল। এই বুঝি ঝপ করে পিছন থেকে কেউ সরে গেল। এই সক্কালবেলাতেও তার শরীর কেমন যেন ভার-ভার হয়ে উঠল।

তার মধ্যেই সে দেখল, না, আলোর পাখি নয়, একটা কাঠঠোকরা। তাদের জমির একদম সীমানা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা চার-সাড়ে চার মানুষ সমান সুপারি গাছটার মাথার দিকটা ঠোকরাচ্ছে। ওটা দেখে ওর মনে হল, আচ্ছা, কাঠঠোকরাটা গাছটাকে ও ভাবে ঠোকরাচ্ছে কেন! সে কি উঠে একবার দেখবে! কিন্তু কেউ যদি তাকে বাড়িতে না দেখে এ দিকে খুঁজতে আসে! আর এসে যদি দেখে সে গাছে উঠছে, তা হলে তো একেবারে কেলেঙ্কারি কাণ্ড হয়ে যাবে।

কবে কোন জন্মে তাদের কোন এক কাকা নাকি খেজুর গাছে ভরসন্ধেবেলায় রসের হাঁড়ি বাঁধতে গিয়ে পা ফসকে পড়ে গিয়েছিলেন। বহু ডাক্তার-বদ্যি করেও তিনি নাকি সারা জীবনেও আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি। তাই তার পর থেকে তাদের বাড়িতে শুধু খেজুর গাছ কাটাই যে বন্ধ হয়েছে, তাই-ই নয়, নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, তাদের বাড়ির কেউ আর কোনও দিন কোনও গাছে চড়তে পারবে না। ফলে তিনাইও পারে না।

তিনাইয়ের বন্ধুরা যখন গাছে চড়ে পাকা খেজুর পাড়ে, পেয়ারা পাড়ে, চালতা পাড়ে, ও তখন ফ্যালফ্যাল করে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ও জানে, ওর হাত-পা-মন নিশপিশ করলেও এ জীবনে ওর আর কখনও গাছে চড়া হবে না। কিন্তু আজ যখন আশপাশে কেউ নেই, ও আর সময় নষ্ট করল না। ঝপ ঝপ করে উঠে পড়ল সেই সুপারি গাছে। আঃ, গাছে চড়ার যে কী আনন্দ!

তাকে গাছের নীচে আসতে দেখে কাঠঠোকরাটা উড়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। কিন্তু সে যেখানটায় ঠোকরাচ্ছিল, অতটা ওঠার আগেই ওর শরীর কেমন যেন ছেড়ে দিল। বুঝতে পারল, ও পড়ে যাচ্ছে।

পড় তো পড়, কোথাও কিছু নেই, ধপাস করে পড়ল একটা পুকুরে। এখানে তো কোনও পুকুর ছিল না! পুকুর তো সেই অণুদের বাড়ির কাছে। তবু জলে পড়ে ও হাত-পা ছুড়ে সাঁতার কাটতে লাগল।

ওদের বাড়িতে কেউ জন্মালে, তাকে আর কিছু শেখানো হোক, ছাই না হোক, ছোট্টবেলাতেই সাঁতারটা শিখিয়ে দেওয়া হয়। ওদের বাড়ির বড়রা বলেন, ডাঙা তো মাত্র এক ভাগ। পৃথিবীর তিন ভাগই তো জল। সাঁতার না শিখলে হবে?

আসলে ওদের বাড়ির কে নাকি একবার ঠাকুর ভাসান দিতে গিয়ে পুকুরে ডুবে মারা গিয়েছিল, সে নাকি সাঁতার জানত না। তাই তার পর থেকেই ওদের বাড়ির বাচ্চাদের সাঁতার শেখাটা বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে। সেই নিয়ম আজও সমানে চলছে। তাই তিনাই প্রতিদিন স্নান করার আগে ওদের বাড়ির লাগোয়া পুকুরে অন্তত ঘণ্টাখানেক জল উথালিপাথালি করে সাঁতার কাটে। না, কেউ বারণ করে না। বরং খুশিই হয়।

তিনাই ঝপাৎ ঝপাৎ করে সাঁতার কাটতে লাগল। হঠাৎ ওর মনে হল, ও যেখানে সাঁতার কাটছে, সেটা নিশ্চয়ই পুকুর নয়, পুকুরে কি এত বড় বড় ঢেউ হয়! পিছন ফিরে দেখে, চারিদিকে শুধু জল আর জল। জল আর জল।

তার মানে ও এখন পুকুরে নয়, সমুদ্রে! তড়িঘড়ি কোনও রকমে পাড়ে উঠে দেখে, এ দিকে ও দিকে  প্রচুর লোক। কেউ সমুদ্রে নামার জন্য তোড়জোড় করছে। কেউ সমুদ্র থেকে উঠে গা মুছছে, তো কেউ পাড়ে বসে রোদ পোহাচ্ছে।

হঠাৎ ওর নজরে পড়ল, তাদের সেই ঝিলম গাছের মতো এখানেও একটা ঝিলম গাছ। অবিকল একই রকম দেখতে। তাদের ঝিলম গাছটার পাশে যেমন একটা সমাধিক্ষেত্র আছে, স্বপ্নে দেখা আমেরিকার সেই ঝিলম গাছটার পাশে যেমন আছে একটি কবরখানা, ঠিক তেমনি এখানেও এই গাছটার নীচে ও রকম কোনও বেদি-টেদি না থাকলেও, ভুর করে প্রচুর ডাব নিয়ে বসে আছেন এক ডাবওয়ালা। ও সোজা সেই ডাবওয়ালার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, এটা কোন জায়গা গো?

ডাবওয়ালা বললেন, সে কী! তুমি এখানে এসেছ, অথচ এই জায়গাটার নাম জানো না? এটা তো পিকাচো সি-বিচ।

তিনাই এর আগে এই রকম কোনও সমুদ্রতটের নাম শোনেনি। তাই অবাক হয়ে বলল, পিকাচো সি-বিচ! এটা কোন দেশ?

--- কেন? মালয়েশিয়া।

'মালয়েশিয়া' শুনেই চমকে উঠল তিনাই।

ওর চমকে ওঠা দেখে পিছনের ঝিলম গাছটাকে ইশারায় দেখিয়ে ডাবওয়ালা বললেন, ও বুঝেছি... তুমি নিশ্চয়ই পৃথিবীর কোনও না কোনও প্রান্ত থেকে হুবহু এই রকম একটা ঝিলম গাছের পাশের কোনও গর্তে পাতা পিঁড়িতে বসে ভুল করে এখানে চলে এসেছ, না?

তিনাই হ্যাঁ-সূচক মাথা ওপর-নীচে করল।

সেটা দেখেই ডাবওয়ালা বললেন, তা হলে এখানে বেশিক্ষণ থেকো না। যদি থাকো, তা হলে আর কোনও দিনই তুমি যেখান থেকে এসেছে, সেখানে আর ফিরে যেতে পারবে না। না উড়ানে। না স্থলপথে। না জলপথে। এমনকী পাসপোর্ট-ভিসা থাকলেও যেতে পারবে না। কোনও না কোনও কাঁটা ঠিক তোমার পথ আগলে দাঁড়াবে। একেবারে আমার মতো। জীবনে আর কোনও দিনই মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী--- কারওরই আর মুখ দেখতে পারবে না। পা রাখতে পারবে না নিজের জন্মভিটেয়। এখানে আসা সহজ। খুব সহজ। যে কোনও ঝিলম গাছের কাছাকাছি গর্তে পাতা পিঁড়িতে বসে, মনে মনে যে জায়গায় যেতে চাইবে ঠিক সেখানে পৌঁছে যেতে পারো। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সেটা কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। সেই সময়টা একবার পেরিয়ে গেলে হাজার চেষ্টা করলেও তুমি আর কোনও দিনই ফিরে যেতে পারবে না।

--- তা হলে উপায়?

--- উপায় একটাই। তুমি যখন ঝিলম গাছের তলা দিয়ে এসেছ এবং বেশিক্ষণ আগে আসোনি, তার মানে সেই নির্দিষ্ট সময়টা এখনও পেরিয়ে যায়নি। তোমার হাতে এখনও অনেক সময় আছে। তুমি এই ঝিলম গাছের গোড়ায় উঁকি মেরে দ্যাখো, বড় কোনও গর্ত দেখতে পাও কি না। না পেলে বুঝবে সময় পেরিয়ে গেছে। আর যদি পাও, ভাল করে দেখবে, সেখানে একটা পিঁড়ি পাতা আছে। তুমি যেখান থেকে এসেছ, সেখানে যে ভাবে খুব সাবধানে সেই পিঁড়িতে গিয়ে বসেছিলে, সেই ভাবেই ওই পিঁড়িতে গিয়ে বসবে। বসার সঙ্গে সঙ্গে দেখবে কতকগুলো লতাগুল্ম তোমাকে এমন ভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবে যে, তোমার আর পড়ার কোনও ভয়ই থাকবে না। তবে হ্যাঁ, তুমি কিন্তু ওটায় বসে ভুল করেও অন্য কোনও জায়গার নাম ভেবো না, কেমন? তা হলে কিন্তু আরও বড় কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে, বুঝলে? তার পর দ্যাখো, মাত্র কয়েক সেকেন্ড। ব্যস, তুমি সেখান থেকে এসেছিলে, ঠিক সেখানে পৌঁছে যাবে।

আর কোনও কথা বাড়াল না তিনাই। তড়িঘড়ি করে সেই ঝিলম গাছটার নীচে গিয়ে দাঁড়াল। বুঝতে পারল, মনে মনে কেউ কোথাও যেতে চাইলে, এই ঝিলম তলার মতো এই পৃথিবীতে আরও অনেক ঝিলম তলা আছে। যেখান থেকে হুস করে যে কোনও জায়গায় এক মুহূর্তে চলে যাওয়া যায়। অবশ্য তবে তা চিরকালের জন্য নয়, একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। ও মনে মনে মালয়েশিয়া আসতে চেয়েছিল। এসেছে। এখন ওর ফিরে যাওয়ার পালা।

ও পা টিপে টিপে সেই গহ্বরে নেমে খুব সাবধানে পিঁড়িতে বসতেই, কতগুলো লতাগুল্ম ওকে জাপটে ধরল এবং কিছু টের পাওয়ার আগেই দেখল, ও তাদের সেই ঝিলম গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে।

ও আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। চোখ কান বুজে সোজা ছুটতে লাগল বাড়ির দিকে।

 

সিদ্ধার্থ সিংহ
কলকাতা, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top